এই সময়ে টেলিভিশন , সোশ্যাল মিডিয়া , সকালের খবরের কাগজ থেকে বেরিয়ে , পায়ে হেঁটে যেই খবরটা সারাদিন আমাদের সাথে থাকছে , খাচ্ছে , হাঁটাচলা করছে ; রাতে শুতে গিয়ে স্বপ্নে তাড়া করছে , আমাদের কাছে পরিচিত - জাতীয় নাগরিকত্ব পঞ্জি বা এন আর সি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বা সি এ এ নামে।
২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর , কলকাতায় ততটা ঠাণ্ডা পড়েনি। আমরা সারাদিন অপেক্ষায় ছিলাম , একটা অদ্ভুত আর সম্পূর্ণ আলাদা ধরণের পরিস্থিতির সাক্ষী থাকবো। কেন এমনটা বললাম ? আমরা , মানে আমি আর আমার মতন আরও অনেকেই ,যারা দীর্ঘ সময় ফিসফিস কানা ঘুষোয় শুনছিল বিজেপি ভারতবর্ষের আত্মার সাথে খেলতে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা নেমেছে , আকাশে আলো ফুরিয়েছে কিছুক্ষণ আগে ; পাখিদের বাসায় শব্দ মিশে যাচ্ছে , ঘরে ফেরা পাখির গান আমরা শুনেছিলাম। আমি আমার ঘরের সামনে সবুজ বাগানে অন্ধকার দেখেছি। আজকের আলো হারানো সন্ধ্যা আমার চোখে অন্যান্য সন্ধ্যার থেকে খানিক বেশিই ঘন। ঘরের সিঁড়ি দিয়ে বাগানের মাঝে নেমে এলাম। চারপাশে গাছেদের গায়ে গায়ে অন্ধকার মেখে আছে। আকাশে তারাদের আলোর খেলা। হাতে মোবাইল ফোনের স্কিনে নোটিফিকেশন , - রাজ্য সভাতেই পাশ হয়ে গেল নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা ক্যাব। বর্তমানে ক্যাব এর নাম হয়েছে সি এ এ বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আসলে কী
১৯৫৫ সালে নাগরিকত্ব আইন ছিল । এই যে বিলটি আইনে পরিণত হলও , তা ১৯৫৫ সালের , এখানে বেশ কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা হয়েছে । বলা হয়েছে , আফগানিস্তান, বাংলাদেশ , এবং পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, শিখ , বৌদ্ধ , জৈন , পারসি , খ্রিষ্টান ,ধর্মাবলম্বী অবৈধ অভিবাসী এবং অনুপ্রবেশকারী এবং শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আরেকটু গোদা বাংলায় বললে ভারতের উল্লেখিত তিনটি মুসলিম দেশের অমুসলমান সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে । খুব সহজেই সেই দেশের অমুসলমান নাগরিকরা এই দেশে আসতে চাইলে বা নাগরিক হতে চাইলে , সহজেই তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ১৯৫৫ সালে নাগরিকত্ব আইনে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য টানা ১২ মাস ভারতে থাকার নিয়ম এবং মোট বসবাসের ১৪ বছরের মধ্যে ১১ বছর ভারতে থাকা জরুরি ছিল। এবারে নতুন সংশোধনীতে দ্বিতীয় অংশে পরিবর্তন হয়েছে , উল্লেখিত অমুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষদের জন্য ১১ থেকে ৬ বছর সময়কাল নামিয়ে আনা হচ্ছে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন বলছে – যদি কোন ব্যক্তি বা তার বাবা , মা এই নির্দিষ্ট উল্লেখিত সময় ধরে ভারতে থাকেন , তাঁদের ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য । এখন কথা হচ্ছে বে- আইনি অভিবাসী , শরণার্থীরা এই আইনের আওতায় নাগরিক হতে পারবেন না। তারমানে এই আইন বলছে - যদি পার্সপোর্ট বা ভিসা ছাড়া কেউ দেশে প্রবেশ করে থাকেন। আবার বৈধ নথি নিয়ে প্রবেশ করবার পরে , নির্দিষ্ট সময়ের বেশি এ দেশে বসবাস করেন , তাহলে তিনি বিদেশি অবৈধ অভিবাসী বলে গণ্য হবেন। আর বিদেশি আইন ১৯৪৬ এবং পার্সপোর্ট আইন , ১৯২০ তে তাদের মানে অবৈধ অভিবাসীকে জেলে পাঠানো বা প্রত্যপর্ণের করা হয়ে থাকে।
এই পর্যন্ত গল্পের গতি একইরকম ছিল। এইবার সেখানে আরেকটা মোড় আসছে। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে সরকার ১৯৪৬ ও ১৯২০ সালের আইনানুসারে অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যেও মূলত ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ও তার আগে আফগানিস্তান , পাকিস্তান , বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা হিন্দু , শিখ , বৌদ্ধ , জৈন , পারসি , খ্রিষ্টানদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। মানে এদের কাছে বৈধ নথি না থাকলেও , ভারতে বাস করলেও জেলে বা নিজেদের দেশে জোর করে পাঠানো হবে না ।
২০১৬ সালে এই গল্প আরও একধাপ এগিয়ে যায় , যবনিকা পতনের দিকে। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব বিলটি সংশোধন করে এই ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব দেওয়া হলও। এই সম্পূর্ণ পক্রিয়াটি ভারতীয় জনতা পার্টি এবং মাননীয় নরেন্দ্র মোদী , শ্রী অমিত শাহের নেতৃত্বেই হয়েছে ; এমন অনেকে বলছেন ভাবছেন , একটু প্রথম থেকে দেখলে ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার হবে যে - এটি সংশোধনী , নতুন কোন বিল নয়। বিলটি এখন আইনে পরিণত ।
আগুনের পটভূমি
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলটি আইনে পরিণত হওয়ার অনেক আগে থেকেই এর বিক্ষোভ এর আঁচ আসছিল। ১২ ডিসেম্বর এই বিলটি বিলটি রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর পেয়ে যায়। এর পর থেকেই গোটা দেশে বিক্ষোভ আগুনের মতন ছড়িয়ে যায়। এই আগুনের পটভূমিকা অদ্ভুত !এক অংশ যারা অসম , মেঘালয় , মণিপুর , মিজোরাম , ত্রিপুরা - ভারতের উত্তরপূর্বে বিক্ষোভ ভয়ানক হিংসার দিকে গিয়েছিল। আরেক অংশ যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বড় ভূমিকা নিয়ে চলেছে এখনো , দিল্লি , দেশের অন্যত্র খুব অল্প পরিমাণে হয়েছে।এখানে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভকারীদের সাথে দিল্লি পুলিশের সংঘর্ষ , হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছিল।
আমরা বিক্ষোভের ধরণটাকে মন দিয়ে , মাইক্রোস্কোপ এর আতস কাঁচে দেখলে , দেখবো ১৯৭৯-৮৫ থেকে আসামে আন্দোলন গড়ে উঠেছে , তা হিংসার পর্যায়ে গিয়েছে মূলত ‘বাংলাদেশ ও বাঙালি অভিবাসন ’ ফোবিয়াকে ঘিরে। বাঙালিদের প্রতি তাদের বিদ্বেষ , যতটা বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাবের জন্য , তার থেকেও বেশি নিজেদের ভাষা , সংস্কৃতি , ভূমিসম্পদে , কাজের উপর আঘাতের ভয়ে। ভয় জনজাতি ও জনগোষ্ঠীদের এমন ভাবে ঘিরে রাখে ,তারা তাদের সংস্কৃতির পরিপন্থী সব কিছুকেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খলনায়ক মনে করে। তাদের মতে নতুন আইন বলবত হলে , অসমিয়ারা তাদের জমি আবার হারিয়ে ফেলবে। তারা এন আর সির পক্ষে , নাগরিকত্ব আইনটির বিপক্ষে।
পশ্চিমবঙ্গে যারা বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তারা আবার নাগরিকত্ব আইন ও এন আর সির বিপক্ষে , সবচেয়ে চমকে যাওয়ার ব্যাপার কলকাতায় অনেক বুদ্ধিজীবী, মানবতাবাদী, বামপন্থী সংগঠন নিজেরা নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করছেন , এন আর সির বিরোধিতা করছেন , অসমিয়াদের দাবীকে সমর্থন জানিয়ে !
আমার মনে হচ্ছে ইদানীং বামপন্থীরা যথেষ্ট হোমওয়ার্ক না করেই , এমন বিক্ষোভে সামিল হচ্ছেন। আমি অন্তত দুটো বিক্ষোভকে একই সারিতে নিয়ে আসবার পক্ষে নই। অসমিয়া বিক্ষোভকারীরা যেখানে এন আর সি চাইছেন , সেখানে পশ্চিমবঙ্গের এন আর সি বিরোধী সংগঠন গুলো , নিজেদের সভায় কেন্দ্রকে আক্রমণ করতে গিয়ে অসমিয়াদের এন আর সি সমর্থনের বিক্ষোভকে ঠিক বলছেন কেন ? মানে, কেউ নিজের মত রাখতেই পারেন, যখন নিজের মতই নিজের মতের পরিপন্থী হয়ে ওঠে , পুরো মতামতটাই তখন অ্যাপেনডিক্স , মানুষের দেহে কোন প্রয়োজন নেই , অথচ সেটা বিগড়িয়ে বাড়তি ঝামেলা আনবে --- এমন বার্তাবাহকে পরিণত হয় ।
পশ্চিমবঙ্গে এই নাগরিকত্ব আইন ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকে কেন্দ্র করে যে বিক্ষোভ , দাঙ্গা পরিস্থিতি এবং হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছে , তা কখনই বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ বলা যাবে না। এগুলো পরিকল্পনা মাফিক আক্রমণ ; এর পিছনে কালোবাজারি ও দালাল চক্র থাকতে পারে। কেননা দেশে যখনই অরাজকতা শুরু হয় , যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর আক্রমণ আসে, আমরা সবাই এতোটুকু জানি যোগাযোগের মাধ্যমে যারা বিনিয়োগ করেছেন, এই সময় মুনাফা লুঠবার মোক্ষম সুযোগ তারা নেন। উত্তরবঙ্গ থেকে কলকাতায় আসা বাসের টিকিটের দাম বেড়ে গেলো !মানুষ বেশি টাকা দিয়ে , কালোবাজারিতে টিকিট কিনতে শুরু করেছে। গরীব মানুষ , প্রান্তিক মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন খরচ বাঁচিয়ে রাখা টাকায়, রোজকার দামের টিকিট বাড়তি মূল্য দিয়ে কিনেছেন। এমন পরিস্থিতি শুধু তৈরি হয়নি, বাধ্য হয়ে বাজারি স্বার্থে বানানো হয়েছে। ট্রেন বাতিল হওয়ায় , বাস পরিবহণ ব্যবসার লাভ - আঙুল ফুলে কলা গাছের মতন অবস্থা ।ট্রেন , বাস এর টিকিটের পাশাপাশি বিমানের ভাড়াও আকাশ ছুঁয়েছে! কলকাতা থেকে বাগডোগরা পর্যন্ত ভাড়া কম করে ১৩ হাজারের কাছাকাছি , গৌহাটি ঘুরে গেলে ১৪ হাজার ৬৫৪ টাকা , বেঙ্গালুরু ও দিল্লি ঘুরে ৫৯ হাজার ৮২১ টাকা , প্রায় ২০ থেকে ২৪ হাজারের মধ্যেই বিমানের ভাড়া ঘুরছে , সাধারণ সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ থেকে ২০ গুণ পর্যন্ত বেশি। এটাই প্রতিবাদের ফলে ভারতীয়দের ভাগ্যে জুটেছে !
পৃথিবীর যে কোন দাঙ্গা পরিস্থিতি , অরাজকতা , মানব সম্পদ লুঠের পিছনে সুতীব্র বাজার অর্থনীতি কাজ করে। আধুনিক সভ্যতায় বাজার অর্থনীতিই ধর্ম , আর বাজার অর্থনীতিই বিক্ষোভ , প্রতিবাদ। যারা এই বাজার অর্থনীতির ঘোলাজলে মাছ ধরবেন বলে ভাবেন, তারা অপেক্ষায় থাকেন। সাধারণ মানুষ হয়তো তাদের সেই সুযোগ দিতে চাইবে না , কিন্তু সাধারণ মানুষেরই এক অংশ যারা আদর্শের মোহ ফাঁদে ফেঁসে , সঠিক চিন্তা না করে এগিয়ে আসেন। তাদের এই বোকামোকে কিছু মৌলবাদী পুঁজি করে নিজের স্বার্থে, আবার এই মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক দল গুলো ; শেষে এই পুরো স্তরটাই বাজার অর্থনীতির চোরাকারবারিদের ফাঁদে ফেঁসে যায়।
তাই যখন দেখি এই বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে বাঙলার সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্বপূর্ণ নেতারা , এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ বিরোধী কথা বলেন , তখনই মনে হয় এই যে দক্ষযজ্ঞ চলল , রেলের প্রায় ১০০ কোটির বেশি সম্পত্তি নষ্ট হলও ; এর ব্যয় ভার কে নেবে ? আমরাই মানে যারা অতিসাধারণ তারাই নেবো ! আমি অন্তত কোন রাজনৈতিক দলকে এই পরিস্থিতির বিরোধিতা করতে দেখিনি।
বিরোধিতার আতসকাঁচ
এই যে বিশাল বিক্ষোভের আয়োজন সেখানে কোন শ্রেণীর দিকে দেশ বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দেবে ? আমি আগে যা বলেছে, এখনো তাই বলছি, খালি চোখে এই আইনে কোন সমস্যাই নেই। এটা ভারতবর্ষ, এখানে ধর্মনিরুপেক্ষতা যেমন সংজ্ঞা পাল্টাতে –পাল্টাতে ধর্মীয় তোষণে এসেছে , দেশভক্তির গান শুনতে শুনতে ভক্তকূলের ভক্তিতে এসে ছুঁয়েছে , তেমনই দেশের সংখ্যা লঘু বিশেষত মুসলিম সমাজের মনে হয়তো ভয় দেখা দিয়েছে, কেন্দ্রে হিন্দুত্ব চিন্তাভাবনাকেই পাথেয় করে যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই সরকার হয়তো মুসলিম বিরোধী হবে। সত্যি বলতে বিজেপি দেশের প্রান্তিক মুসলিম সমাজের কাছে নিজেদের নিরুপেক্ষ শাসনের প্রমাণ পত্র দিতে পারেনি। সত্যি বলতে ভারতবর্ষে বামপন্থী সমেত বিরোধী দল যারা ধর্মনিরুপেক্ষতার নামে ভোট চাইলেও , তাদের ধর্ম নিরুপেক্ষতা আসলে মুসলিম মৌলবাদের মৌন সমর্থন। এটা বিজেপির ক্ষেত্রে হিন্দু মৌলবাদ হবে ; স্বাধ্বি প্রজ্ঞা থেকে শুরু করে সম্প্রতি অনেক ঘটনা যেখানে বিজেপির যতটা প্রশাসনিক দক্ষতা দেখানোর ছিল, দেখায় নি! এরপরে মুসলিম সমাজে ভুল বার্তা গেছে। শুধুই কি তাই ? জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের হিংসাত্মক বিক্ষোভ কখনই সুস্থতার পরিচয় নয় , এখন কথা হচ্ছে দিল্লি পুলিশ বাধ্য হয়ে যে ব্যবস্থা নিয়েছে , আমি সেই পথকেও সমর্থন করিনা , কিন্তু তারা আন্দোলনে এমন হয়ে উঠলেন কেন ? পুলিশের প্রতি যে আক্রমণ আমরা দিল্লিতে দেখেছি, একই আন্দোলন উত্তর প্রদেশেও দেখলাম , এই রকম হিংসার ছবি কখনই সুস্থতার পরিচয় নয়। তা হলে হিংসার দরকার কেন ছিল ? হিংসা যারা করছেন তাদের মুখে অহিংস গান্ধীর নীতির কথা শুনলেই হাসি পাচ্ছে।
এখন কথা হচ্ছে হিংসা আর অহিংসা পাশাপাশি অবস্থান করছে কেন ? এই কেন থেকেই শুরু হবে , বিক্ষোভ ও চাহিদার বাজার এর সম্ভাবনা। এই সময় কেন্দ্র সরকার কোন আর্থিক গঠনমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেনি ; বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারের মূল ধারার গঠনমূলক কাজ করতে ব্যর্থ হয়। এই ব্যর্থতাই বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভে , হাওয়া দিচ্ছে !কেন্দ্রীয় সরকার রামমন্দির , ৩৭০ ধারা বিলোপ , তিন তালাক , সব ক্ষেত্রেই এমন একটা বার্তা দিচ্ছে , তারা মুসলিম বিরোধী , আর হিন্দুদের প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায় অবিচার , যার জন্য একমাত্র মুসলিমরাই দায়ি ; সেই সব কিছুর হিসেব বুঝে নেওয়ার জন্যই ক্ষমতায় এসেছে। এতবড় দেশ , বেকারের সংখ্যাও প্রতি দিন বাড়ছে , সমাজের নানা দিকে বৈষম্য , জাতিবাদ এখনো রন্ধ্রে -রন্ধ্রে , নারী সুরক্ষা , শিশু সুরক্ষা , মূল্যবৃদ্ধি , কৃষক সমস্যা --- এগুলো থেকেও হিন্দু , মুসলিম আর পাকিস্তান আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই যে অবস্থা , এর জন্য একভাবে বিজেপিকে দায়ী করে লাভ নেই। সত্যি বলতে ভারতবর্ষ ধর্মনিরুপেক্ষ দেশ হলেও , ধীরে -ধীরে এই দেশের নির্বাচনে ধর্ম জড়িয়ে যায়। সত্যি বলতে ধর্মের নামে ভোট হলে সেখানে রাজনৈতিক দল গুলোকে কম , আর যারা নির্ণায়ক শক্তি ভোটের, তাদের বেশি পরিশ্রম করতে হয়। ধর্মের নামে একে অপরকে আক্রমণ করলে , সুবিধা হয় ক্ষমতাসীন দলের। পরিশ্রম কম। নিজেদের পাঁচ বছর সময়ে কাজের হিসেব দিতে হবেনা।
বিজেপি এখন যে রাজনীতি করছে, সেটা কংগ্রেস , বামপন্থী , তৃণমূল ও অন্য সবদলই করেছে। আমি কংগ্রেসের একাধিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলতে পারি, যেখানে তারা মুসলমান ভোট ব্যাঙ্কের কথা চিন্তা করে নিয়েছিল। সম্প্রতি কংগ্রেসের মহারাষ্ট্রে জোটসঙ্গী শিবসেনা, কয়েক দশক ধরে চলে আসছে ধর্মনিরুপেক্ষতার যে বিবাদ , সেখানে শিবসেনা আজও গর্ব বোধ করে, কেননা তারা বাবরি মসজিদ ভেঙেছে, এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী। কংগ্রেস সেই দলের সাথে হাত মিলিয়েছে দেখে আমার বন্ধুরা অবাক হয়েছিল ! আমি অবাক হইনি , কেননা কংগ্রেসের রাজনৈতিক সময় ইদানীং এতোটাই খারাপ চলছে যে কোন রাজ্যে তাদের সরকারে অবদান থাকাটা দরকার ; যারা যারা ভাবছেন কংগ্রেস ক্ষমতায় আসুক একবার , তারপরেই বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ঠাণ্ডা করবে , তাদের জানা দরকার - ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দল গুলো কখনই উগ্রবাদীদের ঠাণ্ডা করেনা; হিন্দু হোক বা মুসলিম উগ্রবাদী, চিরটাকাল দুইপক্ষই রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় ফেরার কাজকে সহজ করে এসেছে আর করে যাবে। মুসলিম সমাজের কেউ যদি ভাবেন কংগ্রেসের দয়ায় তারা এই দেশে নাগরিক হিসেবে রয়েছেন ; তাহলে সেই সব মুসলিম বন্ধুদের বলব রাজনৈতিক দল নয় , সংবিধান , ইতিহাস , আর নিজেদের বিবেকের উপর ভরসা রাখুন।
কোন আইন পছন্দ না হলে বিক্ষোভ হবে। বিক্ষোভ মানে গুণ্ডামি , অরাজকতা, দাঙ্গা নয়। এই যে দেশে বিক্ষোভ চলছে , তাতে অনেকেই প্রতিবাদ করেছে ; আপনি নিশ্চিত আপনার পাশের বিক্ষোভকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী নয় ? আমি নিশ্চিত এই যে ছাত্র আন্দোলন , গণবিক্ষোভ, রেল লাইন , সম্পত্তি নষ্ট ,পুলিশের লাঠিচার্জ – তার ভিতর অনেকটাই সাজানো। এই আলোচনার পথে আমি এক জায়গায় বাজার অর্থনীতির চোরা কারবারীদের কথা বলেছিলাম ; বিক্ষোভেও এমনই বাজার অর্থনীতির চোরা কারবার চলে।
আপনার বুদ্ধি আপনারই ,সেখানে এই ২০১৯ সালে অন্যের মেধা , চিন্তন , প্রভাব ফেলতেই পারে, তাই বলে কোন পরিস্থিতির গভীরতা মাপবার জন্য বুদ্ধিজীবী ,সেলিব্রেটি নামক মাপকাঠির প্রয়োজন আছে? আমি বেশ কয়েকদিন দিন ধরে অনেক ধরণের বিক্ষোভ দেখলাম , তারমধ্যে এক দল লোক বললেন ওমুক মিশিলে ওমুক মানুষ হেঁটে ছিলেন , তিনি জ্ঞানি তিনি নিশ্চই জেনেই প্রতিবাদকে সমর্থন করছেন। আসল ঘটনা জানা আর প্রতিবাদ, বিরোধিতা আপাতাত এক মনে হলেও , এক নয়। কেননা এটা ভারতবর্ষ , এখানে ঘোলা জলে মাছ ধরা খুব সাধারণ একটা ঘটনা।
কান নিয়ে গেল চিলে
খুব ছোটবেলায় মায়ের মুখ থেকে একটা গল্প খুব শুনেছি, ভুলে যাচ্ছি। আরেকদিন মনে পড়লে গল্পটা বলবো। আজ অবশ্য এই লেখার সাথে , সেই গল্পের কোন যোগাযোগ এখানে নেই , তবে হ্যাঁ সেই গল্পে একজন লোক নিজের কানে হাত না দিয়ে চিলের পিছনে ছুটে ছিল, কেউ তাকে বলেছিল ‘কান নিয়ে গেল চিলে’। ব্যাক্তি সত্যি যাচাই না করেই ছুট দিয়েছিল।
এখন যে আন্দোলন চলছে , এবং আন্দোলনকে ঘিরে দুইপক্ষের যে দড়ি টানাটানি চলছে , তাতে মুরগি হচ্ছে পাবলিক! মুরগি বললাম কেননা এই সময়ে বিনোদনের ক্ষেত্রেও কেউ যেচে বোকা হলে তাকে মুরগি বলা হয় ; আমি অবশ্য জানিনা মুরগিকে নিয়ে আমাদের এমন মূল্যায়নের মানে কি? আমি ব্যবহার করলাম কারণ সবাই ব্যবহার করছে। যারা বিক্ষোভ করছেন এবং বিক্ষোভের বিরোধিতা করছেন, তারা বিক্ষোভ নিয়ে আমার মতনই ভেবেছে।
সংবিধানে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী পক্রিয়া আছে, তাতে খুব সহজে কেউ নাগরিকত্ব পাবেন না। তাই নাগরিকত্ব সব ধর্মের লোককে দিলেও সেটা খুব সহজে ও রাতারাতি সব বিদেশির ভারতীয় হওয়ার সুযোগ কম ছিল।
এতদিন শুনেছি আধার আমার পরিচয়, ভোটার কার্ড নাগরিকত্বের প্রমাণ পত্র, এতদিন বাদে মাননীয় অমিত শাহ বলছেন নাগরিকত্বের প্রমাণ এই গুলো নয়! এই পরিস্থিতি, মজা পরিস্থিতি!
এতদিন যে আধার আর ভোটার কার্ড আমাদের পরিচয় দিল, এখন নাগরিকত্ব খুঁজতে কোন বনে যাবো ? অসমে এই এতো খরচ করে এন আর সি হলও , তা শুনছি বাতিল হয়ে যাবে , ভারতের টালমাটাল অর্থনীতিতে এন আর সি যদি হয় , তার খরচ ভারত নিতে পারবে? যদি সত্যিই বিক্ষোভকারীদের কথায় ভারতে মুসলমানদের ঠাই নেই , দেশ ছাড়তে হবে ; এমন একটা পরিস্থিতিতে ভারতের অনেক বিশিষ্ট মুসলমান আছেন তারাও চলে যাবেন। স্বাধীন ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবদান কেউই অস্বীকার করতে পারবে না , তাহলে এই অস্থিরতা কেন ? এই সময়ে সত্যিই আমাদের নতুন করে এন আর সি হলে খরচ হবে , ভারত সেই খরচ তুলতে পারবে ? অনেকে বলেছেন নাগরিকত্ব বিলটি মুসলমানদের প্রতি অবিচার করেছে। বিক্ষভকারীরা আহমেদিয়া মুসলমানদের মুসলিম মনে করেন না ? যদিও আহমেদিয়া মুসলমানরা , পাকিস্তানিদের কাছে মুসলমান নাও হতে পারে। তারা কিন্তু মুসলমানই ; পাকিস্তানে শোষিত অত্যাচারিত , তাদের ভারত সরকার নাগরিকত্ব দেবে। তাই সব মুসলমানকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না এটাও ঠিক নয়।
সত্যি বলতে বিজেপির তৈরি পিচে, বাকি রাজনৈতিক দল গুলো খেলছে। সেই একই খেলা , ধর্ম নিয়ে রাজনীতির খেলায় বিজেপিকে বিরোধীরা বেগ দিতে পারবে ? এর উত্তর ভবিষ্যৎ দেবে। আমার মজা হতো যদি বিজেপিকে বিরোধীদের তৈরি পিচে ডেকে এনে খেলাতে পারতো , সেই খেলা দেখতাম। সেই জায়গায় বিরোধীরা ব্যর্থ হয়েছে।
অদ্ভুত ভাবে দেশের আর্থিক দিকটি নিয়ে কোন কথা নেই, কিছু বিষয় সাজানো হয়, আমরা সেই বিষয়ে আটকে যাচ্ছি ! তাই কি ?
তা হলে এই ভিড়ে পরিচিত মুখের ছায়া কেন ?
বিক্ষোভ আমি দেখেছি, মিছিলে মিছিলে মিশে যাওয়া স্বপ্ন দেখেছি , শহরের রাজ পথে বেপরোয়া আঠারোর এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শুনেছি কান পেতে । যুবক –যুবতিরা চিরতাকাল ছক ভেঙে এসেছে , ছক ভেঙে যাবে ;এটাই তাদের ছক ভাঙার খেলা। শাসকেরা তাদের ঘিরবে ব্যারিকেডের , প্রেমিকার ঠোঁটে চুম্বনের অঙ্গিকার করে যে প্রতিবাদীরা আজকের এই সভায় এসেছে ; তাদের চারপাশে কুয়াশার মতন কাঁদানে গ্যাস; মানুষের অধিকার বুঝে নিতে , মানুষই রাস্তায় নামে। যে যুব সমাজ দেশের দেশের যে কোন পরিস্থিতিতে স্থির থাকে, সেই দেশে মতের বিভন্নতা হারিয়ে যায় । খুব ভালো লাগছে আমাদের ভারতবর্ষে এখনো বিভিন্নতা আছে। এখানকার হরেক রকমের সংস্কৃতিই , এখানকার অহংকার। আমরা বিভিন্নতাই পছন্দ করেছি।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি এবং সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আমাদের অনেকেরই ধোঁয়াশা আছে। কেন্দ্রীয় সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে এই ব্যাপারটা বলছে না। এই না বলা কথার ভিতরেই অনেক কথা বলা হয়ে গেছে , এই দেশে নাগরিকত্ব নির্ণয় করা ব্যাপারটা খুব সহজ নয় ; সেটা সরকার নিজেও বুঝেছে। প্রতিদিন তারা সংশোধনের , সংশোধন করে চলেছে , করুক। এই ইস্যু যতদিন থাকবে , তত দিন ভালো , নতুন ইস্যুর দরকার হবেনা। আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এই বিরোধিতার আশ্রয়ে রাজ্যের অনেক জ্বলন্ত বিষয় লুকিয়ে ফেলেছেন ; বেকারত্ব , গোষ্ঠী কোন্দল , সরকারি চাকরিতে দুর্নীতি , রাজনীতিকরণ , সব কিছুই যেনও ভ্যানিশ হয়ে গেল ! বিজেপির বিরুদ্ধে ক্রমশই হিন্দু ভোটারদের মধ্যেই বেকারত্ব আর বেরোজগারি নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিচ্ছিল; এখন সেই সব ভুলে আমরা হিন্দু জাতীয়তাবাদে মেতেছি! এমনটাই তৃণমূলের কাছে সংখ্যা লঘুদের মনোভাব।কংগ্রেস আর বামপন্থীরা ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে । বাকী সব দলই প্রতি দিন নতুন করে অবস্থান বদল করছে।
এই সব কিছু এতটুকু প্রমাণ করেছে , শুধু রাজনৈতিক নেতা নয় ,এইরকম পরিস্থিতির জন্য আমারাও দায়ী আর বাজার অর্থনীতির চোরা কারবারিরা সুযোগ নেবেই।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন