শনির বচন | কাজের মাসি কাজের মেশো

শব্দের মিছিল sobdermichil

কথাটা সত্য। রাজনীতিতে কাজের মাসি কাজের মেশোরা আজ আর কল্কে পাচ্ছেন না বিশেষ। নির্বাচন আসলে এদের নিয়ে হইচই হয় না। মানুষ এদেরকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করতেও রাজি নয়। কিন্তু আজ থেকে কয়েক দশক আগেও অবস্থাটা এমন ছিল না। কাজের মাসি মেশোদের উপেরই জনতার ভরসা ও বিশ্বাস ছিল মূলত। কিন্তু দিনে দিনে একটা পরিবর্তন নেমে এলো রাজ্য রাজনীতিতে। কাজের মাসিদের জায়গায় অকাজের ধারীরা নেচে গেয়ে জায়গা করে নিতে শুরু করলো। স্নো পাউডার লিপস্টিক। মাসকারা ফাউন্ডেশন ইত্যাদিই রাজনীতিতে কল্কে পাওয়ার ফাউন্ডেশন হয়ে উঠতে থাকল। যার যত চড়া মেকআপ। তার তত জনপ্রিয়তার জৌলুশ। কাজের মাসি কাজের মেশোদের দিন গেল অস্তাচলে। অকাজের ধারীরাই মঞ্চজুড়ে জগঝম্প শুরু করে দিল। জনতাও পাগলু ড্যান্স দেখতে রাজনীতির ময়দানে ভিড় করতে শুরু করল। আর সেই ভিড়ের পালকে মশগুল রাখতে আরও বেশি সংখ্যায় অকাজের ধারীদের ডাক পড়তে শুরু করে দিল। পয়সাও মন্দ নয়। তারপরে নির্বাচনের টিকিট পেয়ে গেলে তো সোনায় সোহাগা। আর দলীয় রাজনীতির কলাকৌশলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সাংসদ বিধায়ক হয়ে গেলে তো কেল্লাফতে। একেবারে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় চৌদ্দ পুরুষের জন্য জমি জায়গা স্থাবর অস্থাবর সম্পদ সম্পত্তি আর রাজনৈতিক প্রতিপত্তি। সাথে অকাজের লাইমলাইটে থাকার বিশেষ জনপ্রিয়তা। ফলে আর্থ সমাজিক রাজনীতির এই পট পরিবর্তনে প্রকৃত কাজের মাসিদের থেকে, কাজের মেশোদের থেকে হুজুগে জনতা মুখ ফিরিয়ে নিল।

দিন দিনে মানুষ ভুলতে বসলো। রাজনীতিতে কাজের মাসি কাজের মেশোদের গুরুত্বের কথা। এখন কাজের মাসি হয়ে উঠতে গেলে বিশেষ যোগ্যতা লাগে। যা অকাজের ধারীদের কোনদিনই থাকে না। এবং থাকে না বলেই তাদের দিয়ে রাজনীতিও হয় না। জনসেবাও হয় না। দেশ ও সমাজেরও কোন উন্নতি হয় না। শুধুমাত্র নির্বাচন জিততে প্রয়োজনীয় আসন জোগার ছাড়া এদের দিয়ে আর কোন উপকার হয় না। এখন নির্বাচন জিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের জন্য জরুরী আসন সংখ্যার বাইরে এদের কোন কার্যকরিতাও থাকে না। দিনের পর দিন সান্ধ্য টিভিতে মুখস্থ সংলাপ বলে আর সিনেমায় নাচ দেখিয়ে উপার্জিত জনপ্রিয়তায় এঁরা নিজেদেরকে সেলিব্রেটি বলে মনে করে থাকেন। এবং জনতার দরবারে সেই সেলিব্রেটি পুঁজি ভাঙিয়েই ভোট ভিক্ষা করে থাকেন। তার বাইরে এদের জীবনে জনসংযোগের আর কোন দিগন্ত খোলা রাখেন না এঁরা। সমাজে জনসংযোগ বাদ দিয়ে রাজনীতি করার প্রবণতা একবার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে কাজের মাসি কাজের মেশোদের আর দরকার পড়ে না।

তাই অকাজের ধারীদের ভিড়ে দুই একজন কাজের মাসি মেশোদের দেখা পেলে জনতাও হাসাহাসি শুরু করে দিতে পারে। কারণ ততদিনে জনতার চেতনায় রাজনীতিতে কাজের মাসি মেশোদের গুরুত্ব উপলব্ধি করার মতো আর কোন শক্তি অবশিষ্ট থাকে না। জনতা ততদিনে পাগলু ড্যান্সের সিলেবাস মুখস্থ করে ফেলেছে। ফলে জনতার চোখে ততদিনে মাসকারা বিভ্রম থেকে শুরু করে স্নো পাউডার লিপস্টিক ফাউন্ডেশনের মৌতাত জমে উঠেছে। সে স্ফূর্তি করতে চায়। মিছিলে হোক। মিটিঙে হোক। জনসভায় হোক। সে নাচতে চায়। ঠিক সেইভাবেই, যেভাবে নাচাতে অকাজের ধারীদের রাজনীতিতে নামানো হয়। হচ্ছে। এখন রাজনীতির এই সংস্কৃতিতে উন্নয়ন ও বিকাশের ঢক্কানিনাদে কাজের মাসি কাজের মেশোদের আওয়াজ চাপা পরে যাবে। সেটাই স্বাভাবিক। জনতারও অতশত গুরুত্বপূর্ণ কথায় আগ্রহ নাই। সারদার টাকা কে খেলো। নারদায় কে টাকা দিল। সারদা নারদার টাকা নিয়ে কে কবে দল পাল্টালো। এসবে জনতার কি যায় আসে? জনতা শুধু দেখে নেবে, এতদিন কাটমানির রং ছিল নীল। এবার কাটমানির রং গেরুয়া হলো কি হলো না। কারণ শুধু কাটমানি খেলেই তো আর হবে না। মহাকাব্যের নায়কের নামে জয়ধ্বনি দিয়ে খাচ্ছে কিনা, সেটাই বিচার্য্য। না হলে যে কাটমানি শুদ্ধ হয়ে উঠবে না। অশুদ্ধ কাটমানির বিরুদ্ধেই তো জনতাকে শুদ্ধ কাটমানির পক্ষে ভোটটা দিতে হবে। না হলে কাটমানি শুদ্ধ হবেই বা কি করে? না, শুধু কাটমানিও তো নয়। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় তোলাবাজির ঠেকেও আগে দেখে নিতে হবে মহাপ্রভুর ছবি টাঙানো আছে কিনা। ভারতমাতার নামেও মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি উঠছে কি উঠছে না। না হলে তোলাবাজিকেও শুদ্ধ করা যাবে কি করে? সবকিছুই থাকবে। সবকিছুই চলবে। শুধু নাম মাহাত্ম্যে জয়ধ্বনি দিয়ে শুদ্ধ করে নিতে হবে, এই যা। কাজের মাসি কাজের মেশোদের কথা শুনতে গেলে জনতার তাই চলবে কি করে? জনতাও আবার নতুন বোতলের হদিশ পেয়ে গিয়েছে। পুরানো মদ নতুন বোতলে ঢেলে নেওয়ার অপেক্ষা শুধু। এতদিন বাংলা ব্রাণ্ডের বোতল নিয়ে ঘুরতে হয়েছে। প্রেস্টিজ তাতেই যা পাংচার হয়ে গিয়েছে। এখন আর বাংলা ব্র্যাণ্ডের বোতল নয়। খোদ গুজরাট নাগপুর ইউপী ব্র্যাণ্ডের বোতল। তার কেতাই আলাদা। চেকনাই দেখলেই বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার দশা। জনতাও হুঁশ হারিয়ে বহুৎ খুশ।
তাই এমন সময় কাজের মাসিরা এগিয়ে আসলে কার আর মেজাজ ঠিক থাকে? এখন মনের সুখে পদে ছাপ দিয়ে ঘাসফুল সাফ করে দুদণ্ড মৌতাত করে নেওয়ার সময়। কিংবা এক দশকের উন্নয়নের প্রসাদ নিয়ে সন্তুস্ট থেকে দিদিকে খুশি করার সময়। বিশেষ করে জনতার অনেকেরই আবার বাংলা ব্র্যাণ্ড না হলে নেশা ছুটে যেতে পারে। 
ঠিক সেই সময় এইসব কাজের মাসি কাজের মেশোরা আবার রাস্তায় কেন। তাদের অপেক্ষায় তো আর কেউ বসে নেই। জনতা উন্নয়নের এক্সপ্রেস আনিয়ে নিয়েছে কবেই। এখন আবার বিকাশের মেল দরজায় দাঁড়িয়ে হুইসেল মারছে। চড়ে বসলেই নগদ নারায়ণ। পদ্মছাপ শাড়ী, গেঞ্জি টুপি সব ফ্রীতে! অন্তত ২রা মে অব্দি। তারপর সেলিব্রেটিদের ছড়াছড়ি। কি উন্নয়নের এক্সপ্রেস। কি বিকাশের মেল। এখানে পাগলু ড্যাণ্স তো ওখানে দ্রৌপদী নৃত্য।

না না। বাংলার জনতার আর কাজের মাসি কাজের মেশোদের কোন দরকারই নেই। একদিকে চটিপিসি তো অন্যদিকে ঠগেন্দ্রনাথ। এ বলে আমায় দেখ। ও বলে আমায় দেখ। বাঙালিও তাই দেখেই যাচ্ছে। এ দেখার শেষও নেই কোথাও। শিল্প নেই। কৃষি গেল। দেশের সম্পত্তি বেহাত হয়ে যায়। কর্মসংস্থানের হদিশ নেই। না থাক। চপ আছে পকৌড়া আছে। ঢপ আছে ধরপাকর আছে। জাল ডিগ্রী আছে। জাল পেশা আছে। গালগল্প আছে। মন্দির মসজিদ আছে। পালা পার্বণ আছে। দয়া দাক্ষিণ্য আছে। লাইন বেলাইন আছে। ব্যাংকে সিঁদকাটা আছে। চাল চুরি আছে। রেল চুরি আছে। রঙ বদল আছে। নাম বদল আছে। না, শুধু দিন বদল নেই। কারণ একটাই। এদেশে এখন বেশি বেশি কাজের মাসি নেই। বেশি বেশি কাজের মেশো নেই। কাজ করার বাসনা নেই। কাজের হদিশ নেই। এদেশে এখন হাত সাফাইয়ের যুগ। যে যত বেশি সাফাই কর্মী। সে তত বড়ো পূজনীয়। সারদা হোক নারদা হোক। রেল বীমা ব্যাংক হোক। কৃষি হোক খনি হোক। এই সাফাই কর্মীরা জনতার চেতনাও সাফ করে ফেলেছে। তাই জনতা আজ আর চিন্তা করে না। হোয়াটসআপের সিলেবাস মুখস্থ করে নিজেদের ভিতরে আলাপ করে। এমনকি অবস্থা যখন বিলাপ করার মতো ভয়াবহ। জনতা তখন মুখস্থ সংলাপে প্রলাপ বকে আনন্দ পেতে বেশি আগ্রহী। তাই সেই জনতা কাজের মাসিদের কথায় পাত্তা দিতে যাবেই বা কেন। কেনই বা কাজের মেশোদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে যাবে। না জনতা এখন বাধ্য ছাত্র। সে কোন ট্যাঁফু করতে রাজি নয়। তাকে যেমন বলে দেওয়া হয়েছে। সে তেমন প্রতীকেই আঙ্গুল টিপবে। তারপর কি হতে পারে। কি হতে চলেছে। সেসব ভাবতে গেলেই তো সর্বনাশ। তখন যদি দমকল ডাকার মতো কাজের মাসি কাজের মেশোদের ডাকতে ছুটতে হয়? সেই ছোটা তো আর পাগলু ড্যান্স দেখতে যাওয়ার মতো নাচতে নাচতে হবে না। কিংবা ঠগেন্দ্রনাথের দাঁড়ি দোলানো বিকৃত বাংলা শোনার মতো হাসি তামাশার ব্যাপার হবে না। ব্যাপার যে গুরুতর। সেটা বুঝতে পারলে তো আর অকাজের ধারীদের করেকম্মে খাওয়া হতো না। তখন কাজের মাসি কাজের মেশোদের হাতে জনতা দেশের ভার তুলে দিতেই ভোটের লাইনে ভিড় বাড়াতো।



১৭ই এপ্রিল’ ২০২১
কপিরাইট সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ