শনির বচন | প্যাকেজের ফাঁদে

শনির বচন

প্রায় গোটা দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ যখন বন্যায় বিপর্যস্ত সেই সময়ে মহালয়া থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন কলকাতার বিভিন্ন পুজোমণ্ডপের উদ্বোধনে। এও এক বড়ো পরিবর্তন। পরিবর্তন দুই দিক দিয়ে। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পুজো উদ্বোধন করে বেড়াচ্ছেন। এবং হিন্দু শাস্ত্রমতে ষষ্ঠী’র উদ্বোধনের অনেক আগেই মহালয়া থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হাতে বিভিন্ন মণ্ডপের উদ্বোধন শুরু হয়ে যাচ্ছে। পরের দিন থেকেই মণ্ডপে মণ্ডপে দর্শনার্থীদের ভিড়। তিন দিনের পুজো অনেক দিন আগে থেকেই ষষ্ঠী থেকে দ্বাদশী পার করে দিয়েছিল। পরিবর্তনের ধাক্কায় ষষ্ঠী থেকে মহালয়ায় এগিয়ে এসেছে। দুগ্গা ঠাকুরের পুজো এখন বারো থেকে চোদ্দ দিনের প্যাকেজ। হ্যাঁ এই প্যাকেজের দরকার আছে বই কি। মানুষ ফুর্তি করবে না? বিশেষ করে ক্লাবে ক্লাবে সরকারী কোষাগার থেকে পঞ্চাশ হাজার করে ফুর্তিভাতা ঢালার পর। মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ উদ্যোগের সাফল্যে। এখন ধুমধাম করে লম্বা প্যাকেজে পুজো না হলে কাঁচা টাকা মানুষের হাতে হাতে ঘুরবেই বা কি করে? ফলে এই লম্বা প্যাকেজের সাথে রাজ্যের সাধারণ মানুষের অর্থনীতির প্রশ্নও কিন্তু জড়িয়ে। একটা পুজো মণ্ডপে খাবারের স্টল দিয়েও যদি তিন দিনের বদলে দশদিনও ব্যাবসা করা যায় তবে কত ঘরে মুখে অন্ন ওঠে, সেই হিসেবটাও তো রাখতে হবে। ফলে পুজোর প্যাকেজ যত লম্বা হবে কাঁচা টাকা তত বেশি মানুষের হাতে ঘোরার সুযোজ পাবে। মানুষ অর্থনীতির সোজা হিসেবটায় খুশি থাকে খুব। হাতে নগদ নারায়ণ এসে পৌঁছালেই মানুষ খুশি। দুর্গাপুজোর লম্বা প্যাকেজ আর ক্লাবে ক্লাবে ফুর্তিভাতা সেই বিষয়টিকে সত্য করে তুলতে পেরেছে। জনমানসে সরকারী দলের জনপ্রিয়তার ভিত্তি কিন্তু এই নগদ নারায়ণের দৌলতেই। তোলাবাজি কাটমানি ভাতামানি থেকে শুরু করে পুজো আর উৎসব জুড়ে একটা বড়ো অংশের মানুষের হাতে কাঁচা টাকা ঘুরে চলেছে। বেশ দ্রুত হারে। ফলে চাকরি না থাক। ব্যাবসা বাণিজ্য একচেটিয়া কারবারীদের হাতে বাজেয়াপ্ত হয়ে যাক। কাঁচা টাকার এই চলাচল যতদিন সচল থাকবে। শাসকদলের জনপ্রিয়তা ততদিন ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাবে সন্দেহ নাই।

এই আলোচনা শাসকদলকে নিয়ে নয়। এই আলোচনা হিন্দু শাস্ত্রমতে দুর্গাপুজার নির্ঘন্ট নিয়েও নয়। এই আলোচনা আমাদের নিজেদেরকে নিয়েই। গ্রামের পর গ্রামে বন্যার জলে মানুষের দিশাহারা দশা। কয়দিন আগেই শহর কলকাতারও বিভিন্ন অংশ ঘন্টার পর ঘন্টা দিনের পর দিন জলমগ্ন ছিল। সেই জল নেমে যেতেই আমরা সব ভুলে ফুর্তিতে মেতে উঠেছি বেশ। আর আমাদের চোখ বানভাসি মানুষের দিকে নেই। টিভি চ্যানেলগুলি কোন মণ্ডপে মানুষের ঢল কত বেশি তাই মাপতে ব্যাস্ত। তারা আর বন্যার জল মাপছে না। আমাদেরও কোন মাথা ব্যাথা নাই বন্যার জল নিয়ে। আমাদের মাথা ব্যাথা মণ্ডপে মণ্ডপে জনজোয়ার নিয়ে। বন্যা দুর্গতের কি দশা হলো। তারা পর্যাপ্ত ত্রাণ সমগ্রী পেল কিংবা পাচ্ছে কিনা। সেই খবরে কার কি দরকার। রাজ্যের মন্ত্রীরা যে যার বারোয়ারি পুজো নিয়ে ব্যস্ত। কার পুজো কাকে টেক্কা দিয়ে যাবে। সব তোড়জোড় তাই নিয়েই। কোথায় কতটা বন্যার জল নামলো। কোথায় কতটা পরিমানে বাঁধ মেরামতির দরকার। কোথায় কাদের বাড়িঘর কি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই কি করে মেরামত করা কিংবা গড়ে দেওয়া যায় নতুন করে। কোথায় কোথায় চাষের ফসল কতটা পরিমাণে নষ্ট হলো। কৃষকের আর্থিক ক্ষতি পুরণে কি কি ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। নতুন করে কত দ্রুত কৃষিজমি গুলি পুণরায় চাষের কাজে তৈরী করে তোলা যায়। প্রভৃতি বিষয়গুলি নিয়ে আমাদের কোন ভাবনা নেই। কোনকালেই থাকে না। এই সব বিষয়গুলি নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার জন্যেই তো আমরা সরকার গড়ে দিই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে। তারপর আমাদের আর ভাবনা কি। তাই অতিবৃষ্টি ও বন্যায় রাজ্যের ভুক্তভুগী মানুষদের দুর্গতি নিয়ে আমরা শহুরে জীবেরা আদৌ চিন্তিত নই। আমরা ততটুকুই চিন্তায় ছিলাম। যতটুকু জল আমাদের চলাচলের চৌহদ্দীতে দাঁড়িয়ে ছিল দিন কয়েক। সেই জলও নেমে গিয়েছে। আমাদেরও ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গিয়েছে। এখন আমরা সকলে পুজোর প্যাকেজেই মশগুল। ফলে সরকারও নিশ্চিতে রয়েছে। মন্ত্রী বিধায়করাও তাই কাঁচি হাতে ঘুরে বেড়ালেন দিন কয়েক। কে কতগুলি পুজোমণ্ডপে কাঁচি চালিয়ে ফিতে কেটে পুজোর উদ্বোধন ঘটালেন। সেটাই আসল কথা।

কিন্তু এই যে পুজোর প্যাকেজ। সাথে তোলাবাজি কাটমানি আর রাজ্যজুড়ে ভাতামানির নানারকমের প্যাকেজ। এই প্যাকেজ কিন্তু একদিন ফুরিয়ে আসবে। সেদিন কিন্তু ঘরে ঘরে অন্ন বস্ত্রে টান পড়তে শুরু করে দেবে। বিশেষ করে আজও যে কয়জনের সরকারী চাকরী রয়েছে। তারা অবসর নিলে। আজও যে কয়জন, একচেটিয়া মুনাফাবাজির ভিতরেও স্বাধীন ব্যাবসা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তারাও একচেটিয়া মুনাফাবাজির করাল গ্রাসে ঢুকে গেলে। তখন কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠবে। বেকার ছেলে মেয়েদের জন্য নতুন কর্মসংস্থান নেই। কয়কটি শপিংমল আর অনলাইন প্রো‌ডাক্টের ডেলিভারী বয় ছাড়া নতুন কর্মসংস্থান প্রায় শূন্য। সারা ভারত জুড়েই নতুন কোন ভারী শিল্পের পত্তন হওয়ার কোন খবর নেই। সম্ভাবনাও নেই। উল্টে বহু কল কারখানাতেই তালাচাবি পড়ে যাবে। রাজ্যের অবস্থা তো আরও এক কাঠি উপরে। গণ্ডায় গণ্ডায় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সন্তানসন্ততিদের ঠেলে দিলেও কর্মসংস্থানের কোন রকম নিশ্চয়তা থাকছে না আর। মানুষের জীবন জীবিকার উপরে তার প্রভাব দিনে দিনে মারাত্মক হয়ে উঠতে থাকবেই। অবস্থা যত মারাত্মক হতে থাকবে পুজোর প্যাকেজ ভাতার প্যাকেজ কিন্তু সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে না কোনভাবেই। ফলে দুর্নীতির প্যাকেজের উপরেই জোর পড়বে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তখন সবচেয়ে বড়ো সমস্যা দেখা দেবে একটা জায়গাতেই। কে কার কাছ থেকে তোলা আদায় করবে? কে কাকে কাটমানি দেবে। কোথা থেকেই বা দেবে। সেই ভাঁড়ার তো শেষ। ফলে শূন্য ভাঁড়ার নিয়ে কাটমানি তোলাবাজি’র অর্থ যোগাবে কারা?

অর্থাৎ আজকের কাঁচা টাকার যোগান কিন্তু যত বেশি মানুষের হাতে হাতেই ঘুরতে থাকুক না কেন। দিনে দিনে সেই টাকার পরিমাণ ক্ষয় হতেই থাকবে। কাঁচা টাকার চলাচলে নতুন সম্পদ গড়ে ওঠে না। নতুন সম্পদ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিমাণে ও সঠিক বিষয়ে লগ্নী। লগ্নীর পরিমাণ যেখানে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। উল্টে কমতে শুরু করে দিয়েছে। সেখানে নতুন করে কাঁচা টাকার জোগানই বা আসবে কোথা থেকে? তার সাথে যদি যুক্ত হয় পুঁজির নিস্ক্রমণ তাহলে তো আর কথাই নেই। রাজ্যের অর্থনীতি দ্রুতই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে বাধ্য। গত দশ বছরে তার বহু লক্ষ্মণ দেখা দিয়েছে প্রাথমিক ভাবে। বিশেষ করে কেন্দ্র সরকারে জলের দরে সরকারী সম্পত্তি বেচে দেওয়ার কার্ষক্রম রাজ্যের পক্ষে মড়ার উপরে খাঁড়ার ঘায়ের মতো হয়ে উঠবে। অন্তত সেই সম্ভাবনাই সমধিক। এমনিতেই রাজ্যের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা, কোনটাই বাঙালির হাতে নাই। ফলে বাঙালির অবস্থাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হতে বাধ্য। কাটমানি তোলাবাজি আর ভাতামানি দিয়ে সেই সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না ক‌োনভাবেই। না, এসব ভেবে আমাদের আজকের মৌতাত নষ্ট করার পক্ষপাতি নই আমরা। অবশ্যই। একটা ব্যবস্থা হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ে যায় না। ভেঙে ভেঙে পড়তেও কিছুটা সময় লাগে। যার প্রথম পর্বে ভাঙনের শুরুটা ঠিকমতো টের পাওয়া যায় না সহজে। আমাদের বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটা সেই রকমের। তাই বানভাসি মানুষদের দুর্গতির কথা ভুলে শহর নগর জুড়ে উৎসবে মেতে উঠতে আমাদের দুইবার ভাবতে হয় না। তিন দিনের দুর্গাপুজোকে টেনে টেনে বারো চোদ্দ দিনের প্যাকেজে মুড়ে দিলেও আমাদের অসুবিধে লাগে না। বরং উৎসাহ উদ্দীপনা আরও জমে ওঠে। শাসকদলের পিছনে পিছনে আমরাও লেগে থাকতে পারি। নো চিন্তা ডু ফুর্তিতে।

১৬ই অক্টোবর’ ২০২১

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ