■ শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় | ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যে

শব্দের মিছিল


রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দু নিয়ে জোরাজুরি, তার জেরে বাংলাভাষার দাবি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলন, ২১ ফেব্রুয়ারির ভাইয়ের রক্তে রাঙা ও দিনটির আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতির ইতিবৃত্ত সবার কমবেশি জানা। কিন্তু প্রচলিত আলোচনায় যে দিকগুলো অনুল্লেখিত থেকে যায়, সেই পটভূমির দিকে একটু তাকানো যাক।

১৯৪৭ সালে দেশভাগ তথা স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই পরেই করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশ করে প্রচারমাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের দাবি উত্তাল হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা থেকেই বাদ দেয়। সেই সঙ্গে মুদ্রা ও ডাকটিকিট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজ়লুর রহমান মালিক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর তড়িঘড়ি বিশাল প্রস্তুতি নিলে, তাতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি বিশাল ছাত্র-সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপিত হয়। এই লক্ষ্যে ঢাকায় চলে ছাত্রদের মিছিল ও সমাবেশ। সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেন যে, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ ‘নিরক্ষর’ ও যাবতীয় সরকারি পদের জন্য ‘অনুপযুক্ত’ হয়ে পড়বে। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয়।

এরপর ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন ‘গণপরিষদ’ (Assembly member​ ) সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ইংরেজিতে দেওয়া বক্তৃতায় পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু নাগরিকের ভাষা হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি তোলেন এবং সরকারি কাগজেপত্রে বাংলা অপসারণ করার কড়া প্রতিবাদ জানান। পার্লামেন্ট সদস্য প্রেমহরি বর্মণ, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত এবং শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানান। কিন্তু তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে পাকিস্তান গণপরিষদের (Constituent Assembly of Pakistan) সকল মুসলিম লীগ সদস্য এমনকি বাঙালী সদস্যরাও একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। খাজা নাজ়িমুদ্দিন সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, “পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক”। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের মতে প্রস্তাবটি পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা এবং লক্ষ কোটি মুসলমানের ভাষা হিসাবে “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবলমাত্র উর্দুই হতে পারে”। শেষপর্যন্ত সংশোধনীটি গণপরিষদের ভোটাভুটিতে বাতিল হয়ে যায়। সংসদীয় দলে আপত্তির কারণেই বাংলাভাষী মুসলিম সদস্যরা সেদিন ধীরেন্দ্রনাথের প্রস্তাবের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ সমগ্র পরিক্রমায় সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। শেখ মুজিবর রহমানের অন্যতম সহযোগী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর পুত্র দিলীপ কুমার দত্তকে পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনার ময়নামতী শিবিরে নৃশংস বর্বরতা সহ্য করে মরতে হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ভাষা আন্দোলনের প্রচলিত ইতিহাসে হিন্দু যোদ্ধাদের নাম খুঁজেই পাওয়া যায় না, যদিও বাংলাভাষার দাবি প্রথম তারাই উত্থাপন করেছিল বলে পাকিস্তানি সেনার অকল্পনীয় নৃশংসতা ও গণহত্যার শিকার হয়েছিল হিন্দু বাঙালীরাই।

যাই হোক, গণপরিষদে ঘটা ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বা তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের পড়ুয়াদের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস বর্জন করে। ২৯ ফেব্রুয়ারিও ধর্মঘট ঘোষিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ফজ়লুল হক’ হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশ-সভায় দ্বিতীয়বারের মত “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” (National Language Action Committee) গঠন করে ধর্মঘট কর্মসূচী গৃহীত হয়। সেইমতো ছাত্ররা ১১ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর সাহসী ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানায়।

এর জেরে চলে ব্যাপক ধরপাকড় ও অবদমন। ১১ মার্চ নেতাদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১২-১৫ মার্চ চলে টানা ধর্মঘট। বেগতিক দেখে ১৫ মার্চ ১৯৪৮ খাজা নাজ়িমুদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে বৈঠক করেন। দুই পক্ষের মধ্যে ৮ দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে গ্রেফতারকৃত বন্দীদের মুক্তি, পুলিশের অত্যাচারের নিরপেক্ষ তদন্ত, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম ও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া, সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সরকারের এই নমনীয়তার কারণ ছিল ১৯ মার্চ জিন্নাহ্'র ঢাকা আগমনের আগে পরিস্থিতি শান্ত রাখা। কিন্তু পাকিস্তানের স্থপতি ও গভর্নর জেনারেল মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ তাঁর প্রথম পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (অধুনা সোহ্রাবর্দি উদ্যান) তাঁর গণ-সম্বর্ধনায় বক্তৃতা রাখতে গিয়েই ঘোষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনও ভাষা নয়” [“State language of Pakistan is going to be Urdu and no other language]. খাজা নাজ়িমুদ্দিনের সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখান করে একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে রেডিও সম্প্রচারেও।

এই অসন্তোষের মধ্যে মওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’। ১৯৫০ সালের ৬ ডিসেম্বর এই কমিটি আবার ভাষা সংঘাত সমাধানের লক্ষ্যে এক বিচিত্র সুপারিশ করে – বাংলাভাষাকে আরবি হরফে লেখা। ভাগ্যিস ১৯৫৮ সালের আগে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। এই টানাপোড়েনে পেরিয়ে যায় দুই বছর। একদিকে পুলিস-প্রশাসনের বল প্রয়োগ, আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি; আর অন্যদিকে মুসলিম লীগের হামলা, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, মানবাধিকার হরণ। এই পরিস্থিতিতেই কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক – সমাজের সব স্তরের বাঙালীর মধ্যে অসন্তোষের বারুদ জমতে থাকে, যার বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি যখন পাকিস্তানের প্রথম বাঙালী প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজ়িমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে জিন্নার বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। ভাষা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূত্রপাত তখন থেকেই, যা শুধু পূর্ববঙ্গে মাতৃভাষার অধিকারই ছিনিয়ে আনে না, মুক্তিযুদ্ধের পথ ধরে জন্ম দেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির।​

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ