সুশান্ত কুমার রায়

বসন্ত গানে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ
ষড়ঋতুর দেশ আমাদের দেশ
রূপের যে তার নাইকো শেষ, 
গ্রীষ্ম আসে তাপদগ্ধ প্রকৃতি নিয়ে 
বর্ষা আসে বারি বর্ষণে-  
শরৎ আসে কাঁশ ফুলের নরম ছোঁয়ায়  
হেমন্ত আসে কৃষকের হাসি আর গানে।  
শীত আসে হৃদয়ে কাঁপুনি দিয়ে, 
বসন্ত আসে কোকিলের সুমধুর ডাকে  
ছয়টি ঋতু বিচিত্ররূপে আসে-  
আমাদেরই মাঝে এইখানে। 

বাংলার রূপ সৌন্দর্যে কবি শিল্পীরা মুগ্ধ হয়ে কবিতা রচনা করেন। শিল্পী তার তুলির আঁচড়ে ছবি আঁকেন অকপটচিত্তে অবলীলায়। তাইতো কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে হয়- “আবার আসিব ফিরে / ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়”...। অকুতোভয় বাঙালি ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধার দেশ, নদীমাতৃক বাংলার আঁকাবাঁকা মেঠোপথ আর সোনালী আঁশের দেশ, গাংচিল শঙ্খ-শালিকের দেশ, বিজ্ঞানী-শিল্পী, কবি- সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের দেশ, ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, নিপীড়ন-নির্যাতন, লাঞ্চনা-বঞ্চনা ও গঞ্জনার দেশ, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্র, কীর্ত্তন, আউল-বাউল, জারি-সারি, মুর্শিদী, ভাটিয়ালী-ভাওয়াইয়া, ভাটির দেশ- কৃষিপ্রধান দেশ- বাংলাদেশ। সবুজ শ্যামল লীলাভূমি আমাদের এই বাংলাদেশ । এই দেশে জন্ম গ্রহন করে মোরা সবাই ধন্য। আঁকা বাঁকা বাংলার মেঠোপথ আর ফসলে ভরা মাঠ দেখে কার অন্তর না জুড়ায়। তাইতো দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সগর্বে রচনা করেন- 

“ধন ধান্য পুষ্পে ভরা  আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক  সকল দেশের সেরা।  
ও স্বপ্ন তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,  
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি”...।

বাংলা বর্ষের অন্তিম দু’মাস ফাল্গুন ও চৈত্র নিয়ে ঋতুরাজ বসন্ত। ষড়ঋতুর আমাদের এই দেশে ঋতু বৈচিত্র্য ও বিষয় বৈভব বিচার বিশ্লেষণে বসন্ত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল ও উদ্ভাসিত। তাই বসন্তকে ঋতুরাজ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ঋতুরাজ বসন্ত আসে-আমাদের দ্বারে জাগ্রত অভিসারে।

তাই পঞ্চকবির গানে ‘বসন্ত বন্দনা’ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঋতুরাণী’ বর্ষাকে নিয়ে যেমন অনেক কবিতা ও গান রচনা করেছেন তেমনি ফাগুনের মাতাল সমীরণে দোল খেয়ে অতি উচ্চ মার্গের অনেক বসন্ত গানও লিখেছেন। তাইতো কবি গুরুর গানের বাণী ও সুরের মধুময় মুছর্নায় আমাদের অন্তরে আজ বেজে ওঠে বসন্তের গান-

“আহা আজি এ বসন্তে-
এত ফুল ফোটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়
আহা আজি এ বসন্তে” ...

বসন্ত মানে নানা বাহারি-রঙিন ফুলের সমাহার। গোলাপ, গাঁদা, সূর্যমুখী, মাদার, বাদর লাঠি, কৃষ্ণচূড়া, শিমুল পলাশ এর সুবাসিত দক্ষিনা মলয়ে প্রাণমন ভরে উঠে অনুক্ষণ। লাল, নীল, হলুদ ও সবুজের সমারোহে বর্ণবৈচিত্রতায়-নব আনন্দ, নব-আভরণে প্রকৃতি সুশোভিত ও মাতোয়ারা হয়ে ওঠে বসন্ত অবগাহনে স্রোত ধারায়। তাই গানে গানে-প্রাণে প্রাণে ধ্বনিত হয়-

“ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে 
ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,
আড়ালে আড়ালে-কোণে কোণে
রঙে রঙে রঙিল আকাশ
গানে গানে নিখিল উদাস
যেন চল চঞ্চল নব পল্লব দল
মর্মরে মোর মনে মনে” ...

বসন্তকালে প্রকৃতি যৌবনা প্রাপ্ত হয়। ফাগুনের উতল হাওয়ায় ঘটে নব-দম্পতির শুভ পরিণয়। প্রজাপতি মনের আনন্দে রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়। ভ্রমর গুনগুন শব্দে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ায় মধু আহরণে-কবিগুরুর ভাষায় ও গানে-

“মধুর বসন্ত এসেছে আমাদের মধুর মিলন ঘটাতে 
মধুন মলয় সমীরে মধুর মিলন রটাতে।
কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে,
লিখিছে প্রণয়কাহিনী বিবিধ বরণ ছটাতে” ...

বসন্তে মিলনের বাণী ও আনন্দ জোয়ার থাকলেও কবি গুরুর গানে বিরহ বেদনার করুণ সুর ও রয়েছে-

“আজ জ্যোস্না রাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে।
যাবনা গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায় রব আপন কোণে” ...

অতীতের দুঃখ কষ্টকে কাটিয়ে সবার হৃদয়ে ধরা দিক বসন্ত। বসন্ত বিরাজমান থাকুক অন্তরে অন্তরে। বসন্ত ‘চির বসন্ত’ হয়ে আসুক আমাদের মাঝে-

নব সাজে  ঋতুরাজ বসন্ত
কৃষ্ণচূড়া-শিমুল-পলাশ,
গানে-গানে প্রাণে-প্রাণে ভরে উঠুক
বসন্ত বাতাস।
কোকিলের কুহু-কুহু তান
বসন্তেরই আগমনী গান,
চারিদিক নব আনন্দ- নবরূপ
এমনি বসন্তেরই ঘ্রাণ-
গানে-গানে প্রাণে-প্রাণে ভরে উঠুক 
ঊসন্ত বাতাস।
নববধূ-হলুদ বরণ শাড়ি
ফাগুন প্রাতের উদাসী
নবপত্র পল্লব-আকাশ
গানে-গানে প্রাণে-প্রাণে ভরে উঠুক
বসন্ত বাতাস। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .