অনেকদিন ধরেই ইচ্ছেরা মনের দরজা জানালা দিয়ে উকিঝুঁকি মারছিল আর সুযোগ পেতেই স্বপ্নীল ডানা মেলে মুক্ত বিহঙ্গের মতো নীল আকাশে বাঁধনহারা ওড়ার নেশায় ছুটে চলল। মানুষের মনের ভেতর ঘুরে বেড়ানোর একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছে সব সময়ই থাকে। আমারও আছে। আর সেটাই বাস্তবে রূপ নিল মায়াপুরে বেড়াতে গিয়ে। মায়াপুর সত্যিই মায়া দিয়ে ভরা। এই অঞ্চলেই চৈতন্যদেবের জন্মস্থান। সেদিক থেকে মায়াপুর হিন্দুধর্মালম্বীদের কাছে একটা তীর্থস্থানের তকমা লাভ করেছে। তবে যারা ধর্ম, অলৌকিক ঘটনা বা ঈশ্বরে খুব একটা বিশ্বাস করেন না তাদের কাছেও এই জায়গা ভালো না লাগলেও খুব খারাপ যে লাগবে না তা আমি বলতে পারি। আর যারা বিশ্বাস করেন তাদের জন্য তো ঈশ্বর এখানে তার সমস্ত সাম্রাজ্য নিয়ে উপস্থিত আছেন। শুধু ঘুরতে গেলেই দর্শন আর পূর্ণ লাভ। তবে শোনা যায়, ধর্মের কল নাকি বাতাসে নড়ে কিন্তু যদি বাতাস বন্ধ থাকে তাহলে কি হয়?
ভ্রমণের দিন সকাল থেকেই মন ভীষণ খুশি ছিল। সত্যি কথা বলতে কি প্রতিদিনের রুটিন থোড় বড়ি খাঁড়া আর খাঁড়া বড়ি থোর জীবনে শরীর মন একঘেয়ে অবসাদে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। এমনাবস্থায় একঘেয়েমি রুটিন থেকে একটু মুক্তির স্বাদ পেতেই মন চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। তাই সেদিন সকাল থেকেই মনটা আনন্দে ভরে ছিলো আর ছিলো ভীষণ উৎসুক। কি নেব আর কি নেব না তা নিয়ে নানা রকম প্রস্তুতিপর্ব শেষ করে ছোট ট্রাভেল ব্যাগটা গুছিয়ে নিলাম। আমাদের টুরটি যেহেতু একদিনের ছিলো তাই বিশেষ কিছু নেইনি। ক্যামেরা, একসেট করে জামা প্যান্ট, টাওয়েল আর অবশ্যই প্রিয় ডায়েরি ও কলম। সেদিন ছিলো শুক্রবারের রাত, ডিসেম্বর মাস। রাত দশটার দিকে মালদা থেকে আমাদের আগেই ভাড়া করা গাড়িটি ছাড়লো। পথের মধ্যে দু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভোর চারটা নাগাদ মূল ইসকন মন্দিরে পৌঁছে গেল। গাড়ি থেকে নেমেই কয়েকজন সহযাত্রীসহ মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলাম। জানলাম সকাল সকাল একটা আরতি হয় কিন্তু তখনো একটু সময় বাকী ছিলো তাই সবাই অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেশি সময় অপেক্ষা করতে হলো না। একটু পরেই দরজা খুলে গেলো। দেখলাম প্রচুর ভক্তের সমাগম। আমরাও তাতে যোগ দিলাম ঘন্টাখানেকের ওপরে নামকীর্তন হলো। সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে হয়তো জানালো হলো আমরা এখনো তোমাকে মনে প্রাণে ডাকি তবে তোমার প্রদর্শিত পথে চলি কি তা নিয়ে তোমার বিশেষ ভাবার কোন প্রয়োজন নেই।
ওখানের পাট চুকিয়ে সবার জন্য একদিনের একটা ঘরভাড়া করতে বেরোলাম। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। জিনিসপত্র রেখে ফ্রেশ হওয়াটাও দরকার। এখানে মূল মন্দির এলাকার ভিতরেই এসি, ননএসি, ডবল বেড, ডরমিটরি বিভিন্ন রকম রুম আছে। আমরা সাধ্যমত একটা ঘর নিলাম। আমরা বাইরে দেখিনি। বাইরেও বিভিন্ন মানের ছোট বড়ো ঘর আছে। প্রয়োজন আর সামর্থ্য মতো ভাড়া নিলেই হলো। তবে বাইরে ঘর নিলে দরদাম করে দেখে শুনে নেওয়াই ভালো। ঘর নিয়ে হালকা কিছু খেয়ে ঘন্টা তিনেকের ঘুম দিলাম। রাতের ধকলের ফলে শুতেই ঘুম চলে এলো।
সকাল দশটার দিকে উঠে চটপট স্নান করার জন্য দৌড়ালাম নদীতে। কেউ কেউ অবশ্য এখানেই স্নানের জায়গায় প্রাতঃকর্ম ও স্নান দুইই সেরে নিলো। কিন্তু আমরা কজন গঙ্গানদীতে স্নান করে পাপক্ষালনের লোভে নদীর দিকেই গেলাম। কথিত আছে এবং সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই বিশ্বাস করেন গঙ্গা স্নানে নাকি পাপ ক্ষয় হয়। তবে ব্যাপারটা মন থেকে সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারি না আবার না মেনেও পারি না। কারণ যেহেতু আমিও একজন হিন্দুর ছেলে এবং শ্রীকৃষ্ণ ও রামে বিশ্বাসী যদিও আমি তাদের কখনই নিজ চোখে দেখিনি তথাপি তাদের এবং অদৃশ্যমান ঈশ্বরে বিশ্বাসী তেমনি এই গঙ্গাস্নানের ব্যাপারটাও হালকা মনেই মেনে নিলাম। অত যুক্তি তর্কে গিয়ে কি লাভ? কথায় আছে -"বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর"। কিন্তু যদি কেউ বিশ্বাস করে "দুই আর দুই এ আট হয়" - আসলে কখনো-কি-তাই হয়?
স্নান সেরে ফিরে, তৈরি হয়ে ঘুরতে বের হলাম। ইসকন মন্দির এবং তার পাশের আরও বেশ কয়েকটি মন্দির দেখে নিলাম। পুরোনো সেসব তবে সুন্দর করে সাজানো গোছানো। ঘুরতে ঘুরতে মায়াপুর থেকে নদী পার হয়ে গেলাম নবদ্বীপে। নৌকা করে নদী পার হবার সময় দেখলাম দুটো স্রোতের মিলন ধারা। জলঙ্গি নদীর জল কালচে আর ভাগীরথীর জল ঘোলাটে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল দুটো নদীর মিলনধারা। দুটোর স্রোতের রংই যে আলাদা। কেউ কেউ অবশ্য বোতলে সেই জল সংগ্রহ করলেন বাড়িতে নিয়ে ঠাকুরঘরে রাখবেন বলে। আমি অবশ্য হাতে স্পর্শ করে মাথায় ছোঁয়ালাম। নবদ্বীপ জায়গাটাও বেড়ানোর জন্য বেশ ভালো আর মন্দিরগুলোও সুন্দর।
নবদ্বীপ ঘুরে দুটোর দিকে আবার ফিরে এলাম মায়াপুরে। সকালেই মন্দিরের খাবারের টিকিট কেটে নিয়েছিলাম। ২০, ৫০, ৭০ টাকার টিকিট আছে। সব পদই নিরামিষ। খাওয়া জায়গাটা বিশাল বড়ো। মাটিতে মাদুর পেতে বসতে হয়। আমার তো মনে হলো দু হাজার লোক খাচ্ছে এক সাথে। যেন কোন উৎসবে সামিল হয়েছি বা পিকনিক করছি। খাওয়া শেষ করে এবার বের হলাম ইসকন মন্দির দেখতে। নতুন মন্দিরের কাজ তখনো শেষ হয়নি তাই পুরাতন মন্দির দর্শন করলাম। সাথে মহাপ্রভুর দিব্যলীলা প্রদর্শনী, শ্রীল প্রভুপাদ পুষ্প সমাধি মন্দির, গোশালা এবং আরো কয়েকটি স্থান। বিশাল বড়ো এলাকা। সবটা পায়ে হেঁটে ঘোরা একটু মুশকিল। এখানে অনন্ত দুরাত থাকার মতো সময় হাতে নিয়ে এলে আরো অনেক জায়গা বা এই জায়গার সুষমা ভালো করে হৃদয়ঙ্গম করা যাবে। মূল মন্দির এলাকার ভিতরেই দেখলাম বিদেশী প্রচুর ভক্ত থাকেন।
এমনভাবে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা নেমে এলো। কিছু টুকিটাকি কেনাকাটা করলাম স্মৃতি হিসেবে রাখবো বলে। গোটা দিন বেশ ভালোই কাটলো। সেই রাতেই (শনিবার) আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে। রাতের খাবারেরও টিকিট আগেই কাটা ছিলো। গীতাভবন রাতের খাবারের জায়গা। এখানেও ৭০, ১০০, ২০০ টাকার বিভিন্ন রকম থালি আছে। এবং বলাই বাহুল্য সব পদই নিরামিষ। লাইনে দাঁড়িয়ে প্লেট নিয়ে খেয়ে ঘরে ফিরে একটু রেস্ট করছিলাম। গাড়ি রাত এগারোটার দিকে ছাড়ার কথা। মেন গেট অতো রাত পর্যন্ত সাধারণত খোলা থাকে না। আমরা আগেই বলে পারমিশন নিয়ে রেখেছিলাম। তো এমন সময় এক বন্ধু গল্প প্রসঙ্গে আমার কাছে জানতে চাইলো আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কি না। আমি বললাম ঈশ্বর সম্পর্কে তো নানাজনের নানা মত, যুক্তি, তর্ক, আলোচনা, সমালোচনা আছে। আমি এসব গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যেতে চাই না। তবে আমার এটা মনে হয় এই ঈশ্বর, অলৌকিক ঘটনা বা এই বিশ্ব প্রকৃতিকে চেনা জানার বিভিন্ন স্তর থেকে দেখা সম্ভব। নানা স্তর থেকে নানা প্রশ্নের হরেক উত্তর আসবে। এবং এটাও ঠিক নিজ নিজ দেখার ক্ষেত্র থেকে সবগুলোই গ্রহণযোগ্যতার দাবী রাখবে। কিন্তু এদের বিরোধী ধরে নিলে অকারণ বির্তক বাড়ে এবং তার সমাধান অসীমে গিয়ে ঠেকে। আমি শুধু এই সব নানা বাদ, বিবাদ, অপবাদ, অনুবাদের বাইরে সত্যটাকে গ্রহণ করতে চাই। বন্ধুটি কি বুঝলো জানি না। এই বিষয়ে আর কোন কথা এগোলো না। তারপর সারাদিনের বেড়ানো, খাওয়া, বাজার এসব নিয়েই গল্পগুজব চললো।
রাত সাড়ে দশটার দিকে সবাই আস্তে আস্তে গাড়ীর দিকে এগোতে থাকলাম। মনটা আবার চেনা ছকের গন্ধ পেতে লাগলো। সেই রুটিন আর সেই একই জীবনের ঘানি। তবে এই স্বল্প বেড়ানোর স্মৃতি মনের কোণে অক্ষয় হয়েই থাকবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। শেষে সার্বিকভাবে বলতে পারি, এই জায়গা যে কোন সময় এবং আট থেকে আশি সব বয়সের মানুষের কাছে বেড়ানোর পক্ষে নিরাপদ আর ধর্মীর জ্ঞান আহরণের পক্ষে তো বিশেষ উপযোগী তাতে কোন সন্দেহ নেই। সময় আর সুযোগ হলে আরো এক দুবার যে এখানে সময় হাতে নিয়ে আসবই সেটা অসংকোচে বলতে পারি।
প্রয়োজনীয় তথ্য : পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গা থেকেই এখানে আসার বাস ও ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটামুটি ভালো। আসার আগে একবার নেটে দেখে নিলে অহেতুক ভয় কেটে যায়। ট্রেনে নবদ্বীপের বিষ্ণুপ্রিয়া স্টেশনে নেমে টোটো করে ফেরিঘাট। তারপর ফেরি পার করে আবার টোটো করে মন্দির আসা যায়। বাসে গেলে ধুবুলিয়া নেমে পাবলিক ছোট গাড়িতে আরামেই যাওয়া যায়। আর নিজস্ব রির্জাভ গাড়ি হলে কোন অসুবিধাই নেই। রুমের জন্য নামহট্ট কার্যালয়ে ফোন করে বুকড করা যায়। নম্বর - ০৩৪৭২ ২৪৫৩০৫ বা মোবাইল - ৭৫৪৮৯ ৬৯২৬৯। আগেই বলেছি প্রয়োজন জানলে উনারা ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া কম খরচে ভেতরেও রুম মেলে। নম্বর - ৮৬১৭৫ ২৬৯৮৩। তাছাড়া বাইরেও প্রচুর হোটেল আছে। সবক্ষেত্রেই ভালো করে কথা বলে নেবেন। ভীড় এড়াতে শনি রবিবার না যাওয়াই ভালো। প্রতিদিনই কম বেশি ভীড় থাকে বটে। ভিতরে থাকলে বাইরের কোন খাদ্য বস্তু নিয়ে ঘরে প্রবেশ নিষেধ। তবে বাইরে খেয়ে আসলে কোন অসুবিধা নেই। ভেতরের সব খাবারই নিরামিষ। থাকার ঘরে কোনরূপ নেশাজাতীয় বস্তু সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং নারী পুরুষ অশালীন মেলামেশাও। কিছুক্ষেত্রে পোশাক বিবিধও আছে তবে বাঙালীর স্বাভাবিক পোশাকে কোন অসুবিধা নেই। মূল মন্দিরে মোবাইলে নিয়ে ঢোকা বারণ তাই তা রুমে রেখে যাওয়াই ভালো। নইলে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে কুফন কেটে লকারে রাখতে হবে। তাতে জমা দিতে আর তুলতে অযথা সময়হানি হয়। মোটামুটি এই ছিলো জানানোর। বাকীটা ওখানে গেলেই বুঝে যাবেন। বিশেষ কিছু অসুবিধা নেই।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন