এক এক সময়ে খুব আতান্তরে পড়ে যেতে হয়। কোনটাকে কি নামে অভিহিত করব কিছু ঠিক করে ওঠা যায়না। একদিকে হয়তো টগবগ করে ফুটে ওঠা কারও বুকের রক্ত নিমেষে প্রেশার চড়িয়ে শোক কে পরিণত করে দিচ্ছে ক্রোধে। অন্যদিকে আবেগে আপ্লুত হওয়া অজস্র মন কোন কিছুই না বুঝে ভেসে যাচ্ছে সযত্নে লালিত উগ্র প্রেমের জোয়ারে। তার জন্য যা কিছুই ঘটে যাক ডোন্ট কেয়ার। নিয়ন্ত্রনহীন সেই পরিস্থিতির তোড়ে তখন কি কি তছনছ হয়ে যাচ্ছে তা ভাববার আর সময় কোথায়?
অবধারিত ভাবেই তাই জেগে ওঠে সেই প্রশ্নটাই – এত হিংসা কেন? কেন এত চরাচর জুড়ে অ-প্রেম ছড়িয়ে? অন্য কারও দিকে তাকানোর আগে যদি ঘরের দিকেই তাকাই তাহলে সেখানেও যে সবাই সুখে শান্তিতে বেঁচে আছে এমন দৃশ্য সর্বজন-গ্রাহ্য নয়! গার্হস্থ হিংসা তো কম কুরে কুরে খাচ্ছেনা মানুষকে! কত সংসারেই তো অকালে ঝরে যায় মানুষের জীবন, বিশেষ করে নারীদের। যতদিন লাঞ্ছনা গঞ্জনা সহ্য করে পারা চালিয়ে যাওয়া, তারপর তো সেই পরিবারের সদস্যদের হাতেই নিগ্রহ, কখন কখনও খুন হয়ে যাওয়া। যাদের সঙ্গে অতি নিজের আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়েছিল বলে ধরা হয় তাদের হাতেই! এত নিষ্ঠুরতা মানুষ পুষে রাখে কোথায়?
কেন এত হিংসা? প্রাণ এত হেলাফেলার বস্তু হয়ে উঠলো কেন? বিনা কারণে? ভাবা যায়না। একটা পরিমিতি বোধ থাকবে ধরে নিয়ে জীবন যাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছন্দ মিলিয়ে পূর্ণতার দিকে যেতে চায়, অনেক সময় তাদেরই কারও হিংসার আগুনের সামনে পড়ে যেতে হয় আচমকা। কিসে আসলে শান্তি চায় মানুষ? পরিবারের ছোট্ট গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজের দিকে তাকালে সেখানে ছবিটা আরও ভয়ংকর। একটা দমবন্ধ চাপা চাপা ভাব। যা যা ঘটে যায় চারদিকে তার পরিপ্রেক্ষিতে নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা ব্যক্ত করতে গেলে হাজার বার ভাবতে হয় যার যার পছন্দ হলনা তারা কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে? মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলে একটা ধারণা আছে, অন্য কেউ অন্যরকম ভাবে কিছু বলতে পারে ভাবতে পারে এটা অনেকে জানেই না। হয়তো এই অবস্থাটা ধীরে ধীরে খুব সাবধানে তৈরি হয়ে যায়। বিরুদ্ধ মত প্রকাশের অধিকার ততক্ষণই সহনীয় যতক্ষণ তা স্রোতের সঙ্গে মেলে।
না মিললে? গণতন্ত্র চুলোয় যাক। প্রকৃত সত্যকে জানা আর চিনে নেওয়ার জন্য যে মিনিমাম ধৈর্য আর শিক্ষার প্রয়োজন সেই ভাবনা অর্থহীন। অশিক্ষা আর অসুস্থ চেতনা থেকে জেগে ওঠা মতবাদের উলটো সুরে কথা বললে তুমি চিহ্নিত হয়ে যাবে। তুমি অপছন্দের। তোমাকে নিয়ে তখন যা খুশি করা যায়। সীমাহীন হিংসা আর নিষ্ঠুরতা দিয়ে তোমাকে শেষ করে দেওয়া যায়। তুমি বলতে চেষ্টা করবে – শোন, বিরুদ্ধ মত থাকবে, আমাদের দেশটাই তো এমন, বিবিধের মাঝে মিলন মহান। জল হাওয়া মানুষ সংস্কৃতি ইতিহাস দর্শন সব মিলিয়েই তো ভারতবর্ষ। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। আসলে তুমি জানোনা ওসব শব্দগুলোকে কেউ পাত্তা দেয়না এখন। অনেকে শোনেইনি, জানেনা। তাই ‘অবাধ্য’ হলে বা কিছু পরামর্শ দেওয়ার মত কথা বললে তোমার প্রাপ্য নির্ভেজাল ক্রোধ আর হিংসা। যাদের মতের বিরুদ্ধে বলেছ, তাদের হাতে। এ শুধু ঘরে বা ঘরের বাইরেটাতেই নয়, এর পরিমণ্ডল অনেক ব্যাপক, বিস্তৃত। অথচ এর একটুও প্রতিফলন পড়েনা সমাজে ঘটে চলা হাজারো অনিয়ম, মিথ্যাচার, কুসংস্কার, বঞ্চনা আর সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে।
যতদিন না প্রকৃত শিক্ষা আর সুস্থ চেতনার বিকাশ হচ্ছে, ততদিন দাপিয়ে বেড়াবে শুধু এই অসহায়তা। ততদিন এর থেকে মুক্তি নেই।
tarasankar.b@gmail.com
তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়
Reviewed by Pd
on
এপ্রিল ১৫, ২০১৯
Rating:
Reviewed by Pd
on
এপ্রিল ১৫, ২০১৯
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন