শনির বচন | এক ছোবলেই ছবি

শব্দের মিছিল

হ্যাঁ এক ছোবলেই ছবি। গড়ের মাঠে রণহুঙ্কার দিয়ে গেলেন অভিনেতা থেকে নেতা হয়ে ওঠার মঞ্চে। আরও জানালেন আঠারো বছর বয়সের সেই স্বপ্ন। গরীব মানুষদের জন্য কিছু করার। আজীবন কর্ম ব্যস্ততায় সম্ভবত সেই সুযোগ তিনি পাননি। যদিও তাঁকে বিভিন্ন সময়ে রাজ্যের ক্ষমতাসীন বিভিন্ন রাজনৈতিক শিবিরের একনিষ্ঠ অনুগামী হিসাবেই দেখা গিয়েছে। দেখা গিয়েছে ভারতবর্ষের রাজধানীতেও। আইনসভার উচ্চতম কক্ষ রাজ্যসভায় নির্দিষ্ট রাজনৈতিক শিবির মনোনীত সম্মানিত সদস্য হিসাবে। তখনও অবশ্য তিনি গরীবদের জন্য কিছু করার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেন নি। খুবই পরিতাপের কথা। মেগাস্টার হয়েছেন। কিন্তু দাতা কর্ণ হয়ে উঠতে পারেন নি। গড়ের মাঠের মেঠো বক্তব্যে রাজ্যবাসীর অনেকেই নিশ্চয় আশা করবেন গুরু এবার ফাটিয়ে দেবেন। মেগাস্টার থেকে দাতাকর্ণ হয়ে উঠবেন। গরীবদের জন্য আঠারো বছর বয়সের সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ করতে। বিশেষ করে মঞ্চে যখন পাশে পেয়েছিলেন সেই মহা পুরুষের। যিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে প্রত্যেক ভারতবাসীর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স পনেরো লাখ টাকা করে বাড়িয়ে দেবেন বলেছিলে। বলেছিলেন বছরে দুই কোটি বেকারের সরকারী চাকুরিতে নিয়োগ দেওয়ার কথা। বলেছিলেন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনে দাঁড়ানোর টিকিট দেবেন না। বলেছিলেন সকল অভিযুক্ত সাংসদ বিধায়ক কাউন্সিলারদের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত নিষ্পত্তি করে, অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। বলেছিলেন ছয় বছরে কৃষকদের আয় দ্বিগুন বাড়িয়ে দেবেন। হ্যাঁ সেই মহাপুরুষ ব্যক্তির সংস্পর্ষে এসে মহাগুরু এবার গরীবদের জন্য কিছু করতে চান। দাতাকর্ণ হয়ে উঠবেন কিনা, সে বিষয়ে যদিও বলেন নি কিছু। কিন্তু এক ছোবলেই ছবি করে দেবেন বলে গেলেন।

ওদিকে রাজধানী দিল্লীর সীমান্তে এক ছোবলেই ছবি করার এক মহা পরিকল্পনার বিরুদ্ধেই সম্প্রতি গর্জে উঠেছে ভারতীয় কৃষক সমাজ। নতুন আনা তিন কৃষি আইন ২০২০’র দৌলতে কৃষকদেরকে এক ছোবলেই ছবি করে দেওয়ার বিশেষ পরিকল্পনাটি পাঞ্জাব হরিয়ানা পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ উত্তরাখণ্ড রাজস্থান মহারাষ্ট্র মধ্যপ্রদেশ কর্ণাটক বিহার সহ একাধিক রাজ্যের কৃষকরাই বুঝতে পেরে গিয়েছেন। তারা বুঝতে পেরে গিয়েছেন নতুন তিনটি কৃষি আইন কিভাবে কৃষক মজদুর সহ সাধারণ মানুষকে এক ছোবলেই ছবি করে দেওয়ার পথ তৈরী করতে চলেছে। আর বুঝতে পেরে গিয়েছেন বলেই তারা গর্জে উঠেছেন।

নতুন এই কৃষি আইন প্রণেতাগণ আশা করছেন, পশ্চিমবঙ্গের কৃষক মজদুর সহ সাধারণ জনগণ এখনো এই আইনের আসল উদ্দেশ্য ধরতেই পারেন নি। তারা সরকার প্রচারিত ফেক নিউজে অভ্যস্থ বলেই মিথ্যা প্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে কালো আইন প্রণেতাগণের পাশেই রয়েছেন। থাকবেন। আর জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখার মহাসভার সুউচ্চ মঞ্চ থেকে তাই তারা রাজ্যের বাঙালিকে সোনার বাংলা গড়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতেই মহাগুরুকেও সামিল করেছে। 
কিন্তু বিধি বাম। মহাগুরু মুখ ফস্কে আসল কথাটাই রাষ্ট্র করে ফেলেছেন। এক ছোবলেই ছবি। বলে ফেলেছেন তিনি জাত গোখরা। অর্থাৎ ভয়ঙ্কর বিষধর। সাধারণত বিষধরেরা বিষ ঢালবেই। যতক্ষণ না তাদের বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। ততক্ষণ তাদের বিষের থলি খালি থাকে না। আর সেই ভরা বিষের থলি নিয়ে বিষদাঁতে শান দিতেই মঞ্চ আলো করে রথী মহারথীরা মহাসভার আয়োজন করেছিলেন। আর তাদের বিষবাণী হৃদঙ্গম করতেই গড়ের মাঠে ভিড় উপচিয়ে পড়ছিল। মুহুর্মুহ জয়ধ্বনি দিতে দিতে। বেদের মোহন বাঁশির মতো সেই ধ্বনিতেই নতুন কৃষি আইন প্রণেতাগণ সহ মহাগুরুও নিশ্চয়ই বিমুগ্ধ চিত্তে বিহ্বল হয়ে উঠেছিলেন।

বিশ্বাস তাদের আরও সুদৃঢ় হয়ে উঠল আশা করাই যায়। গোটা ভারত যাদের বিরুদ্ধে খেপে উঠেছে। এই বাংলাই এবার তাদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠবে নিশ্চয়। বাঙালি সগর্বে বলতে পারবে। দেখো সারা ভারত তোমাদের ছুঁড়ে ফেলে দিলেও আমরাই তোমাদের কুড়িয়ে নিয়েছি। বাঙালির আত্মশ্লাঘাও নিশ্চয়ও আরও স্ফীত হয়ে উঠবে। সারা দেশে যাদের জায়গা হয় না, বাংলায় তাদের অবারিত দ্বার। এখনেই বাঙালির অপার মহিমা। তাতে নিজের পায়ে কুড়াল চালাতেও বাঙালি দ্বিধা করে না। ক্লাইভের অভ্যর্থনার দিনেও বাঙালি দ্বিধাহীন চিত্তে খাল কেটে কুমীর নিয়ে এসেছিল। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এটাই পাখির চোখ এখন নতুন এই কৃষি আইন প্রণেতা শিবিরের। বাঙালির ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁদের জ্ঞান ভাণ্ডার সত্যিই সমৃদ্ধ। আর সেই জ্ঞান ভাণ্ডারকে সম্বল করেই তাঁরা ২০২১ এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন জিততে এমন মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়েছেন। কারণ তাঁরা টের পেয়েছেন, রাজধানী ঘিরে বসে থাকা কৃষকদের মোক্ষম টাইট দিতে পশ্চিমবঙ্গ দখল একান্তই জরুরী। এই জয়ই তাদেরকে কৃষক বিদ্রোহ প্রতিহত করতে অক্সিজেন জোগাবে।

আর সেই মরিয়া প্রচেষ্টার মোক্ষম অস্ত্র হিসাবেই মহাগুরুকে উড়িয়ে নিয়ে আসা। এই বাংলায় গুরুর চেলাদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এক চেলা মানেই একটা পরিবারের সকলের ভোট। অংকটা সহজ। এই পথেই কেল্লাফতে করার স্বপ্ন দেখতে হচ্ছে এখন। কারণ পরিস্থিতি এমনই ডেলিকেট। কাউকে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। কারুর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি। বেকারদের কাছে শিল্প গড়ার প্রতিশ্রুতি। ধার্মিকদের জন্য ধর্মীয় শ্লোগান। বঞ্চিতদের জন্য সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখানো। বিশ্বাসীদের জন্য গরুর দুধ দুইয়ে সোনা পাওয়ার বিধান। আর বাঙালির ভাবাবেগকে মূলধন করতে মহাগুরুর হাতে দলীয় পতাকা তুলে দেওয়া। ভোট পেতেই হবে। যেভাবেই হোক। কোন উপায়ই যেন বাদ না থাকে। কিন্তু বিধি বাম। মহাগুরু মুখ ফস্কে সেই আসল গূঢ় সত্য প্রকাশ করে দিয়ে গেলেন। এক ছোবলেই ছবি।

বস্তুত বিগত সাত বছরের কেন্দ্র সরকারের সকল কার্যক্রম সুচারু ভাবে পর্যবেক্ষণ করলে এই আপ্তবাক্যটির গূঢ় অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব। লাখে লাখে কৃষকদের আত্মহত্যা। বেকার যুবক যুবতীদের চাকুরি না পাওয়া। হাজারে হাজারে চাকুরিজীবীদের ক্রমান্বয়ে বেকার হয়ে যাওয়া। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক লুঠ। জনগণের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা করের টাকায় শিল্পপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মকুব। লক ডাউনের সুযোগে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাজার হাজার মাইল পায়ে হাঁটিয়ে মেরে ফেলা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে দেশে দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা। এবং মহিলাদের উপরে নির্যাতনের সুনামি। ব্যাংকে জনসাধারণের আমানতের উপরে সুদ সর্বনিম্ন করে দিয়ে দেশব্যাপি অর্থলুঠের বিপুল কর্মযজ্ঞ। আবার সরকারের জনবিরোধী নীতিমালার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা জনকন্ঠের কন্ঠরোধে হত্যা ও মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার করার ধারাবাহিক পদ্ধতির সফল প্রয়োগ। মুহুর্মুহ ছোবলের এমন সর্বাত্মক ছবি স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অভুতপূর্ব।

আর সেই আসল কথাটিই প্রকাশ্য জনসভায় মহাগুরুর বেঁফাস মন্তব্যে মুখ ফস্কে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। এবং লক্ষ্মীয় মঞ্চে উপস্থিত রথী মহারথী গণের কেউই কিন্তু তাঁর এই বেফাঁস মন্তব্যের দায় নিতে অস্বীকার করে কোন বক্তব্য রাখেন নি। ফলে আমাদের ধরে নিতে অসুবিধা নাই। এক ছোবলেই ছবি করার এই রণহুঙ্কার মঞ্চে উপস্থিত সকল রথী মহারথীরই মনের কথা। এবং এই রণহুঙ্কারের সার্থক প্রয়োগই আমরা বিগত সাত বছর ব্যাপী ভারতশাসনের ধারায় প্রত্যক্ষ করে চলেছি। যে রণহুঙ্কার প্রতিহত করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েই দিল্লীর সীমান্তে পথ আঁকড়িয়ে পড়ে রয়েছে দেশের কৃষক সমাজ। এখন সেই এক ছোবলেই ছবি করার কার্যক্রম আমাদের রাজ্যেও প্রয়োগ করতে সরকারী ক্ষমতা দখলে উঠে পড়ে লেগেছে এই রাজনৈতিক শক্তি। মহাগুরু রং বদল করে যাদের কোল আশ্রয় নিয়েছেন সম্প্রতি। কেন তাঁর এই রং বদল। কেন তাঁকে এই ভাবে বিষধর বিষদন্ত প্রদর্শনী করতে হলো। কোন ব্যক্তিগত বাধ্য বাধকতায়। সেসব প্রশ্ন অবান্তর। আসল প্রশ্ন একটাই, রাজ্যবাসী এখন সাপের ছোবলে মাথা গলাতেই ইভিএমের বিশেষ বোতামে আঙুল ছোঁয়াবে, না কি বিষধর সরীসৃপদের হাত থেকে আপন রাজ্যকে রক্ষা করতে উপযুক্ত কার্বলিক অ্যাসিডের খোঁজ করতে শুরু করবে। বিষয়টা রাজ্যবাসীর মৌলিক অধিকারের বিষয়। সেই বিষয়ে পরামর্শ বা বিধান দেওয়ার দায় অন্য কারুরই নয়। আগামী ২রা মে জানা যাবে। রাজ্যবাসী এক ছোবলেই ছবি হওয়ার পথ বেছে নিল কিনা। কিংবা উপযুক্ত কার্বলিক আ্যাসিডের ব্যবস্থা করে রাজ্যকে বিষধর সরীসৃপদের থেকে রক্ষা করতে পারলো কিনা। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।


১৩ই মার্চ’ ২০২১
©কপিরাইট লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ