◆ শ্রীশুভ্র / ফেক এনকাউন্টার এণ্ড ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল ডিসকোর্স


না, ঘটনা নতুন কিছু নয়। ধরা পড়া অপরাধীর কান টানলেই যেখানে প্রভুত প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী সরকারী বেসরকারী রাঘববোয়ালদের মুখ বেড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা সেখানেই এনকাউন্টারে মৃত্যু। পুলিশি হেফাজতে। আমারা সাধারণ জনগণ। অনেকটা অবোধ নির্বোধ শিশুদের মতো। আমাদের ফিডিংবোতল খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেল। রোজ যে পথ্য যেরকম ভাবে খাওয়ানো হবে। আমরা সেইরকম ভাবেই খেয়ে নেবো। কেউ যে বেয়াড়াপানা করবে না, তা নয়। ক্ষমতায় নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের তৈরী ফিডিংবোতলে মুখ না লাগালেই সে নিশ্চয় দেশদ্রোহী। পাকিস্তান কি চীনের দালাল। তাই আমরা সুবোধ বালক। আমরা কোন প্রশ্ন করবো না। করলেই আর গোপালকে কেউ সুবোধ বলবে না। 

আমরা মোটেই প্রশ্ন করবো না। দাগী অপরাধী পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর চারধারে পুলিশ প্রহরায় থেকে হাতে হাতকড়া কোমরে দড়ি পড়া অবস্থায় পুলিশের বন্দুক ছিনিয়ে নিচ্ছে। একেবারে হিন্দী সিনেমার স্টাইলে। সিনেমায় স্ক্রিপ্ট থাকে পরিচালক থাকেন। অবিশ্বাস্য ঘটনাটাকে দেখানোর জন্য। এখানেও স্ক্রিপ্ট থাকে। পরিচালক থাকেন। অবিশ্বাস্য ঘটনাটাকে ঘটানোর জন্য। কিন্তু একটা পার্থক্য বর্তমান। সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটারকে ও পরিচালককে মুখ লুকাতে হয় না। সিনেমার টাইটেলে তাদের নাম উজ্জ্বল ভাবে লেখা থাকে। কিন্তু পুলিশি হেফাজতে থাকা বন্দীর ক্ষেত্রে বন্দুক ছিনিয়ে নেওয়ার স্ক্রিপ্ট যিনি তৈরী করেন। যাঁর পরিচালনায় সমগ্র ঘটনাটা নিপুণ দক্ষতায় সংঘটিত করা হয়, তাঁদের আর মুখ দেখানোর উপায় থাকে না। না, মুখ তারা সারাদিনই দেখাচ্ছেন। আর তাদের মুখঃনিসৃত দৈববাণী আমাদের ফিডিংবোতলে ভরে দেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের কম ছোটাছুটি করতে হয় না। কিন্তু এই ফেক এনকাউন্টারের টাইটেলে তাদের নাম থাকে না। রাখা যায় না। 

আমরা এও প্রশ্ন করবো না। দাগী অপরাধীদের যখন হাতকড়া পড়ানো হয়। তখন আন্তর্জাতিক প্রচলিত পদ্ধতি হলো দুই হাত পিঠের দিকে পিছমোড়া করে বেঁধে হাতকড়া পড়িয়ে দেওয়া। ভয়ঙ্কর ভায়োলেন্ট অপরাধীর ক্ষেত্রে দুই পায়েও বেড়ি পড়িয়ে দেওয়া। যাতে হেফাজতে নেওয়া অপরাধীকে আনা নেওয়ার সময়, অপরাধী কোন ভাবেই পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পালানোর চেষ্টাও করতে না পারে। আমাদের দেশেও যে এমনটা করা হয় না, তাও নয়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যেখানে দাগী অপরাধীর সাথে ক্ষমতার অলিন্দে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দহরম মহরম, সেখানে এমনটা করার রীতি নাই। যখনই দেখা যাবে অপরাধী মুখ খুললেই গণতন্ত্রের ঝুলি থেকে ঘরের কেচ্ছা কাহিনী সব বেড়িয়ে পড়বে, সেখানে এই রীতি মানা যাবে না। সেটাই ভারতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। আর সেখানেই এনকাউন্টার। সেই এনকাউন্টার জনগণের ফিডিংবোতলে ঠিক মতো খাওয়াতে হবে। সিনেমাহলে দর্শক যেমন সিটি দিয়ে টিকিটের দাম উসুল করে, নায়কের হাতে ভিলেন নিধনে। ঠিক সেইরকম ভাবেই যেন জনগণ ভোটের লাইনে দাঁড়ানোর কষ্টও উসুল করে নিতে পারে এই এনকাউন্টারে অপরাধীর মৃত্যুর স্ক্রিপ্টে। 

ঠিক হয়েছে। বেশ হয়েছে। এদের গুলি করেই মারা উচিত। কোর্টে গেলেই উকিল দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকবে। শাস্তিও বিশবাঁও জলে। আর শাস্তি? খুব বেশি হলে চৌদ্দ বছর! আমি হলে তো একটাকেও ছাড়তাম না সোজ গুলি করে উড়িয়ে দিতাম। ওটাই ওদের শাস্তি। এইভাবেই আমাদের ফিডিংবোতলে খাইয়ে খাইয়ে তৈরী করা হয়েছে। আমরাও তৈরী। একটার পর একটা এনকাউন্টার ঘটে। আর সান্ধ্য নিউজটাইমের টিআরপি বাড়ে। আমাদের রাতের ঘুমও আরও স্বপ্নময় হয়ে ওঠে। 

ভারতবর্ষের রাজনীতির ধারা ও গতিপ্রকৃতির দিকে লক্ষ রাখলে দেখা যাবে তার দুইটি ভিন্ন মুখের ছবি। পরাধীন ভারতে রাজনীতির ধারা ও স্বাধীন ভারতে রাজনীতির ধারা। সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী দুইটি ঘরনা। স্বাধীনতার আগে রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল, দেশকে বিদেশী শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করা। স্বাধীনতার পর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ক্ষমতা কুক্ষিগত করে চৌদ্দ পুরুষ গুছিয়ে নেওয়া। স্বাধীনতার আগে রাজনীতিতে যোগ দিত মূলত উজ্জ্বল মেধার উচ্চশিক্ষিত যুব সম্প্রদায়। স্বাধীনতার পর দিনে দিনে সেই ধারা আজ অবলুপ্ত। আজ রাজনীতিতে যোগ দেয় অশিক্ষিত মেধাহীন ও অল্প শিক্ষিত মধ্যমেধার যুব সম্প্রদায়। স্বাধীনতার আগে রাজনীতি দূর্বৃত্তদের আশ্রয়স্থল ছিল না। স্বাধীনতার পর রাজনীতিই দূর্বৃত্তদের শেষ আশ্রয়স্থল। স্বাধীনতার আগে রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলার অবকাশ থাকতো না। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রে যত বেশি প্রশ্ন উঠবে, ততই তাদের ভোট বাক্সে ব্যালট পেপারের ওজন বাড়বে। স্বাধীনতার আগে জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে আদর্শ নীতি সৎসাহস অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার শক্তি প্রভৃতি গুণাবলীর শিক্ষা নিত। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে জানগণ অন্যায় সুবিধে ও অনৈতিক সুযোগ নিতে আগ্রহী। তারা রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে দুর্নীতির পাঠ নেয়। রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে শঠতা কদর্যতা অশ্লীল ভাষা ও মিথ্যাচারের শিক্ষা নেয়। স্বাধীনতার আগে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল মেধাবী নক্ষত্ররা রাজনীতিতে পা রাখতো। স্বাধীনতার পর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বখাটে ডানপিটে টুকে পাশ করা নিরেট মুর্খ মাথার ছেলেমেয়েরাই প্রধানত রাজনীতিতে পা রাখে।স্বাধীনতার আগে রাজনৈতিক নেতাদের মূল পরিচয় ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতাদের মূল পরিচয় ক্ষমতাসংগ্রামী। স্বাধীনতার আগে রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল দেশসেবা। স্বাধীনতার পর রাজনীতির মূল লক্ষ্য দেশ লুঠ করা।

ফলে আজকের ভারতীয় রাজনীতি একদম সঠিক দিশায় নিপুন হাতে পরিচালিত হচ্ছে। একেবারে সুনির্দিষ্ট অভিমুখে। কোথাও এতটুকু ভেজাল নাই। সংসদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের চল্লিশ শতাংশের বিরুদ্ধেই নানাবিধ ভয়ঙ্কর ফৌজদারী মামলা ঝুলে রয়েছে। ঝুলেই আছে। কেননা ঝুলিয়ে রাখা আছে। পরবর্তী সংসদে আশা করা যায় নির্বাচিত অভিযুক্ত দাগী অপরাধীদের সংখ্যাটি পঞ্চাশ শতাংশে পৌঁছিয়ে যাবে। এবং এটি হিমশৈলের চুড়া মাত্র। এর তলায় সব কয়টি রাজ্যের নির্বাচিত বিধায়ক। পুরসভার নির্বাচিত জন প্রতিনিধি। নির্বাচিত গ্রাম পঞ্চায়েত সব মিলিয়ে গোটা দেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এখন দাগী অপরাধীদের হাতেই। তাদেরই অঙ্গুলি হেলনে আজ ভারতবর্ষের রাজনীতির স্বরূপ নির্ধারিত হচ্ছে। তাতে সঙ্গত দিচ্ছে আর বাকিরা। যারা সরাসরি অপরাধের সাথে যুক্ত নয়। কিন্তু নানাবিধ সুযোগ সুবিধার সাথে যুক্ত। আর সঙ্গত দিচ্ছি আমরা সাধারণ জনগণ। প্রতিদিনের ফিডিংবোতলে পুষ্ট হতে হতে। 

ঠিক এই কারণেই ভারতীয় রাজনীতি আন্ডারওয়ার্ল্ডেকে বাদ দিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এই রাজনীতির উঠতে বসতে আন্ডারওয়ার্ল্ডকে প্রয়োজন। আর সেই কারণেই সমাজবিরোধীরাই আজ সমাজসেবক সেজে মঞ্চ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এখন এই যে সংস্কৃতি। মূলত যেটিকে দেশলুন্ঠনের সংস্কৃতি বলা যেতে পারে, তাতে লুঠের মালের ভাগাভাগির হাইওয়েতে পরস্পর গায়ে গায়ে ঠোকাঠুকি হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। মুশকিল হয় তখনই। তাখনই কাউকে না কাউকে স্কেপগোট না করলে গোটা ব্যবস্থাটাই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়তে পারে। ফেক এনকাউন্টার সেই রকমই একটি ওয়ে আউট। সাপও মরবে। লাঠিও ভাঙবে না। দুর্নীতির সাম্রাজ্যকে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়া থেকে রক্ষা করার অনেকগুলি উপায় রয়েছে। রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা সেই বিষয়ে আরও বেশি ওয়াকিবহাল। ফেক এনকাউন্টারে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনকে উড়িয়ে দেওয়াও তার অন্যতম উপায়। না হলে অপরাধী যদি প্রেসের কাছে মুখ খোলে। অপরাধী যদি আদালতে রাজনীতি ও আণ্ডারওয়ার্ল্ডের যোগসাজগের সব প্রামাণ্য নথী তুলে ধরে। তাহলেই কান টানলে যে সব মাথাগুলি একের পর এক বেড়িয়ে আসতে থাকবে, তারপর সরকার ধরে রাখা সংবিধান মেনে প্রায় অসম্ভব। ফলে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। আত্মরক্ষার অধিকার সকলেরই রয়েছে। তা, সে যে পথেই হোক না কেন। আর ফিডিংবোতল ধরিয়ে দেওয়া জনগণকে ম্যানেজ করতে দুদিনও লাগবে না। বরং জনগণকে বোঝানো যাবে সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন ভাবে কঠোর পদক্ষেপে বিশ্বাসী। তাই অপরাধীদের ধরা শুরু হয়েছে। 

না আর কোন প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন করলেই আয়ুর নিশ্চয়তা নাই। বিপদের ঝুঁকি পদে পদে। মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার হাত সবসময় লম্বা। আর সেই হাতে আসুরিক শক্তি। নাগালের বাইরে পালানোর উপায় নাই। আমরা তাই দুইবেলা ফিডিংবোতলে মুখ লাগিয়ে দিবানিদ্রা দেবো। আর কুম্ভকর্ণের মতো পাঁচ বছর অন্তর একদিন জেগে উঠে ভোটের লাইনে দাঁড়াবো। তারপর কোন বোতামে আঙুল টিপতে হবে, বলে দেবে লোকাল দাদা দিদিরা। নজর তাদের সর্বত্র। অবিরত। নয়তো পাড়া ছাড়তে হবে যে তাই। তাই প্রশ্ন নয়। কোন প্রশ্ন নয়। 

১২ই জুলাই’ ২০২০


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ