পিনাকি

ধূসর সন্ধ্যার রঙ
!১০!

বাস থেকে যখন নামলাম । ঘড়িতে রাত আটটা । শিবপ্রসাদকে আমি শিবু বলে ডাকি । পাতলা চেহারা , মাথায় চুল ছোট –ছোট করে ছাটা । চোখ দুটো স্থির , উজ্জ্বলতা হারিয়েছে । তবুও আমার ভালো লেগেছে । সত্যি বলতে আমার চারপাশে যে নিঃশব্দে অবস্থান করা অপার্থিব জগত রয়েছে , মানুষের জীবন্ত পৃথিবীর মধ্যেও আরেক পৃথিবী রয়েছে ; বিশ্বাস , অবিশ্বাস , লৌকিক , অলৌকিক --- এইসব কিছু সেখানে তুচ্ছ । আমি দেখছি সেই সব ছায়া ,আমাকে ঘিরে আছে । আবার আচমকা আমার সামনে কাঁদছে ! কোন বিষণ্ণ মুখ আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে । আমার এই গুপ্ত পৃথিবীর খোঁজ শুধুমাত্র শিবুর কাছেই পেয়েছিলাম । আমি আমার এই সমস্যা সেই সময় যাদের বলবার চেষ্টা করেছিলাম , সকলেই মনের অসুখ বলে কোন মনোবিদের কাছে দেখানোর পরামর্শ দেয় । দেখিয়ে ছিলাম । তাতেও লাভ হয়নি । নিজের ভিতর আর নিজের বাইরে এক যুদ্ধ চলেছে । নিজের সাথে যুদ্ধ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ । এখানে নিজের প্রতিপক্ষ নিজেই । বাঁচানোর কেউ নেই । 

শিবুই প্রথম আমাকে বিশ্বাস দেয় , যে জগত আমি দেখেছি ,সেখানে আমাকে প্রবেশ করতে হবে ।আজ নয়তো কাল , আমিও সেই অদেখা জগতে বাসিন্দা হবো । নিজের কাছে এইসব ঘটনা অবিশ্বাস্য বলেই মনে হচ্ছিল , আবার আমি জানি এই অবিশ্বাস্য ঘটনা একদম সত্যি । আসলে আমরা একই সাথে দুটো জগতে বাস করে চলেছে , একটা স্পর্শের আর আরেকটা অনুভূতির । দুটো জগতের বাসিন্দাও আলাদা । খুব কম মানুষই আছেন , যারা অনুভূতির জগতে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারেন । ভারতীয় সাধকেরা এই জগত সম্পর্কে সব কিছু জানেন ; তাঁরা গুপ্তই রাখতে চান ;নচেৎ সাধারণ মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসবে । মানুষ যেইসব অনুভূতি স্পর্শ করতে পারেনা বা প্রভাব এর স্পর্শগত প্রমাণ পায়না --- বিশ্বাস করেনা । প্রেমিক আর প্রেমিকার মধ্যে যেমন চুম্বন বা দৈহিক স্পর্শ না থাকলে ; অবিশ্বাস জন্ম নেয় । মা এর আদর শিশুর মনের নিরাপত্তাহীনতা দূর করে । প্রকৃতির তাণ্ডবে মানুষের সাজানো বাগান যখন তছনছ হয়ে যায় -------- তখনই আমরা সর্বশক্তিমান অদৃশ্য অনুভূতির কাছে মাথা নুইয়ে ফেলি । এই অদৃশ্য শক্তির উপাসনাই ঈশ্বরচর্চা । আমার কাছে তখনও এতোটা জগত উন্মুক্ত ছিল না । ইচ্ছা ছিল । চারপাশে যে ছায়া –ছায়া জগত দেখছি , আমি তার রহস্য জানতে চাই । 

শিবুর কথা আর সেই অদৃশ্য জগতের অভিজ্ঞতার লোভেই আমি ছুটে এসেছি । এখানে বাস থেকে নামতেই চারপাশ অন্ধকারে এমন ভাবে ডুবে রয়েছে , যেনও আমরা পৃথিবীর সেই সময়ের বাসিন্দা যখন চারপাশটা অন্ধকারে ঢেকে থাকত ; মানুষ আগুনের ব্যবহার শেখেনি । বড় –বড় গাছেদের ছায়া দেখে তারা দৈত্য দানবের কল্পনা করত ! সত্যি তাই ? আমরা এতো রাক্ষস , শয়তান , জিনের , গল্প পড়েছি ; এইসব কিছুর অস্তিত্ব ছিল , নাকি মনের কল্পনা ? আরব্য রজনীর সেই দৈত্য সেও বুঝি সত্যি নয় ! নাকি সেই সময়টা খুবই সরল ছিল । অনেক খোলামেলা আর প্রকৃতিময় ছিল ! এখানেও আমি আর শিবু যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি --- সামনে দিগন্ত ছুঁয়ে থাকা ঘাস ভূমি ; বাসে আসবার সময় শিবুই বলেছে – আমাদের আলপথ পেড়িয়ে যেতে হবে । অন্ধকার রাতে মাথার উপর আকাশে চাঁদের আলোর খেলা । আলোর তলায় অন্ধকারের চাঁদোয়া । খোলা মাঠ , আসলে ধান ক্ষেত কিন্তু । জলে ডুবে থাকা দুধারে ধানের জমি , মাঝখানে সরু পথ । আমরা সেখান থেকেই আধঘণ্টা হাঁটব । তারপর একটা জঙ্গল , এর ভিতর পাক্কা চল্লিশ মিনিট । ভয় নেই , এই জঙ্গলে মানুষ খেকো পশু নেই । তুমি বিশ্বাস করতে পারো ।

এখন বাজে আটটা , মানে শিবুদের গ্রামে পৌঁছাতে গেলে এক ঘণ্টা দশ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ । আমি কেন জানি একটা বিপদের আভাস পাচ্ছি । ভয় করছিল । কলকাতায় যারা আলোর আশ্রয়ে বড় হয়েছে , তারা অন্ধকারকে চেনেনি । দেখেনি অন্ধকারের ভিতর লুকিয়ে থাকা রহস্যের । খোঁজ নেয়নি রূপবতী অন্ধকারের । আমি সেই সময় চারিদিকের অন্ধকার দেখছিলাম , এই চেহারা , সৌন্দর্য আমাকে বিস্ময় করে ফেলেছে ! এরা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল । এদের সাদর আপ্যায়ন মাথা পেতে নিচ্ছি । আমার ভয় হচ্ছিল , আবার মনে –মনে কেউ সংকেত দিলও – এটাই আমার জগত । আমি বিশ্বাস করছি যা আলো তা প্রতিফলিত সত্য । আর যে সত্য প্রতিফলিত হয়না তাই অন্ধকারের উপমায় ভূষিতা । আমি কখনই প্রতিফলিত না হওয়া অন্ধকারকে মিথ্যা বলতে পারিনা । আমার চারপাশে যে অন্ধকার ,তাহলে তার ভিতরেও সত্যি আছে ? 

এটা কেমন সত্যি ! আমি মুহূর্তে হারিয়ে ফেলছিলাম নিজেকে । এই প্রথম গ্রাম্য প্রকৃতিকে এতো কাছ থেকে দেখছি । মাথার উপর গভীর কালো আকাশ । বুকে অজস্র নক্ষত্র রা জ্বলছে আর নিভছে । এই মাঠের উপর দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে , এক সীমানাহীন সমুদ্র । জলরাশি স্থির । এই জলরাশির বুকে পর্যবেক্ষণের জন্য আলো স্তম্ভের ব্যবস্থা করা হয়েছে । সেই পর্যবেক্ষণ শিবির থেকে যে আলোর ছটা তাতে যেনও গোটা চরাচর আলোকিত । আচ্ছা আকাশে যে মানচিত্র , আলোকচিত্র রচিত হয়েছে , তেমন পৃথিবীর বুকেও আছে ? এটাও প্রতিফলিত সত্য ।

হাঁটতে শুরু করেছি । একটু পা চালিয়ে যাচ্ছি । শিবু বলল – চারপাশ দেখে আসবে । তুমি আগে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওনি ।

আমি বললাম সত্যিই এমন রাতের ছবি আমি কোন সিনেমাতেও দেখিনি ! 

-দেখবে কেমন করে , সিনেমা আমাদের স্বপ্ন দেখায় । প্রকৃতির বাস্তবতা ছুঁয়ে দেখতে হয় । সেই ছুঁয়ে দেখবার মুহূর্তটা উপভোগ করবার মতন । তুমি নিজের পরিচিত জায়গা থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে , জীবনের অনেকটা বড় অংশই অদেখা থেকে যাবে । এটাই জীবন । তুমি খাচ্ছ , ঘুমাচ্ছ আর পরিচিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে লড়াই করছো । সেটা লড়াই বটে , তবে তাতে নতুন অভিজ্ঞতার সম্ভাবনা নেই । আজ এতো দূরে এসেছো । আমাকে বিশ্বাস করেছো , এর পিছনে সেই অজানা জগতের প্রতি আকর্ষণ ।

-তা ঠিক । আমি এখানে এসে এমন দৃশ্য দেখব কল্পনাও করিনি ! 

-ত্রিনয়ন আমরা যা কল্পনা করি , তার সবটা দেখতে পারিনা । অনেক অকল্পনীয় পরিস্থিতিই আমাদের অভিজ্ঞ করে । তোমার অভিজ্ঞতার পরিধি বাড়তে চলেছে ।

-ঠিক বুঝলাম না !

-সময়ের আগে সব কথা বোঝা যায়না ।

-আমি বুঝতে চাই । অন্তত সময় এলে যেনও কোনও কিছুই ঝাপসা না থাকে ।

-যদি নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকে , তাহলে নিজেই পরখ করবে ।

-সবসময় পরখ করতে গেলে অনেক সময় চলে যায় । এই যে এখানকার অভিজ্ঞতা গুলো , তুমি কোনোদিন হয়ত কোন কৌতূহলীকে বলবে । সে বিশ্বাস করবে না । কিন্তু পরখ করতে হলে তাকে অপেক্ষা করতে হবে । 

আমি থেমে গেলাম । এতক্ষণ খেয়াল হয়নি , এখন দেখলাম আমরা আলপথ পেড়িয়ে খোলা মাঠের উপর দাঁড়িয়ে আছি ! চারদিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম , এটাতো মাঠ নয় ; দেখে মনে হচ্ছে পুরানো ধ্বংস স্তূপ । চারপাশে মাটির ঘরবাড়ি ছড়িয়ে আছে । মনে হচ্ছিল , এখানে কোন একসময় জন বসতি থাকতে পারে । ধীরে – ধীরে বিলোপ ঘটেছে । দেখেই মনে হচ্ছিল প্রাচীন জনপদ । মাটির সবকটা ঘরই ভেঙে গিয়েছে । অন্ধকার এখানে আরও বেশি করে চেপে ধরেছে ।

আমার সামনে ভাঙা দালানের ইতিহাস । আমি দেখছিলাম । এই জনপদ গুলোর কথা কোন বইতে নেই । তবুও চারপাশে তাকিয়ে আমার ভিতর শিহরণ হচ্ছিল । এটা আদপে মাঠ নয় , কোন ছোট্ট গ্রাম হবে । মানুষের স্নানের ঘর অর্ধেক ভাঙা । মাথার উপরের চাঁদের আলো , হাল্কা স্নিগ্ধতা স্পর্শ করছে । আমি ভাবলাম শিবুকে জিজ্ঞেস করবো । শিবু এই বিস্মৃত জনপদের ইতিহাস আমাকে বলবে । জীবন এমন অভিজ্ঞতার সামনে নিয়ে এসেছে ,আমি নিজেই টের পাচ্ছি ; রহস্য রয়েছে । এই জগত রহস্যে ভরা । আমার মাথার উপর , দূরের ছায়ায় ভেসে থাকা মাঠ , ক্ষেত , জঙ্গল ---- এইসব কিছু আমার চেনা ! না ,আমি এইসব কিছু দেখিনি । শুনিনি । তবুও যেনও আমি এইসব কিছুর জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম ! মানুষ অনেক সময়ই অপরিচিত পরিবেশে হাঁপিয়ে ওঠে । প্রস্তুত পরিস্থিতিতে নিজের ভিতরে চাপা উত্তেজনা তৈরি করে , কিন্তু আমার এইসব কিছুই হচ্ছে না । আমি যেনও এক অদ্ভুত মেনে নেওয়া মনোভাবের অধীনে চলে গিয়েছি । 

কার জন্য অপেক্ষা করছি আমি ? কাকে অপেক্ষা করাচ্ছি ? কেন অপেক্ষা করছি ? সব প্রশ্নের উত্তর ,সব সময় পাওয়া যায় না । তবুও মানুষ উত্তর খুঁজবেই । মানুষ এই উত্তর এর সন্ধানেই অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে । পৃথিবীর দর্শনের সূত্রপাত এমনই কোন উত্তরমুখরিত নতুন প্রশ্নের জন্মের সন্ধিক্ষণে । 

শিবুর কণ্ঠস্বর কানে এসেছে , আমি হুঁশ ফিরে বললাম – এতক্ষণ অনেক কিছু ভবাছিলাম ।

-তুমি এতক্ষণ এই চারপাশের পরিবেশের রহস্য খুঁজছিলে । তাইতো ?

-মানে !!

অবাকই হলাম কাকতালীয় হলেও আমার মনের কথা শিবপ্রসাদ বলে ফেলেছে ! শিবপ্রসাদকে আমি শিবু বলে ডাকি । আগেও দেখেছি , ক্যান্টিনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শিবু মনের ভিতরের অনেক কথাই বলে দিয়েছে । আমি জানতে চেয়েছিলাম , হাসতে –হাসতে বলেছিল – এটাও একটা অনুশীলন । ভারতীয় যোগবিদ্যা । 

আমি বললাম – শিবু , এই অঞ্চল এমনই ? মানে মানুষ নেই , শুধুই অন্ধকার , শূন্যতা , ভাঙাচোরা বসতি ; দেখে মনে হয় কোন ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান । এই ভূমির ভিতর লুকিয়ে আছে ইতিহাস ।

-হাঃ হাঃ হাঃ।

হাসিটা এই রাতে কানে এসে লাগল । এখানে জনমানুষ নেই , আবার এতোটা নির্জনতা যে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ পর্যন্ত মনে হচ্ছে কানে এসে লাগছে ! শিবুর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট মনে হচ্ছে আমি যে শিবপ্রসাদকে নিউআলিপুর কলেজে চিনতাম , যাকে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ঘুরেছি ---- সে যেনও অন্য কেউ ! আমার সামনে শিবপ্রসাদকে অন্য একজন বলে মনে হচ্ছে । 

-শিবু আমি এতোটুকু বুঝতে পাচ্ছি এই অঞ্চলে কিছু রহস্য আছে । তুমি আমাকে বলও ।

শিবু শান্ত আর শক্ত কণ্ঠস্বরে বলল - এই অঞ্চল সত্যিই প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক । 

-মানে ? আমি আগে শুনিনি !

-আমরা তন্ত্রের সভ্যতাকে এখনো স্বীকৃতি দিইনি , তোমাকে বলেছিলামতো এই স্থানে তোমাকে নিয়ে এসেছি তন্ত্রের জগতে পরিচয় করাবো বলে । এই স্থান তান্ত্রিকদের কাছে ঐতিহাসিক স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম ।

আমি নিজের উত্তেজনাকে সামলাতে পারলাম না । বললাম – মানে ?

-তুমি কখনো কোন তান্ত্রিকের প্রতিশোধের গল্প শুনেছো ?

-মানে ?

-তুমি জানো , একজন সাধক কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ! তার প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে এই অঞ্চল ।

-মানে ? 

-এই কাহিনীর শুরুতে যেতে হলে , শুরুর শুরুতে আরেকটা গল্প শুনতে হবে ।

-মানে !

-সে যুগ মুঘল আমল হতে পারে বা ইংরেজ আমল , আমাদের এখানে তখন মড়ক লেগেছিল । গাঁয়ের পর গাঁ -বাচ্চারা মারা যাচ্ছিল । বলতে পারো মড়ক ভয়ানক ভাবে এই গ্রামেই চলে এসেছে !

এই পর্যন্ত বলেই ত্রিনুদা গল্প থামালও । পিছনে দাঁড়িয়ে আছে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পড়া বছর কুড়ির ছেলে । আমাদের কাছ থেকে খাবারের বায়না নেবে । মুমিন বলল - বিকেল চারটে , তিন ভাঁড় চা আর দুটো করে তিন প্লেট শিঙারা গরম –গরম । 

ত্রিনুদা বলল - তাড়াতাড়ি না আনলে ক্ষতি নেই । আজ মোটামুটি তোমাদের এখানে নটা পর্যন্ত আছি । 

আমি আর মুমিন বেশ গুছিয়ে বসলাম । আমরা জানি ত্রিনয়নদা যখন গল্প শুরু করে , তখন আমরা সেই বিচিত্র জগতে হারিয়ে যাই ! আমরা চোখের সামনেই এমন পৃথিবীর বাসিন্দাদের দেখি , যাদের চারপাশে দেখিনি আগে , অপরিচিত সেই সব মুখ গুলো আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে । মনে হয় এই পৃথিবীতেই ঘুরে বেড়ায় , চলাফেরা করে । এক অন্য জগতের সেইসব বাসিন্দারা অন্যদের কাছে রূপকথা মনে হলেও , তাদের উপস্থিতি নিয়ে অন্তত আমাদের কোন সন্দেহ নেই । আর আমি নিজে ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি আমার লেখা পড়ে কেউ যদি ভাবেন সেই সব চরিত্ররা নেহাতই কল্পনা তা হলে আমার কিছু করবার নেই । আমার পাঠকেরা কখনো যদি কোন অতিপ্রাকৃত পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে যায় , আমি চাইব তখন নিজেদের উদ্ধার করতে বেশি সচেষ্ট হয় । যুক্তি দিয়ে সবসময় বিচার করতে হবে , মানতে হবে ,বিশ্বাস করতে হবে । কিন্তু যুক্তির তত্ত্ব কে সামনে রেখে যারা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বিলম্ব করতে নিষেধ করেছে , ত্রিনুদা । আজ এই গল্পে , ত্রিনুদার কিছু দর্শনের ঝলক পাচ্ছি ! এই গল্প এখন আমাদের চুম্বকের মতন টানবে । 

ত্রিনুদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল - আমি শুরু করছি , মন দিয়ে শুনবি ।

শিবু আমার দিকে তাকিয়ে বলল - এই যে জনপদ একসময় এখানে মানুষ বসবাস করত । গ্রামে মেলাও বসতো । নদীর ধারে শুনেছি সেই মেলায় নানা জনপদের রাজরাজারা আসত । তেমন মেলার আগেই মড়কে পুরো গ্রাম শুকিয়ে যাচ্ছিল । গ্রামের মাতব্বররা বললেন – এই মৃত্যুর পিছনে ডাইনের হাত রয়েছে , কেউ বিষ নজর দিয়েছে । 

গ্রামবাসীরা অনেকেই জায়গা ছাড়ছিল । গরীব ,যাদের গ্রামের বাড়িই সম্বল তারা কিন্তু এখানেই থেকে গেলো । তারাও বুঝে গিয়েছি মৃত্যুই তাদের ভবিতব্য ।

আমি বললাম – তারা কোন ব্যবস্থা করল না ?

শিবু আমার কথা শুনে বিরক্ত হলও , বলল – দেখো বাচ্চাদের মতন কথা বলছ ? তোমার মনে হয়না যে তারা বাঁচবার সবরকম চেষ্টা করেছিল । আগেকার দিনের মানুষ এখনকার মতন আধুনিক নয় , তাই বলে তাদের বুদ্ধি নেই –এই ভবানাটাই অর্থহীন । 

আমি বুঝতে পারলাম কথাটা ভুল নয় । আমি বললাম –তারপর ?

-পঞ্চায়েতের সবাই এই এখানেই বসেছিল ।

আমরা একটা মাটির বেদীর উপর বসেছিলাম । আমি বললাম –তারপর ?

শিবু বলছিল - গ্রামের মানুষের মধ্যে তখন হাহাকার । যারা অর্থবান তারা পালিয়ে গিয়েছিলেন । কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষই দুবেলা কোন রকমে খেয়ে কাজ চালায় । বড় জমিদারদের জমিতে চাষ করে ছোট কৃষক ।নিজেদের রুজি –রোজগার ছেড়ে তারা কোন মতেই যাবে না । তাহলে উপায় ? সময় কিন্তু থেমে নেই হু হু করে প্রায় দশ দিনের মধ্যে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো । এরপর গ্রামের গর্ভবতী মহিলাদের আচমকাই গর্ভপাত হতে শুরু হলও । জোয়ানরা আন্ত্রিকের প্রভাবে পড়ল । সবাই নিশ্চিত এই রোগ আমাদের গ্রামটাকে খেয়ে ফেলবে । 

আমি যেনও শিবুর কথায় সেই অজানা সময়ে ফিরে যাচ্ছিলাম ! সেই সময়কার অন্ধকার আর মড়কের ছবিটা ভেসে উঠছে । মর্মান্তিক । অসহায় মানুষ গুলোর পাশে কেউ নেই ! মৃত্যুই যেনও ওদের আলিঙ্গন করছে । এমন পরিস্থিতি থেকেই এই জনবসতি শেষ হয়ে গিয়েছে । শিবুর গল্পে তেমনই ইঙ্গিত পাচ্ছি । ইস , এই জনবসতির ভগ্নপ্রায় চেহারা রাতের অন্ধকারে মৃত সভ্যতার প্রেতাত্মা হয়ে উঠেছে ! কিছুটা মন খারাপ লাগছে । মানুষ গুলো বাঁচবার চেষ্টা করেছিল । 

-শিবু , ওঠো । এই স্থানে ভালো লাগছেনা ।

-কেন ? 

-মনে হচ্ছে বড্ড শূন্যতা । কাঁদতে ইচ্ছা করছে । গোটা জনবসতি চোখের সামনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল ! 

শিবু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল - এর জন্য এখানকার মানুষের মূর্খতাই দায়ী । 

-মানে ? এরা চেষ্টা করেছিল বাঁচবার । সেই সময় চিকিৎসাবিজ্ঞান আজকের মতন ছিল না ।

-সে ঠিক , তবে মন্ত্র শক্তি ছিল । যদিও আধুনিক বিজ্ঞানের উপরই মানুষের ভরসা থাকা দরকার । কেননা মন্ত্র খুব শক্ত মাধ্যম , তা সকলে জাগ্রত করতে পারে না । তা সঠিক ভাবে জাগ্রত হলে মানুষের সামনে এমন অনেক অভিজ্ঞতার দরজা খুলে যায় , যা মানুষ বিশ্বাস করতে পারে না । আবার বিশ্বাস করা মানুষ বিশ্বাস ঘাতকতাও করে ফেলে । 

-মানে ?

-তোমাকে আমি এতক্ষণ যে ঘটনাটা তোমাকে বলেছি , তা সূত্রপাত । এই গ্রামের লোকেরা টের পায়নি আরও বড় কিছু ঘটতে চলেছে । 

-মানে ? তুমি কি বলছো ?

-দেখো , সেই মড়কে এই গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়নি ।

-মানে ?

আমি নতুন আশা খুঁজে পেলাম । ভালো লাগছিল , সব শিশুর হাসি মিশে যায়নি , নতুন প্রাণ জন্মেছে । জানিনা কোন সময়ের কথা , কিন্তু মানুষের সংগ্রামে জয়ী হওয়াটাই আমার আনন্দের কারণ । 

আমি বললাম – সেই মোড়ক থেকে বাঁচবার কোন উপায় তোমারা খুঁজে পেয়েছিলে ?

শিবু হাসল । এই প্রথম শিবুর দুচোখের কোণায় আমি নিষ্ঠুর বিদ্রূপ দেখলাম । যেনও সে অপেক্ষা করে আছে আমাকে কোন রহস্যময় পথের হদিশ দেবে ! 

আমি বললাম - তুমি কিছু গোপন করছো ?

শিবু বলল – একদম নয় । আমি গোপন করবো কেন ? পৃথিবীতে এতো কিছু গোপন আছে যে , নতুন করে আমি আর কিছু গোপন করতে চাই না । তবে এটা ঠিক , সব গোপন রহস্য সকলের সামনে বলতে নেই । আমি তাই সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম । 

-এই চারপাশের অন্ধকার , ঝি ঝি পোকার ডাক , মাথার উপর ঝিকমিক করতে থাকা নক্ষত্রদের আলো , দূরে কোন জঙ্গল থেকে ডেকে ওঠা শেয়াল , এতো কিছুর মাঝে নতুন রহস্যের সন্ধান দেবে ?

-তুমি এখন এমন বিশ্বাস আর অবিশ্বাস এর মাঝখানে বসে আছো ত্রিনয়ন । তুমি এমন জগতে রয়েছও যেখানে বিশ্বাস খুব সীমাবদ্ধ । আর আমি তোমায় এমন জগতে প্রবেশ করাতে চলেছি , যা এই সব সীমাবদ্ধ বিশ্বাসকে অতিক্রম করেই আসতে হবে । এখানে সব কিছুই বিশ্বাসের উপরেই নির্ভর করছে । 

-আমি তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই এখানে এতো রাত অব্দি বসে আছি । বলও ।

-এই গ্রামের মুরুব্বিরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত । এতোটা যে তারা ধরেই নিয়েছে তাদের হাতে আর কিছু নেই । এই জনপদ নষ্ট হতে চলেছে । এমন সময় , ভোরে এক জটাধারী সাধু এসে গ্রামের সীমানায় পা রাখলেন । মুখে হিমালয়ের স্নিগ্ধতা । । খুব ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিল কৃষকের দল । জীবনে যতই ঝড় বয়ে যাক , চাষ করতে হবে । জমিতে হাল টানতে হবে । 

তখনও ভালো করে গ্রামের পূর্ব দিকে সূর্য ওঠেনি । তবে আকাশের হাল্কা আলোর ছাপ দেখা যাচ্ছে । এই মুহূর্তটাকে দানির খুব মায়াময় মনে হয় । সে তাকিয়ে দেখছে ক্রমশই আকাশের গায়ে আলোর ছবি ফুটে উঠছে ; কোন গর্ভবতী যেনও সন্তান প্রসব করল ! 

‘জয় শম্ভু ’ – দানি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল জটাধারী এক সাধু দাঁড়িয়ে আছেন । এতো সকালে কোথা থেকে এসেছেন , যাবেনই বা কোথায় ? মনের মধ্যে এই প্রশ্ন গুলো উঁকি মারছিল ।

সাধুর গলায় অদ্ভুত টান রয়েছে । বেশ গম্ভীর ,অথচ প্রবল ভাবে বিশ্বাস করতে বাধ্য করায় । সাধু বললেন 

-আমি হিমালয় থেকে আসছি । যাবো দক্ষিণে । এই গ্রামে এসে মনে হলও একটু বিশ্রাম করি । 

দানি মনে –মনে বলল – এমন দিব্য পুরুষ এই গ্রামে ! উনি যদি জানেন এখানে মড়ক লেগেছে পালিয়ে যাবেন । ওনার কাছে সত্যি কথা লুকিয়ে যাওয়াটাও ঠিক নয় । অথচ এমন একজন সাধু মহাত্মা যদি এই গ্রামে থাকেন , গ্রামবাসীর ভাগ্য ফিরতেও পারে । 

-আরে আমি সব কিছু ছেড়েছি । রোগের ভয়কেও ছেড়েছি । তুই না বললেও আমি জানি ,এই গ্রামে রোগের অশুভ ছায়া এসেছে । 

দানি কিছুটা অবাক হয়ে গেলো ! সে এতক্ষণ যেটা ভাবছিল , এই লোকটি তা বুঝে ফেলেছে ! এও সম্ভব ! লোকটি নগ্ন শরীরে ছাই মাখা । কপালে ভস্মের তিলক । নিম্মাংশে যৎসামান্য কাপড়ের টুকরো । দানির নিজেকে সবচেয়ে গরীব আর অসহায় বলে মনে হতো । অথচ এই লোকটার কাছে দানির থেকেও যৎসামান্য বস্ত্র রয়েছে ; লোকটি অসহায় নয় আবার গরীব নয় । এর মানে অর্থ , বস্ত্র না থাকলেও কেউ অসহায় , গরীব নাও হতে পারে ! সাধুর দেহে তাম্র বর্ণ ফেটে পড়ছে । সারা গায়ে ছাই ভস্ম ভেদ করে , সেই তেজ যেনও দানিকেও ছুঁয়েছে । 

সাধু হেসে বলল – তুই যা ভাবছিস তার উত্তর আমি দিচ্ছি । মানুষের জীবনে অর্থ দরকার । কিন্তু অর্থ না থাকা মানেই মানুষের জীবন ব্যর্থ নয় । অর্থ মানুষকে বড়লোক করতে পারে , কিন্তু অসহায়তার থেকে মুক্তি দিতে পারেনা । 

দানি বলল –আপনি আমার মনের কথা জানলেন কেমন করে ?

-তোর মুখে ভেসে উঠেছে । কি নাম তোর ?

-দানি । বাবা , আমরা বড় অসহায় । জানিনা এই গ্রামে কেন এমন অশুভ নজর পড়লো ! আজ নিয়ে দশ দিনের বেশি হয়ে গেলো , মৃত্যু যেনও থামতেই চাইছে না । আমাদের উদ্ধার করুন ।

-মৃত্যু নিশ্চিত , তাকে কখনই ফিরিয়ে দিতে নেই । আমি শুধু তোদের গ্রামের অশুভ শক্তিকে থামাতে পারবো । মৃত্যুকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই । 

দানি সাধুর পায়ের উপর গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল । বলল – বাঁচান ।

-আমাকে থাকতে দে ,আমি এখানে সাধনায় বসব । তাহলে বুঝতে পারব এই গ্রামের অশুভ শক্তির ক্ষমতা । 

-আপনি কোথায় থাকবেন ? জমিদার বাবুর সাথে কথা বলি ?

-মূর্খ ...

সাধুর কথা শুনে দানি চমকে গেলো ! ভয় পেলো , সে ভাবছে যদি রেগে গিয়ে অভিশাপ দেয় !

-মাপ করেদিন আমি বুঝতে পারিনি প্রভু ।মাপ করে দিন ।

দানির কথা শুনে সাধু বললেন – আমি চাইলে জমিদারের ঘরে যেতে পারতাম । তোর কাছে এসেছি ,ভাববি এটার পিছনে কোন কারণ আছে । 

-প্রভু আমি মূর্খ , এতো কিছু বুঝিনা ! শুধু আপনাকে শান্তিতে কয়েকদিন সেবা করতে চাই । আপনার কষ্ট যাতে না হয় তাই জমিদার বাড়ির কথা বলা ।

সাধুর রক্তিম মুখমণ্ডলে সুনির্মল হাসি ছেয়ে গেলো ! দেখে মনে হচ্ছে , টানা দুর্যোগের শেষে আচমকাই আকাশে মুক্ত আলো ! সাধু বললেন 

-আমি এই পৃথিবীর যত ভোগ্য বস্তু ,সব কিছুকেই তুচ্ছ মনে করি । আমার পিতা আদি যোগী । তোরা যাকে ভোলাবাবা বলিস । আমি তার ছেলে । আমাদের কাছে জমিদার আর ভিক্ষুকের মাঝে কোন তফাৎ নেই । শুধু স্বার্থহীন ভালোবাসা , আত্মসমর্পণই আমাদের উপাসনা । তুই খুব সরল । চল , আমাকে এই গ্রামের কোন ভাঙাচোরা মন্দিরের দিকে নিয়ে চল ।

-কোথায় বলুনতো ?

-সব আমিই বলবো কেন ? তো তোদের গ্রামে তোরাই তো জানবি ।

-প্রভু , আপনি সিদ্ধপুরুষ । আমাকে এমন ভাবে পরীক্ষা করবেন না ।

-বেশ । এই গ্রামের শেষ সীমায় একটা বটবৃক্ষ রয়েছে ।পাশ দিয়ে গেলেই , সালুর জঙ্গল । ওখানে , মায়ের মন্দির আছে , ভগ্ন প্রায় । সেখানেই হবে আমার আস্তানা । তুই আজ রাতের বেলা আয় । বৌকে বলে আসবি , রাতে আমার কাছে থাকবি । তোকে আমার খুব ভালো লেগেছে । 

দানি বলল –প্রভু চলুন এগিয়ে দিই আপনাকে ।

হেসে সাধু বললেন – আমি চলে যেতে পারবো , তুই রাতে আসিস । দানু দেখল , সাধু সামনের দিকে হেঁটে চলেছেন । ধীরে –ধীরে চোখের পলক ফেলতেই ,সে অদৃশ্য ! দানি মনে –মনে বলও – এই সাধু মহাপুরুষ , যোগী হবেন । অলৌকিক ক্ষমতার মালিক । রাতে সাহস করে , কনি ঘুমিয়ে পড়লে জঙ্গলে আসবো । 

দানি আর কনির বিয়ে হয়েছে প্রায় দশ বছর হয়ে গেলো । দানির বয়স ত্রিশ । ওরা নিঃসন্তান । 


দানি সালুর জঙ্গলের সীমানায় এসে থমকে গিয়েছে । সে নিজেও জানেনা , এতো রাতে এতদূর পর্যন্ত সে কেমন ভাবে পায়ে হেঁটে চলে এলো ! রাত দশটায় এই গ্রাম অন্ধকারের সমুদ্রে ডুব দেয় । মাথার উপরের তারা গুলো যদি ভোর অব্দি না জ্বলতো , এই গ্রাম আর আকাশের মধ্যে ভেদাভেদ ঘুচে যেতো । জঙ্গল থেকে শেয়ালের চীৎকার ভেসে আসছে । দানির ভয় -ভয় করছে । 

আরে কিছুটা দূরে আমড়া গাছের পাশে ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে । সাধু বাবা এখানে অপেক্ষা করছেন ? হ্যাঁ , দানি স্পষ্ট দেখলও । সেই দীর্ঘ চেহারা , এই রাতের অন্ধকারেও তাঁর উজ্বল বর্ণের তাম্র রঙ চোখে লাগছে , জটা যেনও আলোর উৎস ! সাধুর শুধু মুখ দেখা যাচ্ছে না । ছায়া –ছায়া । সে পিছন ফিরে হেঁটে চলল । দানি বুঝতে পেরেছে , তাকে পিছনে অনুসরণ করতে হবে । সে হেঁটে যাচ্ছিল ।

বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে , ভাঙাচোরা মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখল , চারপাশ অন্ধকার । এতক্ষণ দানি মধ্যে ছিল । সে সাধুকে দেখতে পেলো না , মন্দিরের পিছনে ঘন জঙ্গলে হাল্কা আলো দেখতে পাচ্ছে , গ্রামের মানুষেরা ভয়ে এখানে আসেনা ,দানি এসেছে । 

মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতেই দেখলও খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে , পাশে বসে সাধু নগ্ন হয়ে মন্ত্র পড়ছে । সামনে আগুন জ্বলছে , শুকনো পাতার স্তূপের উপর মানুষের মাথার খুলি । 

দানি এমন ভাবে গ্রামের পূজোতে ব্রাক্ষ্মণদেরও দেখেনি । এই যে আগুন জ্বালিয়ে মন্ত্র পড়া ,এটাকে হোম যজ্ঞ বলে । সাধুর যজ্ঞ যেনও আরও প্রবল ।আর মন্ত্রের উচ্চারণ আরও আকর্ষণীয় । দানিকে ক্রমশই সম্মোহিত করে ফেলছে । এখন দানির মনে প্রশ্ন - সাধু তাকে এতো দ্রুত এনেই , এই সব আয়োজন করে বসলেন কখন ! ভোরে চোখের পলক ফেলতেই গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন ! 

সাধু মন্ত্র উচ্চারণ থামিয়ে বললেন - আমি এখানেই ছিলাম , তুই যার সাথে এলি সে আমার ছায়া ।দানি বুঝতে পারল না । বলল – মানে ? আপনি যদি এখানেই থাকেই , তাহলে আমার সাথে কে এলো ? 

সাধু হাসছেন – আমার মন্ত্র । এটাই মন্ত্র জাগরণ । 

-মানে !

-এই বিশ্বে এমন অনেক মানে রয়েছে , যা আজও আমাদের জানা হয়ে ওঠেনি । পিতার দয়া ছারাআ আমরা কণা মাত্র উদ্ধার করতে পারিনা ।

দানি ,সাধুর পাশে গিয়ে বসলো । আমি কেনও এখানে এসেছি , আর আমার উদ্দেশ্য কি আর আমার উপাসনার পদ্ধতি সম্পূর্ণ ভাবে গোপন রাখতে হবে ।

-কিন্ত আপনি কে ? আর আপনার পরিচয় কী ? 

সাধু হাসতে – হাসতে বললেন – সব বলছি , তার আগে একটা গল্প বলছি , মন দিয়ে শুনবি । 

পৃথিবীর শুরুতে যে যুদ্ধ ছিল , তা এখনো আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবে । এই যুগ অধর্মের ।অন্যায়ের ভেদাভেদের । এই যুগ কলি । 

-কলি !! 

- এই বিশ্ব ব্রহ্ম।ন্ড সৃষ্টি হয়েছে এক প্রবল ইচ্ছা শক্তিতেই । তন্ত্র সেই ইছা শক্তির ফসল ।

-তন্ত্র ?

-হ্যাঁ , তোকে জঙ্গলে যে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো ,সে আমি ছিলাম না । আমার সূক্ষ্ম দেহ ছিল । আমি মন্ত্র শক্তির দ্বারা আমার সেই রূপকে তোর কাছে পাঠিয়ে ছিলাম ।

-এটা সম্ভব !!

-অবশ্যই , তবে আমার এই ছায়া শুধুমাত্র তুই দেখতে পেয়েছিস , কেননা তুই আমার কথা ভাবছিলিস ।তুই যে ভাবছিলিস আমাকে । এটাই যোগবল । মনঃ সংযোগ । তন্ত্রক্রিয়া । মন্ত্র উচ্চারণ । আমি আগেও ছিলাম এখনো আছি আর ভবিষ্যতেও থাকবো । আমরা সবাই আগেও ছিলাম মৃত্যুর পরেও থাকবো । এই যে দেহ দেখছিস এটা শুধু মাত্র এই পার্থিব পৃথিবীর জন্য । পার্থিব বিশ্বের সাথে আরেকটি ঐচ্ছিক শক্তির বিশ্ব রয়েছে । সেই শক্তির সাধনাই আসলে তন্ত্র সাধনা । 

দানি হাতজোর করে বলল – তন্ত্র কী ?

-তন্ত্র এক বিশেষ সংস্কৃতি , যেখানে ইন্দ্রিয় অতিরিক্ত ক্ষমতা অর্জনের জন্য পথের সন্ধান করা হয় । এই যে আমরা পাশাপাশি বসে আছি ,এটা ইন্দ্রিয় যুক্ত , তুই যে আমাকে দেখলি ,মানে আমার ছায়ার সাথে পিছু পিছু এখানে এলি –তাও ইন্দ্রিশক্তি । কিন্তু আমার ছায়াটা অতিন্দ্রিয় ছিল । আমার ইচ্ছা শক্তির জন্যই সে তোর আকাঙ্খাকে নিজের রূপ দেখাতে সক্ষম হয়েছে । 

-এমনটা সম্ভব !!

-হাঃহাঃ ।এটা লৌকিক । আর এই তন্ত্রই বাস্তব । এখানে ভেদাভেদ নেই । এক চণ্ডাল , শূদ্র তন্ত্র সাধনা করে মহাজ্ঞানী হয়ে উঠতে পারে । তোদের সমাজে যে ধারা সেখানে বামুনের ছেলে বামুন হয় , তার ব্রক্ষ্ম জ্ঞান না থাকলেও ,সেই উঁচু শ্রেণী । ক্ষত্রিয়ের বংশ সমাজের ক্ষমতাবান ।আর এইসব উঁচু শ্রেণী দাবিয়ে রাখে নিচু কম ক্ষমতাবানদের । তারা নানা ফন্দিফিকির করে ,পাছে পিছিয়ে থাকা শ্রেণী এগিয়ে না আসে । তন্ত্র এই সমাজ ব্যবস্থা মানে না । তন্ত্র সংস্কৃতি মানুষের কর্মকেই স্বীকৃতি দেয় ,তার বংশ পরিচয়কে নয় । আমরা সবাই আদি শক্তির অংশ । তাই কেউই অযোগ্য নই । এই বিশ্বের প্রতিটি কণা সম্ভাবনাময় । 

দানি বলল – আপনি এখানে কেন এসেছেন ? এই গ্রামের অবস্থা আপনার অনেক আগেই জানা আছে । প্রভু আপনি অন্তর্যামী । গুপ্তবিদ্যার উপাসক । আমাকে আর ধাঁধায় রাখবেন না । আপনি কেন এই গ্রামে এসেছেন ?

-আমি কেন তোকেই এখানে আসতে বললাম , তা জানতে চাইবি না ? তুইই কেনও ,অন্য কেউ কেনও নয় ? এখানে যা ঘটে , তা ঘটবে বলেই ঘটে । এই যে আমাদের কথা হচ্ছে ,তা হবে ।তাই প্রকৃতি চেয়েছিল । প্রকৃতির ইচ্ছা ছাড়া তোদের ভগবানও নিঃশ্বাস ফেলতে পারে না । 

-আমাদের ভগবান ? প্রভু আমাদের ভগবান আর আপনাদের ভগবান আলাদা?

-পৃথিবীতে যা শুভ শক্তি তা যে কোন পথেই শুভ ।শুভ শক্তিকে আহ্বান করবার পদ্ধতি আলাদা হতে পারে । ঈশ্বর সাধনা হচ্ছে সেই ইচ্ছাশক্তির সাধনা , যা থেকে এই রহস্যময় ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি । তোরা নিয়ম , নিষ্ঠাকে , আচার ব্যবহার আর ভেদাভেদের খাঁচায় এমন ভাবে আটকে রেখেছিস যে , ঈশ্বর সাধনা থেকেও মনোবিকারে তোদের আগ্রহ বেশি । তোরা ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করতে শিখিস নি। তাই এই চারপাশের প্রাণ শক্তি , আদি শক্তি তোদের ঈশ্বর নয় । নিজেদের তৈরি করা সংস্কারই তোদের ভগবান । যেমন , পূজায় অহেতুক ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার করিস , কিন্তু ভগবানের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হলে যে এই সব কিছু ভুলতে হয় তাই জানিস না । 

-ভুলবো ? কেমন করে ভুলবো ?

-নিজেকে খোঁজ । মনে রাখবি মহর্ষি বাল্মীকি একসময় দস্যু ছিলেন । এই খোঁজই তো জীবন , আর জীবন মানেই খোঁজ । যে ব্যক্তির জীবনে খোঁজ নেই সে অতি সাধারণ । খুঁজতে হলে একটা শক্ত মন চাই , টগবগে আত্মবিশ্বাস চাই । প্রকৃতির সাথে লড়াই করবার মানসিকতা চাই । মনে রাখবি , কেউই এমনি এমনি প্রকৃতি থেকে কিছু পায় না । তোকে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হবে ।

-আমি কি দিতে পারি ?

- ভয় । আমাদের কাছে ভয়টাই আমাদের জমিয়ে রাখা সম্পদ । ওটা দিয়ে দিলে আর হারানোর কিছু থাকে না । তখন তুই অপরাজেয় হয়ে উঠবি । তুই চাসনা জীবনে ভয়হীন ভাবে বেঁচে থাকতে ?

-চাই । খুব চাই । মন থেকে চাই । কিন্তু চাইলেও তা পাচ্ছি কোথায় ?

-পাবি সব পাবি । পাওয়ার জন্য চাইতে হবে । 

দানি হাত জোর করে বলল – প্রকৃতি আসলে কে ?তন্ত্রের প্রকৃতি সাধনার রহস্যও বা কী ? 

-সব বলবো । এই যে চরাচর যেখানে ঝড় ওঠে , বৃষ্টি পরে , নদীর বুক ঝাঁপিয়ে জলে ভেসে যায় গ্রাম । এই সব কিছুই নির্ভর করে শক্তি । তন্ত্রপূজা আসলে শক্তি পূজা । আর এই শক্তির আধার হচ্ছে নারী , পুরুষ নয় । তন্ত্র সাধনার পথই হচ্ছে নারী আর পুরুষ শক্তির মিলন । এখানে একজন অন্য জনের ছাড়া ব্যর্থ । পুরুষ ও নারী হচ্ছে শিব ও শক্তি । এরাই আদি পিতা আর মাতা । আমরা সেই পিতা আর মাতারই সন্তান , সন্ততি । অনুসরণকারী , তাই তন্ত্রে নারী পুরুষের থেকেও ক্ষমতাশালী । নারী আর পুরুষের ইচ্ছা শক্তির সাধনাই আমাদের পথ । 

- এই পথ অনুসরণ করবো কেমন করে ?

-সদ গুরুর কৃপা ছাড়া এই মার্গে কেউই উন্নতি লাভ করতে পারে না । 

-আমি এই পথে প্রবেশের মার্গ কেমন ভাবে খুঁজবো ? আর তন্ত্রের লক্ষ্যই বা কী ? 

-তার আগে তোকে জানতে হবে শ্রেয়ঃ আর প্রেয়ঃ কী ? 

-মানে ?

-দেখ শ্রেয় আর প্রেয় একসাথেই মানুষের কাছে এসে উপস্থিত হয় । ধরে নে ওরা দুইবোন । সাধারণ মানুষ প্রেয়কেই কামনা করে । আর দু ‘একজন অতিমানব বরণ করে শ্রেয়কে । 

-এরা কে ?

-প্রেয়ঃ হচ্ছে এই জগতের সব প্রিয় বস্তু ,যা মানুষকে সব দিক থেকে সুখ প্রদান করবে বলে সে আশা করে । মানুষের কামনার উৎস । মানুষের ভোগের পথ । আর শ্রেয়ঃ হচ্ছে চরম শান্তি , সর্ব কামনা ও সর্ব বন্ধন থেকে মুক্তি । ভোগের যন্ত্রণা থেকে রেহাই । 

-তাহলে আমি কেন প্রেয় চাইবো ? তন্ত্রে শ্রেয়র ভূমিকাই থাকা দরকার । 

সাধু থেমে গেলো , হাসল । বললও – তন্ত্রের জন্মবীজতো এই প্রেয় কামনাতেই রয়েছে আর তার পরিণতি ঘটছে তন্ত্রসাধনায় । তুই ভোগ না করলে , মুক্তির জন্য কেমন ভাবে কাতর হবি । এই যে সুখ ভোগ করবার প্রবৃত্তি , তার হাত থেকে রেহাই পেতেই তুই খুঁজবি নিবৃত্তির পথ । সবটাই যে একে অপরের সাথে যুক্ত । তন্ত্র বিশ্বাস করে , মানুষ আগে প্রেয়কে স্বীকার করবে । তারপর প্রেয়ের পাশকে গ্রহণ করবে , তারপর বর্জন এবং শেষে অতিক্রম করে শ্রেয় লাভের দিকে এগিয়ে যাবে । তন্ত্র কখনই মানুষের কামনা –বাসনাকে অস্বীকার করেনি । তাই তোকেও এই সব কিছুর মধ্যে দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে । 

দানি হাতজোর করে বলল – হে প্রভু , আপনার কৃপা ।আমার মতন মূর্খ আর নির্বোধকে এমন জ্ঞান দান করলেন । নিজের আকাঙ্ক্ষাকে ভয় না পেয়ে ,তাকেই আমার মুক্তির পথ ধরে নেবো । আমি আপনার শিক্ষার যোগ্য কি না জানা নেই ।

সাধু সামনে রাখা মড়ার খুলির গায়ে লেগে থাকা লাল সিঁদুর নিয়ে দানির দুই ভ্রুর মাঝখানে কপালে লাল তিলক এঁকে দিলও । বলল 

-দানি , প্রস্তুত হও । তুমি যোগ্য , তাই আমার সূক্ষ্ম শরীরকে দেখতে পেয়েছো । সকাল বেলার আমি সেই সূক্ষ্ম শরীরই ছিলাম । তোমার সামনে বসে থাকা আমিই আমার আসল দেহে বসে আছি । এটা তন্ত্রের জগত , ইচ্ছাশক্তির দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশ । তুমি যোগ্য তাই এখনো টিকে আছো । দানি , এই অদৃশ্য তন্ত্রের দৃশ্যমান সাম্রাজ্যে তোমাকে স্বাগত ...... 

chakrabortypinaki50@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ