শনির বচন | শেষপ্রশ্ন

শব্দের মিছিল

আসুন নিজেকেই কয়েকটি প্রশ্ন করা যাক বরং। আমার কিংবা আপনার, যাদের ব্যাংক একাউন্ট রয়েছে। সেই একাউন্টে, ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সেই ১৫ লক্ষ টাকা এসে গিয়েছে তো? জানি, অনেকেই বলবেন তার আগে সুইজারল্যাণ্ডের ব্যাংক থেকে ৭৫ লক্ষ কোটি কালো‌টাকা উদ্ধার করতে হবে তো না’কি। খুবই সত্যি। তা বিদেশে গচ্ছিত ভারতীয়দের কালোটাকা ফিরিয়ে নিয়ে আসার সেই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিটির কি হলো? সাত সাতটি বছর তো অতিক্রান্ত হলো। দেশ আজকে ভক্তবৃন্দদের দখলে। তাই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আর দরকার নাই মনে হয়। ফলে সকলেই নিশ্চুপ। 

এবার আসুন নিজেদেরকে আমরা দ্বিতীয় বড়ো প্রশ্নটি করি বরং। বছরে দুই কোটি চাকরি দেওয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির কি হলো? বিগত সাত বছরে তো তাহলে চৌদ্দোকোটি বেকার যুবক যুবতীর সরকারী চাকরি হওয়ার কথা ছিল। কতজন সরকারী চাকরি পেয়েছেন ইতিমধ্যে? আর কত সহস্র সরকারী চাকুরিজীবীর চাকরি চলে গিয়েছে? আমি বা আপনি, সেই তথ্য জানি তো, ঠিকঠাক? উল্টোদিকে তাকিয়ে দেখি বরং। সেই দিকে, যে পথে দেদার সরকারী প্রতিষ্ঠান বিক্রী করে দিচ্ছে জনদরদী রাজনৈতিক শিবিরটি। লাখে লাখে সরকারী চাকুরিজীবীর পেশাগত জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ছে প্রতিদিন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করা না করা এক বিষয়। কিন্তু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাইরে গিয়ে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি জলের দরে বিক্রী করে দেওয়া অনেক বেশি ভয়াবহ বিপর্যয় না’কি? না’কি আমি বা আপনি এই বিশেষ ধরনের জনদরদী ক্রিয়াকলাপেই অধিকত লাভবান হলাম, হচ্ছি এই সাত সাতটি বছরে? আসুন না হয়, একটু বরং ভেবে দেখি। স্বাধীনভাবে ভাবতে তো এখনো যখন ট্যাক্স লাগে না কোন। 

এবার আসি তৃতীয় বড়ো প্রশ্নের সামনে। পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের দাম কমলো কতটা? এটা তো আমাদের মানতেই হবে, এই তিনটির দাম কমানোর ইস্যুটি ২০১৪ সালের নির্বাচনের অন্যতম মুখ্য বিষয় ছিল। যখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য আকাশ ছোঁয়া ছিল, তখনো কি এই তিনটির দেশীয় মূল্য এমন আকাশ ছোঁয়া ছিল? বিশেষ করে বর্তমানে তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য যখন সেদিনের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সেদিন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল পেট্রল ডিজেল রান্নার গ্যাসের অগ্নিমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের উপরে করের বোঝা লাঘব করা। আর আজকে তেলের উপরে অতিরিক্তের অতিরিক্ত কর বসিয়ে জনগণকে দেশহিতার্থে অংশগ্রহণের বাণী শোনানো হচ্ছে। এই বিপুল করের টাকা নাকি দেশের ভালোর জন্যেই সংগ্রহ করা হচ্ছে। যখন দেশবাসী দেশের ভালো করার আসল সত্যিটা জেনে গিয়েছে। রাজকোষের টাকা বিশিষ্ট কয়েকজন শিল্পপতির হাতে ভাগ করে তুলে দেওয়াই বর্তমানে দেশের ভালো করার দর্শন। আসুন তাহলে নিজেকেই প্রশ্নটা করি। এবার খুশি তো? 

চতুর্থ বড়ো প্রশ্নটা হয়তো সব প্রশ্নের আধার। ২০১৪’র নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, সাংসদ বিধায়ক পুরসভার চেয়ারম্যান পঞ্চায়েত প্রধান প্রভৃতি যে সকল জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা ঝুলে রয়েছে, সেগুলির দ্রুত নিস্পত্তি করে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। এবং পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে অভিযুক্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নির্বাচনে দাঁড়াতে না দেওয়া। আমাদের মনে রাখতে হবে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরপরেই ২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের ৩৫%-এর বিরুদ্ধেই চলছিল নানবিধ ফৌজদারী মামলা। আর এরপর ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের ৪২% ই নানবিধ অপরাধে বিচারাধীন। ফলে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ উল্টো পথে হেঁটে লোকসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভিতরে অভিযুক্ত অপরাধীদের শতাংশের হার রীতিমত বৃদ্ধি পেয়েছে। এবং সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক শিবিরের ১১৬ জন সাংসদের নামও রয়েছে এই তালিকায়। ফলে বিগত সাত বছরে লোকসভায় যে সকল আইন পাশ হয়েছে, তাতে এইসকল ফৌজদারী অপরাধে অভিযুক্তের হাতও রয়েছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এইটি কতটা শুভ এবং প্রয়োজনীয়, সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আমি আপনি নিজেদেরকে করেছি কি কখনো? কোনদিন? একটি গণতান্ত্রিক দেশের আইনসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভিতর আইনভঙ্গের অপরাধে অভিযুক্তের শতাংশের হার এই হারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকলে, সেটি দেশ ও দেশবাসীর পক্ষে কতটা স্বস্তিজনক সেটিও কি ভেবে দেখার সময় আসেনি আজও? 

পঞ্চম প্রশ্নটিও এই ফাঁকে করে নেওয়া যাক বরং। নানবিধ আইনভঙ্গের অপরাধে ফৌজদারী আদালতে অভিযুক্ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই যদি রাষ্ট্রের আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে তবে আমি এবং আপনি কতটা নিরাপদ?

ষষ্ঠ বড়ো প্রশ্নটি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নিয়ে। বিগত সাত বছরে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যেভাবে পোশাক দেখে মানুষ চেনার ফর্মুলায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজ হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও দাঙ্গা লাগানোর বিষয়ে যে বিদ্বেষ বিশেষ কার্যকরি, সাম্প্রদায়িক সেই বিদ্বেষ আমাকে আমাকে কতটা আনন্দ স্বস্তি ও পরিপূর্ণ তৃপ্তি দিচ্ছে। আমরা খুব খুশি তো? পড়শির ঘরে আগুন লাগালে নিজের ঘর আলোকিত হবে তো? আসুন না হয়, একটিবার এই প্রশ্নটিও করি নিজেকে। 

সপ্তম প্রশ্নে আসুন একটি বার অযোধ্যা ঘুরে আসি। রামমন্দির হচ্ছে। খুব সুখের কথা। নব্বইয়ের দশকে এই রামমন্দির নির্মাণের কাজে ভারতব্যাপি ১৪০০ কোটি টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। এবারে আবার দেশজুড়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা তোলার কাজ শুরু হয়েছে রামমন্দিরের নামে। এতটাকার সঠিক হিসাব আমি আপনি নিশ্চয় রাখবো না কি বলেন। ফলে এই প্রশ্নটিকে অপ্রাসঙ্গিক ভেবে নিতে অসুবিধা নাই। 

এবারে অষ্টম প্রশ্নের কথা ভাবতে গিয়ে জানা গেল, বিগত দুই লোকসভা নির্বাচনে যে কৃষকরা বিপুল ভোটে বর্তমান সরকার গড়তে সাহায্য করেছিল, তারাই এই সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথ জুড়ে অবস্থান আন্দোলনে সামিল তিন মাসব্যাপী। এবং তাদের প্রতিদিনের স্লোগান সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। কারণ তাদের কাছে সাত বছরের সব রহস্য ফাঁস হয়ে গিয়েছে। লক্ষ লক্ষ কৃষকের আত্মহত্যার উপরে বসে থাকা সরকারকে তারা আর সহ্য করতে রাজি নয়। জানি আমরা কেউ কৃষক নই। কৃষকদের আন্দোলনে আমাদের কি এসে যায়। কিন্তু কৃষকরা যে কয়টি আইনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। সেই আইনগুলিই আমাদের নিত্যদিনের বাজার খরচ বাড়িয়ে দেবে বিপুল ভাবে। সেই সমস্যাটি আমরা সামাল দেবো ঠিক কিভাবে?  আমি এবং আপনি। আমরা নিজেদের কাছে এই সহজ প্রশ্নটিও কি ঠিকমতো রাখতে পারছি? 

না, প্রশ্নের শেষ নেই। কত আর প্রশ্ন করা যায় নিজেকে? ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের অর্থ সরকারের পেয়ারের দোস্তরা হাপিস করে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। সরকার জনগণের আমানতের উপরে সুদ কমাতে কমাতে ক্রমশ শূন্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সৎ পথ আয় করার উপায়গুলি দিনে দিনে সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সরকারী সম্পত্তি জলের দরে বিক্রী হয়ে যাচ্ছে বিশেষ কয়েকজনের কাছে। এবং সরকারের কাজের সমালোচনা করার সাংবিধানিক অধিকারগুলিও অবরুদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ ও মিডিয়া দিয়ে। ফলে প্রশ্ন করতে বসলে নতুন একটি চিত্রগুপ্তের ফাইল তৈরী হয়ে যাবে। তাই হয়তো আমি এবং আপনি কোন প্রশ্নেরই সম্মুখীন হতে রাজি হই নি এই সাত সাতটি বছরে। সে পুলওয়ামা কাণ্ডই হোক আর রাফায়েল কেলেংকারিই হোক। দিল্লীর দাঙ্গাই হোক আর লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকদের হাজার হাজার মাইল পথ হাঁটাই হোক। অসৎ মিডিয়ার দাপাদাপিই হোক আর সাংসদদের দূর্নীতিই হোক। নির্বাচনী মিথ্যা প্রতিশ্রুতিই হোক আর জনসভায় নেতামন্ত্রীদের মিথ্যাচারই হোক। দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের ক্রনোলজিই হোক আর শিল্পপতিদের স্বার্থে চৌকিদারী করা ব্যক্তি বিশেষের জনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতাই হোক। 

আমরা আসলে প্রশ্ন করতেই ভয় পেতে শুরু করে দিয়েছি। কারণ আমরা দেখছি। যারাই প্রশ্ন করছেন। তাদেরকেই মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত করে জেলের ঘানি টানিয়ে ছাড়া হচ্ছে। তা সে কবি ভারভারা রাওই হন আর ডাক্তার কাফিল খানই হন। সাংবাদিক পুনিয়াই হোক কি এক্টিভিস্ট দিশা রভিই হোক। তাই আপনিও জানেন আমিও জানি। আমরা আসলে সকলেই আজকে ভীত এবং সন্ত্রস্ত। আমরা টের পেয়ে গিয়েছি এক বীভৎস শক্তির কাছে আমরা আজ নতজানু হয়ে রয়েছি। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম। এমনকি বিচার ব্যবস্থাও এই শক্তির দম্ভের কাছে নতজানু আজ। ফলে সাধারণ মানুষ আজ আর প্রশ্ন করে গণপিটুনির স্বীকার হতে রাজি নয়। দেশপ্রেমের নামে গণধো‌লাইয়ের নতুন এক সামাজিক সংস্কার গড়ে উঠেছে গোবলয় জুড়েই। সাথে দেশভক্তির নামে বুদ্ধিজীবীদেরও শিবির বদলের হিড়িক পড়ে গিয়েছে। সাধারণ মানুষ এই সোজা সত্যিটাকে আর অস্বীকার করতে পারছে না। তাই আজকে সাম্প্রদায়িক না হলে দেশপ্রেমিক হওয়া যাচ্ছে না। অন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়ালে দেশভক্তির নিদর্শনও রাখা যাচ্ছে না। 

বিগত সাত বছরের ভারতবর্ষের এই নতুন রূপকাররা এইবার বাংলার দিকে নজর দিয়েছেন। বাংলাকে তাদের সাধের গোবলয়ের সাথে সংযুক্ত করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের স্লোগান হয়ে উঠেছে সোনার বাংলা গড়ার ডাক। ২০১৪ সালের সকল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মতো এই সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতিও যে একই ফল প্রাপ্ত হবে। সেবিষয়ে কোন বাঙালিরই বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে অভ্যস্ত একটি জাতি যে সেই মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতেই মজবে, সে আর সন্দেহ কি। তাই এই মুহুর্তের প্রশ্ন একটিই। মিথ্যা প্রতিশ্রুতির এই অশ্বমেধ ঘোড়া থামবে কবে? থামাবে কে? আসুন নিজের কাছে, নিজেদের কাছেই রাখি বরং এই শেষ প্রশ্নটি। 

- ২৭শে ফেব্রুয়ারী’ ২০২১

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ