চিত্রাভানু সেনগুপ্ত

শব্দের মিছিল

অবিশ্রান্ত পার হয়ে চলা দীর্ঘ প্রসারী পথে কেটে গেছে প্রায় তিনটি প্রহর। শ্রান্ত দিনমণি আধারোজ ক্ষয়ে ঢলে পড়েছে উন্মুক্ত নভোলোকের অপর পারে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা বোধে ক্লিষ্ট কলেবর , তবু মনে হয়, এই পথের শেষ নেই। এই বন্ধনহীনা প্রকৃতি প্রতি পলে বদলে দিয়েছে তার বৈচিত্র , বদলে দিয়েছে মাটির রঙ, হেরফের ঘটেছে মানুষের কথার ধরনে , জীবিকায়, গাছে-গাছে লতায়-পাতায় প্রকারন্তর ঘটেছে, পাল্টে গেছে শস্য ক্ষেতের ধরন, চোখ জুড়িয়েছে বিপুলা ধরনীর সৌন্দর্য মহিমায়, কোথাও বা চিরসতেজ চিরচঞ্চলা বসুধা তার লাবণ্য উজাড় করে চিরতরে বাঁধতে চেয়েছে , তবু থেমে থাকা যায়নি। অচেনা গন্তব্যটি যত নিকটবর্তী হয়েছে, প্রকৃতির সুচারু শোভাবিন্যাসে চিত্তকে মোহিত করে তুলেছে , বুকের উপর চেপে বসা বহু পুরাতন পাষাণ খন্ড ধীরে ধীরে লঘু হয়েছে । আজকের যাত্রাপথের ধকলটা তাই ততটা মালুম হচ্ছে না। সরোজিনী বলে উঠলো....."পথ যে আর শেষ হয়না বাবা, কত দূর যাবো আমরা?" কন্যার শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে রামকানাই-এর বড় মায়া হল, বললেন....."তোর খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না মা?"

__"কই না তো! কেবল কখন পিসিমনির সাথে দেখা হবে,এই ভেবে মনটা বড্ড উতলা হচ্ছে বাবা।"

রামকানাই কন্যার চোখের ভাষা বোঝেন, তার এমন অন্তর্মুখী স্বভাব বারে বারে কানাইয়ের মনকে নাড়া দেয়। হাজার কষ্টেও মুখ ফুটে নিজের চাহিদা সে বলতে শেখেনি। কন্যার এই স্বভাব কখনো রামকানাই-এর মনে অতুল সুখের অনুভুতি দেয়, কষ্টও দেয় কখনো। তিনি হেসে বললেন......"আর তেমন দেরি নেই, দুর্গাপুর থেকে বাসে করে এই সামনেই সনুক পাহাড়িতে নামবো, তারপর টোটো করে সোজা জামবনী গ্রাম।​

সবুজের শ্যামলীমা ঘেরা ক্ষুদ্র একফালি গ্রাম বাঁকুড়ার জামবনী । গাঁয়ের চারিদিকে ছড়িয়ে কেবল শাল, পলাশ, ইউক্যালিপ্টাসের বনভূমি আর তার মনোহর প্রাকৃতিক শোভা। অতি স্বল্প তার পরিসর, অল্প তার জনবসত , সীমিত তার প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, তবু এই গাঁয়ে মিলে মিশে আছে হরেক প্রজাতির মানুষ । ভিন্ন তাদের আচার তবুও তাদের একে অপরের প্রতি আন্তরিকতার তুলনা হয়না। গাঁয়ের একটা বিরাট অংশের জীবিকা গড়ে উঠেছে বনজ দ্রব্যের উপর ভিত্তি করে। গাঁয়েরই এক কোনায় বাহান্ন কাঠা জমির উপর এক মহৎ উদ্দেশ্যে ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে আশ্রম ( চিত্তে মায়া কাজল), যার একমাত্র উদ্যোক্তা আর মালকীন হলেন আলো পিসি অর্থাৎ ( আলো দাশগুপ্ত, সরোজিনীর পিসিমনি)। সম্পর্কে তিনি রামকানাইয়ের আপন বোন নন, তবে অনেক আপন মানুষের থেকে কমও নন কিছু। আলো স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষিকা, গ্রামিন অনগ্রসর শ্রেনী এবং বৃদ্ধ মা ও বোনেদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করছেন তাঁর আশ্রম । তাঁর চিন্তার আওতা থেকে বাদ পড়েনি এই সমাজের পঙ্কিলতা থেকে উৎপন্ন অবাঞ্ছিত অনাথ শিশুরাও। নিজের গচ্ছিত কিছু অর্থ আর সামান্য কিছু আর্থিক অনুদানের উপর নির্ভর করে প্রতিদিন একটু একটু করে গড়ে উঠছে তাঁর সাধের স্বপ্নপূরী।

অস্থির চিত্তে উঠানের সিঁড়ির কাছে বসে একনাগাড়ে পথের দিকে তাকিয়ে আছেন আলো। দূর থেকে রামকানাই আর সরোজকে বাড়ির দিকে এগোতে দেখে ছুটে বের হলেন। বললেন......"এবার একটা মোবাইল নাও রাঙাদা। পৃথিবী কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেল, তুমি একটা মোবাইল কিনতে পারলে না? তোমাদের দেরি দেখে আমি চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। পবিত্রকে অন্ততঃ একশো বার ফোন করেছি।"

রামকানাই হেসে বললেন__"তুই ভাবলি রাঙাদা এই ফাঁকে বুঝি হারিয়েই গেল, তাই তো?"

__" ওমা! তা কেন নয় ? শেষ কবে এসেছিলে বোনের বাড়ি মনে পড়ে ? তাও এখানে আসোনি। এসব জায়গা এখন কত পাল্টে গেছে রাঙাদা, একসময় এখানে......"

__"পিসিইমনিই!!" ( মিষ্টি সুরেলা গলায় ডেকে, পেছন থেকে আলোর গলাটা আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো সরোজ)।

__"ওরে ওরে সোনা মা আমার ! কেমন আছিস সোনা?"

__"এটা কি হল? তুমি তো আমাকে চিনতেই পারছো না দেখছি , একটাও কথা বললে আমার সঙ্গে? রাস্তায় আসতে আসতে আমি কেবল তোমার কথা ভেবে উতলা হচ্ছিলাম, বাবা একটুও তোমার কথা বলেনি। সত্যি বলছি! জিজ্ঞেস কর বাবাকে!"

__"তাই? জানিতো। ওই জন্যই তো তোকে এতো ভালোবাসি। আরে আমি তো তোর জন্যই এতো উতলা হচ্ছিলাম। "

কথা বলতে বলতে ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন তাঁরা....

__"চল্ , ঘরে গিয়ে একেবারে হাত পা ধুয়ে নে, তারপর একটু খেতে খেতে অনেক গল্প করবো।"

আলো ঘরের ভেতরে হাঁক দিয়ে বললেন__" মালাআ ! কাটা তি আয়ুব দা দে।"( হাত পা ধোওয়ার জল দে)

দরজার পাশ থেকে এক পল্লিবধূ উঁকি মেরে বলল__" নিদ গিলাং ইমাম কানা।"( এখনি দিচ্ছি)

সরোজ অবাক হয়ে চোখ গোল গোল করে বলল__"ওওমা! একি ভাষা? কি বললে পিসিমনি বুঝলাম না তো?"

__" এখানকার আদিবাসীদের ভাষা।"

__"অ্যাঁ ! তুমি ওদের ভাষা বলতে পারো? "

__"ওদেরকে নিয়েই তো আমার কাজ রে মা! ওদের ভাষা বুঝবো না?"

সরোজ অসহায় মুখ করে বলল __"তাহলে কি হবে? আমরা তো এসব বলতে পারিনা।"

__"তোর চিন্তা নেই, ওরা সবাই আমাদের ভাষাটা বোঝে আর বলতেও পারে। এতো মিষ্টি , সহজ আমাদের বাংলা ভাষা , তাকে বুঝবে না, জানবে তাই হয় ? তুই তোর ভাষাতেই ওদের সঙ্গে কথা বলবি। "

__" কি সুন্দর কি মিষ্টি ভাষা পিসিমনি, আমায় শিখিয়ে দেবে?"

_" আচ্ছা সে হবে ক্ষণ। এখন ঘরে চল তো! ইচ্ছে আছে বিকেলের দিকে তোমাদের আমার আশ্রমে নিয়ে যাবো রাঙাদা। "

#

সারাটা দিন ধকল নিতান্তই কম ছিলো না। দুপুরের খাওয়ার শেষে সরোজ সেই যে বিছানায় গা এলিয়েছে, সন্ধ্যের আগে আর শরীরের ক্লান্তি পুরোপুরি কাটেনি। আলস্য ভরা চোখদুটো বুজে একপাশ ফিরে একটু ঝিমিয়ে নিচ্ছে সরোজিনী। ঘুম জড়ানো চোখেই বাইরের ঘর থেকে পিসিমনি আর বাবার কথা কানে বাজলো।

__"তুমি অহেতুক বড় চিন্তা করছো রাঙাদা। সরো কি আমাদের সেই মেয়ে যাকে নিয়ে তোমার ভুল চিন্তা হতে হবে? ওকে সময় দাও একটু। বিশ্বাস রাখ, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।"

__"চিন্তা করি কি সাধে? এই কটা দিন আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। একটা কথাও বলেনি কখনো। কোন রাগ, অভিমান, দুঃখ কিচ্ছুটি না । মনে কি চলে তাই তো বোঝা যায়না।"

বোঝা গেল সরোজ কে নিয়ে ঘরের সকলেই একটু চিন্তিত। আলো একটু ভেবে বললেন......

__"আচ্ছা রাঙাদা, ওকে তুমি কটাদিন আমার কাছে রেখে যাওনা কেন? এখানকার মানুষ, আশ্রমের মেয়েগুলো, এদের সঙ্গে কটা দিন থাকুক। ওর সামনে একটা নতুন জীবনের দিকে খুলে যাবে, দেখ রাঙাদা, ও ভালো থাকবে। কি বল? রাখবে? "

__"সরো কি থাকতে চাইবে? ওও তো আমায় ছাড়া...."

__"ও তোমায় ছাড়া থাকেনি নাকি তুমি ওকে ছেড়ে থাকোনি বলতো?"

__"আচ্ছা বেশ তো! তুই বলে দেখ, যদি রাজি হয়......"

কথা চলা কালিন কখন যেন দুই ভাইবোনের মাঝে ঢুকে বসলো সরোজ। শারীরিক অবসন্নতা যে এখনো পুরোপুরি কাটেনি সে বেশ বোঝা যাচ্ছে। সেই সময় ঘরে আরো এক মাঝবয়সী প্রৌঢ় হাজির হয়ে বলল......"আজ রাতে কি রান্না হবে মা?"

সরোজিনী একটু অবাক হও আর অছিলায় হঠাৎ সেই প্রৌঢ়ের সাথে আলাপ জুড়ে দিলো। বলল....

__"দাদা, তুমি বাংলা বলতে পারো?"

প্রৌঢ় একগাল হেসে কেমন মাথা নাড়লো। সরোজিনী আবার বলল__" তোমার নাম কি দাদা?"

__"মধুসূদন মুর্মু।"

__"বেএশ! তাহলে বরং আমি তোমায় মধুদাদা বলে ডাকবো।"

প্রৌঢ় আবার মাথা নেড়ে সায় দিলো।

সরোজ বলল......"তুমি বুঝি কথা বলনা? বড্ড রাগি?"

__"কই না তো!"

__"তাহলে কথা বলছো না কেন? তুমি সেই ভাষাটা জানো?"

__"কোনটা?"

__"সেই যে গো, আদিবাসি ভাষা। পিসিমনি যেটা বলতে পারে।"

মধুসূদন আবার ঘাড় নাড়লো। সরোজ বলল...."ফের তুমি মাথা নাড়লে? কথা বলতে হবে । বলবে তো? নাহলে এবার বড্ড রেগে যাবো আমি।"

মধুসূদন হেসে বলল__"আচ্ছা বাবা আচ্ছা! এই এত্তো কথা বলবু।"

সরোজ নিজের দুই বাহুকে প্রসারিত করে বলল.... এইটুকু নয়, এই এত্তো কথা বলতে হবে কেমন?

মধু আবার মাথা নাড়লো।

__"আচ্ছা মধুদাদা, তুমি রান্না কর?"

__"হুঁ,"

__"আজ তুমি আমাদের কি খাওয়াবে?"

__"বনমোড়গের ঝোল, ডাল, আলু চোখা আর ফুলকপির তরকারি।"

__"সকালের রান্না তুমি করেছিলে?"

__"হ্যাঁ।"

__" কি ভালো রা রেধো তুমি মধুদাদা, আমায় তুমি একটা রান্না শেখাবে?"

__"তুমি বুঝি রাঁধতে পারোনি"

__"পারি, অল্প অল্প। আচ্ছা আমি যা পারি তোমায় শেখাবো, তুমি ভালো কটা ভালো ভালো রান্না আর তোমাদের সেই ভাষাটা আমায় শেখাবে কেমন?"

মধু দাদা এক গাল হেসে আবার মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। বহুদিন পর আজ আবার আগের মত হাসছে সরোজিনী। কন্যার হাসি মুখটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে রামকানাইয়ের চোখদুটো কখন যেন জ্বালা করে উঠলো।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ