সুশান্ত কুমার রায়

প্রসঙ্গঃ ভাওয়াইয়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বাদ্য অনুষঙ্গ
উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী ও অত্যন্ত জনপ্রিয় লোকসংগীত ভাওয়াইয়া। সময়ের আবহে ও কালের আবর্তনে দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় তথ্যপ্রযুক্তির ডামাডোলে সমাজ সভ্যতা পরিবর্তনের তালগোলে অজো পাড়াগাঁ তথা গাঁও গেরামের খেটে খাওয়া মানুষের গলা থেকে গীত হয়ে ভাওয়াইয়া উঠে এসেছে আজ জৌলুসে ভরা শহুরে জীবনের মসৃণ চাকচিক্যময় অভিজাত মহলের কন্ঠে। তাই সাম্প্রতিক কালে বড় বড় শহরের অডিটোরিয়ামে অন্যান্য সংগীতের পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংগীতের অনুকরণে ভাওয়াইয়া প্রাচীন ও ঐতিহ্যিক লোকবাদ্য যন্ত্রের পরিবর্তে নব্য-সভ্য অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে ভাব, ভাষা বিষয়বস্তু ও সুর-তাল-লয়কে বিকৃত করে পরিবেশন করা হচ্ছে। এতে ভাওয়াইয়ার নান্দনিকতা তথা শৈল্পিক সৌন্দর্য ও সৌকর্য ব্যাহত হলেও একশ্রেণির শিল্পী ও শ্রোতা এটাকে কিছু মনে না করে বরং অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। বর্তমানে বিষয়টি অনেকটা মগের  মুল্লুকের মতো হয়ে দাড়িয়েছে। যাঁর যা খুশি তা ইচ্ছে মতো ষোলকলা পূর্ণ করছে। একদা যে ভাওয়াইয়া গাঁও গেরামের প্রত্যন্ত পল্লীতে গীত হতো সময়ের বিবর্তনে সমাজ সভ্যতার প্রেক্ষাপটে আজ তা লোক লোকালয়কে ডিঙিয়ে ধরলা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের ভাটি অববাহিকার স্রোতধারায় স্নাত হয়ে শুধু বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি ও আসামের গোয়ালপাড়ায় নয় সুদূর অস্ট্রেলিয়া-নিউইয়র্ক-লন্ডনে বাদিত ও গীত হচ্ছে অমর ঐতিহ্যিক উদাস করা সুরের মূর্ছণায়। ভাওয়াইয়া গানের আদি উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার, আসামের গোয়ালপাড়া এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর দিনাজপুর-এ। যে ভৌগলিক ও নৈসর্গিক পটভূমিকায় ভাওয়াইয়ার উৎপত্তি ও বিচরণ এবং যে আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, ভাব, ভাবনা, ভাষা ও বিষয় বস্তুর বেড়াজালে ভাওয়াইয়ার স্থিতি ও লালন দীর্ঘ সময়ের পথ পরিক্রমায় সেই প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী ও আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট আজ দুস্তর ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়ে গেছে বিপুল পরিমাণে। অঁজো পাড়াগাঁয়ের খেটে খাওয়া মানুষ ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত নয় এমন লোকশিল্পীরা ছাড়াও আজ ভাওয়াইয়া গান রচনা পরিবেশন ও লালনে সম্পৃক্ত হয়েছেন শহরের ডিগ্রীধারী শিক্ষিতের পাশাপাশি সুশিক্ষায় শিক্ষিত অনেক গীতিকার, শিল্পী, সংগঠক, সংগ্রাহক ও পৃষ্ঠপোষক। যার ফলে অনেকটা অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির আচড় বা কষাঘাত লেগেছে ভাওয়াইয়ার ঐতিহ্যিক বাদ্য অনুষঙ্গ ও প্রকরণগত সকল ক্ষেত্রে। ভাব, ভাষা, ভাবনা ও বিষয় বস্তুতে যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি সুর-তাল-লয় প্রকাশভঙ্গি গায়নরীতি ও পরিবেশনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। বাস্তব সত্য যে, অরিজিনালিটি বজায় না থাকার কারণে অনেকেই এটাকে ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়ার অবমূলায়ন বা অবক্ষয় হিসেবে দেখছেন। ভাওয়াইয়া শিল্পী ও ভাওয়াইয়া সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আমি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের যে কয়েকজন ভাওয়াইয়া শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগ্রাহক, সংগঠক, গবেষক ও ভাওয়াইয়া প্রশিক্ষকের সান্নিধ্য ও মুখোমুখি হয়েছি তাঁরা প্রত্যেকেই ভাওয়াইয়ার ঐতিহ্যগত স্বার্থে ভাওয়াইয়ার অরিজিনালিটি বজায় রাখার পক্ষে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। 

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বেতার রংপুরের উপ-মূখ্য সংগীত প্রযোজক ( প্রাক্তন ) ভাওয়াইয়া গবেষক, গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও সংগঠক মো. সিরাজ উদ্দিন বলেন- দোতরা যেমন ভাওয়াইয়ার প্রধান বাদ্য অনুষঙ্গ তেমনি মৃদঙ্গ ( খোল ) শ্যামা সংগীত ও কীর্ত্তনের জন্য অপরিহার্য। তিনি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত বাদ্যযন্ত্রে একই সাথে মৃদঙ্গ, করতাল, দোতরা, ঢোল, বাঁশি, হারমোনিয়াম ও তবলার সমাহারকে মেনে নিতে নারাজ। অপরদিকে কুড়িগ্রামের প্রয়াত বিশিষ্ট ভাওয়াইয়া শিল্পী, গীতিকার, সুরকার, সংগঠক, ভাওয়াইয়া গবেষক ও প্রশিক্ষক মো. নূরুল ইসলাম জাহিদ, মো. সিরাজ উদ্দিনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন- অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তিগত বাদ্যযন্ত্রে একই সাথে অনেক বাদ্যযন্ত্রের সমাহার ঘটে বটে কিন্তু তাতে অনেকটা শূন্যতা বা চ্যুতি অনুভূত হয় প্রত্যেক বাদ্যযন্ত্রের জন্য আলাদা আলাদা বাদ্যযন্ত্রী অনুপস্থিত থাকার কারণে। কারণ গানের কথা ও সুর বৈচিত্র্যতার স্বার্থে গানের কোন অংশে কোন কোন যন্ত্রের বিলুপ্তি বা ছেদ কিংবা সংযুক্তি ঘটানোর প্রয়োজন থাকতে পারে। এক্ষেত্রে একজন যন্ত্রীর পক্ষে পুরো বিষয়গুলোকে মাথায় নিয়ে বাদনে ষোল আনা মাত্রা আনা অসম্ভব হয়ে পড়ে। একই যন্ত্রে শত বস্তুর সমাহার সুর যোজনাগত মধুময় মূর্ছণা সৃষ্টি করতে না পারলেও অনেক যন্ত্রশিল্পীর ব্যয় সংকোচন ছাড়া কিছুই নয়। দর্শক শ্রোতাদের মন মাতানো অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বাদ্যযন্ত্রীর যন্ত্র পরিবেশনা পুরো অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করে তোলে। আমাদের উত্তরাঞ্চলের ধরলা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র বিধৌত রংপুর ভাওয়াইয়ার এক কর্ষিত উর্বরভূমি বলা যায়। ভাওয়াইয়া প্রসঙ্গ আসলে সবার আগে আসে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের নাম। সেই সাথে আব্বাস উদ্দিন পরবর্তী মহেশ চন্দ্র রায়, হরলাল রায়, ভাওয়াইয়া যুবরাজ মো. কছিম উদ্দিন, কে. এস. এম. আশরাফুজ্জামান সাজু, মকবুল আলী ফেরদৌসী রহমান, মো. সিরাজ উদ্দিন, মো. নুরুল ইসলাম জাহিদ, শমসের আলী প্রধান, রথীন্দ্রনাথ রায়, সুরাইয়া বেলী, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, নীলকমল মিশ্র,  সুভাষ চন্দ্র রায়,ভূপতি ভূষণ বর্মা, অনন্ত কুমার দেব সহ এ অঞ্চলের আরো অনেক প্রথিতযশা প্রতিষ্ঠিত গুণী এবং ওপার বাংলার কেশব বর্মন, সুভাষ দাস, হরিশ্চন্দ্র পাল, সুরেন বসুনিয়া, কেদার চক্রবর্তী, গোপাল চন্দ্র দে, যতীন্দ্রনাথ সিংহ সরককার, ধীরেন্দ্রনাথ বসু, সুখবিলাস বর্মা, সুনীল দাস, সুধাংশুশেখর মুস্তাফী, দেশবন্ধু চক্রবর্তী, মাধবচন্দ্র পাল, উপেন্দ্রনাথ সরকার, আব্বাস উদ্দিন  আহমদ, ছত্রমোহন সরকার, ঝাপুরা বর্মন, নায়েব আলী টেপু, অরুণ কুমার ভট্টাচার্য, ত্রিফুল্ল কুমার রায়, প্রসেনজিৎ বর্মন, রবীন্দ্রনাথ গোস্বামী, প্যারীমোহন দাস, গঙ্গাধর দাস, ধনেশ্বর রায়, বিরাজ সেন মাঝু, নীলিমা বন্দোপাধ্যায়, শেফালী সরকার বসু, অসমের প্রতিমা পান্ডে বড়ুয়া ছাড়াও আরও অনেক ভাওয়াইয়া শিল্পী, সংগঠক, গীতিকার ও সুরকার।

ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়া শুধু দেশের উত্তরাঞ্চলের সংস্কৃতিগত সম্পদই নয় ভাওয়াইয়া আমাদের জাতীয় সম্পদ। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রচার, প্রসার ও গবেষণায় ব্যক্তিগত গোষ্ঠীগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি বেসরকারিভাবে জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহন একান্ত কাম্য। এক্ষেত্রে ভাওয়াইয়ার উর্বরভূমি বিভাগীয় শহর রংপুরে ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ভবন বা আব্বাস উদ্দিন আহমদ্ একাডেমি নির্মাণ করা যেতে পারে এ বিষয়ে সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শুভদৃষ্টি একান্ত কাম্য। 

দুই বাংলার ভাওয়াইয়া গীতিকার, সুরকার, সংগঠক ও শিল্পীদের জীবনী সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন যৌথভাবে ভারত-বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করা যেতে পারে। ভাওয়াইয়ার আদি কথা ও সুর বিকৃত রোধে স্বরলিপি সহযোগে ভাওয়াইয়া গানের সিডি প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কন্ঠে ধারণ করে প্রকাশ ও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ গ্রহন করা যেতে পারে । যে সমস্ত বাদ্য অনুষঙ্গ ভাওয়াইয়াকে জনপ্রিয় করে তুলেছে সেগুলোর শরীরী অস্তিত্ব সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে । ভাওয়াইয়ার আদিতে আদিস্বরে স্বরলিপি ও গ্রামোফোন রেকর্ডে যে স্বরলিপি ব্যবহৃত হয়েছে তা উদ্ধার ও সংগ্রহে উদ্যোগ গ্রহন করতে হবে। ভাওয়াইয়া সন্ধ্যা, রজনী, ভাওয়াইয়া বিষয়ক অনুষ্ঠান ও সেমিনারের আয়োজন এবং সেই সাথে নতুন প্রজন্মকে ভাওয়াইয়া প্রশিক্ষণ চর্চায় কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করতে পারলে তবেই আদি, করুণ, হাস্য, বীর ও শান্ত রসে সিক্ত পঞ্চসুরের পঞ্চরসে ভরা ভাওয়াইয়া অখন্ড সুরের মূর্ছণায় অগণিত মানুষের অন্তরে দোলা দেবে অপার মহিমায়।


sk_roy11@yahoo.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .