ভাষা হল জনসংযোগের একটি মাধ্যম । দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য একটি অঙ্গ। সবার কাছে তার মাতৃভাষা সবচেয়ে সুন্দর। ভাব প্রকাশের মাধ্যম হল ভাষা। নিজের মনের ভাব অন্যকে বোঝানোর জন্যে মানুষ ভাষা ব্যবহার করে। আকার ইঙ্গিতেও তা বোঝানো যায়। আর সেটাই আদিম রীতি। তবে ভাষা যতটা স্পষ্ট ও সূক্ষ্ম ভাবে তা প্রকাশ করতে পারে ততটা নয়।
ভাষা গতিশীল, তার পরিবর্তন আছে। নতুন শব্দ সে গ্রহণ করে। মুখে মুখে ব্যবহার হতে হতে তা উচ্চারণ পালটায়। কখনো কখনো তৈরি হয় নতুন শব্দবন্ধ। ভাষার একটা উৎস আছে। আছে তার ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে জানা যায় ভাষার ক্রমরূপান্তর। বিভিন্ন দেশের নানা জনসমষ্টির আছে নিজস্ব ভাষা। একই উৎস থেকে যেসব ভাষার সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে কিছু মিল থাকে। একটা ভাষাকে লিখিত ভাবে প্রকাশ করার জন্যে ব্যবহার হয় লিপি। সেটাও ভাষা বিশেষে বিভিন্ন ধরণের। ভাষার সংবিধান হল ব্যাকরণ। একটা ভাষার নিজস্ব নিয়মকানুন থাকে ব্যাকরণে।
প্রত্যেক মানুষের যেমন নিজস্বতা আছে তেমনই তাদের ভাষারও নিজস্বতা আছে। দুটি মানুষে যেমন পার্থক্য থাকে তেমনই তাদের ভাষাতেও, তা সে মুখের বা লেখার যাই হোক, একটা তফাৎ থাকে। এই পার্থক্য নির্ভর করে ব্যক্তির শিক্ষা-দীক্ষা, পরিবার, রুচি, পরিবেশ এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেষ্টনীর উপর। একজন মানুষ একাধিক ভাষা জানতে পারে । কিন্তু যে ভাষা সে জন্ম থেকে ব্যবহার করে, যে ভাষায় তার পূর্বপুরুষ কথা বলে গেছে, উত্তরসূরীরাও বলে আর লেখে, সেটি তার মাতৃভাষা। এই মাতৃভাষা সবার কাছে খুব সাচ্ছন্দ্যের। অন্য যে কোন ভাষা তার যত ভালই জানা থাক না কেন, সেখানে ঠিক এইরকম সাচ্ছন্দ্য আসে না। কবি মধুসূদন দত্ত যখন ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা ছেড়ে নিজের মাতৃভাষায় কাব্য রচনা শুরু করলেন তখন প্রচুর পড়াশোনা করে বাংলা ভাষা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান অর্জন করলেন। সেই পর্যায়ের একটি কবিতায় তিনি লিখলেন -------
“হে বঙ্গ ! ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;
তা’ সবে --- অবোধ আমি! --- অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।“
ভাষার আক্ষরিক অর্থ নিয়ে এতক্ষণ বললাম অনেক কথা। তবু বলব লিপিবদ্ধ হওয়া বা কথা বলা ছাড়াও ভাষার অন্য আরও ব্যাখ্যা আছে। একজন মানুষ যখন অত্যন্ত বেদনাহত হয় তখন তার চোখদুটি বলে দেয় সে বেদনার কথা। অথবা হঠাৎ পাওয়া অপ্রত্যাশিত কোন আনন্দের অভিব্যক্তিও প্রথম ফুটে ওঠে চোখে আর মুখে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। যাকে বলে শরীরী ভাষা বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। একজন মানুষের শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দেয় অনেককিছু। কখনো তার বর্তমান মানসিক ভাব, কখনো তার সামগ্রিক চরিত্র, শোক দুঃখ আনন্দ অহঙ্কার বিনয় সবকিছু।
কেউ কেউ বলেন নীরবতারও ভাষা আছে। সে ভাষা উপলব্ধি করতে হয়। তা চোখে দেখা যায় না , কানে শোনা যায় না। সঙ্গীতেরও একটা আদি অকৃত্রিম ভাষা আছে। একটা সুর বুঝিয়ে দিতে পারে অনেক কিছু। কথা যা পারে না অনেক সময় সঙ্গীত সেই শূন্যস্থান পূরণ ক’রে হয়ে ওঠে অনেক অর্থবহ। স্পর্শও ভাষার মত কোন কোন সময় হয়ে ওঠে ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মনের কোন এক দুর্বল মুহূর্তে হাত বা কাঁধের উপর অন্য আর একজনের হাতের স্পর্শ ফিরিয়ে দেয় আত্মপ্রত্যয়, তৈরি করে নির্ভরশীলতা। মনখারাপ থেকে নিয়ে যায় ভাললাগার দিকে। অবোধ শিশু আর তার মা পরস্পরের স্পর্শে বুঝে যায় মনের ভাব।
কেউ কেউ বলেন নীরবতারও ভাষা আছে। সে ভাষা উপলব্ধি করতে হয়। তা চোখে দেখা যায় না , কানে শোনা যায় না। সঙ্গীতেরও একটা আদি অকৃত্রিম ভাষা আছে। একটা সুর বুঝিয়ে দিতে পারে অনেক কিছু। কথা যা পারে না অনেক সময় সঙ্গীত সেই শূন্যস্থান পূরণ ক’রে হয়ে ওঠে অনেক অর্থবহ। স্পর্শও ভাষার মত কোন কোন সময় হয়ে ওঠে ভাব প্রকাশের মাধ্যম। মনের কোন এক দুর্বল মুহূর্তে হাত বা কাঁধের উপর অন্য আর একজনের হাতের স্পর্শ ফিরিয়ে দেয় আত্মপ্রত্যয়, তৈরি করে নির্ভরশীলতা। মনখারাপ থেকে নিয়ে যায় ভাললাগার দিকে। অবোধ শিশু আর তার মা পরস্পরের স্পর্শে বুঝে যায় মনের ভাব।
মানুষের শিক্ষা সংস্কৃতি জীবনযাত্রা যেমন পরিবর্তনশীল ভাষাও ঠিক তেমনই। নদীর স্রোতের মত বহমানতাই একটা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সে পরিবর্তিত হতে থাকে নিজের মত করে। তার উপরে প্রভাব ফেলে পারিপার্শ্বিক সবকিছু। কোন আরোপিত নিয়মে ভাষাকে পাল্টানো যায় না। মুখের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাতে থাকে লিখিত ভাষা। সে আগে আসে মুখে , তারপর আসে কলমের মুখে। তাই তার পরিবর্তনের গতিও সেরকম। স্বাগত জানাই সমস্ত ভাষার প্রবহমানতাকে। নাহলে সে একদিন পরিণত হবে মৃত শবে।
“যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
অজস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে”
bidisharay01@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন