শ্রীশুভ্র / ঈশ্বরবাদী ও কমিউনিস্ট


শ্রীশুভ্র  / ঈশ্বরবাদী ও কমিউনিস্ট



ঈশ্বরবাদী ও কমিউনিস্ট
শ্রীশুভ্র 

একজন আপাদমস্তক আস্তিক মানুষ কি কখনো কমিউনিস্ট হতে পারেন? সম্ভব কি আদৌ? অনেকেই বলবেন তা কেন। কমিউনিস্ট হতে গেলে একজনকে নাস্তিক হতেই হবে এ আবার কেমন কথা। অনেকে আবার বলতে পারেন মগের মুলুক নাকি? যা বলবে তাই মেনে নিতে হবে? এখন প্রথম প্রশ্ন, আস্তিক বলবো কাকে? একটু ভেবে দেখলেই দেখা যাবে। আস্তিক তিনিই যিনি ঈশ্বরবাদে দীক্ষিত। যিনি আসলেই ঈশ্বরবাদী। তাহলে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি সামনে এসে দাঁড়ায়, সেটি হলো কমিউনিস্ট মাত্রেই কি নাস্তিক? নাকি নাস্তিক না হলে একজনের পক্ষে সাচ্চা কমিউনিস্ট হওয়াই সম্ভব নয়। তখন আমাদের সামনে আরও একটি প্রশ্ন আমাদের পথরোধ করে দাঁড়াতে পারে। এই কমিউনিজম আর নাস্তিকতার ভিতরে কমন ফ্যাকটরটা ঠিক কি? আছে কি আদৌ তেমন কোন সাধারন বৈশিষ্ট্য?

বহুকাল আগেই কবি বলে গিয়েছিলেন, ‘শুন হে মানুষ ভাই / সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। বাংলার এক কবির এই কথা বলার কয়েক শতাব্দী পরে সম্ভবত প্রায় চার শতক বাদে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শন মার্কসবাদ এই ভাবধারাকেই মান্যতা দিয়ে একটি নতুন বৈজ্ঞানিক মতবাদের জন্ম দিয়েছিল। মার্কসবাদের গোড়ার কথাই আসলে এইটি। সবার উপরে মানুষ সত্য। মানুষের জন্যেই সবকিছু। মানুষের উপরে অন্য কোন কিছুই নয়। ঈশ্বর তো নয়ই। বাংলার কবিও ঈশ্বরকে মানুষের উপরে স্থান দিতে পারেননি। পারলে তিনি কখনোই এই কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু যাঁরা মানুষের উপরেও ঈশ্বরের স্থান নির্ধারণ করে বসে রয়েছে? তাঁরা কি কোনভাবেই চণ্ডীদাসের বলা কথটিকে মান্যতা দিয়েছে কোনদিন, কোনভাবে? নিশ্চয় নয়। দিলে ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতো। বরং ঈশ্বরবাদীরা সর্বকালেই সর্ব দেশেই ঈশ্বরের মাহাত্ম্য প্রচার করতে গিয়ে মানুষকেই বলি দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। কার ঈশ্বর বড়ো। কার ঈশ্বরের ঐশ্বরিক ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। সেই তর্কের নিরসন হয়নি কোনদিন। কিন্তু বলি হয়েছেন বহু মানুষ। আমরা সেই তর্কেও যাচ্ছি না। কিন্তু ঈশ্বরবাদীদের এই যে একটি দৃঢ়তর বিশ্বাস। যে, ঈশ্বরই সব কিছু সৃষ্টির মূলে। পার্থিব অপার্থিব সব কিছুই তাঁরই ইচ্ছায় সৃষ্ট। সেখানে মানুষের গুরুত্ব কিছুই নেই। উল্টে যাঁরা মানুষেরই গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সবচেয়ে বেশি। সেই নিরিশ্বরবাদীরা ঈশ্বরবাদীদের হাতেই অত্যাচারিত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। মানুষের থেকেও ঈশ্বরকে বড়ো করে দেখাতে গিয়ে ঈশ্বরবাদীদের হাতে মানুষ নিতান্ত ক্ষুদ্র, নিতান্ত তুচ্ছ হয়ে গিয়েছে। গিয়েছে বিশ্বের প্রতিটি ধর্মের দৃষ্টিতে। ধর্মের দৃষ্টিতে মানুষ ঈশ্বরের দাস। ঈশ্বরের ইচ্ছাধীন। রামপ্রসাদের কথায়, ‘তোমার কর্ম তুমি কর মা। লোকে বলে করি আমি’। ফলে ধর্ম যাই হোক না কেন। ঈশ্বরবাদীদের চোখে মানুষের কোন কৃতিত্ব নাই। ঈশ্বরের ইচ্ছায় কেউ সাধু। কেউ অসাধু। কেউ মহাপুরুষ। কেউ সাধারণ। কেউ সফল। কেউ ব্যর্থ। সবই ঈশ্বরেরই লীলা। যেখানে মানুষ ঈশ্বরের হাতের পুতুল মাত্র।

এই যে এক ঈশ্বরবাদ। এরই ঠিক বিপরীতে দাঁড়িয়ে কিন্তু চণ্ডীদাসের সেই অমর বাণী। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য। তাহার উপরে নাই’। এবং সেই একই কথার উপরেই দাঁড়িয়ে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দর্শন মার্কসবাদ।

মার্কসবাদে মানুষকে সব কিছুর নিয়ামক হিসাবে দেখা হয়েছে। দেখানো হয়েছে কিভাবে এক শ্রেণীর মানুষ বাকি মানুষদেরকে নানান ভাবে খর্ব করে রাখার নানান পন্থা তৈরী করে তাদেরকে শোষণযন্ত্রের উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত করে ধন উৎপাদন করে। এবং সেই উৎপাদিত ধনের অসম বন্টনে কিভাবে ধনী আর দরিদ্র্য মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করে রাখা হয়। মার্কসবাদের তত্ত্ব থেকে একটু বাইরে এসে দাঁড়িয়ে এই কথাও বলা যেতে পারে, মানুষের তৈরী সেই ধনবৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বয়ং ঈশ্বরেরও কিন্তু কিছুই করার থাকে না। সেখানে মানুষের উপরে ঈশ্বরেরও কোন স্থান নেই। আর সেখানেই একজন নিরীশ্বরবাদী নাস্তিকের কাছে অত্যন্ত আপন হয়ে উঠতে পারে মার্কসবাদী দর্শন। নাস্তিকতার মতো যে দর্শনেও মানুষের উপরে আর কোন কিছুকেই মান্যতা দেওয়া হয়নি। কবির মতো যে দর্শনও সবার উপরে মানুষই যে সত্য, মানুষই যে শেষ কথা; সেই অমো‌ঘ এবং চিরায়ত সত্যকে বুকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে।

আবার নাস্তিক মাত্রেই কিন্তু কমিউনিস্ট নয়। বস্তুত অধিকাংশ নাস্তিকই ধন বৈষম্যের পক্ষে কাজ করতে থাকেন আজীবন। কিন্তু কমিউনিস্ট মাত্রেই অবশ্যই নাস্তিক। না হলে তিনি সবার উপরে মানুষকে স্থান দিতেই পারবেন না। আর তা না পারলে কি করে তিনি ধন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে নামবেন একান্ত ভাবেই নিজের উপরে নির্ভর করে। নিজের উপরেই আস্থা রেখে? যিনি সকলের উর্ধে সব কিছুর উর্ধে কাল্পনিক ঈশ্বরের উপরেই আস্থা রাখবেন। সেই রকম কারুর পক্ষেই কি সম্ভব হবে মানুষের মুক্তির জন্য ধন বৈষম্যজাত বিভক্ত সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে সাম্যবাদের প্রতিষ্ঠা করার? না নিশ্চয়। ফলে সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে গেলে ঈশ্বরবাদী হলে চলবে না। তাঁকে নাস্তিক হতেই হবে। নাহলে বহ্বারম্ভ লঘুক্রিয়া। দুই বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঠিক যে দশা হয়ে বসে রয়েছে।

©শ্রীশুভ্র 
শ্রীশুভ্র / ঈশ্বরবাদী ও কমিউনিস্ট শ্রীশুভ্র  / ঈশ্বরবাদী ও কমিউনিস্ট Reviewed by শব্দের মিছিল on আগস্ট ৩১, ২০২৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.