
দরজায় ঠক্ ঠক্ আওয়াজ। সবে দুচোখের পাতায় ঘুম নেমে এসে ছিল কিন্তু কে এসেছে সেটা না দেখে আমার ঘুমিয়েও শান্তি নেই। দুপুরে সবে একটু ঠুলুনি এসেছে । এই সময় কে আবার এলো। যেই আসুক শুধু ওই হতভাগা কিট্টু না এলেই হয়। কদিন ধরেই সে খাবার সময় উড়ে এসে জুড়ে বসছে। আমার মন মোটেও ছোট নয় বরং বেজায় বড় যদিও দিদি, বাবা, মাম্মাম, মা বলে আমার নাকি ভারি হিংসা কিন্তু একথা মোটেই ঠিক নয়। শুধু খাবার খেয়ে গেলে আমার এতো রাগ হতোনা। খাবার খাওয়ার পর আবার লেজ নাড়িয়ে নাড়িয়ে বাবা বা দিদির আদর খাওয়া দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। রাগতে রাগতে আমার লেজটা অব্দি ফুলে যায়। আমার রাগ দেখে দিদি আমাকে রাগানোর জন্য কিট্টুকে আরো আদর করে আর আমাকে হিংসুটে- হিংসুটে বলে । আমি প্রতিবাদ করি কিন্তু আমার ভাষা বোঝে না বলে আমার প্রতিবাদের ভাষাও দিদির বোধগম্য হয় না। আমি রেগে মেগে কিট্টুকে পেটানি দিই। সেই ভয়ে সে দুই –একদিন বাড়ির পথ মাড়ায় না। প্রথমে বিজয়ীর মত আনন্দ পেলেও পরে মন খারাপ হয়ে যায়। আসলে লোকে যাই বলুক আমার মনতো আর ছোটো নয় বেজায় বড়। আমি চ্যাংদোলা। কিট্টু আমার দাদা। কিন্তু ওর সঙ্গে খেলে সুখ নেই। আসলে কিট্টু খেলতে জানেনা। এতো নাদুসনুদুস যে খেয়েই ঘুমিয়ে পরে । যতই বলি খেলবি আয় কিন্তু কে কার কথা শোনে। ঘাড় উলটে ঘুমিয়ে থাকে। যতই আমি কিট্টুর উপর অত্যাচার করি চট করে আমায় পেটায় না। তবে পেটালে হেব্বি ব্যথা লাগে। লাগবে না যা হাতির মত দেখতে ।
মাঝে মাঝে চার দেওয়ালের মধ্যে আমি হাঁপিয়ে উঠি। আসলে আগে আমি ও আমার আরেক পিঠোপিঠি ভাই নীচে গ্যারাজে থাকতাম। আমার মা মারা যাবার পর না খেতে পেয়ে মরমর অবস্থা হয়েছিল। তখন বাবা মানে দিদির বাবা খেতে দিতো । দিদি আদর করত। একদিন দিদি কোলে করে ঘরে নিয়ে যায়। সেখনে দেখি এক ষণ্ডা মার্কা লোক। আমি ভেবেছিলাম খাবার দেবে উলটে ফুড়ুৎ করে ইঞ্জেকশন ফুটিয়ে দিলো। কী নিষ্ঠুর। খুব রাগ হয়েছিল দাঁত কিড়মিড় করছিল কামড়াবো বলে কিন্তু দিদি হাত ধরে থাকায় কামড়াতে পারিনি উলটে কিরকম নেতিয়ে পরলাম। তারপর থেকে দিদির বাড়িতে থাকতে শুরু করলাম। মা মানে দিদির মা প্রথমে ব্যাপারটা ভালোভাবে নেয়নি কিন্তু পরে মেনে নিয়েছিল বোধ হয়। আমার চেয়ে মা দাদাকেই বেশি পছন্দ করত। দাদা দিব্যি মায়ের ঘরে ঘুমোতো। আমি বাইরের ঘরে থাকতাম। আমার খুব রাগ হোতো। আমার ভিতর ঘরে যাওয়া বারণ ছিল। একদিন দাদা হারিয়ে গেলো। বাবা অনেক খুঁজল । কিন্তু দাদাকে খুঁজে পেলোনা। দিন গেলো মাস গেলো দাদা ফিরে এলোনা । মাঝখান থেকে বাড়িতে আমার আদর বেড়ে গেলো। মাঝে মাঝে এখন মায়ের ঘরেও হানা দিই । মা কিচ্ছুটি বলে না। বরং একদিন দাঁত সুরসুর করছিল বলে মা যে টিভিটায় বসে টক্ টক্ করে কিসব লেখে সেই টিভির তার চিবিয়ে ফেলেছিলাম। মা কটমট করে তাকিয়েছিল কিন্তু কিছু বলেনি। পরে একটা কাকু এসে সেই টিভি সারিয়ে গেলো। ভালোই দিন কাটছিল কিন্তু সুখ কপালে আমার বেশিদিন সহ্য হোলো না। একদিন দুপুরে দেখি এক অচেনা বিড়ালের গলা । শুনেতো আমি চমকে উঠি। বাইরের ঘরে এসে আমি অবাক হয়ে যাই । এর চেয়ে কিট্টুর বাড়িতে আসা ঢের ভালো ছিল। আমার সামনে যে বেড়াল কাতরাচ্ছে সে কিট্টুর চিরশ্ত্রু । দেখতে কিট্টুর চেয়ে সুন্দর বলে আর মুখের মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে বলে সব সময় মেনীদের পটানোর ক্ষেত্রে কিট্টুকে ফেলে সে এগিয়ে যেত। এই বেড়ালটার কি যেন নাম । মনে পড়েছে । সবাই বলে হিরো। হিরো প্রচন্ড নাক উঁচু স্বভাবের। কোনো বিড়ালের সঙ্গে মেশে না। কাউকে পাত্তাই দেয় না। আজ যেন সে খানিক অন্য রূপে ধরা দিয়েছে। অহংকারীর যে পতন হয় সেটা আজ হিরোকে দেখে উপলবদ্ধি করলাম। পিছন পায়ে গভীর ক্ষত। দিদি চ্যংদোলা করে হিরোকে বাড়ি নিয়ে আসার পর থেকে সে বারান্দার এক কোণে গুটি সুটি মেরে বসে আছে। মাঝে মাঝে যন্ত্রণায় কুই কুই করছে। আমি কি সেই আওয়াজে একটু খুশি হলাম? নিজের আচরণে নিজেই মনে মনে লজ্জিত হলাম। আসলে আমার মনে হিংসা নেই, চিন্তা আছে নিজেকে নিয়ে চিন্তা । নিজের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা। সেই জন্য খাবারের পাত্র পাশে থাকলেও রেলিংএ উঠে শিকার করি যাতে আমি আমার সহজাত স্বভাব ভুলে না যাই। একেই মা মরে যাওয়ায় কিছুই শিখিয়ে যেতে পারেনি । যেটা অন্য মা বিড়ালেরা শিখিয়ে যায়। কিট্টু দাদা যাও বা আছে সেও ঢ্যা ঢ্যা ঢেঁড়স। কোথায় সে নিজের ছোট্ট বোনকে উন্নত বিড়াল হবার জন্য ট্রেনিং দেবে সেটা না করে খায় দায় ঘুমায়।
দেখতে দেখতে প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলো। প্রত্যেকদিন ডাক্তারবাবু এসে দেখে ঔষুধ ও ইনজেকশন দিয়ে হিরোকে সুস্থ করে তোলেন। হিরোর গৃহে উপস্থিতির সংবাদ মনে হয় কিট্টুর কানে গেছে। সে হুলো আর বাড়ি মুখো হচ্ছেনা। বাড়িতে অচেনা হুলো এসেছে । তার বোনের নিরাপত্তার ব্যাপারটা অন্তত সরজমিনে তদন্ত করা উচিত ছিল কিন্তু নাঃ কিট্টু সেই ব্যাপারে নির্বিকার । তবে হিরোকে আমি পেটানি দিলেও সে এখনো অব্দি আমার অনুগত প্রজার মতই আচরণ করছে। এরকম ভাবে সে যদি থাকে থাক আমার তাতে আপত্তি নেই। আসলে আমার মনে কোনো হিংসা নেই । শুধু হিংসার মোড়কে লুকিয়ে আছে নিজের অস্তিত্ব ও অধিকার রক্ষার লড়াই।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন