চিলেকোঠার সেপাই : চাঁদের আলোয় মানুষ দেখার স্যাটেলাইট
জনজীবনের বিধ্বস্ত সময়ের স্বরলিপিই লেখককে দিয়ে লিখিয়ে নেয় আখ্যান। একজন গ্রহ নক্ষত্রের মানুষ হিসেবে (চোখ থাকতেও অন্ধ না হলে), সচেতন দায়বদ্ধ নাগরিক হিসেবে (কোনো প্রকার সুবিধাবাদের ত্রাণ গ্রহণের আকাঙক্ষা না থাকলে) ঘটমান বাস্তবতার কলাকৌশলকে অস্বীকার করার কোনো পন্থা নেই। এইসব কথা কেন বলতে হচ্ছে? আজকের সময়বিশ্বের লেখক বড় চতুর প্রাণী(অধিকংশ)। ইনিয়ে বিনিয়ে, প্রেম রোমান্সের গড়গড়ায়, অলীক ভুবন গড়ে তুলে ফ্যান্টাসির পাখায় ডিজেল ঢেলে আধুনিকতার মোহে বাঙালি পাঠককে ভোলাতে চাইছে। যেখানে সারসত্য বলে বেশিরভাগ সময়েই কিছু নেই। বাংলা উপন্যাসের যথার্থ বাস্তবতা এনে দিতে আজও সিকিভাগ লেখক অক্ষম কেন? আত্মপ্রতারণার এই ফাঁদ আবিষ্কার করে লেখক আসলে কোন সত্য জানান দিতে অগ্রসর? সত্যহীন অলীক মায়া গড়ে তুলে বাংলা উপন্যাসকে পথহীন করে তোলার যে নিকৃষ্ট সমীকরণ গড়ে উঠেছে তা থেকে মুক্তির পথ দেখাতে না পারলে বাংলা উপন্যাস নিয়ে বেশি অহংকার না করাই ভালো। যথার্থ ও সচেতন লেখকের আত্মবিশ্বাস, অভিপ্রায়, রাষ্ট্র, প্রশাসনের ভণ্ডামি সম্পর্কে নিজস্ব উপলব্ধি, ছিন্নভিন্ন সমাজ-সময় পরিসর যা মানুষকে প্রতি মুহূর্তে শোষণ করছে, যে শোষণ চক্রের মধ্যে লেখকেরও অবস্থান তা থেকেই উঠে আসে উচিত বয়ানের অবভাস। সেই সত্যনামাকে দেখা ও বোঝার যথার্থ উপলব্ধি থেকেই আখ্যানের জন্ম হয়। জন্ম হওয়া উচিত।
ইলিয়াসের ভাবতরঙ্গে ডুব দেওয়ার আগে পাকিস্তান পর্বের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট জরুরি। জরুরি একারণেই ১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে যে বিকলঙ্গ শিশুর জন্ম হল তার হাড় পাঁজর ধীরে ধীরে যে খসে যাবে তা ছিল অবধারিত। মাতা কখনও বিকলঙ্গ শিশুর প্রসব ভাবতে পারে না। কিন্তু দেশমাতাকে ছিন্নভিন্ন করার পরিকল্পনা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খেলে অবধারিতভাবে বিকলঙ্গ শিশু ভূমিষ্ট হতে বাধ্য। সে পরিণামও ভয়ংকর। পাকিস্তানের জন্ম রহস্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল মৃত্যুরহস্য। গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে যতীন সরকার লিখেছিলেন ‘পাকিস্তান জন্মমৃত্যুর-দর্শন’। বহু চেষ্টা চরিত্র করে সেই স্বাধীনতা আবার বাঙালি ফিরিয়ে এনেছিল। ১৭৫৭ সালে যে স্বাধীন সূর্য অস্ত গিয়েছিল তা আবার উদায় হল ১৯৭১ এ। বাংলা ভাষার জন্য, বাঙালির জন্য স্বাধীন দেশ। এ বড় গর্বের কথা, আনন্দের কথা। এ বাঙালির স্বাধীনতা। কিন্তু কপালে সইল না। ১৯৪৭ এর সংশোধন পর্ব যেন ১৯৭১। কিন্তু ভুল ভুলই। সংশোধন দ্বারা পূর্বের রূপ ফিরে পাওয়া যায় না। যে ভুলের মাশুল এই উপমহাদেশকে কয়েক-শো বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ভোগ করতে হবে। শেখ মুজিবর রহমান বাঙালিকে একত্রিত করেছিলেন, বাঙালির আত্মচেতনা জাগিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন কিন্তু বিরাট চেতনা ছিল না। নইলে স্বাধীন বাংলাদেশ আবার অন্ধকারে ডুবে গেল কেন? বাঙালির মুক্তির জন্য সেদিন যোগ্য নেতার প্রয়োজন হয়েছিল বা বাঙালি অবলম্বন চেয়েছিল। অথবা মুজিবরের আদর্শ বাঙালি মুসলিম গ্রহণ করতে সক্ষম নয়। নইলে কোন দেশের মানুষ স্বাধীনতার পর দেশ ত্যাগ করে? সেই পলায়ন প্রক্রিয়া আজও সমানতালে অগ্রসর। ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় জানি আমার বসস্থানের পশ্চিম প্রান্তে যে নব্য উপনিবেশ গড়ে উঠেছে তা গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাখ্যাত উদ্বাস্তু বাঙালি উপনিবেশ। নইলে গভীর বেদনা থেকে হুমায়ুন আজাদ লিখতেন না ‘আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম’।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গভীর আক্ষেপের সঙ্গে লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যে যথার্থ বাস্তবতার অভাব। কয়লাকুঠি এলেও প্রকৃত জীবনচিত্র অনুপস্থিত। মানিক বাবু এতো সব জেনেও নিজে কিছুটা টালমাটাল হয়ে গেলেন। ‘পদ্মানদীর মাঝি’ও কি যথার্থ বাস্তবতা চিহ্নিত করতে সক্ষম হল? মধ্য পথেই মানিক বাবু কি নৌকার হাল ছেড়ে দিলেন না! ইলিয়াসের আখ্যান উপনিবেশে প্রবেশের আগে ইলিয়াসের মনন বোঝার জন্য ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’ পড়ে নিলে ভালো হয়। আসলে ইলিয়াস কী লিখতে চান। প্রান্ত থেকে প্রান্তিক, মুখের ভাষা সহ গ্রাম্যজীবন, জীবনের নিবিড় ডেটেলিং, খিস্তি খেউড়ের গ্রামবাংলা থেকে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, জমিদারি-মহাজন পরিসর, শহর ভদ্রবিত্ত মধ্যবিত্ত বাঙালি, বুদ্ধিজীবী, আদর্শবাদী থেকে লুম্পেন সমাজ। সেই সঙ্গে সময়ের উত্তাল তরঙ্গমালা। আপাত অশ্লীলতা, যৌনতা, খিস্তি খেউড় নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির যে গ্লানি অথচ ইলিয়াসকে মাথায় তুলে নাচলেন কিন্তু হাংরি সাহিত্যকে বাতিল করে রাখলেন কেন? পড়তে পড়তে এটুকু তো বুঝেছি হাংরি সাহিত্যকে দূরে রাখা, সাহিত্যে শ্লীলতা বজায় রাখার নামে এক বড় চক্রান্ত। আজও বাংলা গদ্য যে হাঁটিহাঁটি পা পা করে চলছে তা কেটে যেত হাংরি সাহিত্যকে মূল ধারার সাহিত্য বলে চালালে। তা হয়নি। হবেও না। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশেষ করে বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে এ বড় বেদনার। মাঝে মাঝে ইলিয়াস বা নবারুণ যখন টোটকা দেবে তখন মাথায় তুলে নাচবেন।
স্বপ্নের বয়ানের মধ্য দিয়ে আখ্যানের যাত্রা। বলা যেতে পারে রুক্ষ বাস্তবের মাটিতে প্রবেশের আগে লেখক পটভূমি গড়ে তোলেন। ওসমানের স্বপ্ন, নিদ্রাচ্ছন্নতা। আছে যৌনতার অবভাস। প্রথমেই যেন বাংলা উপন্যাসের পাঠককে দৃঢ় করে নিতে চান। রগরগে নড়বড়ে পাঠকের জন্য ইলিয়াসের আখ্যান নয়। সেই সত্য প্রথম পৃষ্ঠায় জানান দিয়েই পাঠককে স্বাগত জানান। স্বপ্ন, মৃত্যু, যৌনতা, নগ্নতা দ্বারা বাংলা উপন্যাসের পাঠককে ইলিয়াস কোথায় নিয়ে চলেছেন? জাগতিক জীবনের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব থেকে লক্ষ যোজন দূরে নয়, জাগতিক বোধকে সামনে রেখেই সমাজ কাঠামোতেই তিনি অন্য ফর্ম গড়ে তুলতে চান। পরিসরের বয়ান ভেঙে উপন্যাস যে নতুন পথে যাত্রা করতে পারে তা দেখাতে সক্ষম হন। শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে, শতাব্দী শেষের উপন্যাস সেইভাবে যাত্রা করবে। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দ। ঠিক একই সময় প্রকাশিত হচ্ছে দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ (১৯৮৮), সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘অলীক মানুষ’(১৯৮৮) সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ‘জঙ্গলের দিনরাত্রি’ বা ‘হিরোসিমা মাই লাভ’ (১৯৮৯), অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘মধু সাঁধুখা’ (১৯৮৮), ‘ফ্রাইডে আইল্যাণ্ড অথবা নরমাংস ভক্ষণ ও তাহার পর’ (১৯৮৮), সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘পক্ষবিপক্ষ’(১৯৮৮), অভিজিৎ সেনের ‘অন্ধকারের নদী’(১৯৮৮), আবুল বাশারের ‘ফুলবউ’(১৯৮৮)। আরও বেশ কিছু উপন্যাসের নাম ইচ্ছাকৃত ছেড়ে দিয়েও শুধু এই তালিকা থেকে বাংলা উপন্যাসের পালাবদল চিহ্নিত করা সম্ভব।
আলো-অন্ধকার নিয়ে জীবনের যে সমান্তরাল খেলা, আলোর লীলা ক্রমেই নেমে আসে, জীবন সদা অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাই তো বড় সত্য আর সে সত্যকেই বয়ানে স্পষ্ট করতে চান ইলিয়াস। পরিসরকে বিস্তৃত করতে নিবিড় ডিটেলিং এ যান। আভাস নয় ডিটেলিং এর বিন্দু বিন্দুতে আখ্যানের চরিত্রকে স্পষ্ট করেন। ঘরখানা চিলেকোঠা কেন? পাকিস্তানে ‘দেশ’ নামক ঘরের পরিসর ছোটো হয়ে আসছে। ঘরের মধ্যে একাধিক দরজা দ্বারা দেশনামক ধারণার খণ্ড-বিখণ্ড ঘটছে। তবে সবটাই ধ্বংস হয়ে যায়নি। সবটাই নষ্টদের অধিকারে যায়নি। জানালা দিয়ে কিছু কিছু আলো আসে। আখ্যান শুরুই হয় মৃত্যুর বিবরণ নিয়ে। কেন? পাকিস্তান পর্বের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট চিন্তা করুন। স্পষ্ট হয়ে যায় ইলিয়াস কোন সত্যে পৌঁছতে চান। আবার মৃত্যুর বিবরণ দিয়েই বিদায় নেন না। মৃত্যুর গলিপথ, মৃত্যুরহস্য, মৃত্যুর অনুভব দ্বারা আখ্যানকে তিনি এক পোড়া মাটির উপর দাঁড় করিয়ে নেন। সিঁড়ির সিকোয়েন্স আসে বারবার। কোথায় পৌঁছতে চান ইলিয়াস? সময় পর্বের ডামাডোল। সময় সিঁড়ি ধরে উঠছে নামছে। অস্থির রাজনীতিতে বাঙালি জীবনে অস্থিরতার নিস্ফলা কালো মেঘ নেমে এসেছে। চলছে মৃত্যু মিছিল। মরে আর মারের সত্য। কোনো লিডার মরে না। সাধারণ মানুষের উপর দিয়ে মৃত্যুর ট্রাঙ্ক চলে যায়। ইলিয়াসের ভাষা বয়ান যেন পাঠকের চোখ এড়িয়ে না যায়। বাংলা ইডিয়ামের মধ্যেও কথ্যভাষা, ইংরেজি শব্দ দ্বারা স্বতন্ত্র ভাষা গঠন, স্ট্রাকচার গড়ে তোলেন। ইলিয়াসের বয়ান থেকেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিসর স্পষ্ট হয়ে যায়। বাঙালি বিদ্বেষ শুরু হয়েছিল আগেই। আসলে এতগুলি দশকের অভিজ্ঞতা ইলিয়াসের পকেটে মজবুত ছিল। যা সমাজতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও গ্রাম-শহরের মেলবন্ধনের কোলাজে ক্লাসিক পর্যায়ে পৌঁছে যায়।
ওসমান হয়ে ওঠে নীরব স্তম্ভ। সে যেন গোটা পরিসরকেই দেখছে। ভাঙা সময়ের ঘণ্টা। ভাবা যেতে পারে মহাকালের একক। আরও ভাবা যেতে পারে ওসমান নামক দ্রষ্টা চক্ষুকে সামনে রেখে প্রবাহিত ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে সত্যকে দেখা, ইতিহাসের পাতায় পৌঁছে যাবার প্রয়াস। রঞ্জু < প্রবাহিত সময় > ওসমান। ওসমান যৌবনের সত্তা। রঞ্জু কৈশোরের সত্তা। দুই বিপরীত সত্তাকে সামনে রেখে চরিত্রের বিবিধ কর্ম প্রক্রিয়া উজ্জ্বল করে আখ্যান তীব্র গতি সহ ঘোর সৃষ্টি করে। ঢাকায় ছাত্র আন্দোলন ক্রমে দানা বাঁধছে। মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষ, ন্যায়-অন্যায়, রাষ্ট্র-জনগণ, মিথ্যা-সত্যের বিবিধ বয়ান বেরিয়ে আসে। স্টাইককে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষের চিত্র। মানা- না মানার বয়ান। প্রতিবাদের পক্ষে, রুজি রোজগারের পক্ষে মধ্যবিত্ত বাঙালির ইউটোপিয়া সহ ভণ্ডামি, মেকি মানসিকতা, ব্যাখ্যাহীন, প্রয়োগহীন ঘুণধরা আদর্শবাদ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইলিয়াসের বাক্যের একটা অনিশ্চিত গতি আছে। ঝুঁকিপূর্ণ দোলা আছে। বাক্যের চলন থেকেই বোঝা যায় সময়টা সুখের নয়। প্রতি মুহূর্তে যে বিদ্বেষবাণী, সন্ত্রাস দ্বারা মানুষের যাপিত জীবনের সুখের যে বীণা ভেঙে গেছে সেই ভাঙা একতারার কাঠামোকে লেখক দেখতে ও দেখাতে চান। ছন্দের যে বাঁশী রুদ্ধ হয়ে গেছে, যে বাঁশী সারাইয়ের কর্মকাণ্ড চলছে সেখানে নেমে জন্মভূমির আশাবাদের চিত্রকে যেন উঁকি মেরে দেখতে চান। নিচু তলার মানুষ প্রতিবাদে সামিল হলেও অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মীদের হেলদোল নেই। গণ আন্দোলনের ঢেউ প্রথমে মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজকেই স্পর্শ করে।
ওসমান মধ্যবিত্ত চাকুরে বাঙালি। আনোয়ার রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী। ওসমানের সম্বল আদর্শবাদ, বিপ্লব সম্পর্কিত জ্ঞান বুদ্ধি। আনোয়ার পার্টি, জনগণ, দল নিয়ে সমাজ পরিবর্তনের ভাবনায় দীক্ষিত। ওসমান বিপ্লবে, বিদ্রোহে, প্রতিবাদের মিছিলে অংশগ্রহণ না করলেও ভিতরে ভিতরে প্রতিবাদী। ভিতরে ভিতরে জনদরদী ও পাক শাসন সম্পর্কে ঘৃণা প্রবণ। দেশকে ভালোবাসে। ওসমানের মধ্যেই কি নিখিলেশের উত্তরসত্তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না? ওসমান চিন্তক। আনোয়ার অতি বিপ্লবী। ওসমান বদলের কথা ভাবে কিন্তু অন্য পথে। আনোয়ার ডাইরেক্ট অ্যাকশানে বিশ্বাসী। ওসমানী ধীর। আনোয়ার চঞ্চল। ওসমান জীবনকে দেখে মঞ্চের পিছন থেকে। আনোয়ার জীবনকে দেখে মঞ্চ থেকে খোলা চোখে। ওসমান জানে হঠকারিতায় বিপ্লব অসম্ভব। আনোয়ার জানে ভুল সঙ্গে করে, মানুষকে উত্তেজিত করে ঘর ছাড়ালেই বিপ্লব আসন্ন। ওসমান জানে মধ্যবিত্তের ভয়কাতুরে মানসিকতা। আনোয়ার জানে এই মধ্যবিত্তই ঠেলায় পড়লে ভয় জয় করতে জানবে। আখ্যান ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে রাজনৈতিক। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও বন্দিমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় আনোয়াররা অগ্রসর। শুরু হয়ে গেছে অর্থনৈতিক শোষণ সহ শ্রেণি শোষণ। আবহমান কাল ধরেই এই শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত। শোষণের গহ্বর থেকেই বিপ্লবের বীজ জন্ম নিতে থাকে। বাঙালির আত্মসংকট বড় হয়ে ওঠে। জাতি সংকট। ভাষা সংকট। শ্রেণি সংকট। অস্তিত্বের সংকট। কর্মসংস্থানের সংকট। স্বাধীনতার সংকট। গণতন্ত্রের সংকট। মত প্রকাশের সংকট। এই বিবিধ সংকটের মালাকে লেখক ধরতে চেয়েছেন। এই সংকটের উন্মুক্ত উনোন থেকেই মধ্যবিত্তের আত্মজাগরণ ঘটে যায়। পথহীন, পরিকল্পনাহীন, নেতাহীন, রাজনৈতিক সচেতনতাহীন উত্তাল জনগণ। তারা জানে শুধু স্বাধীনতার লড়াই। পশ্চিম পাকিস্তানের পতনের লড়াই। আইয়ুব খানের বিনাশ লড়াই।
স্থির সত্যে মানুষ বিশ্বাস রাখতে পাড়ছে না। ওসমানের চা পানের দৃশ্য ভাঙা ভাঙা কাঁপা কাঁপা। রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই লেখক যেন বড়ভাবে জানিয়ে দেন। আখ্যান বলয় শহর-গ্রাম করে পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। শহরে উত্তাল মিছিল, আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই। গ্রামে মহাজনি, সামন্ততান্ত্রিক শাসনের পতন ঘটিয়ে কৃষকের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই। গ্রামীণ মুসলিম তথাকথিত প্রান্তিক অভদ্র শ্রেণি চরিত্র যে দক্ষতায় ও অভিজ্ঞতায় ইলিয়াস চিহ্নিত করেছেন তা তারিফ যোগ্য। গ্রাম সম্পর্কে আবেগ বা ফ্যান্টাসি নয় যথার্থ বাস্তবতা তার রক্ত মাংস ক্লেদ সহ যে ভাষা পরিমণ্ডলে উপস্থিত হয় তা সেদিনের উপন্যাসের গতানুগতিক বয়ানকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে নতুন পরিসরে নিয়ে আসে। ভদ্রতার লেশ, যৌন বোধ তথাকথিত মূল্যবোধের শ্লীলতাকে ভেঙে দিয়ে আখ্যান চরম বাস্তব পরিসরে প্রবেশ করে। গ্রাম জীবনের সহজ-সরল বয়ান, জীবনপ্রণালী ইলিয়াসে এসে ভেঙে যায়। যৌনতা, অবদমিত কামনা, চাহিদা, ভোগের ক্ষেত্র এনে সমাজ সম্পর্কিত ট্যাবুগুলি ভেঙে দেন। দুর্বল বাংলা উপন্যাসে যৌনতার ট্যাবু ভেঙে যথার্থ বাস্তব কিন্তু আরও আগে হাংরিরা নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমরা যেকারণেই হোক হাংরিদের নিয়ে ভাবিনি। ইলিয়াসের যে প্রাধান্য, প্রতিপত্তি তা হাংরিদের মধ্যেও ছিল, শুধু দেখার অভাবের জন্য বাংলা আখ্যানের সাবালক হতে এত দেরি লেগে গেল। যৌনতার ট্যাবু, ব্যারিকেড, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ভেঙে তছনছ করে দেন ইলিয়াস। পাশ্চাত্য জীবনের সব গ্রহণ করলেও যৌনতা গ্রহণে আমরা সক্ষম হইনি। সতীত্বের দোহাই দিয়ে মধ্যযুগেই থেকে গিয়েছি। সেখান থেকে লেখক বের করে আনার চেষ্টা করেন—
“এইসব নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে কেবল আপন ভাই বাদ দিয়ে যাবতীয় তরুণের সঙ্গে একজন তরুণীর যৌন-সঙ্গম ছাড়া আর কোনো সম্পর্কের কথা চিন্তা করতে পারে না। যৌন-সঙ্গমকে নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুমোদন দেওয়ার জন্যে বিবাহ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাকবিবাহ প্রেমের মহড়া চলে। বিয়ে করলে যেমন ছেলেমেয়ে পয়দা করাটা অপরিহার্য, তেমনি প্রেম মানেই বিবাহ।” (চিলেকোঠার সেপাই, মাওলা ব্রাদার্স, পৃ. ৭৬)
আখ্যান উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্তের প্যারালাল পরিসরে এগিয়ে যায়। দুই জীবনের মধ্যে সেতু ধরে রাখে মহাজন বৃত্তি। এইসব নিম্নবিত্তের মানুষ কর্মের জন্য মহাজনের কাছে বাঁধা। উপভোক্তা হিসেবে নারীর শরীর ফ্রি। চলতে থাকে আধিপত্যবাদের বিস্তার। কায়েমি শক্তি দ্বারা নারী লাঞ্ছনা সংঘটিত হতে থাকে। ভোগবাদের আতিশয্যে নারীকে পণ্য করে তুলে বল দ্বারা ধর্ষণ ও ভোগের যে প্রতাপমালা গড়ে ওঠে তা পূর্ব পাকিস্তানের সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকে গভীরভাবে স্থাপিত করে। প্রান্তিক পরিসরের জানলা দরজা খুলে বয়ান ভদ্রবৃত্তের বাইরে গিয়ে সমাজের অবহেলিত নিপীড়িত তথাকথিত নিম্নশ্রেণির কথা বলে। শুধু কথাই নয়, জীবনের উপরিতলও নয়, জলের উপরি তলের বাসি সরও নয়, জলের ভিতরে গিয়ে গভীর তলদেশের খোঁজ তল্লাস চালিয়ে জীবনের যে বাস্তবতা অঙ্কিত হয় তা জীবনকেই যেমন ব্যঙ্গ করে তেমনি আলোরিত করে মহাজন পরিবৃত্ত আরেক সময়কে। শোষণ-শাসনের নীতি-দুর্নীতি, ব্যাখ্যা, প্রচলিত রীতি-অরীতি, শোষণের সিস্টেম, কীভাবে মানুষকে বধ করা যায়, যা শ্রেণি বিশেষে, সময় বিশেষে, পরিসর বিশেষে কার্যকারী তা রাষ্ট্র জানে। কোন তাওয়ায় কীভাবে ভাজতে হয় তা রাষ্ট্রের ট্রেনিং প্রাপ্ত পুলিশ বা উচ্চপদস্থ অফিসার জ্ঞাত। কিন্তু মাঝে মাঝে বাদামের তাওয়ায় পাপড় ভাজতে গিয়ে বিপদ ঘটে। বোম ফাটে না। জনগণ জেগে ওঠে। ভাষাচেতনা, স্বদেশচতনার জোয়ার এসে সব ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আখ্যান হয়ে ওঠে রাজনৈতিক-সমাজতাত্ত্বিক-রাষ্টনৈতিক বিশ্লেষক। ইলিয়াস উপলব্ধি করেছিলেন ১৯৪৭ এ ভাগ হওয়া পাকিস্তানের ভৌগোলিক মতাদর্শগত ও কার্যকরী ভুল কোথায়। আখ্যানে বিবিধ সত্য প্রবেশ করিয়ে দিয়ে জনজীবনের মহাকাব্যকে বয়ানে রেখে আসলে পাকিস্তান ভূ-মণ্ডলের প্রকৃত সত্য দেখতে ও দেখাতে চান। যে ভুলের উপর, যে মেকির উপর পাকিস্তান ধারণা দাঁড়িয়ে ছিল সেই ভুলে ভেঙে দিতে চান।
পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে। সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে তুলতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নানাভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। বঞ্চনাই ক্ষোভের জন্ম দেয়। শুধু আইয়ুব খান নয় লড়াই সম্রাজ্যবাদ, সামন্ত্রবাদ, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। ছাত্রশক্তি বুঝে গিয়েছিল মূল সমস্যা কোথায়। ছাত্র আন্দোলন উত্তেজিত করতে আনোয়াররা শহীদ আবু তালেবরের পিতা মকবুল হোসেনকে কাজে লাগায়। আবেগকে জনগণের রক্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চায়। জনগণের উদ্দীপনাকে কাজে লাগাতে চায়। ইন্ধন প্রক্রিয়াকে জরুরি করে তোলা চাই। মকবুল হোসেনের বয়ানের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের ছাত্রদের পথ স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশভাগ যেন বাড়ি ভাগ। নতুন বাড়ি। বাড়িওয়ালার ভাড়া বাড়ি। যা পুঁজিবাদের জন্ম দেয়। এইভাবে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়। ইলিয়াস আখ্যানে বহু ইঙ্গিত রেখে আমাদের টোটাল সমাজ কাঠামোর শরীরকে বিশ্লেষণ করতে চান। রাজনীতি-যৌনতা-খিস্তি, ভদ্র-অভদ্র জীবন নিয়ে ইলিয়াসের বয়ান। সমাজ-সময়-পরিসর সম্পর্কে গভীর দার্শনিক চিন্তা পকটে মজবুত করে ইলিয়াস আখ্যানভুবনে প্রবেশ করেন। বিষয় নয় বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করে খোসা ছাড়িয়ে ফলের বীজে প্রবেশের সৎ ও সুতীব্র ইচ্ছা এবং দক্ষতা আখ্যানকে করে তোলে বলিষ্ট ও একক। একাধিক চরিত্রের সমাবেশে গোটা জনজীবনকেই ইলিয়াস চিহ্নিত করতে চান। বলা ভালো জনজীবনই যেন এই ইতিহাস লিখে চলছে। ইতিহাস-ইতিহাসহীনতা, শ্রেণি-শ্রেণিহীনতা, গোষ্ঠী-গোষ্ঠীহীন মিলে গঠিত-অগঠিত পরিসর যাদের নিয়ন্ত্রক একটা বড় সময়, সেই সময়ই যেন আখ্যানের মূল চালিকাশক্তি। স্বপ্ন-স্বপ্নাচ্ছন্নতা-স্বপ্নহীনতা, তন্দ্রা-ঘোর নিদ্রা-তন্দ্রানুভূতি, বাস্তব থেকে পালাতে স্বপ্নমগ্নতা কিন্তু সেই স্বপ্নেও আঁকড়া বাস্তবের উঁকি ঝুঁকিতে লেখক প্রবলভাবে বাস্তবতার মন্ত্রদীক্ষা দিয়ে যান।
যেকোনো বিপ্লবে সাধারণ মানুষকে বেশি ভুক্তভুগি হতে হয়। ভোটের রাজনীতি, বড়লোকের কায়েমি স্বার্থ দ্বারা সব দখল, অতিসাধারণ মানুষের বিবেক বর্জিত চরিত্র, সামান্য সত্যকে ধরতে গিয়ে বৃহৎ সত্যকে বলি দেওয়া, নিম্নবিত্তের জীবনংসকট, নীতিহীনতা যেন শ্রেণিচরিত্রকেই প্রতিষ্ঠা করে। লুম্পেন খিজিরের ভাঙাচোরা দাম্পত্যজীবন, প্রতিবাদ, চুরি, দাম্পত্য সংকট, সন্তান স্পৃহা আসলে জীবনেরই অপর দিক। যেদিকে ভদ্র বাঙালি তাকাতে অনিচ্ছুক। ওসমান আনোয়ারের পিতারা পার্টিশনের সময় পাকিস্তানে অপশন নিয়ে চলে আসে। সেদিন গভীর ষড়যন্ত্রের দিশা হাদিশ না পেয়ে মুসলিম সমাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাড়ি বদলের তার ফল ভুগতে হয়েছে। রাজনীতি-রাজনীতি সম্পর্কিত গ্রাম্য-শহুরে ভাবনা, রাজনীতির সত্য-মিথ্যা গ্রাম্য চাষির মধ্যে কীভাবে ধরা দেয় উত্তাল সময়ের প্রয়োজনে, যে মারি বেলায় রাজনীতিই হয়ে উঠতে পারে মানুষের বন্দিমুক্তির আকাঙ্ক্ষা তখন মানুষকে সচেতন হতেই হয়। খিজির বা চেংটুদের সচেতনতা বা আবেগ বা দলদাস থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকৃতপক্ষে ব্যক্তির আত্মজাগরণেরই সোপান। ঢাকা প্রথমে উত্তাল হয়েছে। সেই উত্তাল আগুন ধীরে ধীরে গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হচ্ছে। মহাজন-জোতদার পরিবৃত্ত গ্রামজীবন। বন্দি চাষি অর্থহীন অসহনীয় জীবনযাত্রায় অস্থির হয়ে পড়েছে। গ্রামে কুসংস্কার আছে, তা ভেঙে ফেলার নোটিশও আছে। দিন বদলের ডাক এসে গেছে। ভাগচাষিরা গর্জে উঠেছে। লেখক তো প্রবাহমান সময়কেই আইডেন্টিটি করতে চেয়েছেন। সময়ের সন্তান হিসেবে করমালিদের জেদ, আত্মবিশ্বাস মহাজনের রাতের ঘুম যে কেড়ে নিয়েছে তা বলাই শ্রেয়।
স্বাধীন সূর্য কীভাবে পরাধীন হয়েছিল, বিক্ষিপ্ত বিদ্রোহ দ্বারাও দেশ কেন স্বাধীন হয়নি সে সত্য ইলিয়াস জোরকদমে বের করে আনেন। বাঙালি, ভারতীয় সহ গোটা উপমহাদেশের চিত্রই যেন স্পষ্ট হয়ে যায়। উচ্চবিত্ত পরাধীন ভারতে আন্দোলন থেকে দূরে ছিল। আঘাত উচ্চবিত্তে তেমন আসেনি। যোগ্য নেতা, বুদ্ধি, আদর্শ, চিন্তা, চেতনা থাকলে দেশ আগেই স্বাধীন হতে পারতো। নদীকে কেন্দ্র করে যেমন শহর-গ্রাম গড়ে ওঠে তেমনি এই আখ্যানেরও অবস্থান। শহর > সময় < গ্রাম। বহমান সময় বয়ে যাচ্ছে নদীর মতো। দুইতীরে গ্রাম ও শহুরে জীবনের বর্ণমালা এঁকে যাচ্ছে সময়ের বিভীষিকাকে। দুই জীবনে জীবনবোধ, রীতি, বিশ্বাস, কার্যকম ও মুখের ভাষাতে তফাত আছে। সে মেলবন্ধনের সূত্র গড়ে চলেছেন ইলিয়াস কালের প্রহরী হয়ে।
রঞ্জু শৈশব সত্তা। ওসমান যৌবন সত্তা। স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যতের বর্ণচিত্র ইলিয়াস সময় সরণি ধরে অঙ্কন করতে চান। সত্তায় স্মৃতি বারবার হানা দেয়। বাস্তবের কাঠিন্য থেকে বাঁচতে সত্তা অনেক সময় স্মৃতিতে আশ্রয় নেয়। কোনো ব্যবস্থা, সিস্টেম, রাষ্ট্র, শাসনের বিনাশ ঘটাতে হলে নানা দিক থেকে ভাঙন জরুরি হয়ে পড়ে। সিস্টেমের মধ্যে থেকেও সিস্টেমের নাট বল্টু ঢিলে করে দেওয়া যায়। সকলেই প্রত্যক্ষ মিছিলে, বিপ্লবে অংশগ্রহণ করবে না। কিন্তু সকলের সম্মিলিত প্রয়াসই ডাক দিতে পারে পরিবর্তনের। ওসমান যেন মিছিলের অংশ। জন জোয়ারের জল বিন্দু। মহাপ্লাবনের ভাঙন বেলায় যা নতুন সৃষ্টির ইঙ্গিতবাহী সেখানে সে একক পদধ্বনি। ওসমানের উপলব্ধির মধ্য দিয়ে আখ্যান মিছিল থেকে গণঢেউয়ে, মধ্যবিত্ত পরিসর থেকে সমস্ত বন্ধন ভেঙে পথে এসেছে। ওসমান যেন মহাকালের ধ্বনি। ওসমানের চেতন-অবচেতন অস্তিত্বে অস্থির সময়ের দোলা বারবার উল্কি ঝড় এনে দেয়। যখনই সে স্থির সত্যে, আপাত বিশ্রামে যায় শুরু হয় অচেতন অস্তিত্বের দোলা। ওসমানের এই দ্বৈত সত্তার (চেতন-অবচেতন, কৈশোর-যৌবন, রঞ্জু-ওসমান) মধ্য দিয়ে লেখক সময়ের জগাখিচুরিকেই প্রতিস্থাপন করতে চান। ঘটমান বাস্তবতার রুক্ষতা যা বাংলাদেশের জনজীবনকে তছনছ করে দিয়েছিল, জাতির ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি আবার বাঙালির ঐতিহাসিক জয় সহ বিপ্লবের পটভূমি সেই কালরহস্য বড় ক্যানভাসে ধরা দেয়।
আখ্যানে ঘর-বাইরের দোলা বইতে থাকে। বাইরের ঢেউ ঘরে আসে, ঘরের উত্তেজনা আবার বাইরে নিয়ে যায়। আসলে উত্তেজনার পারদ যখন চড়তে থাকে তখন কিছুই স্থির থাকে না। অস্থিরতার মধ্য দিয়ে মানুষ ও জীবন সমান্তরাল গণ্ডি ভেঙে, ছিন্নভিন্ন করে অচেনা অজানা বিচ্ছিন্ন বিভক্ত পরিসরের মধ্য দিয়ে সামান্য সত্য খুঁজতে চায়। বৃহৎ স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন জরুরি। জনকল্যাণের জন্য ব্যক্তি স্বার্থ বিসর্জন জরুরি হয়ে ওঠে। রামায়ণের সেতুবন্ধনে কাঠবিড়ালির মতো ক্ষুদ্র জনগণের স্বার্থ বিসর্জন অনিবার্য হয়ে আসে। বিপ্লব এভাবেই সংগঠিত হয়। বৃহৎ প্রচেষ্টা ও উদার মনোভাব ছাড়া বিপ্লব সম্ভব নয়। উচ্চবিত্ত আন্দোলনে নেই। খিজিররাই আন্দোলনে নেমেছে। বৃত্তিধারী, শ্রমজীবী মানুষের বিপুল অংশগ্রহণই কি গণতন্ত্রের নতুন পরিসর রচনা করে দেয়নি? জনগণের ভিতরের ক্রোধ প্রকাশিত হচ্ছে খিস্তিতে। খিস্তিরও দুই ভাগ দেখা যাচ্ছে। যৌন শব্দযুক্ত ও নিছক গালাগালি। আবার আন্দোলনে বেনোজলও ঢুকে যায়। সমস্ত আন্দোলনে যেমন হয়, সমস্ত মহৎকার্যে যেমন হয়। রিকশাওয়ালাদের সাম্য মৈত্রীর আন্দোলন পণ্ড করে দেবার চক্রান্ত চলে। বয়ানে স্পষ্ট হয় সেই গভীর চক্রান্তের কথা—
“ভাইসাব! আমাদের, আজ আমাদের যে আন্দোলন চলছে, আমাদের লুণ্ঠিত গণতান্ত্রিক অধিকার, মেহনতি মানুষের বাঁচার অধিকার ও আমাদের জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন চলছে সেই আন্দোলন নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য একটি গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের ভেতর অনুপ্রবেশকারী একদল হঠকারী লোক।—” (তদেব, পৃ. ১৮৬)
আন্দোলনের মধ্যপথে আনোয়ার গ্রামে চলে যায়। কৃষকদের অধিকার লড়াইয়ের প্রশ্নে সে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ওসমান-আনোয়ারকে কোথাও কোথাও পরিপূরক সত্তা হিসেবে দেখা যেতে পারে আখ্যানের গতি নিয়ন্ত্রণে। হ্যাঁ তাদের পন্থা, অর্থনীতি, সমাজতান্ত্রিক ভাবনায় বিভেদ থাকতে পারে, পথ আলাদা হতে পারে কিন্তু আন্দোলনের ঢেউ প্রায় এক। শ্রেণি শোষণকে আগে ভাঙতে হবে। পরিসর ভিন্ন হতে পারে। গ্রামের ক্ষেত্রে মহাজন, শহরের ক্ষেত্রে পুলিশ। আনোয়ারের অনুপস্থিতে ওসমান নীরব দর্শক। সংস্কার-কুসংস্কারের বয়ান যেমন উপস্থিত হয় তেমনি তা ভাঙার প্রবণতাও চোখ এড়িয়ে যায় না। দ্বন্দ্বমথিত সময় বিশ্বের পর্ব থেকে পর্বান্তরের রসদ তিনি আবিষ্কার করতে করতে আখ্যানকে এগিয়ে নিয়ে যান।
গোরু একটা বড় ব্যবসা বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজ অর্থনীতিতে। আমরা যে পরিসরে বসবাস করি, বর্ডার অঞ্চল থেকে প্রায়ই গোরু পাচার হয় বাংলাদেশে। দরিদ্র, শ্রেণিশোষণ, মহাজন, মাধ্যম, রাষ্ট্রের শ্রেণিচক্র সমস্ত এনে গোটা সিস্টেমের গণ্ডগোল তথা মেকি বৃত্তি যা প্রকৃতপক্ষে সাধারণ-অতিসাধারণ মানুষকে চুসে নেওয়ার বড় কুয়া তা ইলিয়াস সময় সরণিতে বসে দেখেন ও দেখান। কখনও নিজে, কখনও ওসমান-আনোয়ারের প্রত্যক্ষ বয়ানের মধ্য দিয়ে। ভাঙন শুরু হয়ে গেছে গ্রামে শহরে সর্বত্রই। মিছিল ও জনজোয়ারে সাধারণ মানুষের গর্জে ওঠা যমুনা নদীর মতো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গ্রামে খয়রার গাজীদের পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। মধ্যবিত্তের আদর্শবাদী, কার্যবাদী, বিপ্লববাদী, বুদ্ধিবাদী আন্দোলন ও নিম্নবিত্তের বুদ্ধিহীন, পরিকল্পনাহীন, কায়িকশ্রম নির্ভর মুক্তির পথের মধ্য দিয়ে ইলিয়াস মানুষের যুথিবদ্ধতার যৌথজীবনের সোপানকেই বড় ইঙ্গিত করেন। পথ একই কিন্তু চিন্তা ভিন্ন, চেতনা আলাদা। শ্রেণিচিত্র ভিন্ন বলেই মুক্তির পথ পৃথক পরিসরে অগ্রসর হয়ে যায়।
আগুন-যমুনা-জল সব প্রতীক হিসেবে আসে। সময়ের প্রতীক। শীতল-উষ্ণ সময়ের প্রতীক। ইলিয়াস বড় মাঠের শিল্পী। ফুটবল খেলার একটা কৌশল হল মাঠ বড় করে খেলা। আখ্যানের মাঠ কীভাবে প্রসারিত করতে হয় ইলিয়াস জানেন। আখ্যান যত এগিয়ে গেছে ওসমানের অবচেতন কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বাস্তব পরিসর থেকে দূরে নিয়ে ঘোর বাস্তবের পূর্বাভাস দেয়। ওসমান ইলিয়াসের স্বপ্ন সঞ্চারক নায়ক। যা ঘটেনি তা নয়, যা ঘটতে চলেছে, যা ঘটা অবধারিত সত্য তা ওসমানের অবচেতনে ধরা দেয়, যা প্রকৃতপক্ষে ইলিয়াসের তীক্ষ্ন বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তাশীলতার প্রকাশ। ওসমানের বাস্তববোধ, বাস্তব পরিসর, যৌন চিন্তা ভেঙে দেয় অবচেতন সত্তা। রঞ্জু এসে হানা দেয়। আবার বাস্তব থেকে আত্মগোপন করতেই অবচেতনে যান। চেতন-অবচেতন, বাস্তব-অবাস্তব, যৌন পরিবেশ সব মিলিয়ে বাংলা আখ্যানকে যে দৃঢ় ভূমির উপর দাঁড় করিয়ে দিলেন তা সর্বার্থেই ক্লাসিক। ওসমানের ভেতর রঞ্জু ঢোকে, চেতনের ভেতর অবচেতন আসে, যৌবনের ভেতর কিশোর উঁকি দেয়, ব্যক্তির নিজস্ব পরিমণ্ডল চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় বাইরের অস্থির পরিবেশে। এই অস্থিরমালায় ব্যক্তির সত্তা যেমন দ্বিধাভক্ত হয়ে যায় তেমনি ব্যক্তির সংকট বৃদ্ধি পেতে থাকে। মধ্যবিত্ত আদর্শবাদী বুদ্ধিজীবীর মনে ধরা দেয় না আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি। মধ্যবিত্ত আদর্শনিষ্ট স্বল্প বুদ্ধিজীবী আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। কিন্তু আন্দোলনের ঢেউ মস্তিষ্কে নাড়া দেয়। ক্রিয়া ঘটায়। যা থেকে বিচ্যুত নয় ওসমানও। মিছিলে যোগদান না করেও মিছিলের সত্য ব্যক্তির মনে ঘাত-প্রতিঘাতময় যে বিবমিষার জন্ম দেয় তার রোমন্থনে যে অমৃত-হলাহল উঠে আসে ইলিয়াস তাই খই পাকের মতো জড়িয়ে জড়িয়ে আখ্যান নির্মাণ করেন।
মহাজনি কারবার ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। আসলে এ আখ্যান ভাঙান বেলার। মহাজন, জমিদার, নব্য সামন্ততন্ত্র, পশ্চিম পাকিস্তানি অপশাসনের ভাঙনবেলাকে ইলিয়াস চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। বিনাশ বেলায় যে আগুন জ্বলে ওঠে সেই আগুনের দিনের দিনলিপি এ আখ্যান। শহর-গ্রামের লড়াই। আদর্শ, পথ ভিন্ন। শহর মিছিলে বিশ্বাসী, গ্রাম খতমে। শহর সমস্ত সরকারি কার্যালয়কে বানচাল করছে, গ্রাম মহাজনের পতন অনিবার্য করছে। শহর পথে, গ্রাম হাতে। শহর স্লোগানে, গ্রাম খিস্তিতে। যে বিধ্বংসী আগুন জ্বলে গেল চারিদিকে তা ওসমানের পক্ষে সমর্থন সম্ভব নয়। ফলে রঞ্জু সত্তায় ঢুকে যেতে হয়। বাঙালি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী এই ভাঙনবেলায় বিধ্বংসী আগুনকে সমর্থন নাও করতে পারে। সমস্ত বিপ্লবেই কিছু অনৈতিকতা থাকে। সাম্রাজ্যবাদকে ভেঙে ফেলতে কিছু অনৈতিকতাকে আপোশ করতেই হয়। কিন্তু কীভাবে আপোশ করবে ওসমান? ব্যক্তিসত্তা ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যায়। উপন্যাসের শেষের দিকে আখ্যান গ্রাম-শহর-গ্রাম-শহর-গ্রাম করে এগিয়েছে। শহরে শেখ মুজিবরের মুক্তি উপলক্ষে উৎসব, গ্রামে মহাজন নিধনের উৎসব। খিজিরের সন্তান জন্ম নিচ্ছে। দেশ স্বাধীন হচ্ছে। নতুন শিশুই যেন দেশের প্রতীক। খিজিররাই বাংলাদেশের জন্ম দিচ্ছে। কোনো বুদ্ধিজীবী নয় লুম্পেন-নিম্নবিত্ত-সাধারণ-অতিসাধারণ মানুষ দেশমাতৃকার বাহক।
ব্যক্তির রাজনৈতিক সচেতনতা জরুরি। ব্যক্তির রাজনৈতিক জ্ঞান, সচেতনতা, বোধ বিশেষ প্রয়োজন। আজকের এই বিধ্বস্ত সময়ে রাজনীতির উলটো সমীকরণে, ব্যক্তির অসচেতন রাজনৈতিক বোধে রাষ্ট্র যখন সব তছনছ করে দিচ্ছে তখন বড় মনে পড়ে আনোয়ারের করমালিকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার ভাবনার কথা। উত্তাল তরঙ্গ, উত্তাল সময় বিভঙ্গ থেকে কাহিনি শেষে ওসমান নির্ভর হয়ে যায়। বাইরের ঢেউ অপেক্ষা লেখক ব্যক্তির ঢেউয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। ওসমানের শেষ উচ্চারণ গুলি দুই সিলেবেলের। কীভাবে দেখবেন? সিলেবেল মানে যদি দল ধরি তবে তা মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত। দুই সমাজের বিপ্লবের কথাই কি সে বলছে? সেপাই তো মানুষের মুক্তির পথের সত্য দেখছে, কখনও নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। ওসমানের চেতনায় ছড়া, ক্ষণিক ব্যবধানে শব্দ বর্জন-নতুন শব্দ আগমন যা মৃত্যু ও নব বিপ্লবের সূচনা-বর্জন-গ্রহণ, পিছিয়ে যাওয়া-এগিয়ে যাওয়াকেই জানান দেয়। দিন দিন ছড়া বড় হয় আসলে মিছিল বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষ লড়াইয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মানুষ নিজস্ব চেতনা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। বিকৃত মস্তিষ্ক ওসমানকে আনোয়ার ঘরে আটকে রাখতে চাইছে, দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ওসমান বন্ধন ভাঙতে চাইছে। দ্বন্দ্ব এখানেই। বিপ্লবের পথের দ্বিধাভক্ত চিত্র এখানেই স্পষ্ট করে দিচ্ছেন ইলিয়াস। বর্ণহীন ওসমান পথকেই শেষ অবলম্বন ভাবে। চিলেকোঠার সেপাই ঘর থেকে পথের দিশাতেই নেমে চলেছে দিকশূন্যপুরে। খিজিরের খোঁজ তো অবশ্যই আছে। পথই পথ দেখাবে।
‘চিলেকোঠার সেপাই’ সেই বিরল গোত্রের উপন্যাস যা জনজীবনের সমস্ত সত্য সহ মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত-লুম্পেন চিত্রমালার জীবনচিত্রের একাধিক এককের দ্বৈত্যক। উত্তাল সময় তরঙ্গে মানুষের ঘূর্ণনচক্র কীভাবে পাক খায় এবং মেলোমেলো হতে হতে ভুল-ঠিক পথের সন্ধান খোঁজে, সেই নৈশঃব্দ্যের অক্ষরমালা শব্দবীণায় বাজিয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। গ্রাম-শহরজীবনের নিপুণ চিত্র, মধ্যবিত্তের বিপ্লববাদী জীবনচিন্তার ফাঁকা পরিসর, নিম্নবিত্তের হঠকারিতার মধ্য দিয়ে যে আখ্যানের জন্ম হয় যা বাংলাদেশের সময় রাজনীতির একটি বিশেষ জীবন্ত চিত্র ও চিন্তামালা। সমাজতন্ত্র, বামপন্থী আন্দোলন, পুঁজিবাদ, জনযুদ্ধের খতিয়ানে ইলিয়াস অনেক সময় এলোমেলো হয়ে যান ঠিকই কিন্তু আবেগ বিসর্জন দিয়ে, নিটোল কাহিনির অবতারণাকে উড়িয়ে দিয়ে রগরগে মুখের ভাষাকে সঙ্গী করে মানুষের ভিতরের যে খেদ ও বৈষম্যের প্রকাশ ঘটান তা সময়ের জরুরি পাঠ হিসেবে বিশেষ মূল্য দাবি করে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন