শেষ অব্দি ওই ঢেকুরটাই দিলো সব বারোটা বাজিয়ে। বেশ চলছিল ওদের সম্পর্কটা।
বড়বাজারে গিলোটিলালার গদিতে খাতা লেখে বির্জুপ্রসাদ, উত্তরপ্রদেশের জৌনপুরের ছেলে, মামা গুলবন্তীলাল কোলকাতা থেকে কীসব পাইকারি জিনিসের ব্যবসা করে। সেই জুটিয়ে দিয়েছিল কাজটা। জৌনপুর থেকে বাসে আরও ভিতরে বোগলি, খুব ছোট গঞ্জ-গ্রাম, সেখানকার ছেলে বির্জু। একেবারে শুদ্ধ শাকাহারী ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে, তাদের তিনকুলে কেউ আমিষের স্বাদগন্ধ শুঁকে দেখা তো দূরে থাকুক, পেঁয়াজ রসুন অব্দি শোঁকেনি কিংবা চাখেনি। ঘরে বউ বাচ্চা রেখে এসে ভালো টাকার আশায় এই গদীতে খাতা লেখার কাজ, বাড়িঘর ছেড়ে এতোটা দূরে।
গাঁয়ে ক্ষেতিবাড়ির কাজ সামলায় তার আরও মুখ্যুসুখ্যু দুইভাই, তাদের ব্যস ওই নাম সই অব্দিই বিদ্যে। বির্জু বরাবরই একটু মাথাওয়ালা ছিল তাই ইস্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে ওই মাটিগোবরের ঢাল ডিঙিয়ে।
ঘরে বউবাচ্চা, এদিকে শহরে পড়ে পড়ে শরীর শুখা ভুখা। ঘরের লোকের রুটি ডালের অতিরিক্ত আর একটু অতিরিক্ত সুখ জোগাড় করতেই তো মিত্তিরদের গ্যারেজে নর্দমার আর মাছের মাংসের গন্ধ শুঁকে সারাবছর ঘামে জবজবে হয়ে কাটিয়ে এতো কষ্ট করা। তাই বলে কী নিজের কথা ভাবতে হবে না একটু। প্যান্টের ভিতরে শরীর শক্ত হয়ে উঠে মাঝে মাঝেই নিজের জন্য কিছু চায়।
ভেদিনালই খবরটা দিয়েছিল। হেদুয়ার ধারে রাত্তির দশটার পরে যা। শরীর নরম করার দাওয়াই পেয়ে যাবি।
বান্ধুলি, মেয়েটা বলেছিল ওর নাম, বাড়ি ক্যানিং।
মাছ খাস? মাংস? প্রথম জিজ্ঞাস্য ছিল এটাই বির্জুর। যে মুখে মাছ, মাংস, পেঁয়াজ রসুন ঢোকে সে মুখে মুখ গলিয়ে চুমু খাবে কীকরে, শুদ্ধ শাকাহারী বলে কথা!
আরে না, না, পাগল নাকি? বেধবা যে, এক্কেবারে খাঁট্টি নিরিমিষ্যি জেবন গো বাবু।
যা রেট তাতে পুষিয়েও গিয়েছিল বেশ, তবে রোজ রোজ তো আর এই অভ্যাসের আয়েস করা যাবে না, তাতে টাকায় পুষিয়ে ওঠা যাবে নাকি? তাই , হপ্তায় একদিন হলেই চলবে। ঘরে মানি অর্ডার পাঠিয়ে, এখানে নিজের খাওয়া চালিয়ে দিব্যি শরীরের ঠাণ্ডাই মিলবে।
এই মাছ মাংসে ভরা বিদেশবিভুঁইয়ে শাকাহারী বেশ্যা অত মেলা সহজ নাকি? বড্ড ভাগ্যিজোরে পাওয়া গেছে মেয়েটাকে। সবই শিউজীর কিরপা। প্যান্টের চেন আটকাতে আটকাতে পৈতেটায় তাই আলগোছে পেন্নাম ঠোকে বির্জু।
এভাবেই মাস আষ্টেক দিব্যি পেরলো। হপ্তায় একদিন করে আসবার কথা বলা ছিল মেয়েটাকে । খালের ধারের ওই নির্দিষ্ট অন্ধকারটায়। মেয়েটা ভালো, কোনো ঝামেলা উমেলা নেই, টেইমেরও গলতি হেরফের নেই। টাকা উকা নিয়েও ঝুনঝাট নেই।
আজও সব কিছু ঠিক ঠাকই ছিল, বেলাউজ খুলেছে, কাপড়ও তুলেছে, জায়গার জিনিস জায়গায় প্রবেশ করে সর্বোচ্চ স্বস্তি খুঁজছে, শরীর চাপের উপর চাপ সইছে, এমন তুঙ্গ মুহূর্তে হঠাৎই বেয়াক্কেলে ওই ঢেকুরটা এক্কেবারে নাকের ডগায় গ্যাজগ্যাজে মাংস আর রসুনের গন্ধ ছড়িয়ে বেরিয়ে এলো মাগীর গলা দিয়ে।
বির্জু ধাক্কা দিয়ে ফেলে দ্যায় তাকে নীচে। তু নে বোলি থী তু শাকাহারী হ্যায়।
আজ ইদের দাওয়াতে দুফুরে গোস্তটা একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছিল। টেরেনে উঠবার আগে দুবার করে ক্লোজাপ দিয়ে মুখ ধুয়েছিল রশিদা। যাতে কাষ্টমার টের না পায় জেতের হিসাব। কী করে বুঝবে, শালার ওই ঢেকুর হারামিটার জন্য সব লুকাছুপি বরবাদ হয়ে যাবে। মুখ নীচু করে থাকে সে। বলে, তাহলে আর আসতে হবেক নাই আসছে হপ্তা থিকা, তাই তো?
বিড়িটা ধরিয়ে চুপ করে বসে আছে বির্জু। হঠাৎই ধাক্কাটা মেরে বড্ড লজ্জিত, লাগেনি তো মাগীটার। বলতেও পারছে না, পাছে ওর প্রতি দূর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যায় ওর কাছে। আজ এক ঝটকায় শরীরটা থমকে গেল, হয়তো এতদিনকার আদ্যন্ত ভাবনাচিন্তার বেড়াজালগুলোও।
অন্ধকারে চোট পাওয়া মেয়েমানুষটার চোখের কোণের জলের চিকচিক দেখা যায় না।গোড়ালির কাছটা ছড়ে গেছে অত জোরসে ধাক্কায় পাশের সিমেন্টে ছিটকে গিয়ে ঘষা খেয়ে, জ্বলছে জায়গাটা, হয়তো রক্তও বেরিয়েছে। চেপে যায় রশিদা কথাটা।
বলে, যে কথাটা তোকে বলা হয়নি যাবার আগে জেনে রাখ তুই, আমার নাম রশিদা বিবি, লিবাস কেনিং, সোহর ব্যাটা আজ চোদ্দ বছর বিছানায় হেগেমুতে পড়ে আছে, ঘরে পাঁচ পাঁচটা গেঁড়ি গুগলি বাচ্চা।
"ঠিক আছে ঠিক আছে, আর তোর জাত হিষ্টিরি শুনবার জরুরত নেই আমার। আর সব দিন যা পারিস কর তুই, শুধু এতবার (রবিবার) কা দিন কুছ মাস মছলি লইসান পিয়াজ খাবি না ব্যস, তাহলেই হবে, প্রাণভরে চুমু খেয়ে পুষিয়ে দেবো তোর যত আমিষের লোভ" এ কী আজগুবি উক্তি বেরিয়ে এলো রে বির্জুর মুখ থেকে, নাকি ওই ঢেকুরটার মতন এক্কেবারে বুক থেকে?
রশিদা খুব হেসে ওঠে একচোট, হাসতে হাসতে চোখের জলে গাল এক্কেবারে থইথই। সে জানে না এই জল খুশির নাকি দুক্ষুর, সে শুধু এটা জানে তার রবিবারের বাঁধাধরা আয়টা কাটতে কাটতে খুব জোর বেঁচে গেলো।
খিলখিলিয়ে সে বলে ওঠে, ঠিক আছে রে জৌনপুরী, আজ থেকে প্রতি রোববার তোর জন্যি আমি একাদশী বোরতো পালন করব, হান্ডেড পাসসেন খাঁট্টি বেধবা, একেবারে শুদ্ধ শরীর, আর খাঁটি শাকাহারী ঢেকুর তুলতে তুলতে আসবো তোর কাছে, আজ থেকে আর কোনো টুথপেষ্ট এর আড়াল নেই ।।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন