তৃষ্ণা বসাক / মোমের শহর

তৃষ্ণা বসাক / মোমের শহর

বহুদিন ধরে বরকে বলে রেখেছিলাম একটা অ্যানিভার্সারিতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে নিয়ে যেতে। মোমের মায়া আলো যখন আমাদের মুখে এসে পড়বে তখন কি আমরা পরস্পরকে নতুন করে আবিষ্কার করব না? সেই আলোয় ও আমার অনামিকায় পরিয়ে দিচ্ছে প্লাটিনাম কিংবা হিরের একটা আংটি-কি রোমান্টিক হবে ব্যাপারটা।

কিন্তু তা আর হয়ে উঠল কই? ও সারাক্ষণই এত ব্যস্ত থাকে যে কোন কথাই ওর কানে ঢোকে না। আমি ভাবি বিয়ের চব্বিশ বছর হয়ে গেছে তো, তাই আর কি। অ্যানিভার্সারি কিন্তু ঘটা করেই হয়। নয় নয় করেও পঞ্চাশ ষাট জন লোক, ছাদে ম্যারাপ, বিরিয়ানি, জুঁই ফুল, জারদৌসি, হীরের টপ সবই যথাযথ। এবার তো আবার হোটেলে পার্টি দিল। বাড়িতে কোন ঝামেলা হল না। আমরা শুধু সন্ধেবেলা গাড়ি করে গিয়ে নামলাম। গাড়িটাও নতুন। সবুজ প্যাস্টেল কালার। আমার প্রিয় রঙ। এই গাড়িটা ও এবার আমায় দিয়েছে। বৃন্দা আমার কানে কানে বলল 'বোকা কোথাকার! তার চেয়ে হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করিয়ে নিতিস। কিংবা সিলিকন ইমপ্ল্যান্ট। তোর ফিগারের যা অবস্থা।

শুভদিনে আমার চোখে জল এল। আমি কি শুধু একটা ঝকঝকে শরীরের লোভ দেখিয়ে বরকে টেনে রাখব? চব্বিশ বছরের পাশাপাশি থাকা, এত ঝড়ঝাপ্টা- এসবের কোনও দাম নেই? আসলে আমার গাড়ি দেখে বৃন্দার হিংসা হয়েছে। মুখে বললাম 'শুধু শুধু দিল। আমি আর কোথায় যাই? তবে মেয়েটা প্রাইভেট টিউশন পড়ে কত রাতে ফেরে। ওর কাজে লাগবে। এত ভয় লাগে ওর ফিরতে রাত হলে।'

এ বছর মেয়ে চাকরিতে ঢুকল। সেক্টর ফাইভে অফিস। অফিসের গাড়ি মাঝরাতে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। আমার গাড়ি পড়ে থাকে। আজকাল হাঁটুতে কী একটা খচখচ করে। আগের মতো বেরনো হয় না। আমি টিভিটাকে মিউট করে ড্রয়িং রুমে বসে থাকি যতক্ষণ না মেয়ে ফেরে। বর সারাদিন খাটাখাটুনি করে, ওর ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করে না। চোখের সামনে মনে হয় একদল বোবা উন্মাদের দল নাচছে, গাইছে। এরকম এক রাতে দেখলাম সিঙ্গাপুর থেকে একটা কফিন বন্দি শরীর দেশে ফিরল। দিল্লির ওই ঠান্ডায় এয়ারপোর্টে প্রধানমন্ত্রী। আমার হঠাৎ খুব শীত করছিল।

গাড়ি থামার শব্দ। মেয়ে ফিরে এল। চোখ মুখ লাল।

'শুনেছ?'

আমি ঘাড় নাড়ি।

'আমরা ডিসাইড করেছি এবার নিউ ইয়ার সেলিব্রেট করব না।'

'বেশ তো'

'তার বদলে একটা মোমবাতি মিছিল'

'না!' আর্তনাদ করে উঠি আমি।

মেয়ে অবাক 'হল কী তোমার? দেখোনি টিভিতে, সবাই করছে'

আমি আস্তে আস্তে বলি 'খুব সুন্দর দেখায় না মোমবাতি নিয়ে সবাই দাঁড়ালে? কি নরম আর রোমান্টিক! বোঝা যায় না সাত জন দশ মিলে রেপ করলে একটা মেয়ের কতটা লেগেছিল, কতটা লেগেছিল যখন একটা লোহার রড তার...'

'মা! ফর গডস সেক, চুপ করো' এবার মেয়ে চিৎকার করে ওঠে।

আমার বর ঘুম ভেঙে এসে দাঁড়ায় 'কী শুরু করলে তোমরা মাঝরাতে? আমার কাল জরুরি মিটিং, সকলা নটা থেকে'

আমি তাকিয়ে দেখলাম এখনো কি বলিষ্ঠ চেহারা আমার বরের, সহজ স্পষ্ট দৃষ্টি, মোমের আলোয় একে আমি মিথ্যে চেহারায় দেখতে চেয়েছিলাম! আমি মেয়েকে বললাম 'একদম পার্টি ক্যান্সেল করবি না। আর তোর হাত মোমবাতির থেকে অনেক শক্ত জিনিস ধরার ক্ষমতা রাখে। হাঁটতে হলে সেটা নিয়ে হাঁট'


তৃষ্ণা বসাক / মোমের শহর তৃষ্ণা বসাক / মোমের শহর Reviewed by শব্দের মিছিল on আগস্ট ১৫, ২০২৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.