রাবণের লঙ্কা থেকে এবার আমাদের আলোচনার দৃষ্টিপথ একটু কিষ্কিন্ধার দিকে ঘোরানো যাক। আগের পর্বেই লিখেছি, মহাকাব্যে পরাজিতদের নিয়ে আলোচনায় বালীর কথায় আমাদের ফিরে আসতেই হবে। রামায়ণে তিনি নেহাতই এক ক্ষণস্থায়ী পার্শ্বচরিত্র বটে, কিন্তু নিজের যোগ্যতায় তিনি ওই সময়টুকুর বাইরেও নায়কের মর্যাদা পেতে পারতেন। রামায়ণের কাহিনির এই এক আশ্চর্য প্রবণতা, যে চরিত্রেরা যত বেশি যোগ্য, সম্ভাবনাময় ও প্রতিভাবান; সেই চরিত্রেরা প্রায়শই তত বেশি করে অবহেলা-অবিচারের শিকার! রাবণ নিজে ও তাঁর পুত্র মেঘনাদ তো বটেই, এই তালিকার উজ্জ্বলতম নাম সম্ভবত বানররাজ বালীর। কোনোভাবেই কোনো অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত না-থেকেও যেভাবে হীন ষড়যন্ত্রে তাঁকে নিহত হতে হয়, তা যে-কোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষকে লজ্জা দেবে। কিন্তু মূলধারার তথাকথিত নীতিমালার আড়ালে এই ষড়যন্ত্রকেও কীভাবে বৈধতাদানের ভাষ্য রচিত হয়েছে, তা রামায়ণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল প্রত্যেকেই জানেন।
বালীকে বুঝতে গেলে, আগে আমাদের রামায়ণকে রূপকথা অথবা অলৌকিক ধর্মগ্রন্থ বানিয়ে রাখতে যাওয়া দুটি পরস্পরবিরোধী অথচ পরস্পরকে সাহায্যকারী প্রবণতার বিরুদ্ধে গিয়ে বোঝা দরকার। কারণ, এই দুই প্রবণতা আমাদের বাস্তবোচিত ও নিরপেক্ষ পাঠের সামনে বারেবারেই বাধাসৃষ্টির চেষ্টা করে যাবে। ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গেছি, বালীর কিষ্কিন্ধা ছিল বর্তমান কর্নাটক রাজ্যের হাম্পি অঞ্চলে। অর্থাৎ এলাকাটি দাক্ষিণাত্য, কিন্তু কেরালা ও তামিলনাড়ুর মতো দক্ষিণতর অবস্থানে নয়। এখন কথা হলো, হঠাৎ করে এরকম একটা অঞ্চলে বানরদের রাজত্ব সৃষ্টি হলো কী করে? সেই বানরেরা আবার মানুষের মতো কথা বলে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করে, এবং একটি রাজত্বও চালায়! সেই সময়ে বানরদের যদি এমন মনুষ্যোচিত ক্ষমতাই থাকবে, তাহলে এই বিশাল ভারতভূমির অন্যত্রও তো ছোটোখাটো দুই-একটি বানররাজ্য গড়ে উঠতে পারতো! কিন্তু তা তো হয়নি, বানরেরা অন্যত্র শাখামৃগ হয়েই থেকেছে, যেমন থাকাটা তাদের পক্ষে স্বাভাবিক। তাহলে কি তুঙ্গভদ্রা নদীর আশপাশের অঞ্চলের বানরেরা ছিল বিশেষ কোনো প্রজাতি, যারা মানুষের সমকক্ষ? এর যুক্তিসঙ্গত উত্তর খুঁজলেই আমরা বুঝতে পারি, এই বানরেরা আসলে বানরই নয়, আমাদের মতোই মানুষ। তফাতের মধ্যে এটুকুই যে, তারা জনপদবাসী নয়, বনবাসী উপজাতির। আনন্দ নীলকণ্ঠনের ভাষায় 'Man of the forest', অর্থাৎ এককথায় 'বন-নর'। বনবাসী এই মানুষদের যে বন-নর থেকে একেবারে বানর বা Monkey বানিয়ে দেওয়া হলো, তার কারণ হিসেবে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত ও তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত মানুষের উন্নাসিকতাকে দাঁড় করানো যায়। লক্ষ করলে দেখা যাবে, আজকের আধুনিক জীবনেও এই সমস্যার অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ এই সমস্যা চিরদিনের ও বিভিন্ন রূপের। রামায়ণে উল্লিখিত এই বন-নরদের নিয়ে বলতে গিয়ে আজকের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যায় তাই লেখা হয়, '...the people of the forest, who are often mocked by others as Vanaras, the monkey men. Sandwiched between the never-ending war between Deva tribes in the north and Asura tribes in the south...', অর্থাৎ দেব-অসুরের দ্বন্দ্বের মাঝখানে উলুখাগড়া হয়ে থাকা এক কোনঠাসা জনগোষ্ঠী। নীলকণ্ঠন দেখিয়েছেন, কীভাবে তৎকালীন দেব এবং অসুর, দুই সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যই নিজেদের প্রয়োজনমতো বন-নরদের জঙ্গল থেকে ধরে নিয়ে গেছে এবং দাস বানিয়ে নিজেদের কাজে লাগিয়েছে। বন-নরদের থ্যাবড়া নাক, মোটা ঠোঁট, অতিকুঞ্চিত কেশ, লোমের আধিক্যযুক্ত শরীর ও কালো গাত্রবর্ণের জন্য পশুর বেশি কিছু ভাবেনি তারা; আর সেই ভাবনা থেকেই বন-নরদের সরাসরি বানর বলে চিহ্নিত করার প্রবণতা! বালীর প্রাথমিক কৃতিত্ব এই জায়গায় যে, তিনি এই অবদমিত জনগোষ্ঠীকে প্রথম মাথা তুলে দাঁড়াতে শেখালেন। কিষ্কিন্ধায় তারাও নাগরিক জীবনযাপন করতে শিখলো। নিজেদের জোরে পরিচিত হয়ে উঠলো একটি স্বাধীন জনগোষ্ঠী হিসেবে।
কিন্তু তার আগে তো বালীরও হয়ে ওঠার একটা পর্ব আছে। আর বালীর কথা বলতে গেলেই অনিবার্যভাবে এসে পড়বে সুগ্রীবের কথাও। এই দুই ভাইয়ের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে দুটি গল্প চালু আছে। দুটিই অলৌকিক এবং কিঞ্চিৎ আদিরসাত্মক। তর্কের খাতিরে দুটিকেই একবার করে মনে করে নেওয়া যাক। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ অনুযায়ী, একদিন সূর্যদেবতার রথের সারথি অরুণ যথাসময়ে কাজে এসে দেখলেন, সূর্যদেব তখনও ঘুমিয়ে আছেন। বহু চেষ্টা করেও অরুণ তাঁকে ঘুম থেকে তুলতে পারলেন না। অগত্যা অরুণ আর কী করেন, স্বর্গলোকের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে শুরু করলেন। ঠিক তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর প্রিয় চার অপ্সরা উর্বশী, রম্ভা, মেনকা ও তিলোত্তমার নৃত্য-গীত (এবং অতি অবশ্যই সঙ্গ) উপভোগ করছিলেন। এইরকম সময়ে ইন্দ্রের অন্দরমহলে অন্য কোনো পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু অরুণের ইচ্ছা হলো, তিনি যে-কোনো উপায়ে দেবরাজের প্রমোদগৃহে ঢুকবেনই। প্রবেশদ্বারে বাধা পেয়ে ফিরে এসে, তিনি নিজের জাদুশক্তির বলে একজন সুন্দরী যুবতীতে রূপান্তরিত হয়ে আবার সেখানে গেলেন। অরুণের এই যুবতীরূপকে কোথাও-কোথাও 'অরুণা' বলা হয়েছে। এবার তাঁকে প্রবেশ করতে দেওয়াও হলো। কিন্তু তিনি অপ্সরাদের নাচ উপভোগ করবেন কী, স্বয়ং ইন্দ্র তাঁর নারীরূপী চেহারা দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন! তাঁদের শারীরিক মিলনে বালীর জন্ম হলো। পরবর্তীতে অরুণ যখন সূর্যদেবের কাছে এই ঘটনা খুলে বললেন, তখন সূর্য তাঁর নারীরূপ দেখতে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। অরুণ আবার নারীতে রূপান্তরিত হলেন। তাঁকে দেখে এবার সূর্যেরও একই হাল হলো! সূর্য ও অরুণার মিলনে জন্ম হলো সুগ্রীবের। এরপর ইন্দ্র দুই শিশুকে ঋষি গৌতমের আশ্রমে নিয়ে যান। সেখানেই বৃদ্ধ গৌতমের তরুণী পত্নী অহল্যার কাছে শিশু বালী ও সুগ্রীব আশ্রয় পায়। অসামান্যা রূপসী অহল্যাকে দেখেই ইন্দ্র কামাতুর হয়ে ওঠেন, এবং কিছুদিন পরে ইন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কের জন্যই অহল্যা গৌতমের শাপগ্রস্ত (আসলে শাস্তিপ্রাপ্ত) হলেন। কিন্তু সে-সব অন্য গল্প, এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তবে অহল্যার ওই পরিণতির পরে কিশোরবয়সী বালী ও সুগ্রীব এক বানরগোষ্ঠীর প্রধান ঋক্ষরাজের কাছে আশ্রয় পায় ও তার পালিত পুত্র হিসেবে বড়ো হতে থাকে।
দ্বিতীয় গল্পটি আরও মোটা দাগের। উত্তর রামায়ণ এবং কম্ব রামায়ণমের পূর্বকাণ্ড অনুযায়ী, ব্রহ্মার অশ্রু থেকে ঋক্ষরাজ (মতান্তরে, বৃক্ষরাজ) নামে এক কুৎসিতদর্শন শক্তিধর বানরের জন্ম হয়। ব্রহ্মা তাকে জঙ্গলের দানবদের দমন করার দায়িত্ব দেন। এরকম কাজ করতে গিয়ে ঋক্ষরাজ একদিন এক জলাশয়ে ঝাঁপ দিলে, হঠাৎই এক সুন্দরী রমণীতে পরিণত হয়। ইতিমধ্যে দুই দেবতা সূর্য ও ইন্দ্র তাকে ওই রূপে দেখতে পান এবং দু'জনেই তাকে কামনা করেন। নারীরূপী ঋক্ষরাজ দুই কামাতুর দেবতাদের খপ্পর থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে না। ইন্দ্রের বীর্য তার চুলে পড়েছিল বলে সেখান থেকে বালীর জন্ম হয়, আর সূর্যের বীর্য তার গ্রীবায় পড়েছিল বলে জন্ম হয় সুগ্রীবের। দেবতাদের এই আচরণে ক্রুদ্ধ ঋক্ষরাজ ব্রহ্মার কাছে অভিযোগ জানালে, ব্রহ্মা তাকে একইসঙ্গে পুরুষ ও নারী হয়ে বাঁচার বর দেন। পরে, দুই পুত্র বালী ও সুগ্রীবের সাহায্যে এই ঋক্ষরাজ বানরদের রাজা হয়।
বস্তুত, বন-নর উপজাতির দুই অনাথ বালক বালী ও সুগ্রীবের জন্মের এরকম উদ্ভট গল্প না-বানিয়ে আলোকপ্রাপ্ত সুবিধাভোগী সমাজের আর কোনো উপায় ছিল না। কারণ, ঋষি গৌতমের আশ্রমে অহল্যার আশ্রয় পেলেও সেখানে তারা দাসের জীবনই কাটাতে বাধ্য ছিল। আশ্রমপ্রাঙ্গণ পরিষ্কার করা, গাছে জল দেওয়া, পালিত গবাদিপশুদের খাবার দেওয়া, জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে আনা ইত্যাদি সবধরনের কষ্টসাধ্য কাজই ওই আশ্রয় ও সামান্য খাদ্যের বিনিময়ে করিয়ে নেওয়া হতো এই দুটি বালককে দিয়ে। এর উপরে ছিল 'বানর' বলে আশ্রমের শিক্ষার্থী ঋষি ও ব্রাহ্মণ বালকদের কটূক্তি। তারা নিচু জাতের বলে, অন্যদের ছোয়াঁ বা সংস্পর্শে আসার চেষ্টা করাও ছিল তাদের জন্য অপরাধ। অথচ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে এই বন-নরদের সাহায্য নিয়েই দেববংশীয়দের অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় করতে হবে। তাই বালী-সুগ্রীব প্রমুখের জন্মবৃত্তান্তে একটা দৈবী ছোঁয়া রেখে দেওয়া ছিল জরুরি।
ইন্দ্র-অহল্যা কাণ্ডের পরে আশ্রমের আশ্রয় চলে গেলেও দাসত্ব থেকে মুক্তির এই স্বাধীন জীবন নিশ্চয়ই বালী-সুগ্রীবের কাম্যও ছিল। বন-নরদের তখনকার জীবনযাপন ছিল অরণ্যের গভীরে ছোটো-ছোটো গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে থাকা গ্রামের মধ্যে, পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে, এমনকি গাছের উপরেও। বন্যপশুদের আক্রমণ থেকে বাঁচার লড়াই এবং বন্যপশুদের সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে খাবার সংগ্রহের লড়াই, এই ছিল তাদের জীবনের মূল বিষয়। তারা চট করে কোনো শহরের আশপাশে যেতে চাইতো না। তবে প্রায়শই তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো শহরেই! এই পরিণতি যাদের হতো, তাদের মধ্যে সামান্য কয়েকজনই দেব বা অসুর শাসকদের নাগাল এড়িয়ে পালিয়ে আসতে পারতো। এইরকম অপহরণকারী আক্রমণ এড়াতে বন-নরেরা তাই ঢুকে পড়তে থাকে জঙ্গলের আরও গভীরে, যেখানে বন্যপশুদের ভয় আরও তীব্র! ঋক্ষরাজই প্রথম বন-নর, যাঁর চিন্তায় ক্রমশ পশ্চাদগামী এই অরণ্যমানুষদের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টার কথা এল। কিন্তু সেই চেষ্টা যে খুব একটা সমর্থন পাচ্ছিল, তা নয়। উপজাতির অন্যান্য গোষ্ঠীপতি জাম্বুবান, কেশরী, ঋষভ প্রমুখের বক্তব্য ছিল---এভাবে পশুদের মতো জীবনযাত্রাই বন-নরদের জন্য ঈশ্বর-কর্তৃক নির্দিষ্ট করা আছে। এটাই আইয়ানের ইচ্ছা! (প্রসঙ্গত, বন-নরদের কাছে শিবের পরিচিতি ছিল 'আইয়ান' নামে। দক্ষিণ-মধ্য ভারতে অনেক উপজাতীয় সমাজেই আরাধ্য দেবতার নাম ছিল আইয়ান; যিনি অরণ্যচারী, পশুপতি এবং সকলের রক্ষাকর্তা।) অতএব, বন-নরদের উচিত হবে আইয়ানের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়েই নিজেদের ভাগ্যলিপিকে মেনে নেওয়া। কিন্তু ঋক্ষরাজের চিন্তাধারা দৃঢ় ছিল। তিনি চাইছিলেন, দেব ও অসুরদের ধারাবাহিক নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হয়ে বন-নরেরা যেন একদিন নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি করতে পারে। তিনি বেশ কিছু অনুগামীও পেয়েছিলেন, কিন্তু এই চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত ভবিষ্যৎ-নেতা পাচ্ছিলেন না! ঋষি গৌতমের আশ্রম থেকে বিতাড়িত দুটি কিশোর, বিশেষত বালীকে পেয়ে ঋক্ষরাজের সেই খোঁজ শেষ হলো। বালী সাহসী, স্বপ্নদর্শী, শক্তিমান, অসামান্য যোদ্ধা ও উদারচেতা। এককথায়, নেতা হওয়ার সমস্ত উপাদান নিয়ে তরুণ হয়ে ওঠা এক বন-নর। অনুজ সুগ্রীবের মধ্যে এইসব গুণ না-থাকলেও বুদ্ধিমত্তা, ক্ষিপ্রতা ও সিদ্ধান্তগ্রহণের দ্রুততর ক্ষমতার জন্য বালীর সহযোগী হিসেবে সে একদম উপযুক্ত। ফলে, এদের হাত ধরেই যে বন-নরদের নতুন ও মুক্ত ভবিষ্যৎ আসবে, তা নিয়ে ঋক্ষরাজের সন্দেহ ছিল না।
কিন্তু যা হওয়া উচিত, অধিকাংশ সময়েই তা হয় না! বালীর বীরত্ব ও মহত্বের কারণে প্রথম থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো, যা সুগ্রীবের কাছে ছিল গোপন ঈর্ষার কারণ। এমনিতে কিন্তু অগ্রজের প্রতি সুগ্রীবের আনুগত্য প্রশ্নাতীতই ছিল। তাছাড়া, ছোটো ভাইকে বালী একেবারেই সন্তানস্নেহে দেখতেন। তার প্রতিক্রিয়ায় সুগ্রীবের মধ্যে নিজের ঈর্ষার জন্য অপরাধবোধও ছিল প্রবল। এইসব টানাপোড়েনের মধ্যেও সুগ্রীব হয়তো বালীর একনিষ্ঠ অনুগামী হয়েই থাকতেন, যদি-না দুই ভাইয়ের মাঝখানে এক নারীর আবির্ভাব হতো। এই নারীর নাম তারা, বন-নরদের একমাত্র বৈদ্য সুষেনের কন্যা। তারার আবির্ভাবে ঘটনাপ্রবাহ যেদিকে মোড় নিল, আনন্দ নীলকণ্ঠন তাকে 'arguably the world's first triangular love story' বলেছেন। কিন্তু তারার উপস্থিতি সম্ভব হলো ঠিক কীভাবে? একটি উপকাহিনি বলছে, বন-নরদের কাছে জটায়ু ও সম্বতি নামের দুই বিশালাকৃতি ঈগল বিশেষ পবিত্র বলে বিবেচিত হতো। কারণ, এরা নাকি বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের আত্মীয়! ফলে, এই দুই মাংসাশী পাখির আক্রমণে বারবার অনেকের জীবনহানি হলেও তারা প্রতিরোধের কোনো চেষ্টাই করতো না। তারা ভাবতো, এই-ই বুঝি আইয়ানের ইচ্ছা! মনে রাখতে হবে, এই সেই জটায়ু, যে ভবিষ্যতে সীতাহরণের পরে উড়ন্ত পুষ্পক রথের কাছে গিয়ে রাবণকে বাধা দেবে, এবং রাবণের অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে মরণাপন্ন হয়ে পড়ে থাকবে, আরও পরে সেই অপহরণের খবর রামকে দেওয়া পর্যন্ত! যদিও একটা পাখি কী করে রামকে ঘটনাটির বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দিল, তা নিয়ে বিস্তর কৌতুকজনক আলোচনা হতে পারে। তবে সেই প্রসঙ্গ এখানে অপ্রয়োজনীয়, তাই ঘটনাক্রমে ফিরে আসা যাক। আশ্রম থেকে বিতাড়িত সুগ্রীবকে তাড়া করেছিল এই জটায়ু, আর বালীকে তাড়া করেছিল সম্বতি। ঝোপজঙ্গলে লুকিয়ে সুগ্রীব বেঁচে গেলেও, বালীকে সম্বতি সরাসরি আক্রমণ করে। সংঘর্ষে বালীকে গুরুতর আহত করলেও বালীর প্রতিআক্রমণে সম্বতি নিজেই মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে ঋক্ষরাজ সুগ্রীবকে উদ্ধার করেন এবং আহত বালীকে সুষেনের কাছে নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। 'পবিত্র' পাখিদের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে এই দুই কিশোরকে আশ্রয় দেওয়া ও চিকিৎসা করার জন্য ঋক্ষরাজ ও সুষেনকে গোষ্ঠীপতিদের বাধার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু সুষেনের বক্তব্য, তিনি একজন চিকিৎসক এবং যে-কোনো রোগীকে চিকিৎসা করা তাঁর কর্তব্য। ঠিক এই সময় থেকেই বালীর জন্য তারার মুগ্ধতা ও তারার জন্য সুগ্রীবের কামনার শুরু। প্রাথমিক আড়ষ্টতা কাটিয়ে বালীও তারার প্রেমে নিমজ্জিত হলে, স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই আসে বিবাহ। ফলে, সুগ্রীবের মনে চিরকালীন শত্রুতার বীজ রোপিত হয়ে যায়!
প্রকাশ্যে সুগ্রীব অবশ্য সেই আগের মতোই অনুগত অনুজ, বালীর সকল কাজের সহায়ক। কিন্তু গোপনে বালীকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও তারাকে দখল করার ইচ্ছা সুগ্রীবকে অনবরত তাড়া করে বেড়াতে থাকে। এমনকি, রুমাকে বিয়ে করার পরেও সুগ্রীবের তারা-সংক্রান্ত আগ্রহ একটুও কমে না! বালীর জনপ্রিয়তার কারণে সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কিছু করে পার পাওয়া মুশকিল। তাই সুগ্রীবের কাছে উপায় বলতে ছিল নানারকম গোপন ষড়যন্ত্র। আনন্দ নীলকণ্ঠন দেখিয়েছেন, এরকমই একটি ষড়যন্ত্রে সুগ্রীবের পক্ষ থেকে বালী ও তারার বিয়ের উপহার হিসেবে কিষ্কিন্ধায় আবির্ভূত হয় দুন্দুভি নামের একটি দুর্দান্ত শক্তিশালী ও উগ্রমেজাজী কৃষ্ণকায় ষাঁড় (মতান্তরে, বন্যমহিষ)। দুন্দুভি ছিল কিষ্কিন্ধার দক্ষিণ-পূর্বে বসবাসরত মাহিষা প্রজাতির অসুরদের দাপুটে শাসক মায়াবীর খুব প্রিয় পোষ্য। প্রসঙ্গত, এই মায়াবী রাবণের দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও বটে (মূলধারার অনুসারী ব্যাখ্যাতাদের মতে অবশ্য মায়াবী ও দুন্দুভি ময়দানবের দুই পুত্র, মন্দোদরীর বড়ো ভাই। সেই অর্থে রাবণের শ্যালক। এদের মধ্যে দুন্দুভির নাকি হামেশাই ষাঁড়ের রূপ ধরে আক্রমণ করা অভ্যাস ছিল!)। যাই হোক, রাবণের অসুর সাম্রাজ্যের অন্যতম জায়গীরদার বা সামন্তরাজ হিসেবে মায়াবী কিষ্কিন্ধা-সীমান্তের ওপাশের এলাকাটি শাসন করতেন। কিন্তু মায়াবী ছাড়া অন্যদের কাছে দুন্দুভি ছিল আতঙ্কের অপর নাম। নীলকণ্ঠনের একটি অনবদ্য বর্ণনায় আমরা তার কারণ পাবো---'Something was sinister about the bull. Its shoulders were five feet from the ground and the muscles rippled in its black body. Its curved horns, almost three feet long were as sharp as swords. The small eyes were cruel, and its nostrils flared in anger, as if it was about to charge. It stood, proud and erect, with untamed wilderness brimming from every inch of its chiselled body.' মায়াবীর ঘোষণা ছিল, এই দুর্দান্ত দুন্দুভিকে কেউ যদি পোষ মানাতে পারে, তাকে কয়েকশত গরু-মোষ উপহার দেওয়া হবে। বিষয়টা প্রায় অসম্ভব হলেও লোভনীয় ছিল, সন্দেহ নেই (কারণ, 'For the Devas, cows are holy animals and they worship it like a God. For Asuras, it is a delicious food.')। সুগ্রীব এই শর্তে জেতার জন্য দুন্দুভির এক পরিচর্যাকারীকে ঘুষ দিলেন। লোকটি দুন্দুভির খাবারে আফিম মিশিয়ে দিল। ফলে, দুন্দুভিকে বশ করতে সুগ্রীবের কোনো অসুবিধাই হলো না। কিন্তু কোনো অসৎ উপায় ছাড়া দুন্দুভিকে বশ করা যে সুগ্রীবের ক্ষমতার বাইরে, সে-কথা ঋক্ষরাজ ও তারার বোধের বাইরে ছিল না। কিন্তু সুগ্রীব তাঁদের কাছে সেটা স্বীকার করেননি। স্বীকার করলেন বালীর কাছে, যখন তিনি বালীকে দুন্দুভির সঙ্গে জালিকাট্টু (খালিহাতে শক্তিশালী ষাঁড় বা মহিষ বশ করার আসুরিক খেলা) লড়াইয়ে নামতে যথেষ্ট উসকে দিতে ও উত্তেজিত করতে পেরেছেন। তারা ও ঋক্ষরাজ, দু'জনেই নিজের-নিজের মতো করে বুঝতে পেরেছিলেন, এটা আসলে বালীকে হত্যা করানোর জন্য সুগ্রীবের ছক; কিন্তু ভ্রাতৃস্নেহে অন্ধ বালীকে সে-কথা বোঝানোর সাহস ও সুযোগ, কোনোটাই কেউ পেলেন না। অন্যদিকে সুগ্রীব স্বয়ং বালীর কাছে অসদুপায়ে দুন্দুভিকে আনার কথা বললেও যুক্তি দিলেন যে, মায়াবীর সৈন্যরা তো দুন্দুভিকে বাচ্চা অবস্থায় ঋষি মাতঙ্গের আশ্রম থেকে চুরি করে এনেছিল। সেটা যদি অন্যায় না-হয়ে থাকে, তাহলে এখন তাকে চুরি করা অন্যায় হবে কেন! তা সত্ত্বেও বালী তাঁকে অপরাধ স্বীকার করে পশুটিকে মায়াবীর কাছে ফেরত দেওয়ার কথা বলতেই তিনি জানালেন, এখন যদি লড়াই না-করে বালী দুন্দুভিকে মায়াবীর কাছে ফেরত দেন, তাহলে সবাই বালীকে কাপুরুষ বলবে। ধূর্ত সুগ্রীব জানতেন, ইগোয় খোঁচা দিলে বালী অবশ্যই লড়াইয়ে না-নেমে পারবেন না। ঠিক তাই হলো! বালী প্রথমে দুন্দুভিকে বশ করে, তারপরে ভাইয়ের অন্যায় কাজের জন্য মায়াবীর কাছে ক্ষমা চাওয়া মনস্থ করলেন।
লড়াইয়ের বিস্তারিত বর্ণনা এখানে অপ্রয়োজনীয়। তবে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, বালী মুখোমুখি লড়াইয়ে দুর্দমনীয় দুন্দুভিকে বধ করলেন। বালীর হাতে নিহত হওয়ার আগে দুন্দুভি দর্শকদের আক্রমণ করে বিরাট তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিল। সেই রাগে কিষ্কিন্ধার জনতা মৃত দুন্দুভির দেহ টুকরো-টুকরো করে ফেললো, শেষ অবধি সেই দেহাবশেষ ফেলে দিয়ে এল মাতঙ্গ ঋষির আশ্রমের এলাকায়। ক্রুদ্ধ মাতঙ্গ আশ্রম অপবিত্র হওয়ার কারণে বালীর ওই অঞ্চলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন। সুগ্রীবের এই চক্রান্ত ব্যর্থ হলো। কিন্তু এই চক্রান্তের কারণেই মাতঙ্গের আশ্রমের আশপাশে বালীর প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা ভবিষ্যতে অন্য সূত্রে সুগ্রীবের সহায় হয়ে ওঠার পথ তৈরি করে দিল।
এরপরে দুন্দুভিহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মায়াবীর কিষ্কিন্ধা আক্রমণ ও বালীর প্রতিআক্রমণে পিছু হটে পালানো, তারপরে এক গুহার ভিতরে ঢুকে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে বালীর মায়াবীবধ, পাহাড়ি ধসের কারণে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে বালীর সেখানেই আটকে পড়া ও দীর্ঘ অপেক্ষার পরে বালী আর জীবিত নেই ভেবে অনুসরণকারী সুগ্রীবের কিষ্কিন্ধায় ফিরে আসার বহচর্চিত গল্প নিয়ে আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে গুহার মুখ ধসের জন্যই বন্ধ হয়েছিল, নাকি সুগ্রীবের কোনো হাত ছিল তাতে, এ-নিয়ে বিস্তর সন্দেহ ও বিতর্কের উপাদান আজও রয়ে গেছে আলোচক ও ব্যাখ্যাতাদের লেখার মধ্যেই। এই ঘটনার সময়ে তারা সন্তানসম্ভবা, এবং তার কিছুদিন পরেই অঙ্গদের জন্ম। অঙ্গদের একজন পিতার প্রয়োজন আর কিষ্কিন্ধার প্রয়োজন একজন রাজা, এই যুক্তিতে সুগ্রীবের তারাকে বিয়ে করার উদ্যোগ সেই সন্দেহকে আরও দৃঢ় ও প্রতিষ্ঠিতই করে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই কীভাবে বালী ফিরে এলেন এবং সুগ্রীবকে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় কিষ্কিন্ধা থেকে বিতাড়িত করলেন, সে-গল্প আমরা সবাই জানি। লক্ষণীয়ভাবে, অনেকটা যেন তারার বিষয়ে সুগ্রীবের আগ্রহকে একরকম বৈধতা দেওয়ার জন্যই ও ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে সামঞ্জস্য আনার জন্য কোনো-কোনো কাহিনিতে দেখানো হলো, সুগ্রীবকে বিতাড়িত করে বালীও রুমাকে অধিকার করেছিলেন! যদিও বালীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও রুমার সঙ্গে তার পূর্ব-আচরণের ঘটনাসমূহ বিচার করলেই বোঝা যায়, তা বালীর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। তবে রুমাকে বালীর দখল করার এই গল্প সুগ্রীব কিছুদিন পরেই রামকেও বলবেন, অবশ্যই নিজের কার্যকলাপ সম্বন্ধে কিছুই প্রকাশ না-করে! তখন সদ্য সীতাহরণ ঘটেছে, পত্নীর চিন্তায় রামও আকুল। ফলে, প্রায় অনুরূপ একটি ঘটনার কথা শুনে তিনি সুগ্রীবকে সাহায্য করার কথা দিয়ে বসবেন; এবং এই ঘটনা থেকেই পরে ঈশ্বরের মানবায়ন আরও নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত হবে।
এর মধ্যে অবশ্য সুগ্রীব বারদুয়েক বালীর সঙ্গে মোলাকাতের চেষ্টা করেছেন, এবং ব্যাপক মার খেয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছেন। মায়াবীবধ করে আসার পরে বালী তাঁকে যে তুমুল প্রহার করেছিলেন, তার থেকে সুগ্রীব সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন হনুমানের নিরলস শুশ্রূষার পরে। কেশরীর পুত্র হলেও হনুমান কোনোদিনই বন-নরদের পুরোনো গোষ্ঠীপতিদের মতো ছিলেন না। বরং দেব-সংস্কৃতির আবহে বহুদিন কাটানো ও শিক্ষালাভের কারণে তাঁর মধ্যে উত্তর-ভারতীয় ব্রাহ্মণসুলভ ভাবনাচিন্তা এসেছিল দৃঢ়ভাবে। এই হনুমান যে পরবর্তীতে রামায়ণের কাহিনিতে মোড়ঘোরানো সব কাজ করবেন, এবং বন-নর হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক যুগে এসেও দেবতার মর্যাদা পাবেন, সে তো আমাদের জানা! কিন্তু এখানে তিনি আলোচ্য নন। আসলে, পরাজিতদের গল্পে হনুমানের কোনো স্থান হয় না। কারণ, রামায়ণের কাহিনিতে সর্বার্থে বিজয়ী সামান্য যে কয়েকজন আছেন, হনুমান নিঃসন্দেহে তাঁদের একজন। তবে প্রথমবারের মতোই পরের দু'বারেও তিনিই সুগ্রীবকে উদ্ধার করেন। সভ্য দুনিয়ায় মেলামেশার ফলে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত হনুমান যে ন্যায়নিষ্ঠ হয়েও সুগ্রীবের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তার কারণ, রামেরও অনেক আগে হনুমানকে সুগ্রীব বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে, তিনি আসলে রুমার বিরহে কাতর এবং রুমাকে উদ্ধার করার জন্যই বালীকে হত্যা করতে চান! তারাকে নিয়ে সুগ্রীবের লালসা হনুমান আগে আন্দাজ করে থাকতেই পারেন, কিন্তু কিষ্কিন্ধা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পরে রুমাকে আস্তিনের লুকোনো তাস হিসেবে ব্যবহার করেই সুগ্রীব তাঁর আস্থা অর্জন করেন। যাই হোক, দ্বিতীয়বার সুগ্রীব বালীর রাজদরবারে এসেছিলেন ক্ষমা চাইতে। সেই ক্ষমাপ্রার্থনা আন্তরিক ছিল কিনা, সে-প্রশ্ন অন্য। তবে বালী তাঁকে উত্তম-মধ্যম প্রহার করলেন। কিন্তু রক্তাক্ত সুগ্রীব তো ভাঙবেন, তবু মচকাবেন না! তাই তিনি বালীকে পরেরবার দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। শক্তি ও রণকৌশলে তিনি বালীর ধারেকাছেও আসতে পারবেন না, তাই যথারীতি পরাজিত হলেন। দ্বন্দ্বযুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী এরপরে বিজয়ীর বিজিতকে হত্যা করার কথা। জীবন শেষ হলেও, এতেই পরাজিত যোদ্ধার সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু যত ঘৃণাই থাক, অনুজের প্রতি অন্তঃসলিলা ভালোবাসা বালীকে সুগ্রীবের হত্যা করতে দিল না। এতে আরও অপমানিত হয়ে সুগ্রীব খোলাখুলি ঘোষণা করে গেলেন যে এবার থেকে বালীর মৃত্যুই হবে তাঁর প্রধান লক্ষ্য।
রামের সঙ্গে সুগ্রীবের যোগাযোগ ওই হনুমানের মাধ্যমেই। তখন সীতার খোঁজে রাম ও লক্ষ্মণ দিশাহারা। এই সময়েই তাঁরা কিষ্কিন্ধার জঙ্গলে প্রবেশ করেন। সুগ্রীব বহুদিন আত্মগোপন করেছিলেন ঋষ্যমুখ পর্বতের আড়ালে, মাতঙ্গের দেওয়া শাস্তিস্বীকার করে নেওয়া বালী যেখানে কখনোই আসবেন না। সুগ্রীব চুক্তিবদ্ধ হলেন, বালীকে হত্যা করে রাম যদি তাঁকে সবকিছু ফিরিয়ে দিতে পারেন, তাহলে তিনিও রামকে সীতাউদ্ধারে সাহায্য করবেন। চুক্তি অনুযায়ী সুগ্রীব আবার কিষ্কিন্ধায় গিয়ে বালীকে গালাগালি দেওয়া শুরু করলেন। উত্তেজিত বালী তাঁকে তাড়া করলে দ্বন্দ্বযুদ্ধের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় না-লড়ে, দৌড়ে পালিয়ে সুগ্রীব বালীকে টেনে আনলেন জঙ্গলের আশপাশে। সেখানে একটি ঝোপের (মতান্তরে, গাছের) পিছনে তির-ধনুক নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন রাম। কিন্তু দু'জনের চেহারায় অসম্ভব মিল থাকায় দ্বন্দ্বযুদ্ধের মধ্যে বালীকে রাম চিনতে পারলেন না। যথারীতি ব্যাপক মার খেয়ে পালিয়ে বাঁচলেন সুগ্রীব। সেদিন কোনো অঘটন না-ঘটলেও তারার সন্দেহ ঠিকই ছিল যে, সুগ্রীবের এই হঠাৎ-তৎপরতার পিছনে নিশ্চয় অন্য কারও সাহায্য আছে! তারা বিচক্ষণ নারী, তিনি সে-কথা বালীকে জানিয়ে সতর্কও করে দিতে চেয়েছিলেন। দ্বন্দ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি যেন অচেনা কাউকে তির-ধনুক নিয়ে দেখেওছিলেন গাছের আড়ালে! কিন্তু স্বভাবসিদ্ধ উদারতায় বালী বিষয়টায় কোনো গুরুত্বই দিলেন না। সুগ্রীব তাঁকে হত্যার জন্য এরকম ঘৃণ্য পদ্ধতির সাহায্য নিতে পারেন, তা বালী ভাবতেই পারেন না! একইভাবে তিনি ভাবতে পারেন না, কোনো বীর যোদ্ধা এভাবে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে কাউকে মারার জন্য তির চালাতে পারে! পরেরদিন সুগ্রীব আবার এসে বালীকে নানা কুকথা বলে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানাতে থাকেন। এবার তাঁর গলায় জবাফুলের মালা! একইভাবে বালী তাঁকে তাড়া করলেন। জঙ্গলের ধারে আবার লড়াই শুরু হলো। আবার সুগ্রীবের পরাজয় যখন নিশ্চিত, তখন গাছের আড়াল থেকে একটা তির ছুটে এসে বালীকে বিদ্ধ করলো। রামায়ণের সবচেয়ে সৎ ও নির্ভেজাল নায়কের গুপ্তহত্যা এভাবেই অমর-অক্ষয় হয়ে গেল বীরভোগ্যা বসুন্ধরার বুকে!
rahulbabin1@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন