নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত | চেনা ‘ঝামেলা’ অন্য ‘পোতিবাদ’

[এখন ‘পোতিবাদ’ করে লেখালেখি করতে মানুষ জন খুব ভালোবাসে। গণতান্ত্রিক কাজ কর্মের অন্যতম। আমিও খানিক ‘পোতিবাদ’ করব ঠিক করে নিয়েছি। কিন্তু মুস্কিল হল অন্যের দোষ ধরে বিকট আলোচনা করতে গিয়ে দেখি দোষটা কেবল ‘ওদের’ নয়! ‘আমাদের’ও। তাই রাম দুই তিন চার করে ভালো ভাবে সাজাতে বসলাম।]

সমস্ত বিষয় তখনই টনক নড়িয়ে ছাড়ে ,যখন তা ‘ব্যক্তিগত’। সেই আতঙ্ক সিনেমার সংলাপের মতন। যখন ছেলে আহত হল, তখন প্রতিবাদ করার জন্যে এগিয়ে এলো শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন ‘মাস্টার মশাই’। তার আগে মাস্টার মশাই ‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেন নি’। এখন সাধারণ শিক্ষার পরিমণ্ডল টি ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আমি সাধারণ ইস্কুলে বাঙলা মিডিয়ামে পড়ে ,নিজের আর্থিক কোন কেরিয়ার গড়ে তুলতে পারিনি। একটা দীর্ঘ সময় দোষ দিয়েছি নিজেকে। আমি পারিনি। আমি শিখিনি। আমার জানা হয়নি। তাই আমার কোন আর্থিক উপার্জনের ব্যবস্থা হয়নি। তারপর কিঞ্চিৎ দুঃখ কেটে গেলে ,দোষ দিতে লাগলাম সিপিএম কে,‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ থিয়োরি কে। যদি ক্লাস ৬ থেকে অদ্ভুত অবৈজ্ঞানিক ভাবে আংরেজি পড়ানোর চেষ্টা না করে পুরাতন সিস্টেমে ইংরেজি পড়ানও হত তাহলে হয়ত আমি এবং আমার মতন আরও অনেকে ইংরেজি জানতাম… উপার্জন ক্ষম হতাম। সেই জন্যে যেদিন গর্ভধারণ করলাম সেদিন থেকে আংরেজি ইস্কুলে নবজাতক কে ভর্তি করব স্থির করে নিলাম। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে কম হ্যাটা খাইনি। সন্তান আমার ‘ইট্‌’ ‘মিট্‌’ ‘সিট্‌’ বলবে। আমি এবং আমার মত প্রচুর মানুষ ছেলেমেয়েদের বেসরকারি ইংরেজি মিডিয়ামে ঢুকিয়ে দিলাম।এবার কিছুদিন আগে খবরের কাগজে তাকিয়ে দেখি শহর কলকাতায় প্রায় ৫৬ টি বাঙলা ইস্কুল উঠে গেল।কিন্তু আমাদের বাংলার পড়াশোনা করার ইতিহাস দীর্ঘ আর গভীর। সেই চৈতন্যদেবের আমল থেকে বাঙালীরা অংকে,তর্কে,ব্যকরণে,সাহিত্যে,সংগীতে বেশ পারদর্শী। ব্রিটিশ আমলেও তারা সাহেবদের দেওয়া শিক্ষা কে খুব উপযুক্ত ভাবে গ্রহণ করেছেন। তারপর কি সব ঘটতে লাগল! বাঙ্গালির বুদ্ধির ধার কি ভোঁতা হয়ে গেল… পিছনে দেওয়াল এসে গেল যে।

আমাদের সমাজের দিকে তাকালে একটা প্রবল আর্থিক এবং বোধগত অসমতা দেখতে পাই। আমরা কাউকে শিক্ষায় বা আর্থিক প্রতিপত্তিতে ‘ছোট’ না করে, ‘বড়’ বা সফল হই না। সমস্যাটা এই খানেই দাঁড়িয়ে। ভালো টিউটারের খোঁজ পেলে বহু উচ্চাকাক্ষী মা তার সন্তানের সহপাঠীদের মা দের জানান না। হাসি পেলেও ব্যাপারটা সত্যি।যেমন বাঙালি পরিবারে ছেলে এবং জামাইয়ের আদর তার আর্থিক উপার্জন দিয়েই বিচার করা হয়। মেয়ে বা বউমা বলিষ্ঠ উপার্জন করলে তার স্মোক করা কিংবা অমানবিক হওয়া কোন দোষের হয় না (জানিয়ে রাখি আমি নারী পুরুষ উভয়ের স্মোক করা খুব অপছন্দ করি)।কিন্তু এই শিশুতোষ সামাজিক বিচার, প্রতিযোগিতার পাশে সমাজের অন্য উত্তরণের একটা প্রয়োজন আছে সেই জন্যে সাধারণ শিক্ষার বড্ড দরকার।

দ্রুততার সাথে আমাদের সব কিছু ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে সেখানে যদি কোন মানুষ সঠিক ভাবে তার টাকা পয়সা ব্যাংকে জমা দেওয়া বা পাওয়া বুঝে নিতে না পারে তাহলে খুব বড় বিপদের সামনে দাঁড়াবে। সরকার থেকে নানান আর্থিক সাহায্য পাঠাবে, সেটা বুঝে নিতে একটা ন্যুনতম আর্থিক ‘সাক্ষরতা’র দরকার। বহু মানুষ সেটা না থাকায় অন্যের সাহায্য নেন। খুব অসুবিধার মধ্যে পড়েন।‘ক্যাসলেস’ অর্থনীতির যে চেষ্টা চলছে তাতে সাধারণ লিখতে পড়তে বুঝতে জানা একান্ত প্রয়োজন। বহু মানুষ এই সাধারণ শিক্ষা পাওয়ার অবস্থা থেকে দূরে থাকেন। কারণ গুলো একটু জানার। --

বিদ্যালয়ের ত্রুটি- Aims of Elementary Education in India বলে যে সরকারী নির্দেশ টি আছে সেটি বলছে, তার দু নম্বর আর তিন নম্বর পয়েন্ট এ লেখা আছে -

2 It aims to foster the all-round development of all learners.

3 It aims to facilitate the harmonious and successful development of the children.

আমাদের গণতান্ত্রিক দেশের স্বাভাবিক উচ্চারণ। এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায় আমাদের পাঠশালা গুলি কি all-round development এর জন্যে আদৌ তৈরি।(গবেষণায় দেখা গেছে মেয়েরা স্কুল ছেড়ে দেয় তার অন্যতম কারণ জল ও আব্রু যুক্ত শৌচালয়ের অভাব)

  • স্বাস্থ্যকর ভাবে মিড ডে মিল রান্না হওয়া ,পরিবেশিত হওয়া।
  • খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ।
  • সঠিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ratio

নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত | চেনা ‘ঝামেলা’ অন্য ‘পোতিবাদ’

একটি সাধারণ পরিকাঠামোতে যদি বেঁধে রাখা যায় তাহলে বিদ্যালয়ের সমস্যা মিটবে না।কারণ পরিবেশের নানান তারতম্য রয়েছে। ‘যেখানে যেমন সেখানে তেমন’ ভাবে কাজ করে যাওয়া উচিৎ। কিছু শিক্ষক বলেন তাদের স্কুলে আদৌ মিড ডে মিলের দরকার নেই। কিছু শিক্ষক কে এই কথা বলা মাত্র তারা আঁতকে উঠে বলেন, “কি বলছেন, না খেয়ে থাকবে যে অনেকে।”

আমার ব্যক্তিগত মতামত মিড ডে মিল থাকুক। হ্যাঁ সাধারণ ভাবেই থাকুক। যে খেতে পায় না সে যদি মুখ ফুটে না বলতে পারে! কেন কেউ খেতে পায় না তার ‘গল্প’ টা নিয়ে রাজনীতি হয়, কিন্তু অবস্থার মানবিক এবং ক্ষতির দিক টা কেউ ভেবে দেখে না। মিড ডে মিল নিয়ে অনেক ঘটনা শুনি, যেমন বাবা অন্য রাজ্যে শ্রমিকের কাজে গেছে, মা সাইকেল চালিয়ে জেলা শহরে বাসন মাজা,রান্না করার ,কাজে গেছে। বিকেলে ফিরে এসে রান্না করে।দন্ত হীন বৃদ্ধ আর তার প্রাথমিক স্কুলের দুই নাতি বাড়ি থাকে। নাতি দুই জন ইস্কুলে গিয়ে মিড ডে মিলে থালা পেতে বসে খানিক ভাত খায়,কিছুটা কৌটতে পুরে নেয় । দাদু খাবে। দিদি ইস্কুলে ডিম ভাত খায় যেদিন, ইস্কুলের আশেপাশে দুই বছরের ভাই দাঁড়িয়ে থাকে। যদি একটু ডিম পাওয়া যায়। আমাদের যে ভাগ করে খাবার বহুদিনের ঐতিহ্য। সেটা ভুলে গেলে চলে! প্লিজ বলবেন না, ‘আমাদের ট্যাক্সের টাকায় ভূতের কেত্তন হচ্ছে।’ যদি কিছু মানুষ না খেয়ে থাকে তাহলে আর যাই হোক আমরা সভ্য দেশের বাসিন্দা নই। পরম দুঃখের আর ঘৃণার ব্যাপার সেই বরাদ্দ চুরি হয়!

উপার্জন করার জন্যে যে শিক্ষা দেওয়া উচিৎ সেটা আমাদের সিলেবাসে খুব সীমিত ভাবে আছে। খুব ছোটদের পড়তে শেখা, লিখতে শেখা আর বুঝতে শেখার ব্যাপারটা বহু ক্ষেত্রে ঠিক ভাবে পালন করা হয় না। প্রথাগত শিক্ষার দক্ষতা অনুশীলন করার জন্যে যে পরিকাঠামো দরকার টা তাদের কাছে নেই। বাড়িতে সাহায্য করার কেউ নেই। মন দিয়ে পড়ার জন্যে রোজ যে অভ্যাস থাকার দরকার টা নেই। কারণ বাড়িতে অন্য যারা আছে তাদের কেউ হয়ত আগে পড়েনি, আবার হয়ত পড়েছে কিন্তু সেই পড়াশোনা দিয়ে কোন সুবিধা জীবনে হয়নি। তাই গুরুত্ব দেয়নি।ভালো শিক্ষকদের দায়িত্বে সেটা থাকে। বাচ্চাদের তৈরি করার চেষ্টা বহু ক্ষেত্রে আন্তরিক হয় না। তারা সব সময় ইচ্ছে থাকলেও পেরে ওঠেন না কারণ একটি ক্লাসে হয়ত ৫০ জন বাচ্চা। আবার সম্পূর্ণ শহুরে শিক্ষক গিয়ে পড়লেন একেবারে সভ্যতাবিবর্জিত স্থানে, আর গ্রাম্য আদব কায়দায় মানুষ হয়ে ওঠা একজন শিক্ষক অতি নাগরিক পরিবেশে শিক্ষা দিতে নিয়োজিত হলেন। উভয় ক্ষেত্রে নানান সমস্যা তারা সামলে পাঠ দান করেন। সব সময় পড়ানোর জন্যে ভয়ানক কষ্ট করতে হয়। অনেক সময় এই পরিশ্রম টা তাঁরা করতে চান না। কিছু ব্যাপার আরও কষ্ট দায়ক যেমন ধরুন ভূগোল পড়ানোর ম্যাপ… অতি আব্যশকিয় একটি বস্তু… কিন্তু সেটি উই আক্রান্ত কিংবা ছেঁড়া… চাইলে নতুন পাওয়া যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি তে একটি বাচ্চাকে দেশের সীমানা কিংবা জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয় ‘প্রাঞ্জল’ করে বোঝানো মুস্কিল।খুব জটিল,খুব গভীর, আর বড্ড অভিনব সেই সমস্যা গুলি।

সামাজিক ত্রুটি- সমাজ এখন সিরিয়ালে ‘গুষ্টিসুখ’ প্রচার করলেও আদতে প্রবল ভাবে individualy যাপন করে। প্রত্যেক শিশু গড়ে ওঠার সময় প্রত্যেকের সমস্যা ভিন্ন। যদি এই সাধারণী করন করা যায় যে বাবা, মা লেখা পড়া জানে, খাওয়া পরার অসুবিধা নাই তাহলে সেই শিশুর লেখাপড়ার সমস্যা গুলি হল ,সে মনে রাখতে পারছে কিনা, তার হাতের লেখা ভালো হচ্ছে কিনা, সে ভালো নম্বর পাচ্ছে কিনা ইত্যাদি। কিন্তু যদি বাবা মা লেখা পড়া না জানে তাহলে তাকে পাহাড় প্রমাণ সমস্যার সামনে দাঁড়াতে হয়। তার পরিবার জানে না সে কি শিখবে। সে যা শিখছে সেটাই বা কি ভাবে জীবনের কাজে লাগবে। এছাড়া পড়াশোনা করার যে পরিবেশ সেটাও সে ভালো ভাবে পায় না। এই খানে সমাজের বোধহয় একটু এগিয়ে আসতে হবে। যারা কিঞ্চিৎ লেখা পড়া শিখেছেন সেটা একটু ধৈর্য সহকারে যদি শিখিয়ে দিতে পারেন প্রাথমিক স্তরের বেড়া টা পার করলেই সেই বাচ্চারা শিখে নেয় কি ভাবে এগিয়ে যেতে হয়। সমাজের আর্থিক ও শিক্ষায় ক্ষমতা বান মানুষেরা এই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে ভয়ানক কৃপণ। কিছু এনজিও এই কাজ টি করছেন কিন্তু খুব অল্প সেই কাজ। একটা কথা মাথায় রাখা দরকার ,প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিশুরা শোষণ ও সহিংসতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

দেশের ত্রুটি- দেশের কল্যাণের সাথে এখন কতগুলো রাজনৈতিক দলের ফায়দা তলার ইচ্ছে জড়িয়ে থাকে। ‘দেশ’ তাই ‘দেশে’র ভালো চায় না।রাজনৈতিক দল গুলি কিছুতেই সমগ্র দেশের মানুষের কথা ভাবে না। খণ্ড কিছু অংশের উন্নতির ওপর তাদের কার্যকলাপ কেন্দ্র করে রাখে। সুনাগরিক তৈরি করার জন্যে খুব একটা চেষ্টা আমরা কোন রাজনৈতিক দলকেই দেখি না।সুনাগরিক তৈরি হলে তারা সত্যি কথা বলতে শুরু করবে, ‘ভিক্ষে’ দিয়ে ভুলিয়ে রাখলে শুনবে না, ন্যায্য অধিকার বুঝে নিতে চাইবে। পার্টির দাদাদের কাছে আসবে না।

অথচ সুনাগরিক তৈরি হওয়া খুব দরকার।
আসল শিক্ষা শেখাবে পরিবেশ সচেতনতা। যার ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই মানুষ বুঝবে কে জল নষ্ট করা উচিৎ নয়। কি কারণে জল বাতাস খাদ্য দূষিত হয়। কিভাবে তার থেকে বার হয়ে আসা যায়। অকারণে জোরে মাইকিং করা উচিৎ নয়। জনগণের সম্পত্তিতে আগুন লাগানো উচিৎ নয়। ওটা যে আমরা নিজেদের নিজে ক্ষতি করি সেটা বুঝতে সাহায্য করে সঠিক শিক্ষা। সেই জন্যে বারবার সত্যজিৎ রায় কে আজকাল আমাদের কোট্‌ করতে হয়, ‘যে যত জানে, সে তত কম মানে’।

সব আমরা জানি… কিন্তু নিজেরা এগিয়ে আসব কি?
আমরা আপাতত যেটা করতে পারিঃ
  • যে সব বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্যে মানসিক, বৌদ্ধিক,কিংবা আর্থিক সাহায্য লাগবে তাদের জন্যে এগিয়ে আসা।
  • শিশুদের জন্যে উপযুক্ত যুক্তি বোধক অনুষ্ঠান,খেলা প্রভৃতির অরগানাইজট করা। যাতে একাধারে শৃঙ্খলা আর মনের বিকাশ দুই হয়। আপনি বলতেই পারেন যে, ‘জ্ঞান দেবেন না দিদিভাই এগুলো আমাদের ছেলে মেয়েরা যথেষ্ট এঞ্জয় করে।’কিন্তু আমি আরও অনেকে বঞ্চিত হয়ে আছেন তাদের জন্যে বলছি।
  • বিজ্ঞান কেবল পড়া আর উপার্জনের জন্যে না পড়ে জীবন বোধের সাথে যোগ করা দরকার। বহু মানুষ বিজ্ঞান পড়ে তাবিজ মাদুলিতে বিশ্বাস করে। প্রবল ভাবে মিথ্যাচারী মানুষ শিব পুজাতে বিশ্বাস করে। অন্যের কষ্ট বুঝবার ক্ষমতা তৈরি হওয়া এবার ব্যকরণ শেখার মতোই গুরুত্ব পাক।
  • কে কত নম্বর পেল তাই নিয়ে , শিক্ষার মাত্রা মাপার যে পদ্ধতি আছে ,সেটা কে এবার জলাঞ্জলি দেবার সময় এসেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ