বিদ্যাসাগরের জন্মের দু”শ বছর উপলক্ষ্যে অনেক বিদগ্ধ আলোচনার ভিড়ে তেমন করে প্রকাশ পায়নি তাঁর জীবনের এক বিশেষ অধ্যায়। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত , নির্ভীক শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসক, পুস্তক প্রণেতা এবং পুস্তক ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগরকে আমরা চিনি। আমাদের আলোড়িত করে তাঁর জীবন জোড়া অপরিসীম মানব দরদ , দক্ষ পরিচালনায় সমাজ সংস্কার এবং সর্বার্থেই অক্লান্ত সমাজ সেবার কাজ। আর এই শেষের কাজটি ভাল রকমে করার জন্য তিনি তাঁর সমকালে হয়ে উঠেছিলেন এক ডিগ্রীবিহীন স্বশিক্ষিত নিঃশঙ্ক চিকিৎসক। ডাক্তার ঈশ্বর বিদ্যাসাগর। সেই বিদ্যাসাগরের কথা হয়তো বা আমরা অনেকেই তেমন করে জানিনা।
সেকালে কি বাংলায় ডাক্তার ছিলনা? সেখানে বিদ্যাসাগরের মত অন্যতর শাস্ত্রে পন্ডিতের নাক গলানোর কি দরকার ছিল? তাও জীবনের প্রান্তিক পর্বে ! উত্তরে নির্দ্বিধায় বলা যায় , ব্যবস্থা ছিল তো বটেই। ১৮৩৫ সালে কলকাতায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর পাশ্চাত্য মতে চিকিৎসা- বিদ্যার চর্চা যথেষ্টই হোত। পাশাপাশি দেশীয় আয়ুর্বেদ , হাকিমি চিকিৎসার ব্যবস্থাও পুরোমাত্রায় বজায় ছিল।
বিদ্যাসাগরের এই কাজে এগিয়ে আসার কারণ আর কিছুই নয়, তাঁর বিজ্ঞান- মনস্ক মনের কাঠামোয় সদা জাগ্রত সেই অপার সেবাপরায়ণতার মনোবৃত্তি, যা তাঁকে তাড়না করেছিল দরিদ্র- আর্ত মানুষের রোগের চিকিৎসার জন্য স্বল্প ব্যয়ে নিরাময় যোগ্য এক নতুন ধরণের প্রায়োগিক চিকিৎসা্-ব্যবস্থায় । বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার কেন্দ্রে হয়তো ছিল দেশের অগণিত দরিদ্র – অসহায় মানুষের বেদনায় সেই জীবন প্রমাণ এমপ্যাথি, অর্থাৎ নিজের দারিদ্র ভরা শৈশব অথবা কৈশোরের অভিজ্ঞতায় যা তিনি নিবিড় ভাবে জেনেছিলেন, দুঃখ -দুর্দশা তাড়িত মানুষের জন্য সেই নিজস্ব অনুভব ক্ষণমুহূর্তের জন্য ভোলেন নি। একই স্পন্দনে অনুভব করেছিলেন তাদের দুর্দশার মাত্রা। তাই হয়তো প্রথামাফিক চিকিৎসক না হয়েও তাঁর নিঃসংশয়ে চিকিৎসকের ছদ্মবেশ নেওয়া, তারই জন্য প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় দাঁড়িয়ে সমাজ সেবার ভিন্নতর রূপ আশ্রয় করা।
আগ্রহের পটভূমিঃ
সময়টা ছিল ১৮৬৬ সাল। বহুদিন ধরে বিদ্যাসাগর দুরন্ত শিরোঃপীড়ায় ভুগছিলেন , প্রচলিত চিকিৎসায় কোন রকম উপশম ঘটছিলনা । সেই বিপদ থেকে তাঁকে, সারিয়ে তুললেন কলকাতার বৌবাজার অঞ্চলের পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে শিক্ষিত,অগ্রণী চিকিৎসক, ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল দত্ত, ভারতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় অন্যতম পথপ্রদর্শক। হোমিওপ্যাথি! এই বিচিত্র চিকিৎসা বিদ্যার আবিষ্কারক ছিলেন ১৭৫৫ সালে জন্ম নেওয়া জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হানিম্যান। প্রথাগত ভাবে পাশ্চাত্য চিকিৎসা-শাস্ত্র অধ্যয়ন করলেও সমকালীন চিকিৎসা পদ্ধতির আসুরিক প্রয়োগ পদ্ধতি দেখে তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন। এক সময় উইলিয়াম কিউলেন্স এর “ আ ট্রিটিস অন মেটেরিয়া মেডিকার” অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলেন পেরুভিয়ান গাছের ছাল থেকে পাওয়া সিঙ্কোনা, ম্যালেরিয়া রোগ সারায়। রসায়নে বিশেষ পারদর্শী মানুষটি নিজের ওপর এই রসায়নের প্রয়োগ করে দেখলেন তার নিজের শরীরেও ম্যালেরিয়ার মত রোগ লক্ষণ দেখাচ্ছে । আরও বেশ কিছু রসায়নের এই ধরণের প্রভাব লক্ষ্য করে তিনি সিদ্ধান্ত করলেন, যে সব বস্তু বা জিনিস কোন সুস্থ মানুষের দেহে্ কোন বিশেষ রোগ লক্ষণ দেখাতে পারে, সেই একই জিনিস ওই বিশেষ রোগ বৈশিষ্ট্য যুক্ত রোগীকে নিরাময় করতে পারে। মতবাদটির ব্যাখা করলেন এই ভাবে, “লাইক কিউরস লাইক” । ১৭৯৬ সালে এই ভাবনা থেকে জাত নতুন চিকিৎসা-পদ্ধতির নাম দিলেন হোমিওপ্যাথি। অনেক বস্তুর ওপর পরীক্ষা করে, তাদের প্রয়োজন মত লঘু দ্রবণ তৈরি করে বিষাক্ত রাসায়নিক প্রভাব দূর করলেন। ১৮১০ সালে প্রকাশিত হল তাঁর বিখ্যাত বই “ দ্য অরগ্যানন অফ হিলিং আর্ট”, পরে লিখলেন আরেকটি বই “মেটেরিয়া মেডিকা পুরা”, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সাপেক্ষে রোগ নিরাময়ের তথ্যাদি ও রিপোর্ট। ৮৮ বছরের জীবনকালের এই বিজ্ঞানীর চিকিৎসা-দর্শন বিদ্যাসাগরকে দারুণ ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৪৩ সালে হানিম্যানের মৃত্যু হলেও এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ততদিনে সারা পৃথিবীতে আদৃত হয়ে গেছে। ভারতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রবেশ করে ১৮৩৯ সালে, ড জন মারটিন হনিগরারগার এর মাধ্যমে, পাঞ্জাবের মহারাজা হরি সিং এর অসাড় স্বরতন্ত্রী ও উদরীর চিকিৎসায়। ১৮৪৭-৪৮ সালে ভারতে ঘটে যাওয়া কলেরার মহামারিতে দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোরে এসে চিকিৎসা করলেন আরেক হোমিওপ্যাথি - চিকিৎসক ড স্যামুয়েল ব্রুকিং। ততদিনে জার্মান ও সুইডিশ মিশনারিরা অল্প খরচে ভারতের সাধারণ মানুষ এবং সেনানীদের চিকিৎসা করছিলেন।
কলকাতায় ১৮৫১ সালে এলেন বিখ্যাত ফরাসী হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ড তৌনেরে( Tonnere)। উৎসাহী রাজেন্দ্রলাল দত্ত তাঁর কাছে কিছুটা প্রশিক্ষণ পেলেন। তিন বছর পরে ১৮৬৬ সালে ইউরোপ থেকে কলকাতায় এলেন আরেক বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ড টি বেরেনি( T.Bereigny), খুব সাফল্যের সঙ্গে তিনি কলকাতায় চিকিৎসা শুরু করলেন । ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগরের পরামর্শে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় অভ্যস্ত রাজেন্দ্রলাল তাঁর কাছে আরো নিষ্ঠা ভরে এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রশিক্ষণ নিলেন এবং প্রাকটিশ করতে লাগলেন । কিন্তু তখনও তাঁর কাছে তেমন লোক সমাগম হয়না। এ বিষয়ে স্মরণ করা যাক বিদ্যাসাগরের সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের স্মৃতি চারণ, “অনেকে বলিতে লাগিল, যদি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ভাল এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় আপনার পরম বন্ধু, তবে তাহাকে অগ্রে কেন না চিকিৎসা করেন” ? এই সময়ই বিদ্যাসাগর, তাঁর এই প্রায় সমবয়সী বন্ধু ডাক্তার রাজেন্দ্রলালের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় কয়েক দিনের মধ্যেই পুরোনা মাথাধরা রোগের চিকিৎসার সুফল পেলেন । সুফল ফেলেন আরও কিছু সমকালীন মানুষ। উপকার পেলেন ভীষণ ভাবে কোষ্ঠবদ্ধতায় আক্রান্ত ও আর কিছু অসাধ্য-সাধন ব্যাধিতে কাতর রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় । বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার বিহারীলাল সরকারের ভাষায়, “ এ হেন রোগে কেবল হোমিওপ্যাথিকের বিন্দুপানে আরাম হইল দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় বিস্মিত হইয়াছিলেন” আশৈশব যুক্তিনিষ্ঠ বিদ্যাসাগর চিকিৎসার ফল দেখে নিশ্চিত ভাবে এর গুরুত্ব বুঝতে পারলেন। আরেক জীবনীকার চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়” তিনি যখন বুঝিলেন যে এই বিন্দু বিন্দু ঔষধ সেবনেও উপকার হইয়া থাকে, তখন আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। ঔষধের উৎকৃষ্টতা, মূল্যের অল্পতা এবং সেবনের সুবিধা সন্দর্শনে তিনি ইহার সুপ্রচারে প্রাণপণ সাহায্য করিতে লাগিলেন ।“ বিদ্যাসাগরের আগ্রহ হবেনা কেন? তিনি তো জানেন, উনিশ শতকের দারিদ্র লাঞ্ছিত, ম্যালেরিয়া, কলেরা , প্লেগ ইত্যাদি মহামারী অধ্যুষিত তাঁর স্বদেশে, এমন স্বল্প ব্যয়ের চিকিৎসা –পদ্ধতির ব্যবহার যথার্থ এবং বাস্তব সম্মত। ইতিমধ্যে রাজেন্দ্রলাল দত্ত ও ড তৌনের, ১৮৫০-৫১ সালের ম্যালেরিয়া আক্রান্ত অনেক রুগীকে সারিয়ে তুলেছে। ব্রিটিশ সরকার তখন দেশীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ বা হাকিমি চিকিৎসাকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ)। আবার পাশ্চাত্য ঘরানার চিকিৎসায় দেশীয় মানুষের তেমন আস্থা গড়ে ওঠেনি। এই অবস্থায় ইউরোপীয় ঘরানার এই নতুন চিকিৎসা-পদ্ধতি অবলম্বন করলে দোষ কি? উনিশ শতকের অন্যতম এই প্রাণপুরুষ , চিন্তায় মননে ফরাসী- জার্মান দর্শন –সংস্কৃতির মুগ্ধ সমর্থক , স্বল্প ব্যয়ে, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন এই বিদেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতিকে মনে প্রাণে গ্রহণ করলেন , বিশ্বাস করেছিলেন এর মাধ্যমেই দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তের মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা পাবে। তাই নিজে বিষয়টি সঠিক ভাবে অবগত হওয়ার চেষ্টা করলেন , উদবুদ্ধ করলেন , নিজের ভাই দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন ও আরো পরে আরেক ভাই ঈশানচন্দ্রকে। এই ঈশানচন্দ্রের উত্তরাধিকারী-রাই পরবর্তীতে ভারতের হোমিও -চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছেন। শুধু নিজের ভাইদের নয়, সে কালে তাঁর আরো অনেক অনুগত মানুষজনকে শিক্ষার জন্য পাঠিয়ে ছিলেন রাজেন্দ্রলাল দত্তের দাতব্য চিকিৎসালয়ে । সেই সব শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসা করতে লাগল। তবে এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের সব চেয়ে বড় কীর্তি সে কালের বিশিষ্ট এলোপ্যাথি ডাক্তার, ভারতে বিজ্ঞান গবেষণা প্রচারের আদি পুরুষ, মহেন্দ্রলাল সরকারকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় উৎসাহিত করায় । এ প্রসঙ্গে সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন। “মহেন্দ্রবাবু মধ্যে মধ্যে ভাবিতেন, বিদ্যাসাগর মহাশয় ভারতে অদ্বিতীয় ব্যক্তি হইয়াও হোমিওপ্যাথির এত গোঁড়া কেন? এক দিবস অগ্রজের সহিত অনেক বাদানুবাদের পর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কিরূপ তাহা পরীক্ষা করিবার জন্য তাঁহার নিকট স্বীকার করেন।
এক দিবস মহেন্দ্রবাবু ও দাদা ভবানীপুরে অনারেবল দ্বারকানাথ মিত্র মহোদয়কে দেখিতে গিয়াছিলেন। তথা হইতে উভয়ে বাটী আসিবার সময়ে এক শকটে আইসেন। আমিও উঁহাদের সমভিব্যাহারে ছিলাম। গাড়ীতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা উপলক্ষ্যে ভয়ানক বাদানুবাদ হইতে লাগিল, দেখিয়া শুনিয়া আমি বলিলাম , মহাশয় আমাকে নামাইয়া দেন । আপনাদের বিবাদে আমার কর্ণে তালা লাগিল”। সে সময়ে ভারতে দ্বিতীয় এম ডি বিখ্যাত আলোপ্যাথি চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল এত সহজে রাজি হবেন কেন? তিনি স্থির করলেন এ বিষয়ে নিজে পরীক্ষা করবেন।
ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান-সভার প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোগী মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিজের তাগিদে এই চিকিৎসা- প্রণালী পুংখানুপুংখ রূপে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হলেন । আলোপ্যাথি চিকিৎসা ত্যাগ করে সে কালে প্রতিপত্তিসম্পন্ন হোমিওপ্যাথ- চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন । একই ভাবে এগিয়ে আসেন ড বিহারীলাল ভাদুড়ী, ডা অন্নদাচরণ খাস্তগির প্রমুখ। এই তাগিদের পেছনের মানুষ কিন্তু সেই দরিদ্র -প্রেমী , সমাজসেবক - গোঁয়ার পন্ডিতটি।
শখ – শৌখিনতায় নয়, রীতিমত অধ্যাবসায়েঃ
উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথমার্ধে আলোপ্যাথি চিকিৎসকদের পাশাপাশি সমাজের কিছু বিশিষ্ট মানুষ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আগ্রহী হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য এরা হয়ত সকলেই বিদ্যাসাগরকেই অনুসরণ করেছিলেন । এই তালিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র , শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ, স্বামী বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ। কিন্তু এদের সবার পূর্বসূরী বিদ্যাসাগর ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই অনন্য। কোন সাময়িক শখ অথবা শৌখিনতায় নয়, ইউরোপীয় ঘরানার এই নতুন চিকিৎসা-পদ্ধতি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন শিক্ষার্থীর নিষ্ঠায়। ছাত্র জীবনে যে নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে শিখেছিলেন সংস্কৃত সাহিত্য, ব্যাকরণ , ন্যায়, দর্শন; পরিণত বয়সে যে আকুতিতে শিখেছিলেন ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য; জীবনের প্রৌঢতবে এসেও তাঁর মধ্যে শিক্ষার্থীর সেই আগ্রহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। এমন ভাবে শিখতে কিন্তু কোন দীক্ষাহীন অচিকিৎসককে দেখা যায়নি । কেমন ছিল সেই অধ্যাবসায় পর্ব ?
তাঁর সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের কথায় , বিদ্যাসাগর মহাশয় , প্রতি বৎসর প্রথমে বেরিনি কোম্পানি ও পরে থ্যাকার কোম্পানির মারফৎ অর্ডার দিয়ে বিলাত থেকে অনেক টাকার হোমিওপ্যাথি পুস্তক আনাতেন , তাঁর লাইব্রেরি এই সব বইতে ভরা থাকত । বিদেশে সদ্য প্রকাশিত হোমিওপ্যাথি বই কিনে গোগ্রাসে পড়েছেন , ভাল করে অ্যানাটমি শেখার জন্য নরকঙ্কাল অবধি বিদেশ থেকে কিনেছেন। তার জন্য প্রথামাফিক পাঠ নিয়েছেন সে কালের বিখ্যাত অ্যানাটমির অধ্যাপক ড চন্দ্রমোহন ঘোষের কাছে। ড ঘোষের সুকিয়া স্ট্রীটের বাড়িতে নিয়মিত পাঠ নিতে যেতেন । হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসায় রোগ- লক্ষণ পর্যবেক্ষণ খুব দরকারি । দরকার সে সব তথ্য নথিভুক্ত করা যাতে পরবর্তীতে রোগের অনুসন্ধান পর্বে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, নিরাময় সহজ হয়। এর জন্য একেবারে প্রথা মাফিক ভাবে ডায়েরিতে নথিভুক্ত করেছেন রোগ লক্ষণ, রিপোর্ট এবং নিরাময় কাল। ইন্দ্রমিত্রের লেখা বিদ্যাসাগরের জীবনীতে এ রকম নয় জনের কেস- হিস্ট্রির উল্লেখ আছে। সে সব রোগের প্রকৃতিও ভিন্ন ভিন্ন, বমি ও হিক্কা,ক্ষুধামান্দ্য অম্বল, গোড়ালি ব্যথা, পেট ব্যথা, পাতলা মল, নিতম্বে ফোঁড়া থেকে শুরু করে জরায়ুর ক্যান্সার, এমনকি অতিরিক্ত রজস্রাব , সাদা স্রাব ইত্যাদি মেয়েলি অসুখের উল্লেখ ও প্রেস্ক্রাইবড ওষুধের কথা আছে। শেষোক্ত দুটি অসুখের রোগিনী যথাক্রমে তাঁর কন্যা ও পুত্রবধূ। একুশ শতকের পটভূমিতে যা সহজ ও সবাভাবিক বলে মনে হয়, উনিশ শতকের পটভূমিতে পুত্রবধূ অসংকোচে গোপনীয় রোগের বিবরণ দিচ্ছেন চিকিৎসককে এবং চিকিৎসক শ্বশুরমশাই স্বয়ং পুত্রবধুর স্ত্রী রোগের চিকিৎসা করছেন , নথি রাখছেন , নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা। চিকিৎসা-শাস্ত্রে কোন রকম ডিগ্রী না নিয়ে অকুতোভয়ে চিকিৎসা করেছেন একাদিক্রমে অনেক বছর, বেশ কিছু রোগের, যেমন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কিছু নিয়মিত অসুখ যেমন ঠান্ডা লাগা, জ্বর , পেট ব্যথা, অম্বল ইত্যাদি। আর এই ব্যাপারে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগে থেকেছেন বয়সে ১৩ বছরের ছোট বিখ্যাত চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে । ১৮৭৯ সালের ১২ই এপ্রিল পেট ব্যথায় কাতর মহেন্দ্রলাল চিকিৎসার পরামর্শের জন্য বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করলেন। এক মাস পর, বিদ্যাসাগরের নাতির শরীর খারাপের কারণে তার চিকিৎসা করতে বিদ্যাসাগরের বাড়ি গেলেন মহেন্দ্রলাল । বিদ্যাসাগর তাঁকে উপহার দিলেন লিবেন্থ্যালের লেখা হোমিও থেরাপি্টিক্স (Libenthal’s Homeo Therapeutics)। এক সপ্তাহ পর মহেন্দ্রলাল শিশু রুগীর কুশল সংবাদ জানতে পুনর্বার দেখতে এলেন এবং বিদ্যাসাগরকে উপহার দিলেন হেইনিগসের আনালিটিক্যাল থেরাপিউটিক্স(Heineg’s Analytical Therapeutics)। এভাবেই দুই বিশিষ্ট মানুষ একে অপরের প্রেস্ক্রিপ্সানের যথার্থতা যাচাই করে নিয়েছিলেন এবং অব্যাহত রেখেছিলেন চিকিৎসা বিদ্যার সারস্বত প্রবাহ।
চিকিৎসক বিদ্যাসাগরঃ কিছু স্মৃতি, কিছু কথাঃ
সারা জীবন অজস্র ব্যধিতে ভুগেছেন বিদ্যাসাগর। খুব শৈশবে প্লীহার অসুখএ আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে ক্রনিক পেট ব্যথা, কোষ্ঠবদ্ধতা, উদরাময় রক্ত আমাশা,ইত্যাদি ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী । পরিণত বয়সে কাজের তাগিদে বিস্তৃত ভ্রমণ করতে হয়েছে হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন গ্রামের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য-পরিষেবাহীন দিনলিপি। সামান্য উপায় খুঁজে পেলে একজন অতি সংবেদনশীল মানুষ কি পারেন সমস্যা থেকে মুখ ফেরাতে? বিদ্যাসাগরের চিরকালীন করুণাসিক্ত মন সীমাহীন উৎসাহে তৎক্ষণাৎ পরোপকারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় মনোনিবেশ সেই চিত্তবৃত্তিরই প্রকাশ।
অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বসু স্মরণ করেছেন , তাঁর একবার পেটের ব্যায়রাম হওয়ায় সেকালের বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ড প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার, ব্রজেন বাঁড়ুজ্জের ওষুধ কাজ দিচ্ছিলনা। বিদ্যাসাগর মহাসয় তাঁকে দেখতে এসে বই খুঁজে খুঁজে ওষুধ দিলেন, দু তিন বার সেই ওষুধ খাওয়ার পর সুস্থ হয়েছিলেন । সবয়ং মহেন্দ্রলাল সরকারের ওষুধ পাল্টে দিয়ে বিদ্যাসাগর আরেক রোগী লালবিহারী দের লিভার অ্যাবসেস সারিয়েছিলেন।
বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার অত্যন্ত মানবিক (নাকি ঐশ্বরিক ) বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর কারমাটড় বাস কালে দরিদ্র শিক্ষাহীন সাঁওতালদের সান্নিধ্যে। বিহারীলাল সরকার লিখছেন , “ সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় শয্যাগত, বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন , হাঁ করাইয়া পথ্য দিতেন, উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন, সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন” ----। এ আন্তরিকতার হদিশ পেয়েছে শুধু সাঁওতালরা নয়, সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের মানুষ আর এই প্রয়াসের বলিষ্ঠতা তাঁর আকৈশোরের অভ্যাস অথবা বলা ভাল জীবন-ধর্ম। এই মরমী মনটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বহু আগে থেকেই ছিল। সে কোন কৈশোর কালে বাবা ঠাকুরদাসের আশ্রয়দাতা জগদ্দুর্লভ সিংহের পরিচিত কিছু মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে শুনে বালক ঈশ্বরচন্দ্র বাবা ও দুই ভাই এর ভোজনের আয়োজন করে অসহায় পাঁচজন রোগীর কাছে গেলেন । ক্রমাগত বমি ও মলত্যাগে ক্লান্ত ও পিপাসার্ত মানুষগুলির জন্য স্থানীয় গৃহস্থ বাড়ি থেকে জল এনে খাওয়ালেন, ডাক্তার রূপচাঁদের বাড়ি থেকে বেদানা, মিছরি, এক কলসি পরিষ্কার জল এনে রোগীদের খাওয়ালেন , নিজের হাতে বমি –মলমূত্র পরিষ্কার করে ধোওয়া কাপড় পরালেন । ডাক্তারের জল চিকিৎসায় আর ঈশ্বরচন্দ্রের সেবায় ক্রমে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠতে লাগল। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষে, কলকাতার কলেজ স্কোয়ার অঞ্চলে উপোসী মানুষকে নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করেছেন, বীরসিংহ গ্রামে অন্নসত্র খুলেছেন, বিদ্যাসাগরের কড়া হুকুম , যত টাকা খরচ হোক , কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। ১৮৬৯-৭০ সালে বর্ধমানে এক ভয়ানক জ্বরে প্রচুর মানুষ মারা যায়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেই সব মানুষদের বিদ্যাসাগর সেবা, ঔষধ , পথ্য দিয়ে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছেন। সেই জ্বর ছিল প্রকৃতপক্ষে ম্যালেরিয়া। বিদ্যাসাগর এ রোগের চিকিৎসার জন্য ডিস্পেন্সারি , ওষুধ-পত্রের ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হন নি, কলকাতায় এসে সে কালের ছোটলাট গ্রে সাহেবের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব বোঝান। এর ফলে সরকারী বদান্যতায় আরো অনেক ডিস্পেন্সারি খোলা হল। বিদ্যাসাগরের ডিস্পেন্সারি থেকে শুধু ওষুধ পথ্য নয়, পয়সা ও পরণের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যেত । এই ডিস্পেন্সারির কাজে বিদ্যাসাগরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্যারিচাঁদ মিত্রের ভাইপো ডাক্তার গঙ্গানারায়ণ মিত্র । ম্যালেরিয়া রোগীকে সেখান থেকে কুইনাইন দেওয়া হোত, প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়েও বিদ্যাসাগর স্বয়ং ওষুধ - পথ্য পৌঁছে দিয়ে আসতেন। বিদ্যাসাগরের এই অনন্য সাধারণ সেবার কথা স্মরণ করেছেন আরেক বিশিষ্ট মানুষ রজনীকান্ত গুপ্ত , ১৮৮৩ সালে, “একদা তিনি (বিদ্যাসাগর মশাই) প্রাতঃকালে ভ্রমণ করিতে করিতে এই নগরের প্রান্তভাগ অতিক্রম করিয়া কিয়দ্দূর গিয়াছেন , সহসা দেখিলেন একটি বৃদ্ধা অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পথের পার্শ্বে পড়িয়া রহিয়াছে। দেখিয়াই তিনি ওই মললিপ্ত বৃদ্ধাকে পরম যত্নে ক্রোড়ে করিয়া আনিলেন এবং তাহার যথোচিত চিকিৎসা করাইলেন। দরিদ্রা বৃদ্ধা তাহার যত্নে আরোগ্য লাভ করিল”।
আসলে বিদ্যাসাগর সারাজীবন যখন যে কাজে নেমেছেন , সেখানে তাঁর নিষ্ঠায় কোন খাদ রাখেন নি, নিখুঁত কর্ম সম্পাদনকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা দেখা যায়নি। চিকিৎসকের ডিগ্রী না থাকলেও তাঁর ছিল তন্নিষ্ঠ চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, অপার ধৈর্য এবং সীমাহীন মমতা, যে গুণগুলি না থাকলে একজন ডিগ্রীধারি চিকিৎসকও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারেন । কারমাটড়ে একদিন সকালে এক মেথর কাঁদতে কাঁদতে এসে তাঁকে বলল, আমার ঘরে মেথরানির কলেরা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলেন বিদ্যাসাগর, ওষুধের বাক্স আর মোড়া নিয়ে এক ভৃত্য তাঁর সাথী হল। সারাদিন রোগিনীর কাছে থেকে, প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে তাকে কিছুটা ভাল দেখে সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে স্নানাহার করলেন ।
চিকিৎসক অগ্রজের আরও অন্তরংগ পরিচয় দিয়েছেন সহোদর শম্ভুচন্দ্র। ১৮৭৫ সালে তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছিল, “দাদা প্রাতঃকাল হইতে বেলা দশ ঘটিকা পর্যন্ত সাঁওতাল রোগীদিগকে হোমিওপ্যাথি মতে চিকি্ৎসা করিয়া থাকেন এবং পথ্যের জন্য সাগু , বাতাসা মিছরি প্রভৃতি নিজ হইতে প্রদান করেন------ অপরাহ্ণে পীড়িত সাঁওতালদের পর্ণ কুটীরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন”। এখানে লক্ষ্যণীয় তিনি শুধু ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না, যুক্তিনিষ্ঠ বিদ্যাসাগর জানতেন, পথ্য সঠিক না হলে শুধু ওষুধে রোগ সারেনা।
কারমাটড়ে বিদ্যাসাগরের আরেক দিনের জীবন কথা উল্লেখ করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি দেখলেন সকাল থেকে অনবরত সাঁওতালরা তাঁর কাছে ভুট্টা নিয়ে আসছে, আর তিনিও কোন রকম দরাদরি না করে সব ভুট্টা কিনে নিচ্ছেন। কিছুপরে হরপ্রসাদ দেখলেন প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত বিদ্যাসাগর হনহন করে আল পথ ধরে হেঁটে আসছেন , হাতে একটি পাথরের বাটি। হরপ্রসাদ প্রশ্ন করাতে বিদ্যাসাগর জানালেন , কিছুক্ষন আগে একটি সাঁওতালী এসে খবর দিয়েছে, তার ছেলের নাক দিয়ে হুহু করে রক্ত পড়ছে, বললে, বিদ্যাসাগর, তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। তাই আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলাম । জানিস, এক ডোজ ওষুধেই ছেলেটার রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর আরও বললেন , এরা তো মেলা ওষুধ খায়না, অল্প ওষুধেই এদের উপকার হয়।
হরপ্রসাদ আরও প্রশ্ন করে জেনেছিলেন , গ্রামটি বেশি দূরে নয়, মাত্র মাইল দেড়েক পথ । একুশ শতকে এসে ভাবতে অবাকই লাগে, পঁয়ষট্টি বছরের এক বৃদ্ধ প্রখর রৌদ্রে অনায়াসে তিন মাইল পথ পরিক্রমা করে এলেন শুধুমাত্র দীন দরিদ্র অবহেলিত অন্ত্যজ মানুষের সেবায়।
এই সেবার এক সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন জীবনীকার চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কারমাটড় থেকে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে চিঠিতে লিখছেন বিদ্যাসাগর , “আমি কল্য অথবা পরশ্ব আপনাকে দেখিতে যাইব স্থির করিয়াছিলাম, কিন্তু এরূপ দুইটি রোগীর চিকিৎসা করিতেছি যে তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া কোন মতেই উচিত নহে। এ জন্য দু চারিদিন দেওঘর যাওয়া রহিত করিতে হইল”।
শুধু নিজে চিকিৎসা করতেন এমন নয়, ১৮৭৭ সাল থেকে প্রতি বছর প্রায় দুশ টাকার বই , ওষুধ বিদেশ থেকে আনাতেন, বই পড়তেন নিজে, প্রয়োজনে মানুষকে উদবুদ্ধ করার জন্য বিতরণ করতেন , ওষুধ বিলোতেন দরিদ্র মানুষের চিকিৎসায়, পুরোটাই মানব কল্যাণের নেশায় । তাঁর অতি বড় নিন্দুকেরাও কেউ বলেন নি বিদ্যাসাগর ডাক্তারি করেছেন ফি নিয়ে । ডিস্পেন্সারি করেছেন নিজের গ্রাম বীরসিংহে, সেখানে নিজে গ্রামবাসিদের চিকিৎসা করেছেন , মেজভাই দীনবন্ধুকেও উৎসাহিত করেছেন এরই কাজে। বর্ধমান ফিভারের সময় বিস্তীর্ণ এলাকায় একই ভাবে ডিস্পেন্সারি খুলে চিকিৎসা করেছেন , নিজের উদ্যোগে, প্রয়োজনে সরকারি প্রশাসনের উচ্চতর স্তরে, সেখানে কোন রোগীর জাত –ধর্ম বিচার করেন নি । এখানে একটি কথা না বললেই নয়। যে কোন শাস্ত্রে পারদর্শিতার আড়ালে থাকে দীর্ঘ এবং ধারাবাহিক শ্রম। হোমিওপ্যাথি বিদ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রথাগত শিক্ষা না পেলেও তাঁর স্ব-শিক্ষার আন্তরিকতার কথা জানলে বিস্মিত না হয়ে পারা যাবেনা। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহের স্বাস্থ্য বিজ্ঞান সম্পর্কিত বইগুলি তাঁর নিবিড় অনুরাগের হদিস দেয়। বর্তমানে কলকাতায় সাহিত্য পরিষদ ভবনে রাখা আছে হোমিওপ্যাথি, চাইল্ড কেয়ার, সাইকোলজি , সাধারণ স্বাস্থ্য - সম্পর্কিত অজস্র বই। শারীরবিদ্যায় প্রগাঢ অনুরাগ ও যথোচিত জ্ঞান না থাকলে কি আর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মেয়েদের সহবাস সম্মতি বিলে পূর্ব নির্দিষ্ট বারো বছর বয়সটিকে মান্যতা দিতে আপত্তি জানান ! শুধু শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নয়, তিনি জেনেছিলেন স্বদেশের মেয়েদের রজঃস্বলা হওয়ার বয়স বারো বছরে স্থির থাকেনা, তেরো চোদ্দ এমন কি পনেরোতেও পৌঁছতে পারে। এ ধারণা পেতে তাঁকে হয়ত বা ভাবে সাহায্য করেছিল বাঙ্লায় প্রথম শব ব্যবচ্ছেদকারী, সংস্কৃত কলেজে একদা বৈদ্যক শ্রেণির ছাত্র, পরবর্তীতে পাশ্চাত্য চিকিৎসায় শিক্ষিত চিকিৎসক এবং তাঁর প্রিয়জন পন্ডিত ও গবেষক মধুসূদন গুপ্ত ।
সব শেষে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ না করলেই নয়। পুরোনো হাঁপানির রোগী বিদ্যাসাগর শীতকালে বিশেষ ভাবে কষ্ট পেতেন । তখন তাঁর অভ্যাস ছিল সকাল –বিকেল দুবেলা গরম চা পান। একদিন চা পানের পর তাঁর মনে হল বেশ সুস্থ লাগছে, হাঁপানির টান যেন বেশ কিছু্টা কম, । গৃহভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন , সেদিনের চা সে নিজেই তৈরি করেছে। বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন , চায়ের মধ্যে কি আদার রস মেশানো হয়েছে? গৃহভৃত্য বলল, না সেরকম কিছু সে করেনি, তবে তাড়াহুড়োয় কেটলিটি না ধুয়েই জল চাপিয়ে দিয়েছে। কেটলি খুলে দেখে বিদ্যাসাগর যুগপৎ বিস্ময় এবং ঘৃণা অনুভব করলেন। কেটলির মধ্যে দুটি আরশোলা পড়ে আছে। বিদ্যাসাগরের অনুসন্ধিৎসু মন বলল, এক কেটলি জলে যদি বেশ কিছু আরশোলা ফুটিয়ে , পরে সেই নির্যাস অ্যালকোহলে ফেলে, ছেঁকে ও পরে লঘু দ্রবণ করে হোমিওপ্যাথি ওষুধ বানান যায় । ভুবনকৃষ্ণ মিত্র লিখেছেন , এ ভাবে হোমিওপ্যাথি মতে ওষুধ তৈরি করে তিনি বহু রোগীকে না জানিয়ে এই ওষুধ সেবন করান , এবং বিনা ব্যয়ে বহু লোকের রোগের উপশম ঘটান । যে কোন যুক্তিনিষ্ঠ মন অপ্রাকৃত কিছু দেখলে অনুসন্ধানে ব্যস্ত হবেই। বিদ্যাসাগরও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। প্রাচীন চীনা চিকিৎসা বিদ্যায় এই প্রাণিটির হাঁপানি সারানোর ভুমিকা কিন্তু স্বী্কৃত। আর বর্তমানে হাঁপানির নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি ওষুধে এই প্রাচ্যদেশীয় তথা ভারতবর্ষীয় আরশোলা থেরাপির কথাও কিন্তু মান্যতা পেয়েছে।
কিন্তু এই গবেষণার ইতিহাসে সেই সুপ্রাচীন সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিত, সমাজসেবী এবং স্বশিক্ষায় শিক্ষিত ডিগ্রীহীন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক বিদ্যাসাগরের আদি পরীক্ষাটির কথা হয়ত বা একালের হোমিওপ্যাথি গবেষকেরা কেউই জানেন না।
---------------------
তথ্য সহায়তাঃ
১।ক) শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন , বিদ্যাসাগর জীবন চরিত ও ভ্রম নিরাস , চিরায়ত প্রকাশ ন মার্চ ২০১৯, পৃঃ ৯৫
খ) ঐ পৃ ৯৬
২।. উইকিপেডিয়াঃ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান
৩। ড জি এম ফারুক, আধুনিক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, দৈনিক সংগ্রাম, ঢাকা, ৩রা জুলাই ২০১২।
৪। Dilli Homeopathic Anusandhan Parishad; Origin and Growth of Homeopathy in India (http:// www, delhihomeo.com)
৫।ক) শঙ্কর কুমার নাথঃ ”চিকিৎসা বিজ্ঞানে আত্মমগ্ন ঈশ্বচন্দ্র বিদ্যাসাগর; অজানা বিদ্যাসাগরঃ অনন্য দিশারি( গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ) বিদ্যাসাগর চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র , কলকাতা ২০১৯, পৃ ৭১-৭২।
খ)ঐ পৃ ৭৩
গ)ঐ পৃ ৭৭-৭৮
৬।ক) বিহারীলাল সরকার , বিদ্যাসাগর, ১৮৯৫, পৃ৪৮৯
খ)ঐ পৃ ৪৯১
গ) ঐ পৃ ৫০০-৫০১
৭।ক)চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় , বিদ্যাসাগর , ১৯০৯, পৃ ৫০১
খ) ঐ পৃ ৫০৩
গ)ঐ পৃ ৪৯৭
৮।ক) ইন্দ্র মিত্র , করুণাসাগর বিদ্যাসাগর,আনন্দ, কলকাতা, ২০১২, পৃ১০২-১০৩
খ) ঐ পৃ ৩২-৩৬
গ) পৃ ৪২১
ঘ) পৃ৪২৩
ঞ)পৃ৪২৫
৯। Biswas B, Jhansi S, potu R, patel S et al Physicochemical study of homeopathic drug, Blatta orientalis . Indian J Res Homeopathy 2018 :12: 125-31
১০। ক) Brian A Hatcher. Vidyasagar: The Life and after Life Of an eminent Indian. Routledge, India 2019. P-97
খ) Ibid, p 99
গ) Ibid p100
ঘ) Ibid, p 101
১১। DattaGupta Mahua. Negotiating the Trajectory of a Marginal Medical Discipline : Homeopathy in Colonial Bengal. Ph. D Thesis submitted to the University Of Burdwan 2015.
১২। ক্ষুদিরাম বসুঃ বিদ্যাসাগর স্মৃতি, পঞ্চ পুষ্প, আষাঢ ১৩৬৬, পৃ২৯৩।
১৩। রজনীকান্ত গুপ্ত, স্বর্গীয় ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৯৩, পৃ১৭
১৪। ভুবন কৃষ্ণ মিত্রঃ জীবতত্ত্ব, জন্মভূমি, ফাল্গুন ১৩০৮, পৃ ২৫০-৫১
১৫। Hazra S, Indian Renaissance Of Homeopathy.( https:// www. homeotimes.com )
১৬।. Press Information Bureau, Govt Of India, President’s Secretariat, 22.08.2016. (https://pib.gov.in)
১৭। ড। শঙ্কর কুমার নাথ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গোরার কথাও পন্ডিত মধুসূদন গুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০১৯, পৃ২৫১-২৫৬।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন