সুশান্ত কুমার রায়

নিদান কালের বান্ধব: ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মা সংবর্ধনগ্রন্থ
লোকসংগীতের অমীয় সাগরে প্রাণবন্ত একটি ধারা ভাওয়াইয়া। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর-দিনাজপুর, ভারতের কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও পশ্চিম দিনাজপুর এবং আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত গান ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া আমাদের উত্তরাঞ্চলের গান, খেটে খাওয়া মানুষের প্রাণের গান- হৃদয়ের গান। আর এই ভাওয়াইয়া গানের একনিষ্ঠ একজন সাধক কন্ঠশিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মা। সম্প্রতি এই ভাওয়াইয়া শিল্পীকে নিয়ে “নিদান কালের বান্ধব ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মা সংবর্ধনগ্রন্থ” লোকসংস্কৃতি গবেষক ড. এরশাদুল হকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে। শিল্পীর ৬২তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে এটি ভাওয়াইয়া বিষয়ে একটি মূল্যবান প্রকাশনা। সংবর্ধনগ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন উত্তরাঞ্চলের কৃতিসন্তান ও নন্দিত চিত্রশিল্পী আইয়ুব আল আমিন। ভাওয়াইয়া গানকে প্রথম সাংগীতিক মর্যাদায় অভিসিক্ত করে একে আঞ্চলিকতার গন্ডীর বাইরে এদেশের সর্বাঞ্চলে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ও ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন বাংলা সংগীত ভূবনের অনন্য পুরুষ ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমদ। সম্প্রতি এই মহান শিল্পীর স্মরণে কুড়িগ্রাম জেলা শহরে বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমী, উলিপুর, কুড়িগ্রাম কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক ভাওয়াইয়া উৎসবে বিশিষ্টব্যক্তি, গুণীজন, লেখক, সাংবাদিক ও সুধিজনের উপস্থিতিতে নিদান কালের বান্ধব ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বমা সংবর্ধনগ্রন্থটির মোড়ক উম্মোচন করা হয়। উপদেশক ও সম্পাদনা সহযোগী হিসেবেই শুধু নয় প্রকাশনার কাজকে বেগবান, সুসংহত এবং সুন্দর-সহজ সরলীকরণে নির্দেশক হিসেবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কবি-প্রাবন্ধিক ও গবেষক এবং বাংলা একাডেমির গবেষণা উপবিভাগের উপ-পরিচালক ড. তপন বাগচী। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের গীতিকবি নীলকমল মিশ্র, শিশুসাহিত্যিক তৌহিদ-উল ইসলাম এবং আমি নিজে সামান্য শ্রম দিয়ে সম্পাদনার কাজে কিছু লেখার প্রুপ দেখে সহযোগিতা করেছি মাত্র। তবে শিশুসাহিত্যিক তৌহিদ-উল ইসলামকে সাথে নিয়ে মূল কাজটি করেছেন সম্পাদক নিজেই। নিদান কালের বান্ধব ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মা সংবর্ধনগ্রন্থটি মূলতঃ শিল্পীর জীবন ও কর্মের উপর গুরুত্বপূর্ণ ডক্যুমেন্টরী, যেখানে দুই বাংলার বিভিন্ন লেখক, কবি, গবেষক, শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগঠক, সাংবাদিক ও স্বজনের লেখা স্থান পেয়েছে। মূলতঃ শিল্পীকে কাছে থেকে দেখার যাঁদের সুযোগ হয়েছে, তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছেন-সুরেলা কন্ঠে গান শুনেছেন ও শুনে আসছেন তাঁদের লেখাগুলো নিয়ে ঋব্ধ হয়েছে সংবর্ধনগ্রন্থটি। শিল্পীর জীবন ও কর্মের পাশাপাশি লোকসংগীত ভাওয়াইয়ার নানা উপাদান অনুষঙ্গ, অতীত, বর্তমান ও বিকাশের কথা সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় উঠে এসেছে সত্য ও সুন্দরের আলোকে। দেশের উত্তর জনপদের জনপ্রিয় লোকসংগীত ভাওয়াইয়ার নন্দিত এ শিল্পীকে নিয়ে গ্রন্থটির ভূমিকায় ড. তপন বাগচী লিখেছেন- “বাংলাদেশে ভাওয়াইয়া গানের চর্চা তো আজকের নয়। ভূপতি ভূষণ বর্মার চেয়ে বড় শিল্পীও সেখানে আছেন, তাঁর পরবর্তীকালেও অনেক বড় শিল্পী আসবেন। ভূপতির কোনো শিষ্যই হয়তো একদিন তাঁর গুরুকে ছাড়িয়ে যাবেন। তাতে ভূপতি ভূষণের একটুও টলে না। তিনি যে কাজ করে গেছেন এবং করে চলেছেন, শত নিন্দুকের শত আস্ফালনেও তা ম্লান হবার নয়, বরং নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়েই আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে এই লিখিত উদ্যোগ গ্রহন করেছি। আমরা জানি ভূপতি ভূষণের অবদান নিয়ে এক সময় ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক গবেষণা হবে। সে কাজ করবে ভাবীকালের দীপ্তিমান কোনো চিন্তক-গবেষক। আমরা তাঁর সমকালে ভক্ত ও অনুজেরা মিলে যে কাজটি করেছি, তাতে কোনো পান্ডিত্য নেই, কিন্তু আন্তরিকতা আছে। হয়তো অজস্র বিখ্যাত মানুষের লেখা নেই, কিন্তু শ্রদ্ধাগভীর মূল্যায়ন আছে। হয়তো গবেষকের বিশ্লেষণ নেই, কিন্তু শিল্পীর হৃদয়জাত শুভেচ্ছা আছে”। ভাওয়াইয়া শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মার জীবন ও কর্ম নিয়ে একজন গবেষকের এ ধরনের হৃদয়জাত ও গবেষণাধর্মী মন্তব্য ও মূল্যায়ন পাঠক ও ভাওয়াইয়া গবেষককে নতুন করে চিন্তার পরিমন্ডলে নিয়ে যাবে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। 

ড. মাখন চন্দ্র রায় মহিমান্বিত লোকপুরুষ ভূপতি ভূষণ বর্মা এবং ড. মো. এরশাদুল হক ভাওয়াইয়া সংগীতের ভাস্কর: ভূপতি ভূষণ বর্মা শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছেন সংবর্ধনগ্রন্থটিতে। শিল্পীর গানের হাতেখড়ি যাঁর হাতে, সেই শিক্ষাগুরু লোকসংগীত শিল্পী সুভাষ চন্দ্র রায় একটি স্মৃতিচারণাধর্মী লেখা লিখেছেন। “এক সাধক: এক লড়াই” শিরোনামে শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন ওপার বাংলার কবি ও প্রাবন্ধিক গৌতম সরকার এবং “জয়তু ভূপতি ভূষণ বর্মা” শিরোনামে গবেষণাধর্মী ও স্মৃতিচারণামূলক লেখা লিখেছেন ড. তপন বাগচী। লোকসংগীত শিল্পী ও গবেষক অণিমা মুক্তি গমেজ মূলধারার ভাওয়াইয়া শিল্পী হিসেবে শিল্পীকে মূল্যায়ন করে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজবংশী ভাষার চলচ্চিত্র পরিচালক তপন রায় শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন স্মৃতিচারণামূলক লেখা । ভারতের সিকিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও সংগীত শিল্পী জয়ন্ত কুমার বর্মন শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন। ভারত থেকে আরো লিখেছেন- চলচ্চিত্র পরিচালক রোপ আক্তার আহমেদ,সংগীতশিল্পী গোবিন্দ ধর, লোকসংগীত শিল্পী মঙ্গলানাথ, কবি-শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা মনসূয়ার সম্পাদক অজিত কুমার বর্মা, কবি ও প্রাবন্ধিক সঞ্জয় সাহা ও সুবীর সরকার। বরেণ্য ও জনপ্রিয় এই শিল্পীর শৈশব- কৈশোর থেকে শুরু করে স্মৃতি বিজড়িত নানা ঘটনার উপর একান্ত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে সংবর্ধনগ্রন্থটিতে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুরুল ইসলাম। শিল্পীকে নিয়ে আরো লিখেছেন সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা ছোট নদীর সম্পাদক আবু হেনা মুস্তফা, গীতিকার ও শিশুসাহিত্যিক তৌহিদ-উল ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন, ভাওয়াইয়া শিল্পী তনু রায়, নজরুল সংগীত শিল্পী সুব্রত কুমার ভট্টাচার্য, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ইয়াসমিন জাফরী, সাহিত্যিক ও নাট্যকার সরদার মোহম্মদ রাজ্জাক, কমিউনিটি রেডিও সারাবেলার প্রযোজক কৃষ্ণ কমল, বিশিষ্ট গীতিকার ও দোতরাবাদক সত্যেন্দ্রনাথ রায়, কবি ও গল্পকার তমসুর হোসেন, গীতিকার ও সাংবাদিক আব্দুল খালেক ফারুক, গীতিকার ও শিল্পী পঞ্চানন রায়, কবি জামাল অন্তর, সাংবাদিক জরীফ উদ্দিন, সাংবাদিক সরকার মো. শহিদুজ্জামান, গীতিকার আব্দুল হামিদ, এনামুল কবির, মো. এমদাদুল হক প্রামানিক, অতুল চন্দ্র রায় ও মল্লিকা রঞ্জন রায়। জনপ্রিয় শিল্পী ভূপতি ভূষণ বর্মাকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন গীতিকবি নীলকমল মিশ্র। আরও কবিতা লিখেছেন গীতিকবি বিষাদ চন্দ্র বর্মন, ছোলায়মান মন্ডল, আ.ক.ম. এরশাদুন নবী আনছারী, মাহমুদা বেগম, অজিত কুমার বর্মা ও শ্যামাপদ ঘোষ। শিল্পীকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশে ও দেশের বাইরের পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদের ছায়ালিপি সংবধনগ্রন্থটিকে তথ্যবহুল করেছে। নিদান কালের বান্ধব ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মা সংবর্ধনগ্রন্থটির একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে দেশে ও দেশের বাইরে শিল্পীর পাওয়া আমন্ত্রণপত্র, শুভেচ্ছা স্মারক, সম্মাননাপত্র ও পুরস্কার নেয়ার স্মরণীয় ও স্মৃতিময় মুহুর্তের উল্লেখযোগ্য কিছু ছবি। সংবর্ধনগ্রন্থটির শেষ অংশের পূর্বোক্ত অংশে শিল্পীর জীবন ও কর্মকান্ড সম্পর্কে বিশিষ্ট ও গুণীজনের মন্তব্য ও মূল্যায়নের ছায়ালিপি এবং শেষ অংশে স্বরলিপি সহযোগে যুক্ত করা হয়েছে জনপ্রিয় ও বরেণ্য এই ভাওয়াইয়া শিল্পীর কন্ঠে গীত কয়েকটি কালজয়ী ভাওয়াইয়া গান। নিদান কালের বান্ধব ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মা সংবর্ধনগ্রন্থটি ভাওয়াইয়া শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগঠক, লেখক, গবেষক, পাঠক ও অনুরাগীদের প্রেরণা যোগাতে সক্ষম হবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস। দেশে ও দেশের বাইরে যাঁরা লোকসংগীত ভাওয়াইয়া নিয়ে কাজ করছেন,গবেষণা করছেন, যাঁরা ভাওয়াইয়া গানকে ভালোবাসেন তাঁদের কাছে সংবর্ধনগ্রন্থটি সঠিকভাবে মূল্যায়িত হলে আমাদের শ্রম সার্থক হবে বলে মনে করি।

সম্পাদনা সহযোগি-“ নিদান কালের বান্ধব: ভাওয়াইয়া ভাস্কর ভূপতি ভূষণ বর্মা সংবর্ধনগ্রন্থ“

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .