ঘুমঘোরে আছি। আসলে, ঘুমে নেই। যেটুকু আছি, ওই ঘোরেই। তবুও ঘোরের গায়ে ঘুমের একটা মেঘলা রঙ লেগে থাকে। তাকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। অস্বীকার করা যায় না। তাই ঘুমঘোরে আছি। অথবা কোত্থাও নেই! এই যে 'কোথাও'-এর উপরে বাড়তি একটা 'থ', সেটাই এই থাকার বিশেষত্ব। না-থাকারও। ওখানে কিছু অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। অথবা খুব বিস্ময়ে যেন আক্ষরিকভাবেই 'থ' হয়ে গেল একটা মানুষ! স্তম্ভিত। নীরব। এবং অবশ্যই, নিস্তব্ধ।
ঘোরের মধ্যে একটা গন্ধ লেগে থাকে। নিবিড় পাতার গন্ধ। জীবনের প্রিয় গন্ধগুলি আমি কোনোদিন ভুলিনি। প্রিয় স্বাদ ভুলিনি। গোপন পাতার ঘ্রাণ মেখে ঘুমোতে যাই; মধ্যযাম পার করে। অথবা ঘোরে যাই। ঘোর ঘন হলে, মুখের উপর কার যেন শ্বাস পড়ে! খুব চেনা শ্বাস। আমি তার নোজরিং দেখি। অথবা ঠোঁটের মুদ্রা। সামান্য অসমান দাঁতের ঝলক। অথচ আমার চোখ বন্ধ! ধড়ফড় করে উঠে বসি। যে-সময়ে উঠে বসি, তাকে ভোর বলা যায় না। অথচ রাতও নয়! সে এক অচিন সময়। সময়টাকে চিনতে পারি না। যাকে চিনতে পারি, সে তখন কোত্থাও নেই।
ওই যে বাড়তি একটা 'থ', তার উপরে জীবন জেগে থাকে। এবং মৃত্যুও। অপেক্ষা জেগে থাকে। এবং প্রার্থনাও। কিছু-কিছু অপেক্ষা মরে যেতে-যেতেও, থেকে যায়! যাপিত সময়ের থেকে রসদ নিয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু অপেক্ষা মানে, শুধু একটা বিশেষ 'কেউ'-এর জন্য নয়। লোকে যেটা সাধারণত ভাবে। একজন 'কেউ'-ও ভেবে রাখে তাই। অথচ অপেক্ষা মানে, বিশেষ একটা কিছুর জন্য। তার ব্যাপ্তি অনেক বেশি। পরিধিও। একটা কাম্য পরিস্থিতি। যাকে বলে, ডিজায়ারেবল। একটা বিশেষ কেউ সেই চাওয়ার মধ্যে মানিয়ে গেল কি গেল না, সেই প্রশ্ন আলাদা।
অচেনা সময়ে ঘোর ভেঙে উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। এখানে আমার একটা উত্তরের বারান্দা আছে। যেখানে উত্তর খোলা ছিল না, সেখানে পশ্চিমে ছিল। সেও কিছুটা উত্তরঘেঁষা। এখনকার বারান্দা থেকে দিগন্তরেখার দেখা মেলে। তবে একটু দূরে। হাইরাইজের বাধা পেরিয়ে। দিগন্তে কখন কোন তারা খসে গেল, তার খবর এই অসুস্থ সময় রাখে না। মানুষের নির্লিপ্তিও না! আমি এই সময়টাকে বুঝি। ভবিষ্যতের গর্ভে সে তার দায় রেখে যাবে। কিন্তু মানুষকে চেনা আজও সহজ নয়। বরং দিনকে দিন জটিলতর। দায় ঝেড়ে ফেলতে সে ভীষণ পটু! অথচ এখনও দিগন্তরেখায় আমার ফেলে আসা সাদা টি-শার্ট ওড়ে। বিষাদের মতো ওড়ে ডেনিমের ঘন নীল। একটা তামাটে রঙের উঠোন। দুটো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া হাত। শুধু মুখদুটো কিছুতেই দেখা যাচ্ছে না বলে, চশমার দিকে হাতড়াই। এই ঘটনাক্রম দেখেই একদিন জন্মান্তরে বিশ্বাস এসেছিল।
তবুও মানুষ মূলত আত্মকেন্দ্রিক। কোনো আকুল আক্ষেপ থেকে উৎসারিত ত্রুটির ক্ষমা জানে না। অন্যায্য অন্যায়ে কাউকে অপরাধী বানিয়ে দেওয়ার পাপ করে। তবুও কোনো অনুতাপ জানে না! চেনাজানা অপেক্ষার সঙ্গে তাই সে নিজের মনোভাবকেই জড়ায়। তাই তার মনে হয়, অপেক্ষার আর কোনো মানে নেই। এই অপেক্ষা অকারণ। আমি তাকে দোষ দিই না। এও এক পেরিফেরাল ভিশন। যার দেখার পরিধি যতটা। এখানে বিরোধের কোনো ব্যাপার নেই। আমি তার ওইসব ক্ষুদ্রতাকে উপেক্ষা করতে জানি। আমি কিছু নাভিজল চিনি। বিদায়লগ্নের চুম্বনগন্ধ চিনি। আমার ঘুমের গায়ে ওইসব বিচ্ছিন্ন বাস্তব লেগে থাকে। আমি এই বিধ্বস্ত সময়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে শিখেছি। আমার ঘোরের গায়ে স্বপ্নসন্ধানী ভবিষ্যৎ লেগে থাকে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন