শাসকের ক্ষমতার লেজে পা দেওয়া যাবে না। আমেরিকা নিজেদের বিশ্বের শাসক বলে মনে করে। ইউক্রেন সহ পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সকল দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গেড়ে বসে পড়তে হবে। একটি দেশকেও বাদ দেওয়া যাবে না। এটাই আমেরিকার নীতি ও লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই ইউক্রেনে ২০১৪ সালে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করতে নবনাৎসীদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে দেশজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়। এবং সরকার উৎখাত করে সেখানে মার্কিনরা একটি পুতুল সরকার বসিয়ে দেয়। আজকে রাশিয়া, ইউক্রেনের মাটিতে নেটোর আগ্রাসন ঠেকাতে ও নবনাৎসীদের হাত থেকে ইউক্রেনকে রক্ষা করতে সামরিক অভিযান করায় মার্কিনশক্তির ক্ষমতার লেজে পা দিয়ে ফেলেছে। ফলে বিশ্বজুড়ে রাশিয়ার ধোপা নাপিত বন্ধ। ক্ষমতা বিস্তারের নেশা কোন সীমা মানতে চায় না। মার্কিনশক্তিও তাই মনে করে বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই তাদের নির্দেশ মেনে চলতে হবে। তার বাইরে যেতে গেলেই মার্কিনশক্তি ছোবল মারবে।
বিগত আট বছরে দিল্লীর ক্ষমতা দখল করে পদ্মশিবিরও ঠিক সেই রকম ভাবেই দেশজুড়ে ক্ষমতা বিস্তারে মাঠে নেমে পড়েছিল। নির্বাচিত দলের বিধায়ক ভাঙিয়ে নিয়ে বিধানসভা দখল। সিবিআই ইডি সেবি ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর, ইত্যাদি নামিয়ে দিয়ে বিপক্ষ রাজনৈতিক শিবিরের নেতা নেত্রী ভাঙিয়ে পদ্ম শিবিরে বন্দী করা। বিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করতে ক্ষমতার ব্যবহার এবং মিথ্যা অপপ্রচারে ফেক নিউজকে অস্ত্র করে তোলা। এবং যে বা যারাই সেই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে শুরু করবে। তাদের স্তব্ধ করে দেওয়ার নানবিধ মেকানিজম সবসময়ের জন্য সক্রিয় রাখা। এবং বিগত আট বছরে যারাই সেই ক্ষমতার লেজে পা দিয়ে ফেলেছে। হয় তাদের ঠিকানা হয়েছে কারাগার। না হলে কফিন কিংবা শশ্মান।
ক্ষমতার নেশাই এমন। সর্বব্যাপী ক্ষমতা বিস্তারের নেশায় বিরোধী শূন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে শাসক সবসময়েই সক্রিয় থাকে। এটাই নিয়ম।
ঠিক এই নেশা থেকেই, পশ্চিমবঙ্গে বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে তিরিশ শতাংশ আসনে বিরোধীদের মনোনয়ন পত্র জমা দিতেই দেওয়া হয়নি। বাকি আসনে ভোট সন্ত্রাস চালিয়ে নির্বাচন জয়লাভ নিশ্চিত করা হয়েছিল। যদিও ভোট সন্ত্রাস না করলেও শাসকদলই হেসেখেলে জিতে যেত। কিন্তু বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত হতো না। ক্ষমতার নেশা এমনই। সে বিরোধী পরিসর মেনে নিতে রাজী নয়। এই নেশা থেকেই ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ’ স্লোগান তোলা হয় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে। রাজ্যের বামপন্থীদের একটা বড়ো অংশ শাসকদলের স্বপ্নে ছাই দিতে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতোন, বিগত লোকসভায় পদ্মশিবিরের ভোট শতাংশ বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার ফল ফলেছিল হাতেনাতে। শাসকদলের স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়েছিল। রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছিল পদ্মশিবিরের উত্থান। যার ভিত্তিতে পদ্মশিবির বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে একুশের বিধানসভা নির্বাচনে।
যদিও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বাংলায় প্রতিরোধ করতে রাজ্যবাসী সঠিক সময়ে সঠিক পক্ষ বেছে নেয় একুশের নির্বাচনে। না হলে ভোট ভাগ হয়ে গেলে সাড়ে আটত্রিশ শতাংশ ভোট পাওয়া পদ্মশিবিরেরই রাজ্যের ক্ষমতা দখল করার কথা। অনেকেরই মতে একুশের নির্বাচনে মানুষের সামনে একটিই অপশান ছিল। গ্রেটার ইভিল আর লেসার ইভিলের ভিতরে একটি পক্ষ বেছে নেওয়া। রাজ্যবাসী তাদের অপশান বেছে নিতে দেরি করেনি। ফলে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলবদলের যে হিড়িকে পদ্মশিবিরে জয়োল্লাসের হাসি ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছিল। নির্বাচনের পরে দলবদলের আরো এক হিড়িকে পদ্মশিবিরের হাসি চুপসে যেতে দেরিও হয়নি। আর ঠিক সেই সুযোগে শাসকদল ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনের নিজেদের হারানো জমি ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে বিরোধীশূন্য পুরসভা ও কর্পোরেশন গঠনে ঝাঁপিয়ে পরে। যার ফলাফল এখন রাজ্যবাসীর হাতে। বিরোধীশূন্য পুরসভা নিশ্চিত করতে সদ্যসমাপ্ত পুরসভা নির্বাচনে রাজ্যবাসী কিভাবে ভোট দিতে বাধ্য হয়েছে। সেটি প্রতিটি রাজ্যবাসীই জানেন। শাসকদলের ক্ষমতা দখলের সীমাহীন নেশা কতদূর অব্দি এগোতে পারে। ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচন আর ২০২২ এর পুরসভা ও কর্পোরেশন নির্বাচন তার বড়ো প্রমাণ।
এখন আপনি যদি শাসকদলের ক্ষমতার লেজে একবার পা দিয়ে ফেলেন। ইচ্ছায় হোক। অনিচ্ছায় হোক। জেনে হোক না জেনে হোক। তাহলে আপনাকে তার ফল ভুগতে হবে। যে যেখানে শাসক। তার সেখানে ক্ষমতা। সে সেই ক্ষমতার আস্ফালনে সবসময়েই চাইবে বিরোধীশূন্য পরিসর। ইউক্রেন সঙ্কটে রাষ্ট্রপুঞ্জে মার্কিনশক্তি ঠিক সেই চেষ্টাই করছে। ন্যাটোর হাত দিয়ে গোটা ইউরোপকে মার্কিন স্বার্থে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। না, শুধু গোটা ইউরোপ নয়। গোটা বিশ্বকেই। এবং যে যে দেশ কয়টি এখনও মার্কিন স্বার্থের বাইরে দাঁড়িয়ে একটা নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে চাইছে। মার্কিনশক্তি তাদের উপরেও স্যাংশানের হুমকি দিয়ে রাখছে। হয় মার্কিনশক্তির পক্ষে দাঁড়িয়ে ওয়াশিংটনের নির্দেশে প্যারেড করতে থাকো। না হলে মার্কিন স্যাংশানের শিকার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও। এটাই মার্কিন দাওয়াই। এটাই ক্ষমতার দাওয়াই।
দিল্লী থেকেও ঠিক এই রকম দাওয়াই দিয়ে রাখা হয়েছে। হয় শাসকদলের স্বার্থে খবর প্রচার করো। না হলেই তোমার লাইসেন্স বাতিল। এমনকি ইউএপিয়ে ধারায় দেশদ্রোহের মামলায় ফেঁসে যেতেও হতে পারে। ফলে দেশজুড়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের গ্রাউণ্ড ওয়ার্ক চলছে পুরোদমে। প্রথমে স্লোগান দেওয়া হয়েছিল কংগ্রেস শূন্য ভারত। এখন কাজ চলছে বিরোধী শূন্য ভারতের। আর ঠিক তার ভিতরেই উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফলাফলের উপরে নির্ভর করছে শাসকদলের ক্ষমতার লেজ কতটো ফুলবে। যতটা ফুলবে ততটাই বিরোধীশূন্য পরিসর তৈরীর কাজ বৃদ্ধি পেতে থাকবে।
রাজ্যে পুরভোটের দিন বুথে বুথে যে চিত্র দেখা গেল। তাতে আপাতত এটা পরিস্কার। রাজ্যে বিরোধীশূন্য পরিসর তৈরীর কাজ পুরোদমেই চলতে থাকবে এখন। শাসকদলের ক্ষমতার লেজ প্রায় ফুলে ফেঁপে ঢোল। সেই লেজে পা দেওয়ার সাহস যে করবে। তাকে তো অবশ্যই তার ফল ভুগতে হবে। সেই ফল ভোগার পরিণামে আনিশ খানের মতো পরিণতি হবে কিনা সেটা পরের বিষয়। আগের বিষয়টি পরিস্কার বুঝে গিয়েছে রাজ্যবাসী। এবারের পুরভোট সেটি প্রতিটি রাজ্যবাসীকেই বুঝিয়ে দিয়েছে। ভোটকক্ষে ঘাড়ের কাছে শাসকদলের এজেন্ট নিয়ে ভোটদানের সংস্কৃতি একটা বিষয়ই নিশ্চিত করে। মুখে আঙুল। মুখে আঙুল। হাতের আঙুলের স্বাধীনতা শাসকদলের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। না রাখলে পরিণতি আনিশ খান না অন্য কিছু। সেটি নিশ্চিত নয়। কিন্তু সেটিই সাম্ভাব্য।
না, কোনভাবেই শাসকদলের ক্ষমতার লেজে পা দেওয়া যাবে না। প্রথমে পুতিনের ধোপা নাপিত বন্ধের মতো একঘোরে হতে হবে। তারপরে বাড়িতে মিসাইল হামলার মতো ঢিল পড়তে শুরু করবে। নয়তো রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে কারান্তরালে। আর শাসকদলের ক্ষমতার লেজে পা না দিলে কি হবে পরিণতি? না, বিরোধীশূন্য গণতন্ত্র। গণতন্ত্র থাকতে হবে। তবে বিরোধীশূন্য। সেই গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দপ্তর থেকে। প্রসারিত হয়েছে দিল্লীতে। প্রসারিত হয়েছে নবান্নে। প্রসারিত রয়েছে বুথে বুথে। এবং প্রসারিত হয়ে গিয়েছে সাধারণ মানুষের অবচেতনেও। তাই বিশ্বজুড়ে রাশিয়ান সংবাদ মাধ্যম নিষিদ্ধ করা মানুষের অবচেতনে কোন রেখাপাত করছে না। ভারত জুড়ে শাসকদলের কল্কে বহনকারী সংবাদ মাধ্যমের বাইরে কোন স্বর না থাকাই ভারতবাসীর অবচেতনে দেশপ্রেমের সঙ্গা হয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। রাজ্যজুড়ে শাসকদলের নীল শাদায় রাজ্যবাসীর অবচেতন ঢাকা না পড়লে জীবনের ঝুঁকি সবসময়ে। ফলে দেওয়াল লিখন সুস্পষ্ট। হয় আমাদের সাথে থাকো। না হলে তোমার ধোপা নাপিত বন্ধ। না হলে লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি। না হলে তুমিই আমাদের পরবর্তী টার্গেট। সাদ্দাম। গদ্দাফি। আসাদ। পুতিন। শী। গৌরী লঙ্কেশ। ভারভারা রাও। স্ট্যান স্বামী। শার্জিল ইমাম। কাফিল খান। কাপ্পান সিদ্দিকি। অম্বিকেশ মহাপাত্র। শিলাদিত্য। আনিশ খান……….. অনন্ত লিস্ট। সেই লিস্টে পরবর্তী টার্গেট কে। কেউ জানে না। কিন্তু সকলেই এটা জেনে গিয়েছে। শাসকের ক্ষমতার লেজে পা দেওয়ার পরিণাম কি হতে পারে। সকলেই জেনে গিয়েছে, পরবর্তী টার্গেট খুঁজে নিতে শাসকের ক্ষমতা অতন্দ্র প্রহরায় সজাগ। সক্রিয়। এবং সতর্ক!
৫ই ফেব্রুয়ারী’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন