উত্তম বিশ্বাস

শব্দের মিছিল

মাধুকরী হাসির গল্প প্রতিযোগিতা  ২০২১
★দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা গল্প★

“যাত্রা যাত্রা যাত্রা! আর দেরি নয়! আর কাল বিলম্ব নয়! আগামী শনিবার রাত্রি ঠিক নয় ঘটিকায়​ সুটিয়া-চাকলা প্রাথমিক বিদ্যালয়​ পার্শ্বস্থ​ ফুটবল​ ময়দানে মঞ্চস্থ হতে চলেছে কলিকাতার অগ্রগামী অপেরার এবছরের সাড়া জাগানো যাত্রাপালাআআআ, পাগলা স্বামীর ঘররররররররররররর!”​ ​

অটোটা রোজ ধুলো উড়িয়ে চলে যাচ্ছে!​ ভাইটা বড্ড​ বেবোধ! ও​ ​ অটোর​ পেছন পেছন হুতোশে দৌড়ায় আর হ্যাংলার মতো হলুদ রঙের লিফলেট কুড়িয়ে​ ঘরে এনে ডাঁই করে রাখে!​ কিন্তু আমি থাকি​ অন্য তালে। মাঠে টিন বাঁশ পড়লেই​ আমি আমার​ মতো মাপজোক শুরু করে দিই।​ বিনি পয়সায় পদ্মাবতীকে পেতে হলে গর্ত একখানা কাটতেই হবে এটুকু জানি!

​আমি সোম, অর্থাৎ সোমসুন্দর বিশ্বাস। আর আমার পিঠোপিঠি হয়েছিল বলে ভাইয়ের নাম ভোম। ও খোন্তা কোদাল ছাড়াই শক্ত মাটিতে দারুণ গর্ত তৈরি করতে পারে। কিন্তু ওকে দিয়ে আমার বিশ্বাস নেই। এর আগেও দুদুটো যাত্রাপালা ওর জন্যে ফসকে গেছে!​ কারণ একটাই আমার পেট! আমার মাপে গর্ত কাটতে পারেনা ভোম। ওর ওপর যতবারই গর্ত কাটবার দায়িত্ব দিয়েছি, আমার পেটে এসেই আটকে গেছে!​ এইজন্যে​ কোথাও ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে শুনলেই​ মায়ের লোহার খুন্তিটা কাপড়ের তলায় গুঁজে নিই। কেউ দেখতেও পায়না। কেননা কনকনে শীতে মা আমাদের গলায় ধুতি কাপড় ভাঁজ করে বেঁধে দেয়।​ গলার নলী থেকে পায়ের পাতা অব্দি এক্কেবারে সিল!

তখনকার দিনে যাত্রা মানেই জ্বর! দেখতে না পারলেও জ্বর! দেখে এলেও আরেক জ্বর! অর্থাৎ পয়সা থাক আর না থাক, কোনমতেই মিস করা যাবেনা!​ সবুর সইবার আগেই শনিবার এসে হাজির হল। এবার পলক ফেলার আগেই পুরো মাঠখানা​ আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে!

আজ আমি দুবার​ ভুট হলাম। ভোম একবার চিৎ হল। ভোম গলে গেলেও আমার পেটের দিকটায় সেই আবার আটকে গেল! ভোমকে বললাম, “আরেকটু মাটি তোলনা ভাই!”

পাশ থেকে রাবিয়ার মা রে রে করে ধেয়ে এল, “আরে এই হারুংখুরের পাল, উকেনে গত্তো করে মরচিস ক্যান?”

জায়গাটা নরম আর ভিজে ভিজে। এই জায়গায় বসে রাবিয়ার মা রস বেঁচে। এর আগেও পৌষমাসে দুখানা পালা হয়ে গেছে। রাবিয়ার মা এখান থেকে মোটে নড়েনা। ওকে সরাতেই হবে। নইলে এবার পাগলা স্বামীকেও আমরা দেখতে পাবনা! তাড়াতাড়ি গর্তটা আলত করে বুজিয়ে দিয়ে ওখান থেকে আমরা কেটে পড়লাম।

বিকেলে মোটে কান পাতা যায়না!​ ​ গ্রামের চৌদিক ফেড়ে ঘোষণা ভেসে আসছে, “পাগলা স্বামীর ঘর ঘর ঘর​ ...!”​ ​ হঠাৎ হৈচৈ! ছুটে গেলাম। দেখি রাবিয়াদের উঠোনে মানুষ গিজগিজ করছে! গোলাম গাছ-কাটা দা নিয়ে বউকে তাড়া করেছে। প্রাণে বাঁচতে রাবিয়ার মা ঝাঁপ দিয়েছে নদীতে! শীতেও​ নদীতে​ বুক সমান জল।​ ​ ওর মধ্যে দাঁড়িয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপছে আর কাকুতি মিনতি করছে, “এমা! কী পাগলের পাল্লায় পড়লাম বল দিকিনি!”

“আমার ছয় গণ্ডা ভাঁড় ফাটিয়েছিস! তোকে আজ মেরেই ফেলব!”

দুপুরে গোলাম​ মিয়াঁ​ রাবিয়ার মাকে বলে গিয়েছিল,​ ভালকরে ভাঁড় পোড়া দিতে। নতুন ভাঁড়। পোড়া দিয়ে লাল করে তুলতে হবে,​ নইলে​ জিরেন রসের আসল মজা পাওয়া যাবেনা!​ বাবুরা খাবে, তদবির করতে লাগবে অনেক!​ সেইমতো রাবিয়ার মা বাগান থেকে শিরিশপাতা পল বিচালি ঝাঁটলে মাটি জড়ো করে ভাঁড়গুলো ওপরনিচ ভালকরে সাজিয়ে আগুন দিয়েছিল। ওমা! যেইনা​ ধোঁয়ায়​ একটু বেগ পেয়েছে,​ অমনি ফটাস ফটাস করে ভাঁড় ফাটতে লাগল! মানুষ তো রীতিমত ভয় পেয়ে গেছিল!​ ভাবল, “ওই বুঝি বা বর্ডারে গুলিগোল্লা শুরু হয়ে গেল!”

কেউ​ বলল, “কৌটো বোমা ফাটছে!”​ গরু ধরা পড়লে বিএসএফ​ কে ভয় পাইয়ে দিতে,​ গরু পাচারকারীরা এমনিতেই এসব ফাটায়। কেউ গোলামকে শান্ত করতে পারছিল না। হঠাৎ রাবিয়ার মা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে পানির নিচে তলিয়ে গেল।

হারানের মা চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাদে হেই মিনসে, দেগগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলি ক্যান?​ বউটা মরে যাবে তো!​ ধর গিয়ে!”

গোলাম আবারও উষ্মা উড়িয়ে বলল, “মরুক মরুক মরুক!”

“মরুক আগে, তোকে ঢেঁকিতে ফেলে গাব কোটা কুটে​ ছাড়ব​ বলে দিলাম!”

গোলাম ঝাঁপ দিল। অনেকটা ঘোলা শ্যাওলা আর কচুরিপানা মাখিয়ে রাবিয়ার মাকে​ বঁড়শিবিদ্ধ বোয়ালমাছের মতো করে জল থেকে টেনে তুলল!

হারানের মা হৈ-জকার দিয়ে উঠল, “ওরে, কিডা কনে আছিস পেটে চাপ দে! জল খেয়েছে মেলা!”

কেউ একজন রাবিয়ার মায়ের পেটের কাপড় আলগা করতেই গোলাম বাধা দিল, “এই গুঁটি, তা উঠে মর! পেটে কচি রয়েচে সে খেয়াল নেই?”

“উঁহু এই বয়েসেও রস তুমার কমতি নেই!” হারানের মা গোলামের ওপরে আক্ষেপ উগরে দিয়ে রাবিয়ার মায়ের এলানো খোঁপাটা আঁটি পাকিয়ে দিল!

আরক্তিম মুখ আর চোখে ঘোলা নিয়ে রাবিয়ার মা উঠে বসল। আর ঠিক এইসময়​ বাংলাদেশের ওপার​ থেকে ভেসে আসতে লাগল​ আসেরের আজান,“আ সাধু আল্লা হু আক্বরররর...!”

​এখন সবার মুখে মুখে একটাই কৌতূহলী জিজ্ঞাসা, “এতো বাজি কনথে এল?”

আমি ভয়ে ভয়ে ভোমকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কালী পটকাগুলো তুই তাহলে...?”

ভোমের চোয়াল শক্ত হয়ে এল! কোনও জবাব দিলনা।

তখনও আটটা বাজেনি। ভোম গায়ে জড়িয়েছে মায়ের শাড়ি। আর আমি ভাঁজ করে গলার সাথে গিঁট দিয়ে পরেছি বাবার সেই পুরোনো ধুতি। এটাই আমাদের চাদর। টিনের ফাঁকে চোখ লাগিয়ে দেখে নিলাম প্যাণ্ডেলের পরিস্থিতি। নাহ! লোক এখনো সব এসে পৌঁছায়নি! প্যাণ্ডেলের অনেকটা খালি। মঞ্চে ধাঁধা লাগানো চুমকি আলো একবার ঝিকমিক করে উঠল! ভোম ব্যাস্ত হয়ে গর্তটা খুঁজতে লাগল। আমিও অন্ধকারে আলগা করে রাখা মাটিটুকু খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু এ কী! পুরো প্যান্ডেলটাই যেন ঘুরতে শুরু করেছে। অলীক আলোর উত্তেজনায় দিক হারিয়ে ফেলেছি আমি আর ভোম! অনেকটা অনুসন্ধানের পর গ্রিনরুম লাগোয়া একটু নরম মাটি পেয়ে উৎসাহিত হয়ে পড়লাম। নখ দিয়ে মাটি টানতেই মুঁতের ঝাঁঝালো গন্ধে নাড়ি উল্টে এল,“ওয়াক থু! পোস্টারের ওই পাগলটাই মুঁতেছে বুঝলি!”

ভোম দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “রাবিয়ার মায়ের কাজ নয় তো রে?”

অতশত ভাববার আর অবসর নেই। ভেতর থেকে ভুজিয়া আর বাদামের গন্ধ ভেসে আসতে লাগল। সেইসাথে হাঁকডাক! ক্রমশ বাইরের ভীড় কমে আসতে লাগল। তবলায় টুংটাং হাতুড়ির ঘা পড়ল বুঝি? দুজনেরই রক্ত রক্ত ছলকে উঠল! কিন্তু হাউসফুল এখুনি তো হবার কথা ছিল! হচ্ছেনা কেন? দেখলাম অন্ধকারে ভোমের চোখদুটো ভামবেড়ালের মতো জ্বলছে!

“চল তো ঘাটের ধারে যাই। দেখে আসি!”

আমরা জানি বাংলাদেশী লোক না এলে প্যাণ্ডেল হাউসফুল হবে না। আর হাউসফুল না হলে টিনের ঘেরাও খুলে দেবেনা!

ছুটে এলাম ঘাটে। এসে দেখি রাবিয়ার মা ভাঁড়ে করে রস নিয়ে বসে আছে।

ভোমের ভ্রূ দুমড়ে এল, “রাবিয়ার মা রস পেল কনে রে?”

“রস না ছাই! দেখছিস নে ভাত পচা মতোন গন্ধ!”

একজিন বিএসএফ ঢকাঢক খাচ্ছে। আরেকজন ঘাটের নৌকো নিয়ে আকণ্ঠ তাড়ি খেয়ে টাল মেরে বেড়াচ্ছে। ওটা যাত্রা কমিটির নৌকো। বাংলাদেশী দর্শকদের পার করবার জন্যে রাখা ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে ওর সামনে যেতেও পারছেনা কেউ। জগা যাত্রা কমিটির সদস্য। ঘাটের সব দায়িত্ব ওর। মিয়াঁরা ফিরে যাচ্ছে দেখে, জগা অভয় দিয়ে ডাকছে,“এই আবোধের পাল, এইটুখানি জল পার হয়ে আসবি, তাতেও নৌকো লাগে নাকি? আজ তোদের খুব বাড়াবাড়ি দেখছি! আয়! আয়! একেক করে আয়! তুরা না এলে হবে কী করে!”

মিয়াঁরাও জানে, এইটুকু পানিতে পারানি লাগেনা! পানি বাড়ার সাথে সাথে লুঙ্গিটা গুটিয়ে নিলেই ব্যাস! তারপর আস্তে আস্তে নামাও...!

“কী হল রে? আয়!”

“দেখছনা গুঁটিগুলো কীভাবে লাইট জ্বেলগে রেখেছে! কীকরে আসব?”

যে বিএসএফ জওয়ানটি বেশি মাত্রায় তাড়ি খেয়েছে সে সার্চ লাইট মোটে নেভাচ্ছে না! ওপারের মিয়াঁরা লুঙ্গি একটু করে উঁচু করলেই লাইট পড়ছে। কী মুশকিল পারও হতে পারছেনা। এদিকে একগাদা পয়সা পানিতে যাবার উপক্রম হচ্ছে দেখে ওদের মধ্যে যে দালাল ধরে এসেছিল সে ঘনঘন পাছা দেখাতে লাগল! বিওএসএফ জওয়ানটিও ক্রমশ তেতে উঠতে লাগল! পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে পৌঁছাল, মুহূর্তে পুরো তল্লাটটাই বারুদ হয়ে উঠল! এবার সে ঘাটের ধারে সমস্ত ঘরের দরজায় একটা করে রুলের বাড়ি দিতে শুরু করল।

জগা চেঁচিয়ে উঠল, “এই যে রাবিয়ার মা, গোলাম কোথায়?”

“কেন গো? কী হয়েছে?”

“এটা কীসের রস?”

“আমাদের ও লোক তো বললে তালের রস!”

জগা তালের সাথে অন্ত্যমিল মিশিয়ে একটা কটু শব্দ উচ্চারণ করে বলল, “রস মারানের আর জায়গা পাওনি?” বলেই রাবিয়ার মায়ের ভাঁড়ে একটা লাথি কষিয়ে দিল!

জওয়ানদের মধ্যে একজন বমি করতে লাগল। ওপারে শেয়াল ডেকে উঠল। ওরাও শেয়ালের সুরে সুর মিলিয়ে হুক্কাহুয়া করে মাজা উড়াতে শুরু করল!

হারানের মা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পাটকাঠির মশাল জ্বেলে উঁচু করে হাঁক পাড়ল,“এই বেজাত গুলো! বাইস্কোপ দেখানোর এতো হরিষ চাপল কার শুনি?”

“কী করব কাকি? বিশ মাইল রাস্তা ঘাপিয়ে এইচি, সে হিসেব করো না?”

এবার হারানের মা মিহি অভিমান মাখিয়ে বলল, “তোদের জন্যি আমার বকনা গরুডা দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে গেল! কনে গেল কে জানে! আমি কানা মানুষ। কিডা খুঁজে দেবে বল দিকিনি? কেন একটু সরে যেতি পারছিস নে? যাত্রাপালা তোদের মুড়োয় দুবানি বলে দিলাম! এইবার লুঙ্গি উঁচু করে দেখ, আগুন ঝেদি ওতে না দিইচি!”

“ও কাকি, এট্টা ডুঙ্গা পেইঠে দাও!”

“ক্যান আমি কি চাড্ডি শেয়ার খেয়ে রেখেচি যে পারানি করতি যাব?”

ওরা অতিষ্ঠ করে তুলছে দেখে, পোকার বউ একটা ডোঙা ঠেলে দিল। মিঞারা হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ল। একসাথে পাঁচ ছয়জন উঠে পড়াতে অধিকাংশই টাল সামলাতে পারল না। ভুস করে ডুবে গেল! অমনি জওয়ানটি শূন্যে ফায়ার করতে শুরু করল!

পোকার বউ অন্ধকারে উল্কার বেগে ছুটে এল। হাতে একঘটি জল। জওয়ানটি ততক্ষনে দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করেছে। মুখে বুকে জলের ছিটে দিয়ে ওকে শান্ত করতে লাগল, “এত পাগলামো করলি হয়! ক্যাম্পে পয়সা দেওয়া রয়েচে না?”

“কোন সা প্যায়সা? হামে নেহি মিলা!”

“সকাল হোক। সাহেবের কাচে গিয়ে হিসেব নিয়োখুনু!”

“কিতনে টিকিট বেচ দিয়া আভিতক্? খাতা লেকে আও!”

এবার পোকার বউ গায়ে গুঁতো দিয়ে বলে উঠল, “খাতা উল্টোনোর টাইম পাবানা! ক্যাম্পে যাও আগে, গুলির হিসেব দেওয়া লাগবে!”

​ঝামেলা চরমে পৌঁছাল! আমি হতাশ হয়ে বললাম, “আজ আর হাউসফুল হবেনা রে ভাই! চল শুয়ে পড়ি। যেয়ে কাজ নেই!”

ভোম কথা বললনা। আমাকে চুম্বকের মতো ওখান থেকে টেনে নিয়ে গেল। ঘণ্টায় সবে একটা বাড়ি পড়েছে! ভোম বলল, “চল দাদা, ওই গর্তটা দিয়েই ঢুকব!”

“বিশ্রী ভিজে! কাপড়ে কাদা লেগে যাবে তো!”

আর অজুহাত নয়। নাক টিপে কাদা সরালাম। আমাদের দেখাদেখি আরও দুজন এসে উঁকি দিতে লাগল। আর দেরি করা চলেনা। ভোমের শরীর পাতলা। ও আগে ঢুকে গেল। আমি ধুতি দলা করে ভেতরে ছুড়ে দিলাম। চেঁচিয়ে বললাম, “ভাই, এটা ধর!”

এখন আমি প্রায় নগ্ন। মাত্র একটি গার্ডার দেওয়া পাতলা পাজামা পরা আছে। বুক অবধি ঢুকিয়েও দুবার ব্যর্থ হলাম। শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। ভেতর থেকে ভাইয়েরও উত্তেজিত আওয়াজ পেলাম। সেও যেন বারবার বলছে, “এই দাদা, আয়! আয়! আয়! আয়...!”

আর যাই হোক ভোম ভেতরে আছে, আমাকে যেতেই হবে! মুত কাদা ঘ্যাস্টানি দিতে দিতে হাঁপিয়ে গেছি। জনান্তিকে আহ্বান করলাম, “কেউ আছিস?...ঠ্যাল!”

এবার পিঠে টিন বেধে গেল! আর্তনাদ করে উঠলাম, “ওরে মরে গেলাম! টান!”

একজন টান দিল। আমি বেরতে পারলাম না! আমার পাজামাটা আমার থেকে খুলে বেরিয়ে গেল! কী সর্বনাশ!

“ও ভাই তুই কোই গেলি?”

কনসার্টের সাথে আলোর ঝলকানি। গিজগিজ করছে! আমি নিজেকে ঢাকতে ভুলে গেছি। যখনই ভাই বলে হাঁক পাড়ছি, অমনি সরু সরু সার্চ লাটের মতো আলো আমার দিকেই উড়ে আসতে লাগল! দূরে কেউ যেন একটা বাচ্চা উঁচু করল! ওটাই তাহলে আমার ভাই! আমি ভীড়ের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম! যে যেমন পারল, আমার নিচেরটা টেনে ধরল! কেউ কেউ মৃদু মোচড়ও দিল! হঠাৎ সব চুপ! ওই সেই লোকটা! এদ্দিন যাকে পোস্টারে পোস্টারে দেখেছি। রেডিওয় যার কণ্ঠস্বর শুনে চমকে চমকে উঠেছি! ওই সেই মুখ, আর মুখভর্তি দাড়িগোঁফ! আলুথালু চেহারা অথচ কী অপূর্ব কান্তি! আহা! এই জন্যেই বোধহয় মানুষ ঘরের বাসন-কোসন বিক্রি করেও এমন পাগলকে দেখতে আসে! কিন্তু পাগলটা বেশিক্ষণ থাকল না। ও নেমে যেতেই আলোটা নিভে গেল।

লজ্জা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছি দেখে, একজন মোটা মতো মহিলা সে তার চাদরের নিচে টেনে নিল। খানিকটা স্বস্তি অনুভব করলাম। এমনসময় ভুক করে আওয়াজ হল। অমনি ওই ভদ্রমহিলা খেইখেই করে উঠল, “হেই, কার এত শাঁখ শঙ্খ বাজাতে হরিস চাপল রে? ভিটেবাস্তে জায়গা হয়না? মানস্যেলায় এসব করিস তোদের নজ্জা করেনা বেহায়াগুলো?”

একজন বাদামের ঠোঙা মুচড়িয়ে মুখ চেপে বলে উঠল, “ অ্যাঁ ম্যা! মুলো! মুলো!”

“ঘাসপাতা খেগোদের কাছে কেন যে টিকিট বেঁচে!”​ ​

আরেকজন ওতে ধুনো দিল, “আমরা না মাসী! তুমার ওই ল্যাংটো ছেলের কাছে জিজ্ঞেস করো, সেও সত্যিটা বলে দেবে মেসো আজ মুলো এনেছিল কিনা!”

“এই মিনসে! কার ছেলে রে? তুই ছেড়ে দিয়ে রেকেছিস তাই বল!” ভদ্রমহিলা আমাকে ওর চাদরের আড়াল থেকে বাইরে বার করে দিয়ে ওদের সাথে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হল! পাগল ফেলে মানুষজন এবার আমার দিকেই...! আমি বেগতিক বুঝে জোর কান্না জুড়ে দিলাম! একজন বাদাম ওয়ালা হাত ধরে গেটের বাইরে বার করে দিল।

শীতে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে এলাম। আসতে আসতে অনেকটা যুক্তি সাজিয়ে নিলাম। ভোমের কথা জিজ্ঞাসা করলে বলব,প্যাণ্ডেলে ঘুমিয়ে পড়েছে! আমি কিছু জানিনা! মা মারবে? মারুক। সেই তো টেমি নিয়ে খুঁজতে বেরোবে। আর আমার ঘাড় ধরে নিয়ে টেনে বেড়াবে! যাক! যাত্রা ভেঙে গেলে নিশ্চই ঘুমন্ত অবাস্থায় কোথাও না কোথাও ভাইকে পাওয়া যাবে!

কিন্তু ব্যাপারটা তো পুরোপুরি উল্টো! চঞ্চলদের কলপাড়ে জোর কান্নার আওয়াজ। ভাইকে খেজুরের ছোবড়া দিয়ে ঘষে ঘষে মা চান করাচ্ছে! কলতলায় দাঁড়িয়ে রাবিয়ার মা হাতে তালি দিয়ে দিয়ে হেসে উঠছে, আর বলছে,“আমি গেরাণ্টি দিয়ে বলতে পারি, আমাদের ও লোক না দেখলি তুমার এই কালীপটকা এতুক্ষনে কনে কুথায় চালান হয়ে যেতো!”

আমি মুখ দেখাতেই বাবা মুগুর চেলে মারল! লাগলনা এই রক্ষে! কিন্তু আমার গায়েও মুতের গন্ধ!

রাবিয়ার মা হ্যাঁ হ্যাঁ করে উঠল, “হেই ছুড়া, তোর ধুতি-চাদর কনে?”

তাহলে কী রাবিয়ার মা’ই...?

অনেকটা অনুশোচনা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম! ঘুমের মধ্যে তখনও ইকো হয়ে ধ্বনিত হচ্ছে সেই হাহাহা সেই হাসি! যাত্রার পাগলটা হাসছে! গ্রিনরুমের গা ঘেঁষেই একটা খেজুর গাছ। গাছটা স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর! গোলাম মিয়াঁ ধারালো দা নিয়ে গাছে উঠেছে। সরু নলি বেয়ে রস পড়ছে টুপটুপ...!​ ​ একজন জওয়ান রাইফেল নামিয়ে বসে আছে মঞ্চের ঠিক মাঝখানের উঁচু রস্টামটার ওপর! এটাই রাবিয়াদের বারান্দা! সে রস খাবে।

এখন একটা করে কাঁসরে বাড়ি পড়ছে আর রাবিয়ার মায়ের ভাঁড় ফাটছে দুম দুম দুম...

◆ একটি মাধুকরী উদ্যোগ


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ