হাবা আর বাঁচতে চায়না। সে শুনেছে গঞ্জের পুরোনো পুকুরের কাহিনী। বিশাল দীঘির মতো যার আয়তন, গম্ভীর গভীর জল, কোন কালে কোন রাজার হাতে তৈরি বলে কিনা কে জানে , পুকুর নিজেকে কেমন একটেরে করে রেখেছে বড়ো মানুষদের মতো, তা সেই পুকুর নাকি বছরে একটা করে মানুষ খায়। লোকে ডাকে রাক্ষুসী পুকুর। হাবা মাথা খুঁড়েছে পুকুরের কাছে--’ এই বচ্ছর আমাকে নাও গো পুকুর দেবতা। হাবা হয়ে আর বাঁচতে চাইনা আমি।’
মায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাবা--’ আমি কি হাবা? বোকা?’
সাত বাড়ি কাজ খেটে এসে , সন্ধ্যেবেলা চোখে ঘুম নিয়ে গরম ভাত রান্না করতে করতে ঢুলে পড়া মা চমকে তাকিয়ে বলে--’ কে বলেছে তুই হাঁদা? তুই আমার সোনার চাঁদ ছেলে!’
‘ তবে ওমন নাম কেন?
--’ বাপ রে, গরিবের ঘরে কে আর নাম রাখে? তুই জন্মালি, বাপটা তোর ঘর ছাড়লো। এদিক ওদিক তোকে রেখে কাজে লাগলাম। তা তুই লক্ষী ছেলে। কোল বাছুনি ছিলো না। সবার কোলে উঠে এক গাল হাসি। এট্টু খেতে দিলেই খুশি। তাই ই বোধহয় লোকে হাবা বলে ডাকতে থাকে রে বাপ।’
নামের ব্যাখ্যায় হাবা অকূল পাথারে। কান্না কাটি নেই, অল্পেই খুশি বলে তার নাম হলো হাবা? অদ্ভুত তো! আর বাপই বা কেমন ধারা? বউ ছেলে ফেলে বিবাগী হলি? শুনেছে তার বাপ নাকি ঘর মোটে ভালোবাসতো না। শ্মশানে মশানে পড়ে থাকত। ধুর। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভাবে হাবা, ‘ কি জানি ! মনে হয়, বাপ থাকলে তাকে কেউ হাবা ডাকতে সাহস করতো না।
এর মধ্যে আর এক গেরো। যে চায়ের দোকানে সে কাজ করে তার দামি খদ্দের নতুন দাদা তার নামের সঙ্গে জুড়ে দিলেন কুমার।
‘ হাবা কুমার! এক প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক। হাবা কুমার, আদা দিয়ে বড়ো এক কাপ চা। ‘ নতুন দাদা দোকানে ঢোকা মানে উৎসব। অকারণে খ্যাচ খ্যাচ করা মালিক সাধন দাদুও মাথায় হাত বুলিয়ে বলে --’ যা রে। বড়ো মানুষ। খাতির কর। নাহলে গঞ্জে তো সব বাকি খাবার ধান্দা।’
তা বটে। শনি রবি দুই দিন হাট বসে। সেদিন , ঘুঘনি আলুরদম চা বিস্কুট উড়ে যাবে পলকে। কিন্তু অন্য বার গুলোতে মাছি তাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। বেকার কতগুলো লোক আসবে, বেঞ্চিতে বসে খবরের কাগজ , বিড়ি ফোঁকা শেষ করে যেন কত তাড়া--’ ও কাকা। ভালো করে এক কাপ চা দাও দিকিনি। বসে বসে দেরি হয়ে গেল।’
মালিক খিঁচিয়ে ওঠে--’ গত মাসের ষাট টাকা দাও আগে। তারপর চা। দুদিন পরে কাগজ আর বেঞ্চির ভাড়া দিতে হবে এই বলে দিলুম। হাবা কুমার কে দেখতে হয়, তার খরচ ঘাড়ে এসে চাপলো । আবার বলে বিনি পয়সায় চা?’
হাবার খুব দুঃখ হলো। বাপ নেই। মা লোকের বাড়ি বাসন মাজে। হাতে পায়ে ধরে চায়ের দোকানে কাজে লাগালো মা। এখন তার চোদ্দ বছর বয়স। এই সেদিন পর্যন্ত ইস্কুল যেত। সেখানেও সেই হাবা বলে গঞ্জনা শুনতে শুনতে মা বলে --’ খেটে খাওয়া পয়সা রে হাবা। ছেড়ে দে ইস্কুল। আঁক কষে আর কি হবে? তার চেয়ে গঞ্জের বাজারে কোনো দোকানে কাজ জুটিয়ে দি চল!’
সে কাজ নাহয় পাওয়া গেল। চায়ের দোকানের মালিক চেনা মানুষ। অল্প পয়সা দেয়। কিন্তু বিকেল সাতটা থেকে ছুটি। তারপর নিতাই দাদার দোকানে সাইকেল সরানোর কাজ শেখা। এসবের জন্য দুঃখ নেই। গরিব হলেও মা ছেলে খেটে ভালোই আছে। মুশকিল হলো ওই হাবা কুমার নামটা তার কিছুতেই সহ্য হয়না। এই যে ইস্কুলে পন্ডিত তাকে হাবা বলতেন,কিন্তু ওদিকে যে, নকুল মুদির ছেলে সুবল কেবল ঘুম মারে--তার বেলা সব চুপ। একবার পন্ডিত জিজ্ঞেস করলেন --, ‘এই বলতো ভারতের প্রধান নদীর নাম কি?’
হাবা লাফিয়ে উঠলো। সে জানে -গঙ্গা। কিন্তু জিজ্ঞেস করা হয়েছে সুবলকে, সে ঘুমোতে ঘুমোতে বলে কিনা -- দেবদাস। সেই নিয়ে ক্লাস শুদ্ধ হেসে ফেটে পড়লেও পন্ডিত কিন্তু সুবলকে হাবা ডাকেনি! ফুলি রেগে গিয়ে বলেছে--’ আরে বুঝলি না , নকুল মুদি ধারে বাকিতে দেয়। তবে তো হাতির মতো মোটাকে ওতো আলহাদ দেয় পন্ডিত।’
একমাত্র ফুলি বিশ্বাস করে তার নামটা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। সে মোটেও হাবা নয়। এই বিশ্বাস তার ভারি ভালো লাগে। ফুলি ছাড়া, রাক্ষুসী পুকুর, নদী, গাছপালা তার বন্ধু। সে তেমন বলিয়ে কইয়ে নয়। চুপ করে আকাশের রং বদল, পুকুরের জলের হিম মেখে পদ্ম ফুটে ওঠা ,বিকেলে দল বেঁধে উড়ে যাওয়া পাখির সারি--এই সবের মধ্যে হাবা এক অন্য দুনিয়া খুঁজে পায়। যেখানে কেউ তার নাম নিয়ে কিছু বলে না। সেখানে মাকেও দুবেলা বাসন মাজতে যেতে হয় না। তার এমন চুপ করে ভাবতে থাকার জন্যই কি হাবা নাম? কে জানে?
শীতকালে , নদীর জল কমে তার বুকে জেগে ওঠে চর। কত পাখি এসে বসে। দুপুরের মিঠে নির্জন দুপুরে সে আর ফুলি বসে গপ্প করে। বড় বড় চোখ করে তার কথা শোনে ফুলি। রাক্ষুসী পুকুর থেকে তুলে আনা পদ্ম দেয় ফুলিকে। একদিন সে প্রমাণ করবে সে হাবা কুমার নয়। ফুলির বিশ্বাস সে রাখবেই।
‘এই যে হাবা কুমার? বলি, চায়ের জল ফুটে শুকিয়ে গেলো? কয়লার দাম কে দেবে? তোর বাপ? কি ভাবিস সারাদিন বসে? এই জন্য লোক তোকে হাবা বলে।’
--’ আরে দাদা ছাড়ো। হাবা কুমার বড়ো ভালো ছেলে। ‘ নতুন দাদার পরনে আজ লাল পাঞ্জাবী। গলায় সোনার সেন, হাতের আংটি গালের চকচকে রঙে আলো ঠিকরে পড়ছে। রাজার মতো বসে অর্ডার করলেন--’ চট পট মামলেট বানাও দেখি কাকা। আজ বড়ো বায়না। কলকাতায় যাত্রা উৎসব। এবারে আমার দলকে ডাকলো।’
--’ নতুন বাবু। আপনার গতবারের পালা এখনো চোখে জল আনে গ।’
-- ‘ শ্বশুর কেন পাপী ? সতীর দেহত্যাগ?’ কোনটা বলো দেখি?’ মনের সুখে সিগারেট ধরিয়ে বলে নতুন দাদা।
‘ দুটোই নতুন বাবু দুটো ই। আপনার যা অভিনয়, যেমন শ্বশুরের তেমন শিবের।’ পেঁয়াজ কাটতে কাটতে বলে মালিক।
‘ তা যদি বলো সাধন। বড়ো চাকরি ছাড়লাম যাত্রার জন্য। হতে পারে গাঁয়ের যাত্রা দল। কিন্তু অভিনয় আমরা খেটে করি। ধরো গিয়ে আমার ফিমেল চরিত্র বিমলা দেবী-- বলো?’ উৎসুক ভাবে প্রশ্ন করে নতুন দা।
শীতের দুপুরে, চায়ের দোকানের সামনে ফাঁকা কাঁচা রাস্তায় একটা দুটো সাইকেল যায়। অল্প দু একটা দোকান খোলা। হাটবার নয়। ভীড় নেই। অল্প দূরে বাস এসে থামে। ধুলো ওড়ে। নতুন দাদা মামলেট চা খেতে খেতে যাত্রার গল্প করে, হাবা তাকিয়ে থাকে দূরে। নিমেষে গঞ্জের বাজার রূপ নেয় যাত্রার আসরের। সে যেন কৃষ্ণ। ফুলি রাধা। পালার নাম কি হবে?--রাধার মানভঞ্জন? পদ্ম এনে কৃষ্ণ রাধাকে দেয়। গান করে করে মান ভাঙ্গায় রাধার। লোক জোরে হাততালি দেয়। ফুলিদেবীর অভিনয় আর তার অভিনয়ের জয়ধ্বনি ওঠে। কিন্তু তার নাম? কি নামে উঠবে জয়জয়কার?
‘উফ। দেখেছেন নতুন বাবু? দেখুন আবার জেগে স্বপ্ন দেখছে। এদিকে আঁচ গেল আমার। বিকেলের দুধ জ্বাল দিয়ে রাখ রে হারামজাদা।’
নতুন বাবু সস্নেহে তাকায় কিশোরটির দিকে। সাদা আধময়লা গেঞ্জি,ঢলঢলে হাফ প্যান্টের নীচে রোগা শ্যামলা পায়ে এক কালো সুতো বাঁধা। কোনো মানতের সুতো হবে! রোগা গড়নের লম্বা ছেলে, মুখখানি ভারী মিষ্টি, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল আর সরল হাসিতে ছেলেটি বড়ো মায়াময়। কথা কম বলে। কি যেন ভাবে সর্বক্ষণ। সাধন চা ওয়ালার কি দোষ? এমন ভাবের রাজ্যে থাকা ছেলে নিয়ে অসুবিধে তো হবেই। ভুরু কুঁচকে লাল পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে কি যেন ভাবে নতুন বাবু। তারপর শীতের মিঠে রোদ্দুরে পড়ে থাকা সুড়কি ওঠা রাস্তার দিয়ে চেয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলে --’ যাত্রা করবি না কি রে হাবা কুমার? ‘
বিস্মিত বড় বড় সরল চোখ দুটি তুলে ভগবান না নতুন দাদা কাকে দেখে বুঝতে পারেনা হাবা। ওমন সরল দৃষ্টির সামনে বুঝি ভগবান ও ভয় পায়। দ্বিধা মেশানো গলায় নতুন বাবু বলে--’ কলকাতা থেকে ঘুরে আসি, দেখছি তারপর।’
হুররে! হুররে! মন করছে পাখির মতো উড়ে খবর টা দেয় তাদের যারা বিশ্বাস করে সে হাবা নয়। একজন তার মা, একজন ফুলি। কিন্তু কাকে আগে খবর দেবে? মা তো কেঁদে ভাসাবে। যাত্রা মানে গাঁয়ে গঞ্জে ঘোরা, ছেলে বাড়ি থাকবে না। ধুর । মা এখন থাক। ফুলি কাঁদবে না। ফুলিকেই আগে বলবে সে। অনেক আলো, অনেক লোক, মুকুট পরে তরবারী হাতে হাবা? না না উজ্জ্বল কুমার-- ফুলিকে জিজ্ঞেস করবে উজ্জলকুমার নাম কেমন? কেমন অবাক হবে ফুলি। উজ্জ্বল কুমার? ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। এমন সময় বিকট ছন্দপতন করে চেঁচিয়ে উঠলো মালিক--’ গেল গেল সব দুধ গেল আমার। বলি ও হাবা কুমার, তুমি আজই বিদায় হও। রোজ রোজ এত লোকসান আমার পোষাবে না।’
কতদিন লাগে কলকাতা থেকে আসতে? ঘুর ঘুর করে হাবা চায়ের দোকানের সামনে। নতুন এক ছোকরা কাজে লেগেছে। চটপটে। শিষ দিয়ে হিন্দি গান গায়। আবার বিস্কুট চুরি করেও খায়। লোকসান তো এই ছেলেও করছে মালিকের। মালিককে হাবা বানিয়ে চা দুধ বিস্কুট খায়। হাসি পায় তার। জগতে সবাই নিজেকে চালাক ভাবে। কে যে কখন ঠকে কে জানে? কাজ চলে যাওয়াতে , মা ফুলি কেউই রাগ করেনি। মা বলে--’ সাধন দা চামার। খাটিয়ে মুখে রক্ত তুলতো। তুই সাইকেল সরানোর কাজ ভালো করে শেখ বাপ। ‘ তারপর নিঃশ্বাস ফেলে বলে --
‘ তোর বাপও তোর ধারা। জেগে জেগে কি ভাবতো কে জানে। তারপর তো কোথায় চলে গেল!’
মা এখনো জানে না যাত্রার কথা। ফুলি জানে। দুজনে নদীর জলে পা ডুবিয়ে গল্প করে। এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে গম্ভীর বক। মাথার উপরে ওড়ে দুপুরের চিল। দেখতে দেখতে বসন্ত এসে যায়। নদীর ধারে কৃষ্ণচূঁড়া ভরে ওঠে ফুলে ফুলে। নতুন দাদা আসেনা। লুকিয়ে লুকিয়ে চায়ের দোকানের দিকে চেয়ে চেয়ে তার প্রাণ অস্থির করে। উপায় তো নেই! তার স্বপ্ন দরিয়ার মাঝির খবর জানার যে ওই একটাই জায়গা। চায়ের দোকান।
একদিন মরীয়া হাবা মালিকের কাছে যায়।
মালিক বলে--’ ওমা। হাবা কুমার। রোজ ঘুর ঘুর করিস , আসিস না কেন রে? এই নে একটা বিস্কুট খা। কাজ করবি নাকি আবার। ওই ছোকরা দেখ ,আজো আসেনি। চুরি করে ফাঁক করে দিলো সব। তুই কাজ করবি হাবা?’
জবাব না দিয়ে কাতর গলায় হাবা জিজ্ঞেস করে--
‘ নতুন দাদা আসেনা দাদু?’
--’ আসেনি অনেক দিন। কলকাতা বড়ো শহর। যাত্রা পার্টির রমরমা রে হাবা। হয়তো লুফে নিয়েছে নতুন বাবুকে। অভিনয় তো খারাপ করে না। দেখতেও ভালো। ‘ শ্বাসে দুঃখ ভেসে যায় মালিকের। বিক্রিবাটা নেই তেমন, তার মধ্যে নতুন বাবুর মতো দামি খদ্দের আসেনা। খারাপ তো লাগবেই।
---’ তার যে এক যাত্রা দল ছিল? তবে?’ হাবা করুণ মুখে বলে। যাত্রা দল ভেঙে দিয়েছেন নতুন দাদা? বিশ্বাস হয় না।
---’ সে তো ছিলই। আমাদের গঞ্জে একবার দু বার হলো, তুই দেখিস নি বুঝি? ‘
হাবা দেখেছে। দেখেছে বই কি। তাইতো ভাবে অতগুলো লোক, আলো, বাজনদার সব মিলিয়ে গেল হাওয়ার মতো? তার ছোট বুকটা চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো খালি হয়ে গেল যেন। এতদিন ধরে বয়ে বেড়ানো এক স্বপ্ন তার মধ্যে এক বাসা তৈরি করেছিল। তার মধ্যেই হাঁটা চলা খাওয়া সব চলছিল হাবার। সে আর ফুলি যাত্রার আসরে। মানভঞ্জন পালা। লোকের মুগ্ধ চোখ, হাততালি, জোরে হারমোনিয়াম বাদন, নতুন দাদার পিঠ চাপড়ে বলা--” তুই আমার মুখ রাখলি রে উজ্জ্বল কুমার।’
এগুলো তো এই নদী, গঞ্জের দোকান , এই চারিদিকের মানুষজনের মতোই সত্য ছিল তার কাছে। এখন সে করে কি? ভূতগ্রস্তের মতো উঠে দাঁড়ায় হাবাকুমার। চলতে থাকে। পিছন থেকে মালিক চেঁচায়, সারা সংসার ডাকতে থাকে ,হাবা দাঁড়ায় না। তার মনে হয়, স্বপ্ন কখনো মিথ্যে হয়না। স্বপ্ন মিথ্যে হলে মানুষ বাঁচবে কি নিয়ে ? এক জায়গায় ধাক্কা খেলে অন্য জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। হাবা কুমার থেকে উজ্জ্বল কুমার হতে গেলে তাকে এগিয়ে যেতেই হবে।
এক বুক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে থাকে হাবা কুমার না কি,,,,,,? অন্য কেউ?
joyeelove@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন