কেয়া চ্যাটার্জি

শব্দের মিছিল

মাধুকরী হাসির গল্প প্রতিযোগিতা ২০২১
★প্রথম স্থান অধিকার করা গল্প★

নিশ্চিন্দিপুরে এক অদ্ভুত রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটেছে। ছোট- বড় - মাঝারি সক্কলের মাথা বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে। এই ধরুন নবীন মাস্টার সকালে দাঁতন করতে করতে পুকুর ঘাটে গেল। ঘাটের সিঁড়িতে বসে সবে জলের দিকে হাতটা বাড়িয়েছেন এমন সময় তাঁর মাথা ঘুরতে শুরু করলো। ঘুরতে ঘুরতে নবীন মাস্টার ঝুপ করে চলে গেলেন জল পুলিশের জিম্মায়। অদ্ভূত ব্যাপার জলে পড়েই আবার সব কিছু স্বাভাবিক। ভিজে কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে নবীন মাস্টার বাড়ী ফিরলেন।

এরপর থেকেই শুরু হলো সেই অদেখা, অচেনা রোগের তাণ্ডব। বলা নেই, কওয়া নেই মানুষের মাথা ঘুরতে শুরু করে দিল। এই ধরুন হারু চোর ভিড় বাজারে লোকের মাঝে সেঁধিয়ে গিয়ে সবে মালদার একটা মানিব্যাগ হাতিয়ে পকেটস্থ করতে যাবে এমন সময় তার মাথা ঘুরতে শুরু করলো বনবন করে। সে ঘোরা যে সে ঘোরা নয়, একেবারে বনবন করে ঘোরা। আকাশ, পাতাল, আলু, পটল সব একেবারে খিচুরি হয়ে গেল হারুর কাছে। ধপাস করে মাটিতে উল্টে পড়তেই মানিব্যাগ কর্তা পিছন ফিরে দেখলেন হারুকে। এখন মানবিকতার খাতিরে হারুকে চোর অপবাদে মার খাওয়াবেন না হাসপাতালে নিয়ে যাবেন তা ভাবতে ভাবতেই উদগ্রীব জনতা হারুকে নিয়ে ছুটল। কর্তা মানিব্যাগ উদ্ধার করে সাইকেল নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে নিয়ে বাড়ী ফেরেন। এদিকে হারু চোখ খুলে দেখে তাকে কয়েকজন লোক চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে। সে ডুকরে কেঁদে উঠল, “ মাইরি বলছি দাদারা, এবারের মতো ছেড়ে দাও। আর পকেটমারি করবো না। থানায় নিয়ে যেও না।” কিন্তু কে শোনে কার কথা! পরপকারি জনতা তখন হারু উদ্ধার কাণ্ডে অন্ধ।

আবার ধরুন, খগেন ময়রা একমনে জিলিপি ভাজছে। আড়াই প্যাঁচের প্যাঁচালো গিঁটে রসের হাঁড়ি উপচে পড়ছে। ফচকে ছেলে বিমল ঠোঙা থেকে গরম জিলিপিতে সবে চোখ বন্ধ করে কামড় দিয়েছে এমনসময় খগেনের মাথা ঘুরতে শুরু করলো। খুন্তি হাতে নিয়ে সে চোখ উল্টে পড়ল সদ্য পাকানো নলেনগুঁড়ের কাঁচাগোল্লার ওপর। খগেনের রোগা পাতলা কর্মচারি তো তার বিশাল বপুর মালিককে তুলতে একেবারে হিমশিম খায়। ভাগ্যিস লোকটা তেলের কড়াইয়ের মধ্যে পড়েনি।

এতগুলো ঘটনা পরপর ঘটায় নিশ্চিন্দিপুরের নিশ্চিন্দি উড়ে গিয়ে বসল তালগাছের পাতায়। লম্বা লাইন পড়ল হারান বদ্যির চেম্বারে। হারান হাতুড়ে ডাক্তার। গ্রামের লোকজনের ছোটখাটো অসুখ সে একা হাতেই সারিয়ে দেয়। শুধু কাটাকাটির ব্যাপার হলেই পাঠিয়ে দেয় সদরে। হারানের চেম্বার জনপ্রিয় না হলেও চলনশীল ছিল। কিন্তু এই কদিন ভিড় যেন উপচে পড়ছে। হারানও স্টেথো কানে দিয়ে, নার্ভ গুনে, জিভ ছুলে কিছুই উল্লেখযোগ্য রোগের নাম খুঁজে পেল না। তার আতসকাঁচে পরিচিত কোন জীবাণুর দেখা মিলল না। অবশেষে তিনি প্রমাদ গুনে নিদান দিলেন, এক অজানা ভাইরাসে ছেয়ে গেছে গ্রাম। তাই সকলে যে যার ঘরে ঢুকে পড়ো। খবরদার কেউ বেরোবে না। বেরিয়ে চোখাচুখি হলেই কিন্তু মাথা বনবন করে ঘুরতে শুরু করবে। আর যদি নেহাত বেরোতেই হয়, কালো চশমা পড়া বাধ্যতামূলক। নিশ্চিন্দিপুরে খবর ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের প্রধানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। চাষা চাষ না করলে মানুষ খাবে কি? চা খেয়ে তো আর পেট ভরে না। খাজনা না এলে মন্ত্রীসভা চলবে কীভাবে? নিমরাজি হয়ে হুকুম জারি হলো। স্কুল, কলেজ, অফিস, কাছাড়ি, বাজার, দোকান, পার্ক, পুকুরের ঘাট সব বনধ বনধ বনধ। গ্রামবাসীর মহা উল্লাস। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। ছুটি, ছুটি!! গ্রামবাসী সেই যে বিছানা নিল, নাক ডাকার শব্দে গ্রামে কান পাতা দায়। সেই নাক ডাকার শব্দ ভেসে ভেসে চলল নিশ্চিন্দিপুরের জঙ্গলে। শেয়াল ভায়া খ্যাঁক খ্যাঁকিয়ে বলল, “রাজা মশাই গাঁ শুদ্ধ মানুষ ঘুমিয়ে কাদা। একবার ঢুঁ মেরে আসবেন নাকি? শুনলাম অন্য জঙ্গলের পশু পাখিরাও নাকি একবার করে দেখে এসেছে মানুষের বাড়ি ঘর। আমারও বড্ড দেখার ইচ্ছা।” সিংহ রাজা শ্যাম্পু করা চুলে আঙ্গুল চালিয়ে একপ্রস্থ ঢুলে নিয়ে বললেন, “ নাহ্, নাহ্, মানুষ গুলো যা ত্যাঁদর সিংহ এসেছে এসেছে বলে যদি ঘাড়ে উঠে ছবি তুলতে চায়? বাবা! ওদের দেখে যদি আমার মাথা ঘুরতে শুরু করে তাহলে তো জঙ্গলের বদলে চিড়িয়াখানায় নিয়ে চলে যাবে। তারপর আমার গিন্নী আর ছানাগুলোর কি হবে?” শেয়ালের কথা খানি মোটেও পছন্দ হলো না। মনে মনে বলল, “উঃ! ব্যাটা কুঁড়ের ডিম। সারা দিন বৌটাকে দিয়ে শিকার করায় আর নিজে গান্ডে পিন্ডে গিলে ভুঁড়ি বাড়ায়। আবার বৌটার কি হবে! হাড় জুড়োবে।" মুখে বলল, “ঠিক আছে মহারাজ আপনার যা হুকুম।” কিন্তু রাত হতেই সে দলবল নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এসে পৌঁছল লোকালয়ে। লোম ঢাকা চোখ মেলে চেয়ে দেখল মানুষের বাড়ী। এর আগে যখন গ্রামে এসেছে, দূর থেকে দেখেছে গিজগিজে লোক, বাজার, ভিড়, আলো। আর এখন ফাঁকা, অন্ধকার, নিস্তব্ধ। মন্ত্রী শেয়াল ফিসফিসিয়ে পাশের শেয়ালকে বলল, “দেখেছিস কেমন আউটডোরটা প্ল্যান করলাম। এভাবে কখনও গ্রাম দেখতে পেতিস?” বন্ধু শেয়াল অনুগত স্বরে বলল, “আপনি হেব্বি বুদ্ধিমান সর্দার। সাধে বলি আপনার রাজা হওয়া উচিত।” হঠাৎ তাদের কথপোকথনে ছেদ পড়ল। একদল মানুষ বোচকা বুচকি মাথায় করে কোত্থেকে হেঁটে হেঁটে আসছে। শেয়ালের দল বিস্ফারিত চোখে ওদের দেখছিল। বন্ধু শেয়াল মন্ত্রী শেয়ালকে ঠ্যালা মেরে বলল, “সর্দার শিকার।” মন্ত্রী শেয়াল মুখ ভেটকে বলল, “ ইসস, এসব হাড় জিরজিরে মানুষ খেয়ে লাভ নেই রে বটা। তার চেয়ে আমাদের খরগোশ ভালো।” এমন সময় আলোর ঝলকানিতে তো ওদের চোখ যায় যায় অবস্থা। উল্টোদিক থেকে একদল মানুষ দৌড়ে আসছে ক্যামেরা নিয়ে। ক্যামেরার আলোর চমকে শেয়ালের দল উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় লাগালো জঙ্গলের দিকে। বন্ধু শেয়াল হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “সর্দার মানুষগুলো শুধরালো না। এবার জঙ্গলে গিয়ে ভালো করে ওষুধ পাতা খেতে হবে। নাহলে রাজামশাই আস্ত রাখবে না।”

এদিকে গ্রামে পসরা বেড়ে গেল খেঁদির। তার তৈরি চোখ বন্ধন ব্যান্ড মেয়েদের মধ্যে খ্যাতি পেয়েছে। একদিকে তো কাজল, আই লাইনার, মাস্কারা, আই স্যাডোর দিন গেছে। কোম্পানিও ব্যবসা লাটে তুলেছে। তা বলে কি সাজবে না, সাজবে না মেয়েরা। খেঁদি এনেছে এমন এক চক্ষু বন্ধন ব্যান্ড যা সূর্যের আলো তো চোখে ঢুকতেই দেবে না, আবার ইস্টাইলও হবে। সঙ্গে আবার ডিজাইনার লাঠির ব্যবস্থাও আছে। খেঁদির দেখাদেখি ময়দানে নেমে গেল আরো জনা বিশেক। সবাই বনবন রোগ প্রতিরোধক চক্ষু বন্ধন ব্যান্ড বানাচ্ছে। সব ব্যান্ডই বনবন রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করবে। সঙ্গে ধরে রাখবে ফ্যাশন। যাত্রাভিনেতা থেকে পাশের বাড়ীর বুচকি সবাই এককথায় খেঁদির ব্যান্ডের ভক্ত।

অবশেষে প্রধান হুকুম শিথিল করে দোকান পাট, মিষ্টির দোকান খুলে দিলেন। মানুষ খেতে, খাওয়াতে কোনটাই পারছে না। সেই শুনে এক সকালে ঘোষ গিন্নি ঠোঁট ফুলিয়ে বললেন, “তা হ্যাঁ গো। বাড়িতে রয়েছ একটু ভালো মন্দ রাঁধব না?” ঘোষ বাবু তখন খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে ভিন গ্রামের প্রধানের ভুল উচ্চারনের বিরুদ্ধে লেখা একটা বিশাল নিবন্ধ পড়তে ব্যস্ত ছিলেন। খাওয়ার কথায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললেন, “ মন্দ কেন গিন্নী? ভালোই রেঁধো। এমন ইলিশ আনবো না যে গন্ধে পাড়া ম ম করবে। তার সঙ্গে একটু কুচো চিংড়ি আর এঁচোড়। আর বাদ বাকি যা আনার আছে লিখে দাও দেখি।” বাইরে যাওয়ার নামে স্বামীর এমন প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব দেখে সন্দিগ্ধ হয়ে গিন্নি বললেন, “ তা চোখ যে বাঁধা থাকবে। ছুঁয়ে বুঝতে পারবে কোনটা ইলিশ আর কোনটা সিলভার কার্প?” ঘোষ বাবু জেমস বন্ডের হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, “একবার বলেই দেখো না।” গিন্নী চলে গেলেন রান্নাঘরে। ঘোষ বাবু মনে মনে ঠিক করে নিলেন ফেরার পথে অমৃত কুম্ভ স্টোর্স থেকে এক বোতল অমৃত নিয়ে চলে আসবেন। সন্ধ্যেবেলা কেটে যাবে ভালোই। শুধু এই দজ্জালটার চোখ এড়িয়ে ঘরে ঢোকাতে পারলেই কেল্লাফতে। হিসেব মতো ঘোষ বাবু বাজার ফিরতি অমৃত কুম্ভের সন্ধানে লেগে যাওয়া লম্বা লাইনে গা ভাসিয়ে দিলেন। চোখে কারুর ব্যান্ড, কারুর নেই। যাদের নেই তারা ব্যান্ড পরিহিতদের জ্ঞান স্বরুপ বলছেন— ধুর ওসব ভয় পাবেন না। খুলে ফেলুন তো এসব। যার মাথা ঘোরার এমনিও ঘুরবে অমনিও ঘুরবে। বিধাতা যা লিখেছেন কপালে।” কেউ বলছে, “ শুনেছি নাকি অমৃত খেলেই এই রোগ থেকে বাঁচা যায়। বলছে ভেতর পরিষ্কার হয়ে গেলেই রোগ বাইরে চলে যাবে।” ঘোষ বাবু হাতঘড়ি দেখে চোখ উল্টোলেন। অবশেষে সমস্ত ভিড় এড়িয়ে গিয়ে কাউন্টারের সামনে গিয়ে বললেন, “ একটা ছোট অমৃতের বোতল দিয়ে দে বাছা। সিনিয়র সিটিজেন তাড়াতাড়ি ছেড়ে দে।” অমনি পিছনে রে রে পড়ে গেল। ভিড়ের ভেতর থেকে একটি ছেলে মাথা তুলে চিৎকার করে উঠল, “ ও জেঠু। সিনিয়ার সিটিজেন যখন এই বয়সে এসব গেলার কি দরকার?” ঘোষ বাবু উত্তর দেওয়ার জন্য ঘাড় ঘুরাতেই চমকে উঠে মুখ লুকালেন। ছেলেটিও হতভম্ব হয়ে মিশে গেল ভিড়ে। বাজার হাতে ব্যাজার মুখে ঘোষ বাবু বাড়ী ফিরলেন। উঠোনে রক্তচক্ষু হয়ে বসে রইলেন। ভাবা যায়! যে ছেলের দুধ জোগাড় করার জন্য তিনি হন্যে হয়ে ঘুরেছেন সেই ছেলেই কি না... গেট খোলার শব্দে ছুটে গিয়ে দেখলন ছেলে ঢুকছে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কি বলবেন? বাপ ব্যাটায় অমৃত স্টোর্সে লাইন দিয়েছিল। গিন্নির কানে গেলে দুটোকেই ভাজা ভাজা করবে। ছেলে চোখ নামিয়ে গুটিগুটি পায়ে ঘরে ঢোকার ব্যবস্থা করতেই ঘোষ বাবু তাকে ধরে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে। ছেলে কাতর স্বরে বলে উঠল, “দ্যাখো বাবা। এই নিয়ে তুমি আমায় বকাবকি করতে এসো না কিন্তু। আমি যদি দোষী হই তাহলে তুমিও দোষী। মায়ের কানে এ কথা উঠলে দুজনকেই মুড়ো ঝাঁটা মেরে বিদায় করবে।” ঘোষবাবু এতক্ষন গম্ভীর মুখে সব শুনছিলেন। ছেলের কথা শেষ হলে বললেন, “ জ্ঞান ঝাড়া হয়ে গেলে এবার দয়া করে বলবে, পেয়েছ কি না?” ছেলে ফিচেল হাসি হেসে টি-শার্ট তুলে দেখালো সেই অমোঘ বস্তু। ঘোষ বাবুর ঠোঁটে এক অমায়িক হাসি এক ঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। আবার গম্ভীর মুখে বললেন, “ শেয়ারিং ইস কেয়ারিং। কথাটা যেন মাথায় থাকে। এবার যাও।” ছেলে শিস দিতে দিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই শিসের তালে অলক্ষে বরেন ঘোষও সামান্য কোমর দুলিয়ে দিল। আহা, ছেলেটা কার দেখতে হবে তো! কেমন কাজ হাসিল করে এসেছে।

রাতে ঘটল অন্য বিপত্তি। রাতের খাবার পর্ব সমাধা করে ঘোষ বাবু ছেলেকে চোখের ইশারায় ছাদে যেতে বলে টিভি দেখতে বসে গেলেন। বনবন রোগের ওষুধের পরীক্ষা নিরিক্ষা চলে যাচ্ছে তো চলেই যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই এক এক গ্রাম সোল্লাসে চিৎকার করে উঠছে, ইউরেকা ইউরেকা রবে। সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানী তেড়ে উঠছে। এখনই নয়, এখনই নয়। হতেই পারে না, হতেই পারে না। নিশ্চিন্দিপুরের মানুষ টিভির পর্দায় সেঁটে রয়েছে। কটা রোগী ধরা পড়ল। কজন মরলো। কজনই বা বেঁচে ফিরল। যারা ফিরল তাদের আবার একঘরে করে রাখার দায়িত্বও সবার। খবর দেখে দেখে চোখে চড়া পড়ে গেছে। ঘোষ মশাই খোশ মেজাজে ছাদে উঠলেন। ছেলের অপেক্ষা করতে করতে মেজাজ গেল খাপ্পা হয়ে। হলোটা কি? নিজেই ব্যাটা সব সাবাড় করে দিল নাকি? ঘোষবাবু আবার চললেন নীচে। ছেলের ঘরের সামনে এসে গলা সামান্য খাঁকরাতেই ইঁদুরের গর্ত থেকে বেরোনোর মতো করে বেরিয়ে এলো ছেলে। মুখটা কাচুমাচু করে বলল, “ বাবা পাচ্ছি না তো।”

— পাচ্ছি না মানে? হতভাগা কোথায় রেখেছিলি?

— আমার আলমারিতেই তো রেখেছিলাম। এখন দেখছি নেই।

— নেই মানে কি? কে নেবে?

— আমি কি জানি?

দুই ঘোষ পড়ল মহা মুস্কিলে। ছেলের মনে হলো, মা কোনোমতে ঘর পরিষ্কার করতে এসে খোঁজ পায়নি তো? কথাটা পারতেই দুজনেরই বুক শুকিয়ে কিসমিস। বড় ঘোষ বললেন, “ তোর মা যা কিছু ঝাপে সব খাটের বা আলমারির তলায় রেখে দেয়। চল একবার গিয়ে দেখে আসি।” ছোট ঘোষ একলাফে দশ হাত সরে গিয়ে বলল, “ ইল্লি আর কি! আমি খুঁজে কেস খাই। আর তুমি পগার পার!”

— আঃ, ঠিক আছে। দুজনে একসাথেই খুঁজবো। চল তো।

ঘোষ বাবু এদিক ওদিক তাকিয়ে সন্তর্পনে নিজের ঘরের দরজা খুললেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঘোষ গিন্নি এমন অন্ধকারেই ঘুমোতে ভালবাসেন। ছেলে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটু মুড়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলল আলমারির দিকে। খাটের তলা অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত। ঘোষ বাবুর ঢুকতে সুবিধা হবে। কিন্তু দুজনে গরু খোঁজা খুঁজেও কিছু পেলেন না। আবার হামাগুড়ি শুরু হলো উভয়ের। ছেলে দরজার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে সবে বেরোতে যাবে এমন সময় বাবার কণ্ঠে “ বাবা গো! মা গো! গেলুম গো!” শব্দে পিছন ফিরে অন্ধকারেই কোনোমতে দেখে নিরীহ বরেন ঘোষের পাটকাঠির মতো চেহারার ওপর চেপে বসে আছে একজন বিশাল দেহী একজন। বসেছে তো বসেছে সঙ্গে বাবার সুপ্রশস্ত চকচকে টাকে একের পর এক থাবড়া মেরে যাচ্ছে। ছেলে ঘোষ ধীরে ধীরে দরজার পেছন থেকে খিল তুলে নিয়ে লাইটের সুইচে হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠল। ও হরি! এ যে তার মাতৃ দেবী! ঘোষ বাবুর ততক্ষনে দম টম আটকে খাবি খাওয়ার জোগাড়। ছেলেকে চোখের ইশারায় বাঁচানোর অনুরোধ করে চলেছেন। ছেলে তড়িঘড়ি খিল ফেলে ছুটে এসে মা'কে জাপটে ধরে তুলে বিছানায় বসালো। কিন্তু ঘোষ গিন্নী তৎক্ষণাৎ বিছানা অচেতন হয়ে শুয়ে পড়লেন। বাপ ব্যাটায় হাজার ভেবেও উদ্ধার করতে পারলো না সুস্থ সবল মানুষটার হঠাৎ কি হলো।

বাবা মা'কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বেরোতে গিয়ে ছেলের চোখে পড়ল সেই মহার্ঘ অমৃত কুম্ভের বোতল। ছেলে সবিস্ময়ে দেখল বোতল পুরো খালি। মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে কিছু বাকি রইল না। এখন সে বুঝতে পারল মা যা যা বলছিল তার কোনওটাই প্রলাপ নয়। আসলে ঘোষ গিন্নি বলছিলেন, বদমাশের দল। আমি সারাদিন সংসারের জন্য খেটে খেটে মরছি। এদিকে ছেলে আর বাপে ওষুধ এনে লুকিয়ে রেখেছে একা একা খাবে বলে! কি সাংঘাতিক লোক হ্যাঁ? আমিও বিন্দুবাসিনি ঘোষ। সব ওষুধ খেয়ে ফেলেছি। দ্যাখ কেমন লাগে!” ছেলে ঘোষ গুটিগুটি পায়ে ফিরে গেল নিজের ঘরে। তার মাথাটা কেমন ঘুরছে। একি প্রেশারের ফল না, অতিরিক্ত ক্লান্তি,নাকি...” বিছানায় ধপ করে শুয়ে সে ভাবতে লাগলো কবে ওষুধ বেরোবে, কবে ওষুধ বেরোবে।

■ একটি মাধুকরী উদ্যোগ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ