শনির বচন | বুদ্ধিজীবী সেলিব্রেটিদের’র বাজারদর

শব্দের মিছিল

সামনেই ভোট। বিধানসভা নির্বাচন আসন্ন। সারদা নারদা সিন্ডিকেন্ট কাটমানি তোলাবাজি ইত্যাদির দখল নিয়েই দুই পক্ষের ভিতরে জোর লড়াই। এক পক্ষ তাদের দশ বছরের অধিকার ছেড়ে দিতে নারাজ। অন্য পক্ষ সেই অধিকার কেড়ে নিতে মরিয়া। এক পক্ষের স্লোগান উন্নয়ন। অন্য পক্ষের স্লোগান রামরাজত্ব। এক পক্ষের অস্ত্র বহিরাগত তত্ব। অন্য পক্ষের অস্ত্র হিন্দুত্ব। এক পক্ষের অভিযোগ দাঙ্গাবাজির বিরুদ্ধে। অন্য পক্ষের অভিযোগ সংখ্যালঘু তোষণের বিরুদ্ধে। এক পক্ষের আস্তিনে মা ক্যান্টিন। অন্য পক্ষের আস্তিনে সিএএ। এক পক্ষ ঘোষণা করছে বাংলা ঘরের মেয়েকেই চায়। অন্য পক্ষ ঘোষণা করছে বাংলা ডবল ইঞ্জিন চায়। এক পক্ষ বলছে তোমরা আমাদের ভোট দাও আমরা তোমাদের সুরক্ষা দেবো। অন্য পক্ষ বলছে তোমরা আমাদের ভোট দাও আমরা তোমাদের নাগরিকত্ব দেবো। কিন্তু কোন পক্ষই মানুষের কাছে গিয়ে জানতে চাইছে না। মানুষ ঠিক কি কি চায়। অথচ দুই পক্ষই জানে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা এবং সেলিব্রেটিরা কি কি চায়। তাই দুই পক্ষেই তাদের অবারিত দ্বার। শুধু তাই নয়। অন্য পক্ষের হয়ে ওকালতি করা বুদ্ধিজীবীদের এবং সেলিব্রেটিদের নিজ পক্ষে টেনে নিয়ে আসার বিষয়ে আবার ডবল ইঞ্জিনের স্বপ্ন ফিরি করা শিবিরের উৎসাহ এবং উদ্দীপনা দেখার মতোন। বিপক্ষ শিবিরের সাংসদ বিধায়ক মন্ত্রীদের ভাঙিয়ে নিয়ে আনাই নয় শুধু। তাদের বুদ্ধিজীবীদের ও সেলিব্রেটিদেরও নিজ গোয়ালে ধরে নিয়ে এসে বেঁধে রাখার বিষয়েও তাদের শক্তি দেখার মতোন।

এবং এই বাংলার বুদ্ধিজীবী এবং সেলিব্রেটি। তাদের একটা বড়ো অংশই এই রাজনীতির কাজিয়ায় নিজের নিজের আখের গুছিয়ে নিতে মরিয়া। এই সেদিনও যে বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটি রাজ্য সরকারের ভ্রান্তনীতি, প্রশাসনিক অপদার্থতাগুলিকে ঢাকতে সান্ধ্য টিভির আসরে চিৎকারে কান ঝালাপালা করে দিতেন। ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দলের সকল অপকর্মের পক্ষে সওয়াল করতেন। তাদের একটা বড়ো অংশই এখন রং বদল করে অন্য পক্ষের ধামা ধরতে তাদের গোয়ালমুখো হয়েছেন। কেউ কেউ নির্বাচনী টিকিট পেয়েই ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে দিয়েছেন। এঁদের লক্ষ্য বিধায়ক পদ। এদের লক্ষ্য মন্ত্রীত্ব। নিজের নিজের পেশায় এঁরা কেউই আর সন্তুষ্ট থাকতে চাইছেন না। এঁরা জানেন রাজনীতি পেশা হিসাবে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও, কুবেরের ধনের আড়ত। কোন কোন বুদ্ধিজীবী কিংবা সেলিব্রেটি আবার বিগত দশ বছর আমের আঁটি চোষার মতোন নানান রকমের সরকারী সুযোগসুবিধা ভোগ করে এইবারে দলবদলের পর্বে সামিল হয়েছেন। অর্থাৎ তাঁদের কাছে খবর আছে, ক্ষমতার পাশা ওল্টাচ্ছেই। নাহলে সুখে থাকতে ভুতে কিলানোর কথা ছিল না।
এইবারের রাজ্য নির্বাচনে এক অভুতপূর্ব সাড়া পড়ে গিয়েছে। বিগত দশ বছরে ফুলে ফেঁপে ওঠা সাংসদ বিধায়ক মন্ত্রী থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী এবং সেলিব্রেটিরাও দলবদলের মিছিলে পা মিলিয়েছেন। এঁরা নিশ্চিত ক্ষমতা বদল হচ্ছেই। তাই ক্ষমতার বৃত্তে থাকতেই তাঁদের এই মিছিল। এক দলে থেকে সব সুযোগ সুবিধে ভোগ করে নিয়ে, এবার নতুন দলে যোগদান। কিন্তু মুখে তাঁদের একটিই বুলি। মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। সত্যই মানুষের জন্য একটি দিনও কাজ করতে না পেলে, এঁদের বড়ো কষ্ট। দমবন্ধ হয়ে মারা পড়বেন। মানুষের জন্য কাজ করাই তাঁদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন। আর মানুষের জন্য কাজ করতে দরকার ক্ষমতা। সেই ক্ষমতা সরকারে না থাকলে আর হাতে থাকবে কি করে?
সরকারে না থাকলে তো আর কাউকে কিছু পাইয়ে দেওয়া যায় না। আর কাউকে কিছু পাইয়ে দিয়ে কাটমানি জোগার করাই এই যুগে মানুষের জন্য কাজ। সেই কাজ কি শুধুই রাজনীতিবিদরা একচেটিয়ে ভাবে করে যাবে? বুদ্ধিজীবী এবং সেলিব্রেটিরাও সেই কাজ করতে সমান আগ্রহী। তাই তাদেরও নির্বাচনী টিকিট চাই।

রাজ্যের বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটিদের রাজনৈতিক দর দিনে দিনে ক্রমেই উর্ধমুখী। রাজনৈতিক শিবিরগুলিও এঁদের জনপ্রিয়তার উপরে বিশেষ করে নির্ভরশীল। এঁরা সেকথা বিলক্ষণ জানেন বলেই নিজেদের বাজারদর সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। তাই ভোটের মুরশুমে স্বভাবতঃই সেই দর আকাশ ছোঁয়া। কিন্তু তাতে কি। ভোটের বাজারে এদেশের রাজনৈতিক শিবিরগুলির অর্থের কোন অভাব থাকে না। তাই জলের মতো টাকা খরচ করতে এদের আপত্তির কোন কারণ নাই। বুদ্ধিজীবী সেলিব্রেটিদের সেটাই উপরি পাওনা। ফলে লাইন লেগেছে। নেতা মন্ত্রী সাংসদ বিধায়কদের পাশাপশি বুদ্ধিজীবী সেলিব্রেটিদের।

এই বুদ্ধিজীবী এবং সেলিব্রেটিরাই টিভি ক্যামেরার সামনে নীতি উপদেশ বাক্যে জনতাকে ধন্য করে থাকেন। যখন যে দলের পতাকার বাঁট ধরে থাকেন। তখন সেই দলের হয়ে কথা বলেন। এমন মসৃণ ভাবে বলেন, যেন শুনে মনে হবে নিজেরই জীবনদর্শনের কাহিনী শোনাচ্ছেন। সারা জীবনের অভিজ্ঞতার সার সত্য। যে শুনবে সেই ধন্য হয়ে যাবে। সেই একই বুদ্ধিজীবী সেলিব্রেটি আবার পাল্টি খেয়ে অন্য দলের পতাকার বাঁট ধরে ঠিক বিপরীত মতাদর্শের কাহিনী শোনাবেন। একই রকম মসৃণ ভাবে। দক্ষ অভিনেতা যেমন পরিচালকের নির্দেশিত চিত্রনাট্যের সংলাপ আউড়িয়ে যান। ঠিক একই রকম। যখন যে দলের ধামা ধরবেন। তখন সেই দলের রাজনৈতিক স্ক্রিপ্ট অনুসারে সংলাপ বলে যাবেন। এই বিষয়ে এঁদের দক্ষতা অভিনয়ের জগতে অস্কার পাওয়ার সমতুল্য।

রাজ্যবাসীও আজ এই বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটিদের চক্রব্যূহে আটকিয়ে পড়েছে। এঁদের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। যেখানে যাবেন। সেখানেই ভিড়। কে কি বলবেন। জানতে উৎসাহী জনতার অভাব নাই। টিভি খুললেই রাজনৈতিক নেতা নেত্রীদের পাশাপাশি এঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। এঁদের অনেকেই আবার সেই সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের আন্দোলনের হাত ধরেই পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছিলেন। শিল্প নয় কৃষি। এবার তাঁরাই সিঙ্গুর নন্দীগ্রামে শিল্প গড়ার পক্ষ নিয়ে গলা ফাটাবেন। সেই শিল্প যদি আবাসন শিল্পও হয়, কোন ক্ষতি নাই। যখন যেমন স্ক্রিপ্ট। তখন তেমন সংলাপ। লক্ষ্য অপরিবর্তনীয়। রাইটার্স, নয় নবান্ন। সরকারী ক্ষমতার শেয়ার। পরিবর্তনীয় শুধু রাজনৈতিক পতাকা প্রতীক ও রঙ।

এই যে রাজনৈতিক পতাকা প্রতীক আর রঙ। এর কোনটাই সাধারণ জনগণের জন্য নয়। এইগুলি রাজনীতির সাথে জড়িত নেতা নেত্রী, শিল্পপতি, ব্যাবসাদার, এবং বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটিদের জন্য। জনতাকে বশে রাখার মানদণ্ড। রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নেতানেত্রী ও ভাড়াটে বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটিদের দিয়ে এই পতাকা প্রতীক ও রং বহন করিয়ে জনতাকে বশে রেখে থাকে। জনতা বশে থাকলেই ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকবে। জনতা বশে না থাকলেই ক্ষমতা হাতছাড়া। যখন যে পতাকা প্রতীক ও রঙ যত বেশি মিথ্যে যত বেশি জোরের সাথে প্রচার করতে পারবে, ততবেশি পরিমাণে জনতাকে বশীভুত করে রাখতে সক্ষম হবে। এটাই ভারতীয় রাজনীতির আসল চিত্র। নির্বাচনী গণতন্ত্রের ভেতরের কথা। সেই গণতন্ত্রে বর্তমান সময়ে বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটিদের জন্য একটা প্রশস্ত অঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। জনতাকে বশে রাখার প্রচার কার্যে। এঁরা জানেন, কখন কোন ভঙ্গিমায় জনতাকে কব্জা করা যায়। সংলাপ ঠিক করে দেবে রাজনৈতিক দল। তাদের নিজস্ব স্ক্রিপ্ট অনুসারে। বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটিরা যোগ করবেন শুধু নিজস্ব ভঙ্গিমাটুকু। তাহলেই কেল্লাফতে। সংলাপ ও স্ক্রিপ্টের বদল ঘটবে। যখন যেদিকে হাওয়া, সেই অনুসারে। অপরিবর্তনীয় শুধু ঐ ভঙ্গিমাটুকু। যেটি বুদ্ধিজীবী ও সেলিব্রেটিদের নিজস্ব।

এই যে নিজস্ব এক ভঙ্গিমা। বুদ্ধিজীবী এবং সেলিব্রেটিদের। এটাই তাঁদের ইনভেস্টমেন্ট। এর দৌলতেই তাঁরা করে খাচ্ছেন এই বাংলায়। এই ভঙ্গিমা তখনই অর্জন করা সম্ভব হয়। যখন কেউ নিজস্ব মতাদর্শ বিসর্জন দিতে পারে। যখন কেউ আপন শিরদাঁড়া বন্ধক রাখতে পারে কোন না কোন রাজনৈতিক ক্ষমতার পায়ে। তখনই অর্জিত হয় এক নিজস্ব ভঙ্গিমা। যা দিয়ে মন ভোলানো সম্ভব জনতার এক বড়ো অংশকেই। দেশ গোল্লায় যাক। জাতি রসাতলে যাক। কিচ্ছু এসে যায় না। ইতিহাসে তাঁদের নাম মুছে যাক। ক্ষতি নাই। রাজনীতির বাজারে তাদের বাজারদর উর্ধমুখী রাখাই আসল কথা। যার মূল লক্ষ একটাই। আখের গুছিয়ে নেওয়া। আর কে না জানে আখের গুছিয়ে নেওয়ার কোন শেষ নাই। তাই যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ।

১৯শে মার্চ’ ২০২১
কপিরাইট লেখককর্তৃক সংরক্ষিত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ