◆ সুমনা সাহা / শ্রাবণ রাতের এক নিভৃত আলাপে রবি-ঠাকুরের সঙ্গে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২২শে শ্রাবণ
আবার এসেছে। শ্রাবণ-ধারাপাতের কাল। দুটো দিন গেছে গুমোট গরমে, প্যাঁচপ্যাঁচে ঘামে। সব কাজ সেরে, রাত্রি ঘন হলে পরে বসেছি, ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’। এমন সময় সে এসেছে...রিমঝিম ধারা বরিষণ! আহা! মন আমার গান গেয়ে উঠল, ‘আজি বরিষণ মুখরিত, শ্রাবণ রা...তি/স্মৃতি-বেদনার মালা একলা গাঁথি’ ...গুনগুনিয়ে উঠতেই জলের ছাঁটে জানালার পাশে বই-এর টেবিল গেল ভিজে। ভালো করে বৃষ্টির দাপাদাপি দেখব বলে জানলা বন্ধ করে ব্যালকনিতে গেলাম। এমন শ্রাবণ দিনে জানি না কেন, রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়তে ইচ্ছা করে। ঐ ‘ঠাকুর’-প্রেম তো আজকের নয়! বর্ষা আর রবি-ঠাকুর মিলেমিশে মনের ঘরে সেই কোন্ ছোটবেলা থেকে! খুব যখন বৃষ্টি পড়ে, বাতাসে জোর জলের ছাঁট, জানলার কাঁচে বিদ্যুতের নীলচে শিখার ঝলকানি...তখন কেমন শুদ্ধ ভাষা জেগে ওঠে মনে। ‘সমানে বৃষ্টি পড়ছে, মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে’—এইসব কথার মধ্যে সেই আমেজটাই নেই। ‘অবিশ্রাম বারিধারা ঝরিতেছে, মেঘের মন্দ্রধ্বনি শোনা যাইতেছে, গগনের বুক চিরিয়া সৌদামিনী ঝলসিয়া উঠিতেছে’—শুনলেই মন স্থির হয়ে আসে। 

ব্যালকনিতে একলা দাঁড়িয়ে আছি। চতুর্দিকে অন্ধকার। একে লকডাউনের বাজার। তায় বৃষ্টির ঠাণ্ডা আমেজ। তায় রাত্রি বারোটা। ঘরে ঘরে ছাপোষা মানুষ করোনার আতংককে ‘বহুযুগের ওপারে’ দাঁড় করিয়ে ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ বিহার করছে। ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের শিখায় চমকে চেয়ে দেখি, আবছা অন্ধকারে পাশের ইজিচেয়ারে দীর্ঘদেহী মানুষটি, ও কে? তাঁর আবক্ষ ঋষির মত শুভ্র শ্মশ্রু, এ যে আমার জন্মজন্মান্তরের চেনা মানুষ! ঠাকুর, আপনি! 

স্মিত হাসি ওই মুখে, ‘গোল করিস নে। আয়, বোস।’
কি ভাগ্যি! কি ভাগ্যি! আমার রবি-ঠাকুর আজ আমার এত কাছে! অস্ফুটে বলি, 

‘তবে আপনার পায়ের কাছটিতে বসি!’ 
তিনি নিশ্চুপে বৃষ্টি দেখছেন। আমি দেখছি তাঁকে। নীরবতা ভঙ্গ করে বলি, ‘এখনই ভাবছিলাম, গল্পগুচ্ছ নিয়ে বসব।’

‘তাই বুঝি? তা গল্পগুচ্ছের কোন্ গল্পটা পড়া হবে, শুনি?’
মহানন্দে বলি, ‘আপনার কাছে প্রকৃতিকে অনুভব করতে শিখেছি। বৃষ্টি ঝরলেই আপনার গানই মনে আসে। কেবল বৃষ্টির অনুষঙ্গ আপনার গল্পেও তো কতবার এসেছে!’ 

‘কোন্ কোনটা একটু মনে করিয়ে দে দিকিন্।’
ছোটবেলাকার বারম্বার পঠিত ‘বলাই’-এর বৃষ্টি আসার একটি বর্ণনা কবিকে মনে করাই—

“পুবদিকের আকাশে কালো মেঘ স্তরে স্তরে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ায়, ওর সমস্ত মনটাতে ভিজে হাওয়া যেন শ্রাবণ-অরণ্যের গন্ধ নিয়ে ঘনিয়ে ওঠে; ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে, ওর সমস্ত গা যেন শুনতে পায় সেই বৃষ্টির শব্দ”— সমস্ত শরীর দিয়ে, সমস্ত মন দিয়ে এমন ভাবে বৃষ্টি হয়ে যাওয়া শব্দে-স্পর্শে-গন্ধে...আর কোথায় পাই! 

কবির চোখে বলাই-এর দৃষ্টি। বললেন, ‘ছেলেবেলা থেকেই আমি বর্ষা বড় ভালোবাসি। একসময় লিখেছিলুম, ছেলেবেলার কথা—“বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া মনে পড়ে তখনকার বর্ষার দিনগুলি। ... আরও মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্য দিয়া ঘনবৃষ্টির ঝম্ ঝম্ শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে; একটু সেই ঘুম ভাঙিতেছে মনে মনে প্রার্থনা করিতেছি, সকালেও যেন এই বৃষ্টির বিরাম না হয় এবং বাহিরে গিয়া যেন দেখিতে পাই, আমাদের গলিতে জল দাঁড়াইয়াছে এবং পুকুরের ঘাটের একটি ধাপও আর জাগিয়া নাই।”

কবির চোখে হাসি দেখে উৎসাহে বলি, ‘আরও বলি কবি। কি অপরূপ লিখেছিলেন আপনি ‘অতিথি’-র সেই বর্ষণমুখর রাত্রির বর্ণনা—“দেখিতে দেখিতে পূর্বদিগন্ত হইতে ঘনমেঘরাশি প্রকাণ্ড কালো পাল তুলিয়া দিয়া আকাশের মাঝখানে উঠিয়া পড়িল, চাঁদ আচ্ছন্ন হইল—পুবে-বাতাস বেগে বহিতে লাগিল, মেঘের পশ্চাতে মেঘ ছুটিয়া চলিল, নদীর জল খল খল হাস্যে স্ফীত হইয়া উঠিতে লাগিল— নদীতীরবর্তী আন্দোলিত বনশ্রেণীর মধ্যে অন্ধকার পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিল, ভেক ডাকিতে আরম্ভ করিল, ঝিল্লিধ্বনি যেন করাত দিয়া অন্ধকারকে চিরিতে লাগিল। সম্মুখে আজ যেন সমস্ত জগতের রথযাত্রা— চাকা ঘুরিতেছে, ধ্বজা উড়িতেছে, পৃথিবী কাঁপিতেছে; মেঘ উড়িয়াছে, বাতাস ছুটিয়াছে, নদী বহিয়াছে, নৌকা চলিয়াছে, গান উঠিয়াছে; দেখিতে দেখিতে গুরু গুরু শব্দে মেঘ ডাকিয়া উঠিল, বিদ্যুৎ আকাশকে কাটিয়া কাটিয়া ঝলসিয়া উঠিল, সুদুর অন্ধকার হইতে একটা মুষলধারাবর্ষী বৃষ্টির গন্ধ আসিতে লাগিল। কেবল নদীর এক তীরে এক পার্শ্বে কাঁঠালিয়া গ্রাম আপন কুটিরদ্বার বন্ধ করিয়া দীপ নিবাইয়া দিয়া নিঃশব্দে ঘুমাইতে লাগিল”—আলোর ঝলকানিতে, বাতাসের ও নদীর বেগে, ভেক ও ঝিঁঝিঁর ডাকে এক প্রবল আয়োজনে আসছে ঘনঘোর বর্ষা আর এই তুমুল বর্ষণ-মুখর রাত্রির সম্পূর্ণ বিপরীতে যেন নির্বাণ তুল্য শান্তিতে একটি সুপ্তিমগ্ন গ্রামের অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা...প্রবল শব্দ ও আলোর পাশে, অখণ্ড নীরবতা ও অন্ধকার! যেন সাদা কালো ছবি! এমন ছবি গোটা বিশ্বের সাহিত্যেই বা কটা আছে?’

কবি চুপ করে রইলেন। অনেকক্ষণ আমাদের মাঝে কেবল বৃষ্টি পড়ার শব্দ। তারপর আবছা স্বরে বললেন, ‘তুমি তো আমায় এখন ভুলেই গিয়েচ!’ 

ভুলিনি, কবি, ভুলিনি, বাঙালী যেদিন আপনাকে ভুলবে, সেদিন হবে তার সর্বনাশের। আপনার ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের কথা বলি, অমন লেখা আর কি হবে? প্রকৃতির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে এমন নিবিড় গভীর মিলন মাখানো... যেমন দেহচেতনায় সম্পৃক্ত হয়ে থাকে দেহ-স্বতন্ত্র আত্মা! যখন গণ্ডগ্রামের পোস্টমাস্টার চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বালিকা রতনের কুসুমের মতো নিষ্পাপ মনটি নিজের অজান্তে ব্যথিত করে চলে যাচ্ছেন, সে বর্ণনা ব্যাখ্যা করার ভাষা নেই—“যখন নৌকায় উঠিলেন এবং নৌকা ছাড়িয়া দিল, বর্ষাবিস্ফারিত নদী ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির মতো চারি দিকে ছলছল করিতে লাগিল, তখন হৃদয়ের মধ্যে অত্যন্ত একটা বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন-- একটি সামান্য গ্রাম্য বালিকার করুণ মুখচ্ছবি যেন এক বিশ্বব্যাপী বৃহৎ অব্যক্ত মর্মব্যথা প্রকাশ করিতে লাগিল। একবার নিতান্ত ইচ্ছা হইল, “ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি”- কিন্তু তখন পালে বাতাস পাইয়াছে, বর্ষার স্রোত খরতর বেগে বহিতেছে, গ্রাম অতিক্রম করিয়া নদীকূলের শ্মশান দেখা দিয়াছে- এবং নদীপ্রবাহে ভাসমান পথিকের উদাস হৃদয়ে এই তত্ত্বের উদয় হইল, জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।” 

জগতের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার ছবি দেখেও প্রতিকার করার বিষম কষ্ট-স্বীকারের ভয়ে এহেন দার্শনিক তত্ত্বের উদয় শিক্ষিত মানুষ মাত্রেই বিলক্ষণ জানেন। বর্ষা বিস্ফারিত নদী ও ধরণীর উচ্ছলিত অশ্রুরাশির উপমায় যেভাবে আপনি রতনের বহুকষ্টে সামলে রাখা উদ্গত অশ্রুর বেগ বোঝালেন, তার তুলনা নেই। 

কবি হাসলেন, ‘এখনকার ছেলেমেয়েরা কি এসব পড়ে? পোস্টমাস্টারের ‘রতন’-কে বিখ্যাত করলেন সত্যজিৎ রায়। সেও বা এখন কে দেখে? ‘হটস্টার’ আর ‘প্রাইম ভিডিও’-র ওয়েবসিরিজের রমরমা এখন। যা যায়, তা যায়। স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশিনী অনুরাগীরা কামারহাটিতে গিয়ে গোপালের মা-কে দর্শন করে ফিরে আসার পর তিনি অস্ফুটে তাঁদের বলেছিলেন, “আহা! আজ তোমরা যা দেখে এলে, এই হল প্রাচীন ভারত! উপবাস, ঈশ্বর-বিরহে নীরব অশ্রুপাত...এসব দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে, আর ফিরে আসবে না!”  

কবির কণ্ঠে অভিমান স্পষ্ট। বললাম, ‘আপনি আমাদের রবি ঠাকুর। এই ‘ঠাকুর’ শুধু পদবী নয়। এ এক অন্যরকম ঠাকুর। এই ঠাকুরের মধ্যে দিয়ে আপামর বাঙালী বাংলা মায়ের মুখ চিনতে শেখে। সবে আধো আধো বুলি ফুটতে আরম্ভ করেছে সেই কচি বয়স থেকেই সহজ পাঠের হাত ধরে, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘ছোটখোকা বলে অ আ শেখেনি সে কথা কওয়া’ দিয়ে শুরু হল আমার স্কুলবেলাকার ‘ঠাকুর’ দেখা। তারপর ছোট্ট দুই পনিটেল দুলিয়ে যখন স্কুলে যাতায়াত আরম্ভ হল, পাড়ার ফাংশনে ‘আমি যদি দুষ্টুমি করে চাঁপার গাছে চাঁপার গাছে চাঁপা হয়ে ফুটি’, কিম্বা ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে, মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে’ আবৃত্তি মুখস্থ করতে করতে আপনার হাত ধরে কল্পনার রঙিন পাখা মেলে কতদূর পথ চললাম। আরও বড় হলাম। বয়ঃসন্ধির কিশোরী বেলা এল, মেঘ করলে তখন অজানা মনখারাপ, তখনও আপনার গানের হাত ধরেই ছিলাম ঠাকুর—‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’।
 
তারপর? তারপর তো তোমার জীবনে অন্য ‘ঠাকুর’ এলেন!
লক্ষ্য করছি, ঠাকুর আমায় ‘তুমি’ সম্বোধন করছেন! সত্য স্বীকার করেই বলি, ‘হ্যাঁ, একটা সময় আরেক ‘ঠাকুর’ এলেন মন জুড়ে। তিনি ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। অনেকগুলো শব্দ চিনতে শিখলাম—‘নিত্য-অনিত্য-বিবেক-বিচার’। জীবন নামক ফলটির ওপরের খোসা ছাড়িয়ে ভিতরের শাঁসের দিকে নজর দিতে চাই এখন। বিবেকানন্দ পড়েছি, তাঁর পত্রাবলীতে রাধাকৃষ্ণ প্রেম বিষয়ক মধুর রসের কীর্তন, প্রেম পর্যায়ের শৃঙ্গার ভাব উদ্বোধক রবীন্দ্রসঙ্গীত দেশ ও জাতিকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে, এমন মন্তব্য পড়েছি এবং ওপরের অর্থ না ধরে কথাগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝার চেষ্টায়, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ‘মাতৃভাব শুদ্ধভাব’ প্রভৃতি বাণীর গূঢ়ার্থের আলোয় স্বামীজীর কথা থেকে বিষয়ের গুরুত্ব ও সত্যতা হৃদয়ঙ্গম করেছি। যুগান্তব্যাপী পরাধীনতায় জাতির মেরুদণ্ডহীনতা সারিয়ে তুলতে হলে সাধারণ্যে কিছু ভাব অপ্রচারিত থাকাই প্রয়োজন। কিন্তু এসমস্তই জাগ্রত মনের যুক্তির উপস্থাপনা। ঘুমের ঘোরে, স্বপ্নের মাঝে যেমন দিন-রাত, রাশিয়া-রাসবিহারী মোড় সব আশ্চর্য জাদুতে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, স্বপ্নের সে গুণ বাদল দিনের সজল হাওয়ায় আছে নিশ্চয় খানিকটা। তাই প্রাক্তন প্রেমিকের মত তখন ‘রবি-ঠাকুর’ মন জুড়ে আসেন... ‘ঘন শ্রাবন ধারা যেমন বাঁধন হারা, বাদল বাতাস যেমন ডাকাত আকাশ লুটে ফেরে’... 

কবির কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাস। ধীরে ধীরে স্বগতোক্তির মত বললেন, ‘নরেন্দ্র তো পরবর্তী কালের আমার মনের ভাঙচুরগুলো দেখলে না! সে যে স্বল্পায়ু হয়ে বেঁচে গিয়েছে। আর আমার দীর্ঘ জীবনে একের পর এক কেবল আঘাত। সে আঘাত সয়েও আমার কলম রক্ত নয়, ঝরিয়েছে কুসুম।’ 

বললাম, ‘আমি জানি সে কথা কবি। কিন্তু সে বিতর্ক আজ থাক।’  

কবি বলে চললেন, ‘জানো, তোমায় বলি, পরমহংস মহাশয়ের জন্ম শতবার্ষিকীতে তাঁরা আমায় বলতে এসেছিলেন। সবশুদ্ধ ধর্মসম্মেলনের যে ১৪ টি অধিবেশন হয়, তার মধ্যে অন্তত একটিতে সভাপতিত্ব করতে বলেছিল।  প্রথমে রাজী হইনি। শরীর আমার ভালো ছিল না। বললুম, দেখুন স্বামীজী, আমি যখনই কোন সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছি, তা সে যেখানেই হোক, দেখেছি কেবল বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোল। এমনকি পরস্পর মারামারি ও রক্তপাতের ঘটনাও ঘটতে দেখেছি। আপনি কি চান আপনাদের অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আমি আরেকবার এই ধরনের ঘটনার মধ্যে গিয়ে পড়ি?’ তখন সেই স্বামীজী বললেন, ‘আমি আপনাকে কথা দিতে পারি যে আমাদের অনুষ্ঠানে ওইরকম কিছু হবে না।’ আমি জানতে চাইলুম, সভা কোথায় হবে। তাঁরা বললেন, কলকাতার চিৎপুর রোডের টাউন হলে। আমার বয়স তখন ছিয়াত্তর বছর। আমি অসুস্থ। আমার পক্ষে টাউন হলের সিঁড়ি ভেঙে ওঠা সম্ভবই ছিল না। অগত্যা রাজী হওয়া গেল না। তিনিও দমবার পাত্র নন। বললেন, তবে তাঁরা কলেজ স্কোয়ারের পুবদিকে, ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউট হলে অনুষ্ঠান করবেন, সেক্ষেত্রে সিঁড়ি ভাঙার প্রয়োজন হবে না।  

শেষপর্যন্ত রাজী করিয়েই ছাড়ল তাঁরা, বললুম, ‘যেতে পারি, একটা শর্তে। আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। আমার বক্তব্য পাঠ করেই আমি সভা ছেড়ে চলে আসব। আমি চলে আসবার পর সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন কে?’ 

তাঁরা তখন ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকার (‘প্রবাসী’-পত্রিকার ও) প্রখ্যাত সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে রাজী করালেন, আমার অনুপস্থিতিতে সভাপতিত্ব করার জন্য। তা আমারও মনঃপূত হল। 

পরে আমি তাঁদের জিজ্ঞাসা করেছিলুম, ‘ইউনিভারসিটি ইনস্টিটিউট হলে বড়জোর ১৫০০-১৬০০ শ্রোতা বসতে পারে। কয়েক হাজার লোক হয়তো বাইরে থেকে যাবে আর ভিতরে ঢোকবার জন্য হট্টগোল করবে। নানা গণ্ডগোল পাকিয়ে আপনাদের সভা পণ্ড করবার চেষ্টা করবে। তার কি করবেন?’ 

তাঁরা তখন বললেন, ‘দেখবেন এমন অবাঞ্ছিত কিছু হবে না। হলের বাইরে, কলেজ স্কোয়ার পার্কে যে পাম গাছগুলি আচে, তাতে আমরা অনেকগুলো লাউডস্পিকার লাগিয়ে দিয়েছি। ওই পার্কে বিশ হাজার লোক জড় হলেও তারা ধর্মসম্মেলনের সমস্ত বক্তৃতাই ভালভাবে শুনতে পাবে।’ 

এরপর আমার আর আপত্তির কিছু থাকে না। ৩ মার্চ নির্দিষ্ট সময়ে সভা আরম্ভ হওয়ার আগে আমাকে নিয়ে এঁরা যখন মঞ্চের দিকে এগুচ্ছে, দুজন দর্শক তখন মারপিট শুরু করেছে। একজন চেয়ার তুলেছে অপরজনকে মারতে। ওই স্বামীজী দেখলুম বেশ তৎপর! তিনি ছুটে গিয়ে দুজনকে থামালেন এবং দুজনকে বেশ দূরে দূরে বসিয়ে দিয়ে এলেন। আমি যখন হলে ঢুকি, তখন হল সম্পূর্ণ শান্ত ও নিস্তব্ধ। অন্যান্য বক্তা ও সংগঠকরা মঞ্চের উপর চেয়ারে বসলেন। কেবল আমার জন্য তাঁরা একটি আরামকেদারার ব্যবস্থা করেছিলেন।’
এই পর্যন্ত বলে ঠাকুর হাসলেন। তিনি একটু হাঁপিয়ে গিয়েছেন। আমার কৌতূহল বাড়ছিল। বললাম, ‘তারপর কি হল কবি?’

কবি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘সব বিখ্যাত গুণী মানুষ এসেছিলেন। এই যেমন ধরো, সরোজিনী নাইডু, ব্রিটিশ রাজবংশের বিখ্যাত লেখক স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাজব্যান্ড প্রমুখ। ওই স্বামীজী মাঝেমধ্যেই এসে আমার শরীরের খোঁজ নিচ্ছিলেন। আমি কোন অসুবিধা বোধ করছি কি না, সেদিকে তাঁদের খুব খেয়াল! চমৎকার ব্যবস্থা করেছিলেন মিশনের সাধুরা! আমি চেয়ারে বসেই লিখিত ভাষণখানি পাঠ করলুম। পড়তে আধা ঘণ্টার মত সময় লেগেছিল। কিন্তু প্রায় ১৫০০ শ্রোতা নিবিষ্ট মনে বসে শুনলেন সেই বক্তৃতা। কি বলব তোমায়, হলে একটি সূঁচ পড়বারও শব্দ হয়নি। আমার শর্ত ছিল বক্তৃতার পর চলে যাওয়ার। কিন্তু বিশ্বাস কর, সমস্ত অনুষ্ঠানটি এমন ছিমছাম ও সর্বাঙ্গসুন্দর হয়েছিল যে আমার বড় ভাল লাগছিল! আমি আগাগোড়াই বসে ছিলুম। স্বামীজীরা বারম্বার এসে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, আমার কোন কষ্ট হচ্ছে কি না অতক্ষণ বসে থাকতে, কিন্তু আমি তাঁদের আস্বস্ত করলুম। রামানন্দ-র আর সেদিন সভাপতির আসনে বসা হল না। তাঁকে বুঝি অন্য একদিন সভাপতি করেছিল। পরদিনও, অর্থাৎ ৪ মার্চও তাঁরা আমার সংবাদ নিতে এসেছিলেন, আগের দিনের অতখানি ধকলের পর আমি কেমন আছি, তা জানবার জন্য। আমি তাঁদের বলেছিলুম, ‘স্বামীজী আমি ভালই আছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এত দর্শকের উপস্থিতি সত্বেও এরকম শান্তিপূর্ণ সভার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে প্রথম। রামকৃষ্ণ মিশনের সংগঠন ক্ষমতায় আমি সত্যিই অভিভূত। আপনারা সত্যই একটি বড় কাজ করেছেন। যদিও তাঁরা বিশ্বাস করেন শ্রীরামকৃষ্ণ দেবের কৃপাতেই সব সম্ভব হয়েছে।’

আমি আপ্লুত হয়ে বলি, ‘সেদিনকার ভাষণে কি বলেছিলেন, মনে আছে?’
কবি বললেন, ‘তা আজও স্পষ্ট মনে আছে বৈকি! বলেছিলুম,   

“Friends, 
When I was asked to address this distinguished gathering, I was naturally reluctant, for I do not know if I can be called religious in the current sense of the term, not claiming as my possession any particular idea of God, authorized by some time-honoured institution. If, in spite of all this, I have accepted this honour, it is only out of respect to the memory of the great saint with whose Centenary the present Parliament is associated. I venerate Paramahamsa Deva because he, in an arid age of religious nihilism, proved the truth of our spiritual heritage by realizing it, because the largeness of his spirit could comprehend seemingly antagonistic modes of sadhana, and because the simplicity of his soul shames for all time the pomp and pedantry of pontiffs and pundits.”

[মূল ভাষণঃ The Religions of the World, published by the Secretary, The Ramakrishna Mission Institute of Culture, Calcutta, 1938, pp. 124-133] 

(কবির শ্রীরামকৃষ্ণ শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রামকৃষ্ণ মিশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব সংক্রান্ত উপরোক্ত বিবরণ স্বামী সম্বুদ্ধানন্দ-এর মূল ইংরাজি প্রবন্ধের অনুবাদ, রয়েছে The Global Vedanta, Vedanta Society of Western Washington, Seattle, pp. 3-4; উৎসবের প্রধান অঙ্গ ছিল বিশ্বধর্ম সম্মেলন, ১৯৩৭ সালের ১-৮ মার্চ পর্যন্ত। দেশ-বিদেশের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন; তথ্যসূত্র- ‘নিবোধত’ পত্রিকা, মার্চ-এপ্রিল সংখ্যা-২০১৪ )
  
আমি বলেছিলুম, “আমি পরমহংসকে শ্রদ্ধা করি, কারণ এই নাস্তিকতার যুগে তিনি আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি করিয়া ছিলেন। তাঁহার হৃদয়ের ঔদার্য, পরস্পরবিরোধী সাধনার সত্যকে উপলব্ধি করিয়াছিল এবং তাঁহার সরলতা ঐশ্বর্য ও পাণ্ডিত্যের আড়ম্বরকে ধিক্কার দিয়াছিল।”(৩ মার্চ ১৯৩৭)

তাঁদের অনুরোধে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি চার লাইনের শ্রদ্ধার্ঘ্যও অর্পণ করেছিলুম—“বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা/ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা/তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে/নূতন তীর্থ রূপ নিল এ জগতে/দেশ-বিদেশের প্রণাম আনিল টানি/সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি।” 

তোমার প্রিয় বিবেকানন্দ, সে আমাদের কাছে নরেন্দ্র নামেই পরিচিত ছিল, ও তো তোমার ঠাকুরকে দুটি গান শোনাত—‘সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে’ আর ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’—ও দুটো গানই যে আমারই রচনা ব্রাহ্মসঙ্গীত গো! তোমাদের রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের বহু বরেণ্য সন্ন্যাসী আমার পূজা পর্যায়ের গানগুলো খুব পছন্দ করতেন, বেশ গাইতেনও। তোমাদের মিশন থেকে ভজনসঙ্গীতের যে একটি সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, তাতে তো আমার পূজা পর্যায়ের ৩০ টির বেশী গান আছে, সে কথা জানো তো?

আমি একটু সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেললাম, বার বার তোমার ঠাকুর, তোমাদের মিশন এমন কেন বলছেন? আপনি তো ভালো করেই জানেন, বাঙালির তিন ‘র’-এ আসক্তি—রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ আর রসগোল্লা! একথা কি ঠিক নয়, আপনি রামকৃষ্ণ ও তাঁর দলকে একহাত নিয়েছিলেন? একথাও তো আপনি লিখেছিলেন যে, “কালীর উপাসনা যারা টিকিয়ে রাখে তারা সুস্থ, সঠিক ও সৎ মানসিকতার মানুষ হতে পারে না।”২ 

কবি—ওকথা লিখেছিলুম কেন জানো? বলিদান আমি সহ্য করতে পারি না। ছেলেবেলায় কালীমন্দিরে পশুবলী দেখার যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই স্মৃতি আমার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।’

আমি— আমার কষ্ট হয় এই ভেবে যে, আপনার ও শ্রীরামকৃষ্ণের চেতনার মূলে আধ্যাত্মিকতা। তবু কোথায় যেন আপনারা মিললেন না। আমার ঠাকুর, রামকৃষ্ণও বলী দেখতে পারতেন না। তাই পরবর্তী কালে বেলুড় মঠে শক্তি পূজায় স্বামী বিবেকানন্দ যদিও পশুবলী দিতে চেয়েছিলেন, শ্রীশ্রীমা তাঁকে এই বলে নিবৃত্ত করেন, “তোমরা সন্ন্যাসী। সকল প্রাণিকে অভয় দেওয়াই তোমাদের কাজ।” অতএব মঠে সেই থেকে পশুবলী নিষিদ্ধ হয়েছে এবং কুমড়ো, আখ প্রভৃতি বলী হয় অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিপূজায়। বিকল্প বলী শাস্ত্রসম্মত ও প্রচলিত। আপনি ‘রূপ ও অরূপ’ প্রবন্ধে এক জায়গায় লিখেছেন, “শুনা যায় শক্তি-উপাসক কোনো একজন বিখ্যাত ভক্ত মহাত্মা আলিপুর পশুশালায় সিংহকে বিশেষ করিয়া দেখিবার জন্য অতিশয় ব্যাকুলতা প্রকাশ করিয়াছিলেন—কেন না ‘সিংহ মায়ের বাহন’। শক্তিকে সিংহ রূপে কল্পনা করিতে দোষ নাই—কিন্তু সিংহকেই শক্তিরূপে যদি দেখি তবে কল্পনার মহত্বই চলিয়া যায়। ... যদি তাহা (কল্পনা) কোন এক জায়গায় আসিয়া বদ্ধ হয় তবে তাহা মিথ্যা, তবে তাহা মানুষের শত্রু।” 

এখানে ‘শক্তি উপাসক কোন একজন মহাত্মা’ বলতে তো আপনি শ্রীরামকৃষ্ণকেই বুঝিয়েছেন? কিন্তু এমন ভাবনা আপনার মনে এসেছে, এটা ভাবতে আমার ভালো লাগে না। আপনি কি করে ধরে নিলেন যে, শ্রীরামকৃষ্ণ সিংহকেই শক্তি রূপে দেখেছিলেন? আপনার এই অযথার্থ ও অসতর্ক মন্তব্য ও হিন্দুর প্রতিমা পূজার বিরূপ সমালোচনা কত মানুষকে সমস্যায় ফেলেছে, তা জানেন? শ্রীরামকৃষ্ণ কি কালীকে কেবল মৃন্ময়ী বা হিংসা ও রক্তপ্রিয়া দেবী মনে করতেন বলে আপনি কি সত্যি বিশ্বাস করেন? তিনি অনুভূতির চরম স্তরে আরূঢ় হয়ে তন্ত্রের কালী ও উপনিষদের ব্রহ্মকে এক ও অভিন্ন বোধ করেছিলেন। 

কবি কিছুক্ষণ স্পন্দহীন। ধীরে ধীরে বললেন, “কি জানো? একটা মানুষের কতগুলো লেখা পড়ে তাঁকে ধরতে চেয়ো না। সে সময় বাবামশাই (দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর) প্রয়াত হলেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের দায় তখন আমারই কাঁধে এসে বর্তালো। হিন্দু উপাসনা ও উপাসকদের ভুল ধরা এবং ব্রাহ্মসমাজের উপাসনার শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো—এসমস্তই তখন আমার অন্যতম দায়বদ্ধতা হয়ে উঠেছিল। আমার ভাইঝিকে একখানা চিঠি লিখেছিলুম, ১৯২৫-এ, সেখানা পড়লে বুঝতে পারতে...”

কবির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, “মনটা কিভাবে ভিতরে ভিতরে লেখা সম্বন্ধে হরতাল নেবার পরামর্শ করছে। টাকা ছুঁলেই শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের যে রকম সর্বাঙ্গে আক্ষেপ উপস্থিত হত কলম ছুঁতে গেলেই আমার সেরকম হয়।” এই চিঠির কথা বলছেন তো? 

“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। ১৯৩০-এ যখন ইউরোপ যাই, নিজেই ফরাসী লেখক ও বিখ্যাত মনীষী রোম্যাঁ রোল্যাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলুম। আমি নিজে থেকেই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ তুলে তাঁকে উসকে দিই আলোচনায় আরও জানব বলেই। উনি সেসব কথাবার্তা তাঁর ডায়রিতে লিখে নিয়েছিলেন। পরে সে ডায়রি প্রকাশ হয়েছে এমনকি বাংলায় অনুবাদও হয়েছে বলে শুনেছি। সেসব কি তুমি পড়েছ?”

আমি— না, তা আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। 
কবি— তাহলে আরও বলি শোন সখী।
আমি— কি বললেন আমায়? সখী? আবার বলুন কবি! 
কবি হাসলেন, ভুবন ভোলানো সেই হাসি। বললেন, “শোন সখী, আমার ‘মালঞ্চ’ উপন্যাসে কম করেও তিনবার তুমি তোমার ঠাকুরের নামের উল্লেখ পাবে। ‘পথ ও পাথেয়’-তে লিখেছিলুম, ‘...রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ, শিবনারায়ণ স্বামী ইঁহারাও অনৈক্যের মধ্যে এককে, ক্ষুদ্রতার মধ্যে ভূমাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য জীবনের সাধনাকে ভারতবর্ষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন।’ আরও বলি শোন, স্বামী শ্যামানন্দের নাম শুনেছ? উনি আগে রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সাধু ছিলেন, পরে সঙ্ঘ ত্যাগ করেছিলেন। তিনি একখানি বই লেখেন, ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কাব্যলহরী।’ ৫৭৪ পৃষ্ঠার বই, আমায় ধরলে, ভূমিকা লেখবার জন্যে। লিখে দিলুম, “স্বামী শ্যামানন্দ পদ্যছন্দে শ্রীরামকৃষ্ণ কাব্যলহরী রচনা করেছেন, ইহার যথার্থ মূল্য সরল ভক্তির। ভক্তেরা ইহা শ্রদ্ধাপূর্বক গ্রহণ করিবেন সন্দেহ নাই।”৩

তাহলে তো দেখছি শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে আপনার কোনও বিরোধ নেই। 

আনমনা ভাবে কবি বলে চললেন, “দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলা থেকে এক মাস্টার, যতদূর মনে পড়ছে জয়নগর ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক মহাশয়, চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন, আমি শ্রীরামকৃষ্ণকে কেমন দেখেছি। তার উত্তরে লিখেছিলুম, “সমস্ত দেশের লোকের চিত্তে তিনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) প্রবল ভক্তির সঞ্চার করেছেন তারই মধ্যে তাঁর মহত্ব সপ্রমাণ ও তাঁর কীর্তি চির প্রতিষ্ঠিত হয়ে রইল। আমি যদি তাঁকে সম্পূর্ণভাবে চেনবার সুযোগ না পেয়ে থাকি, সেটা আমারই পক্ষে আক্ষেপের কারণ হয়েছে।” (১৯৩৩-এ ত্রিষ্টুপ মুখোপাধ্যায়কে লেখা)

আমি— আমারও একথা বারম্বার মনে হয়। মত ও পথের কিছু পার্থক্য থাকলেও আপনাদের দুজনেরই চেতনার কেন্দ্রে রয়েছেন ঈশ্বর। আপনারা উভয়েই অধ্যাত্মবাদী ও সমন্বয়মুখী। যে ঔপনিষদিক ব্রহ্মে আরোপিত হয়েছে আপনার হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা, দেশ-কালের সীমা উত্তীর্ণ যে অমৃত উপলব্ধির কথা আপনার একাধিক রচনায় প্রকাশ পায়, সেই পুরুষই কি রামকৃষ্ণ বিগ্রহে মূর্ত হয়ে ওঠেনি? ঈশ্বরের প্রতি শান্তভাব, দাস্যভাব, সখ্যভাব, বাৎসল্য ভাব ও মধুর ভাব আরোপ করে শ্রীরামকৃষ্ণের আপন সাধনা, সিদ্ধি ও সাধন-পথ নির্দেশ, আপনিও কি সেভাবে কখনো প্রকৃতি প্রেমে একাত্ম হয়ে, কখনো মধুর ভাবে প্রেম পর্যায়ে, কখনো দেশ মাতৃকার প্রতি প্রেমে দেশাত্মবোধক বীর ভাবে, কখনো পরম সাধন ধনের উদ্দেশ্যে পূজা পর্যায়ের গানের মধ্যে দিয়ে আপনার হৃদয়ের ষোড়শোপচার আরাধনা করেননি? আপনার সমন্বয়ের আদর্শ—‘দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে’ আপনি দেশে-বিদেশে সর্বত্র প্রচার করেছেন, সর্কীর্ণতার নিন্দা করেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত তত পথ’ মন্ত্রে কি সেই আদর্শই চরম রূপ পরিগ্রহ করেনি? আপনি যখন বলেন, “একবার অন্তরের দিকে চোখ ফেরাও...তোমার এই সুগভীর নির্জনতার মধ্যে তোমার এই অন্তহীন চিদাকাশের মধ্যে তাঁর এই অদ্ভুত বিরাট লীলা—দিনে রাত্রে অবিশ্রাম। এই আশ্চর্য প্রভাতের দিকে পিঠ ফিরিয়ে একে কেবলই বাইরের দিকে দেখতে গেলে এতে আনন্দ পাবে না, অর্থ পাবে না”৪—একথা তো শ্রীরামকৃষ্ণের সেই উপদেশের প্রতিধ্বনি—“ধ্যান করবার সময় তাঁতে মগ্ন হতে হয়। উপর উপর ভাসলে কি জলের নিচে রত্ন পাওয়া যায়?... আগে ডুব দাও, ডুব দিয়ে রত্ন তোল, তারপর অন্য কাজ।”৫  আপনি বলেছেন, “প্রতিদিন সকল কর্মের মধ্যে আমাদের সাধনাকে জাগিয়ে রাখতে হবে। এই সাধনাটিকে আমাদের গড়তে হবে।”৬ শ্রীরামকৃষ্ণও সব কাজের মধ্যে ঈশ্বরচিন্তার জাগপ্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার কথা বলতেন, নানা ভাবেই বলেছেন সেকথা, পিঠের ফোঁড়ার উদাহরণ দিয়েছেন, যেমন ফোঁড়া হলে সব কাজের মধ্যেও মনের এক অংশ পড়ে থাকে ফোঁড়ার ব্যথার উপরে, কিম্বা নষ্ট মেয়ের ঘরের সব কাজ করা ও মনে মনে সর্বদা উপপতির চিন্তা করা, কচ্ছপ জলে চড়ে বেড়ালেও আড়ায় রাখা ডিমের দিকে মন পড়ে থাকা—কত রকম করেই বলেছেন। 

কবি হঠাৎ আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, “যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু/এবার এ জীবনে/তবে তোমায় আমি পাইনি যেন/ সে কথা রয় মনে/যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই/শয়নে স্বপনে।/এ সংসারের হাটে/আমার যতই দিবস কাটে,/আমার যতই দু হাত ভরে ওঠে ধনে,/তবু কিছুই আমি পাইনি/যেন সে কথা রয় মনে।/যেন ভুলে না যাই, বেদনা পাই/ শয়নে স্বপনে।”৭ 

আমার চোখ জলে ভরে এল। বললাম, ‘জানি কবি। জীবন সায়াহ্নে এসে ‘জীবনদেবতা’-কে উদ্দেশ্য করে আপনার যে আকুতি ফুটে উঠেছে গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে বারম্বার, সে জীবনদেবতার খোঁজ তো প্রতিটি মানুষের অন্তরে অন্তহীন! আপনি যে তাঁকে চলার পথে সঙ্গে থাকার অনুরোধ করেছেন’—“হাতখানি ওই বাড়িয়ে আনো, দাও গো আমার হাতে
ধরব তারে, ভরব তারে, রাখব তারে সাথে
একলা পথের চলা আমার করব রমণীয়।”৮  
তাঁকে আপনি ‘বন্ধু’ ডেকেছেন, ‘সখা’ বলেছেন, সে তো রামকৃষ্ণের ঐ ‘মা’। ঐ যে বলেছেন,           
“বন্ধু রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে।
ছিলে কি মোর স্বপনে সাথিহারা রাতে।।
বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে
আজি এ বাদলে আকুল হাওয়ায় রে—
কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে।।”৯ 

কবির চোখে উদাস দৃষ্টি, বললেন, ‘আসলে কি জানো? আমার ভাবটি হল, ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়...’, যে কথা স্বীকার করেছি নানাভাবে, “বস্তু যা পেয়েছি তার চেয়ে রস পেয়েছি অনেক বেশী। আজ বুঝতে পারি এই জন্যেই আমার আসা। আমি সাধু নই, সাধক নই, বিশ্বরচনার অমৃত-স্বাদের আমি যাচনদার, বারবার বলতে এসেছি ‘ভালো লাগল আমার।’১০ 

বৃষ্টির বেগ খুব বেড়ে উঠেছে। আমরা দুজনেই মগ্ন হয়ে শুনছি অবিরাম ধারাপাতের শব্দ। নীরবতা ভঙ্গ করে কবি গেয়ে উঠলেন দু’কলি, আমার পরম সৌভাগ্যে আমি নিজেই অধীর! 

“আমার প্রাণে গভীর গোপন মহা আপন সে কি,
অন্ধকারে হঠাৎ তারে দেখি।।
যবে দুর্দম ঝড়ে আগল খুলে পড়ে,
কার সে নয়ন ‘পরে নয়ন যায় গো ঠেকি।।
যখন আসে পরম লগন তখন গগন-মাঝে
তাহার ভেরী বাজে।
বিদ্যুৎ-উদ্ভাসে বেদনারই দূত আসে,
আমন্ত্রণের বাণী যায় হৃদয়ে লেখি।।”১১  

প্রবল বর্ষণে কবির গান শুনতে শুনতে কী এক অপূর্ব আবেশে হৃদয় মন জুড়িয়ে গেল। ভাবলাম, সকল বিরোধ ও মিলনের শেষে, একদিন সাঙ্গ হয় সকল চাওয়া-পাওয়ার হিসেবনিকেশ, চলে যেতে হয় এ পান্থভূমি ছেড়ে বিজন নিরুদ্দেশ! জানা নেই কোন্ সে নতুন দেশে, কোন্ সে নতুন বেশে, কোন্ নব জননীর কোলে জাগবো আবার হেসে!   

অস্ফুটে বলি, ‘ঠাকুর, আপামর বাঙ্গালির হৃদগগনে সৌরভমন্থর মননে তোমার গানের নিত্য আসন পাতা, যখন যন্ত্রণা পাই, আমার মনের ঘরে, নিঃশব্দ পদসঞ্চারে, বেদনবেলায় বেজে ওঠে, ‘যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙল ঝড়ে, জানি নাই তো তুমি এলে আমার ঘরে’, ‘আমার নিশীথ রাতের বাদল ধারা’-য় রামকৃষ্ণ-ঠাকুরের উপাসনায় রবি-ঠাকুরের গানের নৈবেদ্য সাজিয়ে দিই!  

পাখির ডাকে চোখ মেলে দেখি, বর্ষণ-ক্ষান্ত শান্ত আকাশ, শান্ত বাতাস, প্রশান্ত গম্ভীর সকাল। দূর থেকে ভেসে আসা পরিচিত সুরে মনে পড়ে, এমন শ্রাবণ দিনে রবি-ঠাকুর ‘সুর’লোকে চলে গেছেন। আজ বাইশে শ্রাবণ।    



তথ্যসূত্র—
(১) ‘বর্ষা ও শরৎ’, জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্ররচনাবলী, ১০ম খণ্ড (জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার)। 
(২) রম্যাঁ রোল্যাঁ-র ডায়রি থেকে (স্বামী মেধসানন্দ, ‘নিবোধত’ পত্রিকা, মার্চ-এপ্রিল, ২০১৪)। 
(৩) সাধক ও কবি: শ্রীরামকৃষ্ণ ও রবীন্দ্রনাথ, তুহিনশুভ্র ভট্টাচার্য, কোরক সাহিত্য পত্রিকা, শ্রীরামকৃষ্ণ সংখ্যা, শারদ ১৪১৮।  
(৪) রবীন্দ্ররচনাবলী, বিশ্বভারতী, কলকাতা (১৩৯৫), ৭ম খণ্ড। 
(৫) শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত অখণ্ড সংস্করণ (২০১৩), পৃষ্ঠা-৭৩।
(৬) রবীন্দ্ররচনাবলী, বিশ্বভারতী, কলকাতা (১৩৯৫), ৭ম খণ্ড।
(৭) গীতবিতান, পূজা (বিরহ) পর্যায়, রাগ-কাফি, তাল-একতাল, রচনাকালে কবির বয়স-৪৮ বছর।
(৮) গীতবিতান, পূজা (বন্ধু) পর্যায়, রাগ-সাহানা, তাল-ঝাঁপতাল, রচনাকালে কবির বয়স-৫৩ বছর।
(৯) গীতবিতান, প্রকৃতি (বর্ষা) পর্যায়, রাগ-ভৈরবী, তাল-মধ্যমান, রচনাকালে কবির বয়স-৬৪ বছর।
(১০) আত্মপরিচয়, রবীন্দ্র রচনাবলী, দশম খণ্ড (জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার), পৃষ্ঠা-২২০। 
(১১) গীতবিতান, পূজা (বিশ্ব) পর্যায়, রাগ- বৃন্দাবনী সারং, তাল-তেওরা, রচনাকালে কবির বয়স-৬৪ বছর। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ