
প্রশ্নটা তালিবানরা আফগানিস্তান কিভাবে শাসন করবে তা নিয়ে নয়। আফগানিস্তান একটি বিদেশী রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রে কখন কোন শাসক কি ধরণের শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করবে সেটা সেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন বিষয়। আমরা সেই শাসন প্রণালী সমর্থন করতে পারি। আবার সমর্থন নাও করতে পারি। কিন্তু আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীন বিষয় নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। আমাদের মাথা ঘামানো না ঘামানোর উপরে আফগানদের জীবন জীবিকা ভুত ভবিষ্যৎ কোনটিই নির্ভর করবে না। প্রশ্নটা বরং হওয়া উচিত, আমরা কি আমাদের দেশের বর্তমান শাসকের অধীনে সুখে শান্তিতে এবং সমৃদ্ধিতে রয়েছি? প্রশ্নটা হওয়া উচিত, আমাদের রাষ্ট্র কি আমাদের সংবিধানের আদর্শকে সঠিক মাত্রায় রক্ষা করছে? প্রশ্নটা হওয়া উচিত, যে সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কথা বলা রয়েছে আমাদের সংবিধানে, বর্তমান শাসকশ্রেণী কি সংবিধান নির্দেশিত এই শর্তগুলি যথাযথ ভাবে রক্ষা করে চলেছে? প্রশ্নটা হওয়া উচিত সংবিধান নির্দেশিত সমাজিক অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায় অর্থাৎ জাস্টিস কি ভারতবর্ষে অক্ষুণ রয়েছে? প্রশ্নটা হওয়া উচিত বর্তমান শাসকগোষ্ঠী কি সংবিধান প্রদত্ত ভারতীয় নাগরিকের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংস্কার পালনের স্বাধীনতা, বিশ্বাসের স্বাধীনতা এবং ভক্তি আরাধনার স্বাধীনতাকে স্বীকার করে? প্রশ্নটা হওয়া উচিত ভারতবর্ষে এই মুহুর্তে সংবিধান নির্দেশিত সকলের জন্য সমান অধিকার ও সমান সুযোগসুবিধে আদৌ কি সুরক্ষিত রয়েছে? হ্যাঁ এই প্রশ্নগুলির প্রতিটির যথাযথ উত্তর পাওয়া এই সময়ের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নগুলি সকলের আগে নিজেকেই করা উচিত। আমাদের ভিতরে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিক কি আদৌ এই প্রতিটি প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থায় রয়েছে? না, আফগানদের তালিবানী শাসনের খপ্পরে পড়ে কিরকম দুর্দশা ঘটতে চলেছে ভেবে সময় নষ্ট না করে আমদের অবস্থা বর্তমানে ঠিক কিরকম। সেই বিষয়টি নিয়েই বরং ভাবনা চিন্তা বেশি জরুরী।
সংবিধান প্রদত্ত মত প্রকাশের অধিকার এই সময়ের ভারতবর্ষে কতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, সেটি যে কোন মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করলেই জানতে পারবে। পিছনে কোন রাজনৈতিক দল বা শিবিরের সমর্থন ছাড়া মত প্রকাশের অধিকার যাঁরাই প্রয়োগ করতে গিয়েছেন তাদের একটা বড়ো অংশই রাষ্ট্রের হাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছেন। বিশেষ করে তাঁরা যদি সরকারের বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন তোলেন তো কথাই নেই। সরকার বা সরকারী দলের পক্ষ নিয়ে নিরন্তর ফেক নিউজ প্রচার করে গেলেও কোন অসুবিধে নেই। সরকার বিরোধী পক্ষের রাজনীতি নিয়ে যখন যা খুশি বলে গেলেও কোন অসুবিধে নেই। অসুবিধে শুরু হবে ঠিক তখনই। যখন কেউ সরকারের নীতি রীতি পদ্ধতি’র বিরুদ্ধে মুখ খুলবে। বর্তমান ভারতবর্ষে আদৌ কোন তালিবানী শাসন চলছে না। কিন্তু যে সংস্কৃতি চালু হয়ে গিয়েছে, সেটি হলো। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ততক্ষণই স্বীকৃত। যতক্ষণ সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথা উচ্চারিত হচ্ছে না। এদিকে সংবিধান প্রদত্ত অধিকারে প্রতিটি ভারতীয়েরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু সেই সাথে সরকারের হাতেও একটি ব্রহ্মাস্ত্র রয়ে গিয়েছে। সেটি হলো ইউএপিএ। যে আইনের বলে সরকার যে কোন মানুষকেই যে কোন সময় যে কোন অজুহাতে আটক করে দিনের পর দিন কয়েদ করে রাখতে পারে। মাসের পর মাস বছরের পর বছর বিনা বিচারে এই আইনে আটক থাকার পরে যদি কোন ভাবে প্রমাণিতও হয়। সরকার বেআইনী ভাবে কাউকে আটক করে রেখেছিল। তাহলেও সরকারের শাস্তি বিধান সম্ভব নয় এই দেশে। মামলার দীর্ঘসূত্রীতা আর রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তিতে যে কোন সরকারই বিচার ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। বিশেষ করে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নির্বাচিত সরকার হলে তো আর কোন কথাই নেই। ফলে সংবিধান প্রদত্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতাই বর্তমান ভারতবর্ষে কতটা সুরক্ষিত, প্রশ্ন রয়েছে সেখানেও। এখন মত প্রকাশের স্বাধীনতাই যদি লঙ্ঘিত হয়, হতে থাকে। তবে গণতান্ত্রিক পরিসরই ক্রমশ সংকীর্ণ হতে শুরু করে দেয়। গণতন্ত্র মানেই, পাঁচ বছর অন্তর বুথে বুথে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা নয়। গণতন্ত্র একটা অধিকার। যে অধিকারগুলি একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান স্বীকৃত। সেই অধিকারগুলিই যদি রাষ্ট্র কর্তৃক লঙ্ঘিত হতে থাকে। তাহলে গণতন্ত্রই বিপন্ন হয়। আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক সরকার কেন তালিবানের সমানে বিনা প্রতিরোধে ভ্যানিশ হয়ে গেল, সেই প্রশ্নের থেকে অনেক বড়ো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারের হাতেই নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে না’তো? না, উত্তর অন্য কেউ দিলে তো হবে না। উত্তর দিতে হবে ভারতবর্ষের নাগরিকদের।
তখন যদি দেখা যায়, না সংবিধান প্রদত্ত সকল নাগরিক অধিকারগুলিই প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সুরক্ষিত রয়েছে বর্তমান সরকারের অধীনে। তাহলে অসুবিধে নেই। কিন্তু যদি দেখা যায়, সংবিধান প্রদত্ত সকল নাগরিক অধিকারগুলি প্রত্যেক নাগরিকের জন্যেই সুরক্ষিত নেই। অর্থবান ও ক্ষমতাবান শ্রেণীর মানুষের জন্যেই শুধু সুরক্ষিত। তাহলে কিন্তু অসুবিধে রয়েছে। তখন আফগানিস্তান আর তালিবানের আলোচনায় নিজের দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি আড়াল করে রাখা যাবে না। গণতান্ত্রিক পরিসরগুলি যদি মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য, বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য, বিশেষ গোষ্ঠীর মানুষের জন্যেই কার্ষকর থাকে শুধু। তাহলে বুঝতে হবে ভারতবর্ষের অবস্থা আফগানিস্তানের থেকে খুব একটা ভালো নয়। সেখানেও তালিবান ও তালিবানপন্থীদের জন্যেই সকল অধিকার ও সুযোগ সুবিধে সংরক্ষিত থাকার কথা। অন্তত, সেটাই প্রথম তালিবানী শাসনে ছিল। সেই একই ধারা যদি ভারতেও চলতে থাকে, অর্থাৎ সরকারপন্থীদের জন্যেই সংবিধানের সকল অধিকার সুরক্ষিত। আর বাকিদের জীবনে সাংবিধানিক অধিকারগুলি সুরক্ষিত নয়। অধিকাংশ সময়ে সেই অধিকারগুলির সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই দারস্থ হতে হচ্ছে আইন ও আদালতের। তাহলে কিন্তু বুঝতে হবে, ভারতবর্ষ আর আফগানিস্তানের ভিতরে পার্থক্য খুব বেশি নেই। আফগানিস্তানে হয়তো তালিবানী শাসনে আফগানরা নিরপেক্ষ আদালতের দারস্থ হতেই পারবে না। কিন্তু ভারতে পকেটে পয়সা থাকলে আদলতের দরজায় এখনো কড়া নাড়া যায় অন্তত। কিন্তু একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দেশে নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে বার বার আদালতের দারস্থই বা হতে হবে কেন? জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারেরই তো প্রধান দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারগুলির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সেখানে নাগরিককেই যদি তার সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে প্রতিবার আদলতের শরণাপন্ন হতে হয়, তাহলে নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে ভারতবর্ষে এক ছদ্মবেশী তালিবানী সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। তালিবান হয়তো একটা বিশেষ দেশের এক বিশেষ রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু তাদের মতাদর্শ তাদের কর্মসংস্কৃতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গী’র মূল কথাই হলো জোর যার মুলুক তার। আর এটিকেই নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে তালিবানী সংস্কৃতি। বাকি বিশ্বের আধুনিক সভ্যতার কোন অনুষঙ্গের সাথেই যার কোন সংযোগ নাই। সাযুজ্য নাই। এবং কেবলমাত্র ধর্মীয় ভাবাবেগের কেন্দ্রেই সকল সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রীত। আমাদের প্রশ্ন, ভারতবর্ষেও কি এক বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ভাবাবেগের কেন্দ্রে গোটা দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কার্যক্রম ও অভিমুখ পরিচালিত হচ্ছে না? যে কোন দেশ ও সমাজ যদি এই অভিমুখে এগিয়ে যেতে থাকে। তবে সেই সমাজ ও দেশ ক্রমেই কিন্তু বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকবে। এবং সময়ের উল্টোমুখেই ফিরতে থাকবে। আর সামগ্রিক ভাবেই এই গোটা প্রক্রিয়াকেই তালিবানী ধারা বলা যেতে পারে। না, ভারতবর্ষে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। ভারতবর্ষে একটি সক্রিয় সংবিধান রয়েছে। ভারতবর্ষে একটি সক্রিয় বিচারব্যবস্থাও রয়েছে। ফলে আফগানিস্তানের সাথে ভারতবর্ষের তুলনা চলে না। কিন্তু যে মুহুর্তে নাগরিকের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলি লঙ্ঘিত হতে শুরু করবে, যদি ইতিমধ্যেই করে থাকে। তবে নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের অভিমুখ আর আফগানিস্তানের অভিমুখের ভিতর দূরত্ম ক্রমহ্রাসমান বলেই বুঝতে হবে। এবং ঘটনাক্রম যদি সেই দিকেই পরিচালিত হতে থাকে, তবে আফগানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে না ভেবে ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার দিন সম্ভবত এসে গিয়েছে। এখন দিন এসে গিয়েছে কিনা, বোঝা যাবে কি করে? খুব সহজ উপায়। প্রশ্ন করতে হবে নিজেকেই। পূর্বেই বলা হয়েছে। নিজেকেই প্রশ্ন করে জানতে হবে দেশের সংবিধান স্বীকৃত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের হাতে সুরক্ষিত কিনা। কিংবা কতটুকু সুরক্ষিত। সকলের জন্যেই সুরক্ষিত না’কি শুধমাত্র সরকারপন্থী বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্যেই তা সুরক্ষিত। এই সামান্য কয়টি উত্তরই আমাদের জানিয়ে দেবে আমরা ভারতীয়রা তালিবানের খপ্পর পড়া আফগানদের থেকে কতটুকু বেশি ভালো রয়েছি। আফগানদের জন্য আফগানরা ভাবুক বরং। আমাদের ভাবা দরকার আমাদের জন্য। কারণ আমাদের হয়ে অন্য কোন দেশ অন্য কোন জাতি ভেবে দেবে না। ফলে আমরাই যদি অন্যের জন্য ভাবতে বসে নিজেদের অবস্থা নিয়েই ভাবতে ভুলে যাই বা বড্ড বেশি দেরি করে ফেলি। তখন কিন্তু আমাদেরকে রক্ষা করতে কোন বিদেশী শক্তি এগিয়ে আসবে না। আর আত্মরক্ষা প্রত্যেকের জন্মগত অধিকার। কেউ সেই অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। যদি না আমরা নিজে থেকেই সেই অধিকার বিসর্জন দিয়ে বসে থাকি।
৪ঠা সেপটেম্বর’ ২০২১
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন