কথা হচ্ছিলো শুভর সঙ্গে, শুভব্রত আমার ফেসবুকতুতো ভাই। কবিতা আমাদের মানসিক নৈকট্য এনে দিয়েছে। সেদিন খুব আশঙ্কিত হয়েই প্রশ্নটা করেছিলো শুভ "দিদি, আমরা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে যাবো না তো?"সি .এ. এ. নিয়ে দেশব্যাপী যে সংকট চলছে। যে সময় আর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা ভারতবাসী এই মুহূর্তে চলেছি তাতে শুভর আশঙ্কা অমূলক নয়।এই জরুরী অবস্থায় দেশের বিরোধী দলগুলির চরিত্রও স্পষ্ট নয়। আমার আশঙ্কা দেশের আশু সমস্যা সমাধানের চাইতে নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের নিরাপত্তাই তাদের কাছে সবচেয়ে জরুরী। বিশেষত 'মুসলিম' ভোটব্যাঙ্ক। রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে সমস্যা সমাধানের প্রকৃত পথানুসন্ধানের কার্যকর প্রয়াস কোন দলেরই আছে বলে অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তাই আমার মনে হয় এই আন্দোলন, দেশব্যাপী এই হিংসার,বলা ভালো নিরাপত্তাহীনতা জনিত আশঙ্কা এবং তার স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ এই নেতৃত্বহীন গণঅভ্যুত্থান। আসলে আমি একজন অতিসাধারণ নাগরিক। আমার ভাবনাচিন্তার পরিসরও অতি সাধারণ। সেই সাধারণের দৃষ্টিতে ঘটমান পরিস্থিতির নিরিখে এটাই বলতে হচ্ছে ভারতবর্ষ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।বা বলা ভালো অস্তিত্ব সংকটে। এন. আর .সি, সি .এ. এ. ভালো কি মন্দ, এ নিয়ে দিনরাত তরজা চলছে,এর প্রতিবাদে পারে সারা দেশ আজ পথে নেমেছে একথা বললে অত্যুক্তি হয়না।
একদিকে ঘর বাঁচানোর তাগিদে ঘর ছেড়ে পথে নামা মানুষ দেখি আর সোশাল মিডিয়ায় অশ্রাব্য অকথ্য শব্দের ঢল দেখি আর স্তম্ভিত হয়ে যাই। শুভর মতো আশঙ্কিত হই আমিও। তাহলে কি এ দেশ আমার দেশ থাকবেনা আর! আমার ভাইএর হাতে আবার নিহত হবে অন্য কোনো ভাই! আবার উচ্চারিত হবে "ভাইকে মেরেছি আমি,আমার ভাইএর রক্ত ভিজে আছে আমার দুইহাত!"
একটি সভ্য দেশের একটা বিজ্ঞানসম্মত সুশৃঙ্খল নাগরিক পঞ্জী থাকবে এ নিয়ে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। ভারতবর্ষের মতো জনবহুল দেশে প্রতিবেশী দেশ থেকে কাতারে কাতারে 'অনুপ্রবেশকারী' এসে আস্তানা গাড়বে এটাও একজন সৎ ও দায়িত্বসচেতন নাগরিক হিসেবে কখনোই অনুমোদন করবো না। তাই সরকার যদি একটা নিরপেক্ষ, দায়িত্ববান দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে নাগরিকপঞ্জী তৈরীতে অগ্রসর হতেন তাহলে কারো আপত্তি থাকার কথাও ছিলো না। সি. এ. এ.নাগরিকত্বকে সুনিশ্চিত করার প্রক্রিয়া, এ পর্যন্ত তো কারো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা সেখানেই যেখানে কেবল পার্শ্ববর্তী তিনটি 'মুসলিম 'দেশ থেকে 'ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার ' হয়ে আগত 'অমুসলিম'দের উল্লেখ। 'মুসলিম'শব্দটির অনুল্লেখ। এবং অমিত শাহের এবং বিজেপির বড় ছোট, পাতি, সিকি, আধুলি সমস্ত নেতাকর্মীর বিভিন্ন জনসভায় 'মুসলিমমুক্ত ভারত' গঠনের জোরালো মন্তব্য, 'ঘুসপেটিয়া 'দের দেশ থেকে তাড়ানোর দায়িত্বহীন চিৎকার,এবং পরপর কতোগুলো মুসলিমবিরোধী সিদ্ধান্ত যা খুব স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় মুসলিমদের আশঙ্কার সঙ্গত কারণ হিসেবে যথেষ্ট। তাই অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে তারা পথে নেমেছে। লড়াইটা তাদের শুধু জাতের হলে হয়তো অন্যকথা ছিলো,বাবরি মসজিদ বনাম রামমন্দির এর রায়কে কিন্তু একসেপ্ট করতে কোন অসুবিধা হয়নি মুসলিমদের।সি. এ. এ. তে কিন্তু তাদের তাড়া করেছে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হওয়ার আশঙ্কা। আসামের এন. আর. সি. এবং ডিটেনশন ক্যাম্প এর নারকীয়তা মানুষকে মারমুখী করেছে। মুশকিলটা হলো কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটির যেদিন নির্বাচনী এজেন্ডাতেই ভারতকে 'হিন্দুরাষ্ট্র' বানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে লড়েছিলো এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে মসনদে এসেছিলো সেদিনই সংবিধানের কালো অক্ষরে আগুন লেগেছিলো। তবু দেশটির নাম যেহেতু ভারতবর্ষ, আর দেশের সংস্কৃতির মৌলিকত্ব যেহেতু বহুত্বের মাঝে একতা আর সহনশীলতা তাই মানুষ সময় দিয়েছে। আর এই সময়কে সদ্ব্যহবার করার পরিবর্তে রাষ্ট্রশক্তি স্বৈরতন্ত্র আর ফ্যাসীবাদকে কায়েম করার লক্ষ্যে এগোতে লাগলো দুরন্তগতিতে। ইভিএম কারচুপি করেই হোক,বাহুবল আর অর্থবলকে কাজে লাগিয়েই হোক আর সংখ্যাগরিষ্ঠ 'হিন্দুত্ববাদী'র এককাট্টা মতদান এর জন্যই হোক দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসেই বিজেপি সরকার দেশটাকে নিলামে তুলতে দুবার ভাবলোনা। তারা দেখলো সংখ্যাগরিষ্ঠের তুরুপের তাস দিয়ে 'নোটবন্দী' র ভেল্কিবাজি দেখানো গেলো,জোড়ালো প্রতিবাদ হলো না! যে কজন প্রশ্ন তুলতে গেলো, দেগে দেয়া হলো 'দেশদ্রোহী ','পাকিস্তানের দালাল' তকমা। অন্ধ অনুগামী 'দেশভক্তে'র রৈ রৈ রবে চাপা পড়ে গেলো প্রতিবাদী স্বর।চল্লিশজন সেনার 'পরিকল্পিত হত্যা' , 'পুলওয়ামা'র আইওয়াশ কে যারা স্বচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে চাইলো তাদের ওপর নেমে এলো রাষ্ট্রশক্তি নিয়োজিত স্বঘোষিত 'দেশভক্ত 'দের অশ্রাব্য শব্দবাণ।জি এস টি র নামে সাধারণ খুচরো ব্যবসায়ীদের অস্বিত্ব বিপন্ন করে দেশের 'চৌকিদার ' সুচারু ভাবে দেশের সম্পদ লুটেরাদের নির্বিঘ্নে সীমা পার করিয়ে দিয়ে বেতারে 'মন কি বাত' আওড়ান নির্লজ্জতার সীমা অতিক্রম করে।যে নাগরিকদের ভোটে জিতে ক্ষমতায় এলো,তাদের কাছেই নাগরিক হওয়ার 'প্রমাণপত্র চাওয়ার বালখিল্যতাকে মানবে কেন মানুষ? আর যদি সত্যিই নাগরিক পঞ্জীকরণ করতেই হয় তার দায়িত্বও তো সরকারের ওপরেই বর্তায়! তার কাছে নাগরিকত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো ভোটার আইডি কার্ড!ভোটার লিস্ট ধরেই আপনারা নাগরিক পঞ্জী তৈরী করুন! তারজন্য এতো এতো মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ানো কেন? সভায় সভায় মুসলিম বিদ্বেষ ওগড়ানো কেন? কেন মানুষে মানুষে লড়িয়ে দেয়া? আসলে এইভাবে জাতের নামে লড়িয়ে দিয়ে মানুষের মুখ থেকে একইসাথে ভাতের থালা ও প্রশ্ন করার অধিকারকে ছিনিয়ে নিয়েছে এই সরকার।
মুসলিমমুক্ত ভারত বানানোর ঠিকাদার মোদি আর অমিত শা একের পর মুসলিমবিরোধী ক্রিয়াকলাপ চালিয়ে গেছেন। এবং নিজের কফিন নিজেরাই তৈরি করেছেন। সি. এ. এ. সেই কফিনে স্বখোদিত শেষ পেরেক। ধোকা দিয়ে যে মানুষকে চিরদিন বোকা বানানো যায়না এটা কি মোদি অমিত শাহ বোঝেন না? আলবাৎ বোঝেন। তাই আফগানিস্তান পাকিস্তান বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল, ভুটান তিব্বত থেকে, শ্রীলঙ্কা থেকেও অনুপ্রবেশ ঘটেই চলেছে। সে নিয়ে তাদের চিন্তা নেই। চিন্তা কেবল পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর বাংলাদেশ থেকে আগত ওদের ভাষায় 'ঘুসপেটিয়া' মুসলিমদের তাড়িয়ে দিয়ে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার ন্যাক্কারজনক সংবিধান অবমাননাকর ঘৃণ্য প্রয়াস। যার আইনসিদ্ধ নাম সি. এ. এ.। 'শরণার্থী ' হিন্দুদের 'নাগরিকত্ব' প্রদান করলে আখেরে যে পুরো দেশের অর্থব্যবস্থার ওপরেই চাপ পড়বে, কর্মসংস্থানের এই সংকটে হিন্দুরাও সংকটে পড়বেন এই সরল সত্যটা যারা বুঝতে পেরেছেন, যাদের ভাতে টান পড়বে, পায়ের তলায় মাটিতে টান পড়বে বুঝে গেছেন সেই 'মানুষ 'আজ পথে নেমেছে। তারা মুসলমান নয়, হিন্দু নয়, শিখ ইশায়ী বৌদ্ধ নয়। তারা ভারতবাসী। তাই মোদি আর অমিত শাহ যতোই আইন আনুক। মানুষ কিন্তু প্রশ্ন করতে শিখে গেছে "রাজা তোর কাপড় কোথায়? "
একটা সফল সরকারের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য দেশকে নেতৃত্ব দেয়া। সংবিধান অনুমোদিত পথে নাগরিকের মৌলিক অধিকারকে সুনিশ্চিত কর। বিরোধী শক্তির সাথে ইতিবাচক আলোচনার মাধ্যমে দেশকে আত্মম্ভরিতার পথে, উন্নতির পথে, প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। মানুষের মতপ্রকাশের, ধর্মাচরণের স্বাধীনতাকে সম্মান জানানো হবে, রাষ্ট্র সেই অধিকারকে সুনিশ্চিত করবে গণতন্ত্রে এটাই কাম্য। সফল সরকার বিজ্ঞানের পথে, কল্যাণের পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই তো বাঞ্ছিত।দেশের সীমান্ত সুরক্ষিত করেই তো ঠেকানো যেতে পারে 'অনুপ্রবেশ'!জন্মনিয়ন্ত্রণ আইনে কঠোরতা এনে জনবিস্ফোরণ রুখে দেয়া যায় অনায়াসেই! কিন্তু তা করলে যে রাজনীতিটা করা হবেনা। হিন্দু মুসলিম খেলাটা তাই জিইয়ে রাখতে হয়। সীমান্ত প্রহরাকে স্বেচ্ছায় শিথিল করে রাখতে হয়। পঁয়ত্রিশ হাজার হিন্দু শরণার্থী আর মেরেকেটে হাজার পাঁচেক বৌদ্ধ, পার্সি, জৈন শরণার্থীর নাগরিকত্ব দিতে গোটা দেশকে ব্যতিব্যস্ত করে পথে নামাতে হয়। আসলে সবটাই রাজনীতির খেল।এই সরকার তাই শুরু থেকেই একদিকে বিরোধীশূন্য সংসদ, বশংবদ মিডিয়া,আর অন্ধ অনুসরনকারী স্তাবকদের নিয়ে একটার পর একটা জনবিরোধী নীতি নির্ধারণ করে সাধারণের জীবনকে ওষ্ঠাগত করে তুলেছে। দিনরাত হিন্দুমুসলিম হিন্দুমুসলিম করতে করতে ভুলেই গেছে দেশটা ভারতবর্ষ। এখানে মানুষের পরিচয় সে ভারতীয়। তারা ভুলে গেছে দেশ চালাতে গেলে দেশের অন্তরের শক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা চাই। সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে আর 'হিন্দু মুসলিম' তাস খেলে, কাশ্মীরকে স্তব্ধ করে দেয়া যায়, আসামকে ডিটেনশন ক্যাম্পের নারকীয়তা দেখিয়ে পার পাওয়া যায়। হাজার হাজার কৃষককে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে, বেরোজগারীতে দেশের স্থান সর্বনিম্নে নামিয়ে, অর্থব্যবস্থাকে কোমায় পাঠিয়ে, শিক্ষা-স্বাস্থ্য- দারিদ্র্য সূচকে অধঃপতনের শেষসীমায় দেশকে নামিয়ে এনে, নারী নিরাপত্তায় চরম ব্যর্থ হয়ে, শিশুমৃত্যুতে রেকর্ড করে। একটার পর একটা সরকারী সংস্থাকে বেচে দিয়ে সাধারণ নাগরিকের হাতে হিন্দু মুসলিম ললিপপ ধরিয়ে দেবে আর সাধারণ মানুষ চুপ থাকবে চিরটাকাল। মানুষ তবু চুপই ছিলো। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেললেও ভারতবর্ষের মানুষ ভারতীয় সংস্কৃতির সহিষ্ণুতার আদর্শকেই তবু আঁকড়ে ছিলো। বাবরি মসজিদ বনাম রামমন্দির মামলায় বিচারের নামে প্রহসনকে মেনে নিয়েছে মহামান্য আদালতের প্রতি আস্থাশীল বলেই। সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই। তিনশ সত্তর ধারার অবলুপ্তির পরেও মানুষ গর্জে ওঠেনি। কিন্তু সংবিধানের চোদ্দ নম্বর ধারাকে ভায়োলেট করে, সি.এ. এ পাশ করিয়ে মানুষের শিকড় ধরে টান দেবার ঔদ্ধত্বকে মানুষ ক্ষমা করেনি। করা সম্ভব নয় বলেই আজ দিকে দিকে এতো আলোড়ন, আন্দোলন, প্রতিবাদ।সরকার মানুষের সবচেয়ে বড় সেন্টিমেন্টের জায়গায় থাবা বসিয়েছে। তার মূল্য তো চোকাতেই হবে। কথায় আছে "ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারার গোসাঁই "।মানুষ ভাত চায় এই সরল সত্যটা বুঝুন সরকার। মনে রাখবেন সময়ের চেয়ে বড় কোন শক্তি নেই, সময়ের চেয়ে নিরপেক্ষ কোনো বিচারক নেই এটা সরকার যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করতে পারবে ততোই মঙ্গল।ভুলে গেলে চলবেনা সময়টা একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের প্রাক্কাল। মানুষের কাছে কিন্তু জাতের প্রশ্ন নয় ভাতের প্রশ্নটাই এখন প্রখর বাস্তব। অর্থব্যবস্থার ভরাডুবি নিয়ে, শিক্ষা নিয়ে, স্বাস্থ্য নিয়ে, নারী নিরাপত্তা নিয়ে, মানুষ কিন্তু প্রশ্ন করতে শিখছে। আর এই সন্ধিক্ষণে সি. এ. এ. এক হরপা বান। যা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব।আশার কথা যারা পথে নেমেছে তারা শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম নয়, তারা প্রত্যেকেই এক একটি আত্মম্ভর ভারতবর্ষ। তাই ভয় পেয়োনা শুভ। এ দেশ বাপুজীর। এ দেশ বাবাসাহেবের। এ দেশ নেতাজীর,ভগৎ সিং এর, আশফাকউল্লার। জাতি ধর্ম বর্ণ নিরপেক্ষতার আদর্শে, শুভবোধের তাগিদে,আত্মিক শক্তিতেই এ দেশ আবার কাটিয়ে উঠবে সমূহ আঁধার।শুধু সময়ের অপেক্ষা।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন