শনির বচন | বঙ্গরাজনীতিতে বারমুডা

শব্দের মিছিল

সম্প্রতি নির্বাচনী প্রচার অভিযানে হুইলচেয়ারে আসীন মুখ্যমন্ত্রীকে কটাক্ষ করে বিরোধী দলনেতার বারমুডা তত্ব নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে জল ঘোলা হচ্ছে বিস্তর। বিরোধী পক্ষ থেকে আরও বলা হচ্ছে এক পা উঁচিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নাকি রাজ্যবাসীকেই অপমান করছেন। বিরোধী দলনেতার অশোভন মন্তব্য নিয়ে জল যতই ঘোলা হোক, রাজ্যবাসী যে তাতে বিরোধী দলনেতার উপরে ঘোরতর অসন্তুষ্ট হয়ে উঠেছে, এমনটাও বলা যাচ্ছে না। বরং অনেকেই বারমুডা পরিহিতা মুখ্যমন্ত্রীর কাল্পনিক ছবির কথা মনে করে ভিতরে ভিতরে আমোদ পাচ্ছেন হয়তো। নয়তো এমন চরম অশোভন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যে রাজ্যে প্রতিবাদের ঝড় ওঠার কথা ছিল। যেকোন সভ্য সমাজেই এমন কুরুচিকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে গোটা সমাজেরই গর্জে ওঠার কথা। কিন্তু এ হোল একবিংশ শতকের বাংলা। বিংশ শতকের নৈতিক আদর্শ ও বৌদ্ধিক প্রজ্ঞা এই শতকে আর আশা করার উপায় নাই। নাই বলেই, মুখ্যমন্ত্রীর অপমানকে রাজ্যবাসী নিজেদের অপমান বলে মনে করতে অপরাগ। কিছু কিছু জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর দলীয় সমর্থকদের উদ্যোগে প্রতিবাদ প্রদর্শন ছাড়া, বিষয়টি নিয়ে সাধারণ জনমানসে বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়নি। প্রতিক্রিয়া যতটুকু দেখা গিয়েছে, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির অভিমুখেই। সরকারে ক্ষমতাসীন দল স্বভাবতঃই বিষয়টি নিয়ে ভোটের প্রচারে আসর গরম করে বিরোধী ভোটের কিছুটা নিজেদের দিকে টেনে আনার প্রয়াসী। অর্থৎ সবটাই নির্বাচনী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। বিরোধী দলনেতার এই কুরুচিকর বীভৎস মন্তব্য যে বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই বেআব্রু করে দিলো তাই নয়। বাংলার সমাজ জীবনের অধঃপতনের চিত্রটিও সুস্পষ্ট করে তুলল। আমরা এমন একটা সময়ে এসে পৌঁছিয়েছি, যেখানে কুরিচকর মন্তব্যই রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াইয়ে রাজনৈতিক নেতাদের তুরুপের তাস। যে নেতার মুখ যত খারাপ, তার রাজনৈতিক প্রতিপত্তি তত বেশি। অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে জনসমর্থনের যে ভিড়, সেটি অনেকটাই নির্ভর করে, কে কত নিকৃষ্ট মানের ভাষা ব্যবহার করতে পারে। কে কত নীচে নামতে পারে। যে নেতার মুখ যত খারাপ, তার জনসমর্থনের ভিত তত পোক্ত। এই যে রাজনৈতিক নেতানেত্রী ও অসামাজিক দুর্বৃত্তদের সংস্কৃতি এতটা কাছাকাছি চলে এসেছে। সেটি কিন্তু জনসমর্থনের ভিত্তিতেই ঘটেছে। নেতানেত্রীরা যদি দেখতে পেতো, মুখ খারাপ করলে, রুচির বিকার ঘটালে দুর্নীতিতে জড়ালে জনসমর্থন কমে যাচ্ছে, তবে যে যত বড়ো মাপেরই নেতা কিংবা নেত্রী হন না কেন। মুখ খারাপ করার সাহসই দেখাতে পারতেন না। দুর্নীতিতে জড়ানো তো দূরস্থান। প্রত্যেকটি নাগরিক জানে, কোন নেতা কোন নেত্রী কতটা সৎ। কতটা সভ্য। আর কতখানি অসৎ। কি পরিমাণ অসভ্য। কিন্তু সেই জানাও জনসমর্থনের ভিতে কোন প্রভাব ফেলতে পারে না। বরং এটাই দেখা যায়, নেতা বা নেত্রী যদি নিপাট ভালো মানুষ কিংবা সৎ সজ্জন ব্যক্তি হন তবে তাঁর পিছনে জনসমর্থনের ভিড় কমতে কমতে একদিন শূন্য হয়ে যায়। বস্তুত আজকের দিনে রাজনীতিবিদ মাত্রেই এই সত্যটুকু জানেন। আর জানেন বলেই নিজেদের ভিতরে এক অঘোষিত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েন। কে কত বেশি নীচে নামতে পারেন। এ এক ভয়াবহ প্রবণতা। প্রতিটি দশক এই বিষয়ে পূর্ববর্তী দশকগুলিকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে চলেছে সবেগে পিছনের দিকে। গণতান্ত্রিক অধিকার এখন ভাষা সন্ত্রাসের অধিকার। নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দেওয়ার অধিকার। অন্যের ক্ষতি করার মতো ক্ষমতা অর্জনের অধিকার। আর নির্বাচনে জয়লাভ এই অধিকার গুলিকেই সুরক্ষিত রাখে। ফলে পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে শুরু করে লোকসভা নির্বাচন অব্দি সংবিধানই বস্তুত এই অপসংস্কৃতির রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছে দশক থেকে দশকে। আরও ব্যাপক ভাবে। আরও সর্বাত্মক ভাবে। আরও সর্বজনীন ভাবে।

মুখ্যমন্ত্রী বারমুডা পরিহিতা হয়ে জনসমক্ষে হুইলচেয়ারে আসীন হবেন কিনা, বিষয় সেটি নয়। বিষয় হলো প্রকাশ্যে একজন বর্ষীয়সী মহিলাকে এই ভাষায় অপমান করার স্পর্ধাটুকুই। জনমানসে এই স্পর্ধাই জনসমর্থনের তুরুপের তাস হয়ে উঠেছে। মূল বিষয় সেটিই। সমাজে প্রকৃত শিক্ষার প্রসার যত অবরুদ্ধ হয়ে উঠবে, ততই এই অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটতে থাকবে। অনেকেরই স্মরণে রয়েছে, অভিনেতা তাপস পালের সেই বিখ্যাত নির্বাচনী ডায়ালগ। ঘরে ঘরে মেয়েদের রেপ করিয়ে দেওয়ার হুমকিসহ। তাপস পাল যে ঠিক এই ধরণের হুমকি দেওয়ার মানুষ ছিলেন, তাও নয়। কিন্তু রাজনীতির এই খোঁয়াড়ে টিকে থাকা ও বাকিদের থেকে স্পটলাইট নিজের দিকে টেনে আনার প্রাণান্তকর নিরন্তর প্রচেষ্টার অলিখিত প্রতিযোগিতার গাড্ডায় পড়ে গিয়েছিলেন। তারই পরিণতি সেই কুখ্যাত ডায়ালগ। কিন্তু যে রাজনৈতিক শিবিরের হয়ে তিনি সেই ডায়ালগ দিয়েছিলেন, সেই সময় সেই শিবিরের প্রতি মানুষের আস্থা ভালোবাসা জনসমর্থন কিন্তু তাতে এক ফোঁটাও কমেনি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছিল বল্লেও ভুল বলা হবে না মোটেও। এটাই আমাদের সমাজের আসল চেহারা। ঠিক যেমন, ২০১৬’র বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক মুহুর্তে টিভির পর্দা জুড়ে ডজনখানেক দলনেতাকে লাখ লাখ টাকা ঘুষ নিতে দেখেও মানুষ সেই নেতাদেরই ও তাদের দলকেই রেকর্ড ভোটে বিধানসভায় বিজয়ী করে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল। এটাই একবিংশ শতকের বাংলা। এটাই বাংলার সমাজচিত্র। এটাই নবজাতকদের সামনে আমাদের তৈরী করে রেখে দেওয়া পথ। এইভাবেই আমরা বাঙালিরা বিগত শতকের সকল অর্জন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এক নিঃশ্ছিদ্র অন্ধকারে পা রেখেছি।

মুখ্যমন্ত্রীকে বারমুডা পরে সবটা দেখানোর পরামর্শ সেই অন্ধকারেরই দৃপ্ত ঘোষণা। এবং ঘোষক খুব ভালো করেই জানেন এর ডিভিডেণ্ড আছড়ে পড়বে ইভিএমের একাউন্টে। এই যে জোর করে খারাপ কথা বলবো। খারাপ ভাবে বলবো। এই প্রতাপ রাজনীতিবিদদের বাকিদের থেকে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলে। 
একটা গোটা সমাজ যখন এইভাবে জনপ্রিয়তার পিছনে ছুটতে থাকে, তখন সুস্থ রুচি সুস্থ সংস্কৃতি সুসভ্য সামাজিক আদর্শ ইত্যাদি আশা করাই বৃথা। এখন কথা হলো, এই অপসংস্কৃতির মূল সুবিধে হলো একটাই। রাজনীতিবিদদের জনগণের কাছে কোন জবাবদিহির দায় থাকে না। 
রাজনীতিবিদরা জনসেবার নামে দলসেবা করে ব্যক্তিগত আখের গুছিয়ে নিয়েও নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। জনসাধারণ তাদের চৌর্যবৃত্তির বিরুদ্ধে কোনভাবেই সমবেত হবে না। জমাট বাঁধবে না। প্রতিরোধ তৈরী করবে না। সমাজে তাদের মুখ খারাপ করা নিয়ে রসালো চর্চা হতে থাকবে। কিন্তু জনসেবার নামে আখের গোছানোর কার্যক্রমে বাধা পড়বে না আদৌ। জনগণ রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের নিয়ে সামাজিক তরজায় ব্যস্ত থাকবে মনের সুখে। সিধেঁল চোরের কাজ হলো গৃহস্থকে অন্যদিকে ব্যস্ত রেখে ঘর সাফ করে নেওয়া। রাজনীতিবিদদেরও কাজ জনসাধারণকে নানান ভাবে বিক্ষিপ্ত রেখে নিজেদের কাজ হাসিল করে নেওয়া। এই যে নানান ভাবে বিক্ষিপ্ত রাখার কার্যক্রম। অকথা কুকথা বলা গালিগালাজ করা, অবৈজ্ঞানিক তত্ব আউরানো ইত্যাদি হলো সেই কার্যক্রমেরই অংশ। রাজনীতিবিদরা তাই খুব সচেতন ভাবেই নিজেদর প্রতিদিনের সংলাপ সাজিয়ে নিয়ে মাঠে নামেন। তাঁরা জানেন কোন কথায় কতটা জল ঘোলা হবে। আর যত বেশি জল ঘোলা হবে তাদের পক্ষে মাছধরাও তত সহজ হয়ে উঠবে।

ঠিক এই কারণেই নির্বাচনী ভোটের বাজারে নেতা নেত্রীদের বিশেষ বিশেষ প্যাকেজ নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে দেখা যায়। জনগণের মাথা যত বেশি করে ঘুলিয়ে তোলা যাবে। ভোটের বাজারে আসন জেতা ততই সহজ হয়ে ওঠে। কারণ জনগণ তখন আর কোন জবাবদিহি দাবি করে না নেতা নেত্রীদের কাছ থেকে। তাদের মুখনিসৃত অকথা কুকথায় মজে থাকে দিনভর। খেয়াল করতে পারে না, এই নেতা বিগত পাঁচ বছরে ঠিক কোন জনসেবা মূলক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। জনগণের অপকার করার বদলে ঠিক কোন উপকারটি করেছেন। না, সত্যিই জনগণ তখন আর সে সব কথা জানতে চায় না। জনগণ সেই কথাটিই বরং শুনতে চায়, যে কথায় আমোদ পাওয়া যায় বেশি। যে কথা নিয়ে দুদণ্ড স্ফূর্তি করে নেওয়া যায়। রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়ন সম্পূর্ণ হলে সমাজের অবস্থা ঠিক এইরকমই হওয়ার কথা। আমাদের বাংলায় রাজনীতি আজ আমাদের ঠিক এইখানে নিয়ে এসেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর থেকে বাংলা ও বাঙালিকে মুক্ত করার মতো কোন শক্তি আজও তৈরী হয়ে ওঠে নি। তাই সামান্য বারমুডা পড়ার পরামর্শে জল যতই ঘোলা হোক না কেন। তাতে আমোদই রয়েছে। কোন প্রতিরোধ নেই। কোন বিকার নেই সমাজে এখন। কারণ গোটা সমাজটাই এখন বিকারগ্রস্ত। কোমায় আচ্ছন্ন।


২রা এপ্রিল’ ২০২১
কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ