সেতু খুব টানে আমাকে। যে কোনও সেতু, বা ব্রিজ। ছোট হোক, বড় হোক, বেশি লম্বা বা কম লম্বা। এমনকি ছোট নালা বা খাঁড়ির উপরে যে ছোট্ট কালভার্ট, তাও। আসলে সেতুর ওপারটা টানে। এইপার থেকে ওইপারে পৌঁছে যাওয়ায় ভীষণ আনন্দ যে!
তাই হয়তো সামনে সেতু দেখলেই ভিতরে কেমন একটা তাগিদ অনুভব করি। তার ওপারে যেতে চাই। যাওয়ার দরকার থাক আর না থাক। ওপারটা যেন চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। না যাওয়া অব্দি শান্তি নেই। এই নিয়ে একবার একটা কবিতা লিখেছিলাম। ছাপাও হয়েছিল একটা কাগজে। অনেকেই ভালো বলেছিল। কেউ বলেছিল, রোমাঞ্চিত হলাম। এতে রোমাঞ্চিত হওয়ার মতো কি ছিল কে জানে! আমি আমার মনের কথা লিখেছিলাম। কবিতা কি মনের কথা? হোক আর না হোক আমি ওই কবিতাটাতে আমার মনের কথাগুলোই লিখেছিলাম। ভালো লাগলে কি করব? সে যে এক অমোঘ ডাক।
কে ডাকে ওপার থেকে? এপারে যে জীবন, ওপারেও তো তাই দেখি। একই কোলাহল, একই ধুলোবালি, একই বাতাস। আকাশের রঙও এক। এপারে যে শিকড় আছে, ওপারেও গাছেদের সেই একই রকম শিকড়বাকড়। এপারে যে যন্ত্রণা, ওপারেও তার থেকে মুক্তি নেই। ছোটদের পুতুল খেলা সেই একই। ছেঁড়া-ফাটা জামাকাপড় পরে ঘরহারাদের ফুটপাথে রান্নাবান্না, ময়লা বিছানা আর তেলচিটে বাসনের জোড়াতালি সংসার, এগুলো তো সেতুর দুই পারেই এক। সব গানের সুর এপারে যা ওপারেও তাই। আলাদা সুরে তো বাজেনা! খিদে পায় একই রকম।তাহলে এত ওপারে যেতে চাই কেন? ব্রিজ দেখলেই?
শুধু কি ব্রিজ বা সেতু দেখলেই? না দেখলেও তাই। মাঝখানে একটা পারাপার আছে এটা মনে হলেই হলো। তখন একটা কাল্পনিক সেতু ঠিক গড়ে ওঠে মনের মধ্যে। তাতে পার হতে যাই। সেরকমও না হলে নিজে নিজেই সেতু হয়ে যেতে মন চায়। এরকমটা হয় মাঝখানে যেকোনো রকমের একটা ব্যবধান দেখলেই। নদী নালা খাল বিল তো বটেই। এমনকি কোন কিছুর মাঝখানে শূন্যতা দেখলেও। সেটাও তো একটা ব্যবধান। কোন কোন মানুষের মধ্যে এই শূন্যতা বড় বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। তখন মনে হয় কোন সেতু দিয়ে যদি যোগাযোগটা করিয়ে দেওয়া যেত! যদি তার শূন্যতাটা ঘুচিয়ে দিতে পারতাম! তার মন যদি খুব সহজেই ভিতরে ভিতরে এপার এপার করতে পারত! পাশাপাশি বা দূরে দূরে দুটো মানুষের মধ্যেও এই ব্যবধান কিম্বা শূন্যতা যাই বলি তা বড় কম নয়। দুদল মানুষের মধ্যেও একই রকম। দেখি তো। দেখতে পাই। সেতু না থাকলে ব্যবধান দিন দিন আরও বাড়তে থাকে। মাঝখানের নদী বা নালাটা দুপাশের পাড় খেয়ে আরও চওড়া হয়। এদিকটা ভাবে আমি বেশ আমার মতো। যেমন খুশি তেমনই। ও ওর মতো যেমন আছে থাক না। আমার সাথে ওর কোন সম্পর্ক নেই। আমরা আলাদা আলাদা। খণ্ড খণ্ড। যে যার রাজ্যে রাজার মতো। এতেই আমাদের সুখ। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার দরকারটা কি? নাইবা থাকল যোগাযোগ? কিসের অসুবিধা?
আসলে অসুবিধাটা সাধারণের। আর সেটা ঘোচানোর জন্যই একটা সংযোগের সেতু খুব দরকার হয়। সুসম্পর্কের সেতু। ভালোবাসা আর বিশ্বাসের সেতু। তখন দুটো পার এক হয়ে যায়। বোঝা যায়না যে তারা আলাদা। সেতু সেই দূরত্ব ঘুচিয়ে দেয়। এক করে দেয়। তখন মনে হয় নদী বা নালাটার এপার থেকে ওপার পর্যন্ত একটাই টানা রাস্তা। কোথাও কোন ছেদ তো নেই! একটা অখণ্ডতার বোধ কাজ করে।
সেতুই এটা সম্ভব করে দেয়। তাই সেতু দেখলেই মনে হয় কেউ ডাকে। বলে এসো, ওপারের সঙ্গে এক করে দিই। সেটা একটা অন্তরঙ্গতার ডাক। জুড়ে দেওয়ার ডাক। কে ডাকে? ছেলেবেলাটা ডাকে কি? নাকি আরও বড়বেলা খণ্ডগুলোকে জুড়ে জুড়ে বুঝিয়ে দিতে চায় জীবনটাই একটা সেতু?
■ তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় | সেতু যখন
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ৩১, ২০২১
Rating:
Reviewed by Pd
on
আগস্ট ৩১, ২০২১
Rating:

কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন