নিলয় কুমার সরকার

" মাঘমন্ডল ব্রত ও তার অনুষঙ্গ "
[ বারেন্দ্র বাঙলার অধুনা বিলুপ্তপ্রায় ব্রতকথা ও লোকগান ]
আধুনিক হতে হতে আমরা আজ অনেককিছুই হারিয়েছি । সমকালীন হতে হতে আমরা ফেলে আসা দিনের নিজস্ব সমকালকেও হারিয়েছি । এই দ্রুত ধাবমান যুগ সন্ধিক্ষণে , মিডিয়া আশ্রিত প্রবাহ মানতায় আজ শুধু স্মৃতির জারণ । কোন প্রবাহের হাত ধরে আমরা এগিয়ে এলাম এতটা পথ । সামাজিক , অর্থনৈতিক , ও রাজনৈতিক কারণের হাত ধরে বিবিধ লোকধারা শুধু এক স্থান ও কাল বাচক হয়ে থাকেনি । কালক্রমে অভিবাসনের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র বাংলাদেশ হয়ে শিলচর , আসাম ত্রিপুরার বিবিধ জায়গায় । এমনই এক লোকধারা নিয়ে আজ আমাদের আলোচনা , বিষয় "মাঘ-মন্ডল" বাংলার ব্রতকথা ।

পূর্ব বাংলার বারেন্দ্রভূমিতেই কুমারী কন্যাদের ব্রত ছিল এই মাঘমন্ডল। এ ব্রতের আয়োজন কিন্তু সামান্য নয় বেশ বিস্তৃতই বলা যেতে পারে। মাসাধিককাল ধরে চলেও ব্রতটি । বিবিধ বিচিত্র আলপনা , কথা, গান, সবই এর মধ্যে আছে । চালের শুকনো গুড়ি দিয়ে সাদা , সুরকি দিয়ে লাল, গুঁড়ো বেলপাতা দিয়ে সবুজ, হলুদের গুঁড়ো, তুষ পোড়ান ভূষা দিয়ে কালো, নীলের গুঁড়ো দিয়ে রঙের নীল বা নীলাভ উপাদান, কাঠের গুঁড়িতে খয়েরগোলা মাখিয়ে সেটা শুকিয়ে আলপনার জন্যে তৈরী হয় নানান উপচার । এমন ব্যয়বহুল উপচার-সামগ্রীর সমারহে প্রতিদিন ভোর সকালে আঁকা হয় শুকনো গুঁড়োর লতানো আলপনা । পুজোর পরে দুরন্তগতিতে তা পরিষ্কার করে একটা হাঁড়িতে তুলে রাখা হয় । এর পরের কাজ হলো প্রতিদিনের পুঞ্জিত গুড়ি ও বিবিধ উপাদান যা ইতিমধ্যে ঐ হাঁড়ির মধ্যে জমিয়ে রাখা হয়েছে তা প্রতি রবিবার কলার খোলের সুসজ্জিত ভেলায় চাপিয়ে নিরঞ্জন । মাঘ মাসের প্রথম দিনটি থেকে এই ব্রত-পুজো চলে মাঘ মাসের শেষ দিনটি পর্যন্ত । স্মর্তব্য যে ব্রতের নির্ধারিত সময়কাল কিন্তু পর পর পাঁচ বছর বা তিন বছর । ব্রতসমাপ্তির দিন বা উৎযাপনের দিন ব্রাহ্মণ আসেন মূল পুজোর পৌরহিত্য করতে । আলপনা চিত্রে চন্দ্র ও সূর্যই প্রধান । বালিকা ও কিশোরী কন্যার ব্রতটিতে সামগ্রিক চিত্র সবটুকুই পরিবারিক সমৃদ্ধির । এই আলপনায় আঁকা হয় --হাতী, ঘোড়া, পাল্কি, নৌকা, দোলা, রথ, পুকুর, ধান, পান, সুপারিগাছ, এরপর গহনা, শাড়ির আঁচলের অলংকরণ ইত্যাদি । বস্তুতঃ এই সময় গ্রাম বাংলায় এক একজন মহিলা আলপনা এঁকে নিজের শিল্পচাতুরীর পরিচয় দেন । ব্রাহ্মমুহূর্তে গঙ্গা বন্দনার গান । তারপর মুঠোয় দূর্বাখন্ডর মাধ্যমে জল সিঞ্চন করা হয় সূর্যের উদ্দেশ্যে । বাংলা লোকগানে ভরপুর , তারই স্ফুরণ ঘটে লোকাচারে । 

ব্রতের গান :--

" লও লও সুরয ঠাকুর লও তোর পানি 
লির্খিয়া--জুথিয়া সাতজল পানি 
সাত জল পানি না হয় একজল সোনা 
একজল সোনা না হয় লাড়িয়া পিতল 
ধাক্কা দিয়া ফালাইলাম বাড়ীর ভিতর 
বাড়ীর ভিতর আবুডুবু পানি 
তার থেইক্যা দিয়া আইলাম সূর্যরে পানি । 

********* **********

উঠ উঠ সুরয ঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া 
উঠিতে না পারি আমি হিমালের লাগিয়া 
হিমালয়ের পঞ্চকন্যা সূর্যে করল বিয়া । 
চান পুজি চন্দনে সুরয পুজি বন্ধনে 
চান পুইজ্যা ঘরে যাই , সুরয পুইজ্যা দুধভাত খাই 

******** *********

সূর্য উঠে বামুন পাড়া দিয়া ---সূর্য উঠে রাজার বাড়ী দিয়া
তিন কোনা পৃথিবী পুজি মায়ের সমান ।।

অদ্ভুত দুটো মোটিফ দেখলাম , যেখানে বলা হচ্ছে সূর্য তাহলে প্রথম উঠে উচ্চবর্ণ সমৃদ্ধ পাড়ায় । আর পৃথিবীর আকৃতি তাহলে ত্রিকোণ ! বিষয়টি কি কোথাও মনের অবচেতনেই প্রজননতত্ত্বের অভিসারী । উপরিউক্ত গানটা পূর্ববঙ্গ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমা থেকে সংগৃহীত । কুমারী কন্যার আশা আকাঙ্খা ব্রতের গানে কিভাবে প্রকাশ পায় তার আরও কিছু নিদর্শন দেখা যায় প্রথমে একজন স্ত্রী হওয়ার আকাঙ্খায় , পরবর্তী পর্যায়ে পিতা ও ভাইয়ের ঘরের সমৃদ্ধি কামনা , এবং পরিপার্শ্বের প্রতি গভীর মমত্ববোধ , এ সবই আছে ব্রতের গানে ও কথায় । যেমন :-

" উথল( নধর ? ) ঘোড়া নকল ঘোড়া 
ষোল বইনের ষোল ঘোড়া 
তেল কলসী হাতে ঘি কলসী মাথে 
প্রথম পুতে করে কাজ ,
প্রথম বৌয়ে ভোগে রাজ 
মুই মইলে যাই শ্রীকৈলাস "

অথবা অন্যত্র দেখি

" বাপে দিল পুস্কনী ভাইএ দিল পাড় 
শুয়া পইঙ্খে জল খায় দে ঘরে সংসার "

আবার ......

" আমি পুজি গুঁড়ির অনন্ত 
আমার জন্য থাক সোনার অনন্ত "

মাঘ মণ্ডল ব্রতের নিজস্ব গান হলো দেউল ভাসানোর গান । দেউল বা কলার ভেলা ভাসানোর গান যা যোগাড় করা গেছে তা হলো এই রকম :-

" কন্যা হাঁটিয়া যাও গো ধীরে 
তোমার বাপে দীঘি দিছে 
ডেউরা( ভেলা ) ভাসাইতে 
কন্যা হাঁটিয়া যাও গো ধীরে 
তোমার লাইগ্যা বাজন বাজছে 
তোমার বাপের মন্দিরে "

মাঘমন্ডল ব্রতের এই গান কথায় সুরে মিশিয়ে সকলে মিলে গাওয়ার রীতি । হাতে হাঁড়ির ভেতরে আলপনা বর্জ্য উপচার ও তারমধ্যে ঘিয়ের প্রদীপ নিয়ে সারাদিন গান গাইতে গাইতে , ব্রতিনীরা পরস্পরের বাড়ী আসা যাওয়া করেন , বসবার নিয়ম বা প্রথা নেই । এইভাবে ঘুরে ঘুরে সূর্য অস্ত যাবার পর , ভেলা ভাসিয়ে ঘরে ফেরেন ।

সাবেক পূর্ববঙ্গে প্রচলিত এবং প্রতি মাঘ মাসে পালিত পাঁচ বৎসর ব্যাপী সূর্যোপাসনা মূলক একটি কুমারীব্রত হল মাঘমন্ডল। এই ব্রতের দুটি মূল কৃত্য হল পঞ্চগুঁড়ির রঙ্গিন আলপনা অঙ্কন এবং 'বারৈল' বা 'লাউল' নামক মৃত্তিকা-প্রতীক নির্মাণ, ফুল-দূর্বা দিয়ে তার সাজসজ্জা ও পূজন। 

এই ব্রতে আঙ্গিনায় অঙ্কিত হয় ব্রতমন্ডল; তার উপরে গোলাকার সূর্য আর নীচে অর্ধচন্দ্র বা চন্দ্রকলা; মাঝে অয়ন-মন্ডল। অয়ন-চিহ্নের সংখ্যা দ্বারা উপলব্ধ হয় ব্রতের পূর্ণতার বৎসর। আমার মা'র বাপের বাড়ি গ্রন্থে রানী চন্দ লিখছেন, "এক বছরে এক গোলের আলপনা, দু' বছরে দু গোলের। এক গোলের গায়ে আর একটি বৃত্ত দাগা...তিন বছরে তিনটি বৃত্ত, চার বছরে চারটি -- আর পাঁচ বছরে পরপর রেখা টানা পাঁচটি বৃত্তের প্রকান্ড একটা আলপনা"। 

মাঘ মন্ডলের ব্রতে পিটুলি গোলার আলপনা দেওয়া হয় না, দিতে হয় চালের গুঁড়ির সঙ্গে হলুদ, সিঁদুর, ধানের পোড়ানো তুষ, শুকনো বেলপাতার গুঁড়ো মিশিয়ে নানা বর্ণে রঞ্জিত করে রঙিন আলপনা। রোজই দেওয়া হয় এই আলপনা, দু' আঙুলের টিপে গুঁড়ি নিয়ে আঙুল সামান্য নাড়িয়ে ঝুরঝুর করে ফেলে আঁকা হয় লতাপথ। পৌষের সংক্রান্তি থেকে মাঘের সংক্রান্তি পর্যন্ত চলে এই ব্রত। 

'হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান' গ্রন্থে চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখছেন, " প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ করিয়া ব্রতিনীকে দূর্বাগুচ্ছের সাহায্যে চোখে ও মুখে জল ছিটাইতে হয়। এই অনুষ্ঠানের নাম 'চউখে মুখে পানি দেওয়া'। সূর্য উঠিলে পাঁচালি গান করিয়া 'বারৈল' ভাসান হয়।...বারৈল দুইটিকে ফুল দূর্বা দিয়া সাজাইয়া একখানি ছোটো তক্তার উপর বসাইয়া পুষ্করিণীর জলে ভাসাইতে হয়। ইহার পর মন্ডলের উপর ফুল দিতে হয়। পাঁচালিতে সূর্যের পূর্বরাগ ও বিবাহের কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে।"

গ্রামের কিশোরীরা কাকভোরে মাথা-ঘাড়ে কাঁথা জড়িয়ে ঘন কুয়াশা ঠেলে তাদের মা কিংবা দিদা-ঠাকুমার সঙ্গে দু'পাশের ঝোপ ছাড়িয়ে, শিশিরে ভেজা ঘাস মাড়িয়ে চলে ঘাটলায়। কে আগে ঘাটে যাবে যেন তার প্রতিযোগিতা চলে। জলের কাছে ঘাটে রাখা হয় বারৈল বা লাউল। তার সর্বাঙ্গ অতসী, টগর, কলকে, গাঁদা অথবা নানান বুনো ফুলে ঢাকা, কারণ তার গা দেখা গেলেই দোষ। আগের রাতে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল এই বারৈল। কিশোরীরা একসঙ্গে সুর করে গায় ব্রতের ছড়া; সূর্যকে স্বাগত জানানোর মন্ত্র,

"উঠো উঠো সূর্যিঠাকুর ঝিকিমিকি দিয়া,
না উঠিতে পারি মোরা শিশিরের লেইগা।"

( সূর্য উঠবেন, তাই তার পথ প্রশস্ত করতে কিশোরীরা সাজির ফুল জলে ছুঁড়ে সুর করে গায়,)

"খুয়া ভাঙ্গি খুয়া ভাঙ্গি এ্যাচলার আগে,
সকল খুয়া গেল বড়ই গাছটির আগে।"

ধীরে ধীরে বড়ই বা কুল গাছের মাথা পরিষ্কৃত হয়ে কুয়াশা দূরীভূত হয়, সূর্য ওঠে, তার আলোকিত করুণায় পৃথিবী সচল হয়। 'বারো মাসে তেরো পার্বন' গ্রন্থে স্বামী নির্মলানন্দ লিখছেন,

"তিনি উদিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, ধোপা, নাপিত, কামার, কুমোর, তাঁতি, সুরি, তিলি, মালী সকলকে জাগিয়ে তোলেন, সকলের গৃহই তিনি আলোকিত করেন, তখন প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্তব্যে ব্রতী হয় -- সমগ্র জগত্ কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে। ব্রাহ্মণ বধূ উপবীত, তন্তুবায় বধূ বস্ত্র, কর্মকার বধূ মাল্যাদি সরবরাহে ব্যস্ত হয়।ব্রতের ছড়ার ভিতরে এ দৃশ্যের এক চমত্কার বর্ণনা পরিস্ফুট। সামাজিক কর্তব্য ও দায়িত্ববোধের একটা পরিষ্কার ছবি কুমারীদের অন্তরে স্বতঃজাগ্রত হয়। ব্রতের ছড়ার মধ্যে এ রকম অনেক শিক্ষাই আছে।"

এই ব্রতের সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয়টি দেখানো হয়েছে চন্দ্রকলার সঙ্গে সূর্যের বিবাহানুষ্ঠানের প্রসঙ্গে। মাধবের কন্যা অপরূপ লাবণ্যবতী তন্বী-বালা চন্দ্রকলা। তাকে দেখে, তার রূপে সূর্য পাগল হয়ে বিয়ে করতে চান। ছড়ায় দেখতে পাই,

"চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা মেলিয়া ছিলেন কেশ।
তারে দেইখ্যা সূর্য ঠাকুর ফিরেন নানা দেশ।।
চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা মেলিয়া দিছেন শাড়ি।
তারে দেইখ্যা সূর্য ঠাকুর ফিরেন বাড়ি বাড়ি।।
চন্দ্রকলা মাধবের কন্যা গোল খাড়ুয়া পায়।
তারে দেইখ্যা সূর্য ঠাকুর বিয়া করতে চায়।।"

সূর্যের মত এক পাত্র পেলে মাধবের আপত্তি থাকার কথা নয়, তাই সুসম্পন্ন হয়ে গেল তাদের শুভবিবাহ। সূর্য পেলেন অজস্র দান সামগ্রী। কী নেই তাতে; আর হবেই বা না কেন? মাধব যে লক্ষ্মীপতি! অতএব বিয়ের পর চন্দ্রকলা চললেন পতিগৃহে; আর এখানেই দেখানো হয়েছে বিচ্ছেদ আর মিলনের বেদনা-সুখের আনন্দঘন মুহূর্ত, পল্লী বাংলার চিরায়ত আবেগসঞ্চার। ব্রতিনীদের জীবনেও আসবে এই দিন; মা-বাবা-ভাই-বোন, প্রিয়জন, ক্রীড়াসহচরীদের ছেড়ে যেতে হবে স্বামীগৃহে। আবার মিলনসুখ অপেক্ষা করছে সেখানে, মিলনানন্দের আবেগ, লোকলাজ -- সব মিলিয়ে এ এক দুঃখ-সুখের যুগলবন্দী!

মাঘমন্ডল ব্রতের অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করেছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিন-অঙ্কে বিভক্ত ব্রতের ছড়ার অসাধারণ বিবরণ দিয়েছেন তিনি। 'বাংলার ব্রত' গ্রন্থে তিনি লিখছেন,"এই মাঘমন্ডল-ব্রতের প্রথম অংশে দেখা যাচ্ছে যে সূর্য যা, তাঁকে সেই-রূপেই মানুষে দেখছে এবং বিশ্বাস করছে যে, জলের ছিটায় কুয়াসা ভেঙে দিলে সূর্য-উদয়ের সাহায্য করা হবে। এখানে কামনা হ'ল সূর্যের অভ্যুদয়। ক্রিয়াটিও হ'ল কুয়াসা ভেঙে দেওয়া ও সূর্যকে আহ্বান। দ্বিতীয় অংশে চন্দ্রকলাকে দীর্ঘকেশ গোল-খাড়ুয়া-পায়ে একটি মেয়ে এবং সূর্যকে রাজা বর এবং সেই সঙ্গে সূর্যের মা ও চন্দ্রকলার বাপ কল্পনা করে মানুষের নিজের মনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ির যে-সব ছবি আছে, সূর্যের রূপকের ছলে সেইগুলোকে মূর্তি দিয়ে দেখেছে। তৃতীয় অংশে সূর্য-পুত্র বা রায়ের পুত্র রাউল বা লাউল, এক-কথায় বসন্তদেব; টোপরের আকারে এঁর একটি মূর্তি মানুষে গড়েছে, এবং সেটিকে ফুলে সাজিয়ে মাটির পুতুল হালামালার সঙ্গে বিয়ের খেলা খেলেছে। এখানে কল্পনার রাজ্য থেকে একেবারে বাস্তবের রাজ্যে বসন্তকে টেনে এনে, মাটির সঙ্গে এবং ঘরের নিত্যকাজের এবং খুঁটিনাটির মধ্যে ধরে রাখা হলো"। লাউল বা লালুর বিয়ে করতে যাবার ছড়াটি খুব মনোরম।

"জলের মধ্যে ছিপছিপানী কিসের বাদ্য বাজে,
চান্দের বেটা লাউল্যা আজ বিয়া করতে সাজে।
সাজোরে সাজোরে লাউল্যা সোনার নূপুর দিয়া,
ঘরে আছে সুন্দরী কন্যা তুইল্যা দিমু বিয়া।"

লাউল বউ নিয়ে আসে; বিয়ের ভোজে সূর্য গামছা মাথায় দিয়ে অন্দরমহলে তদারকি করছেন। 'ঝিকুটি' খেলতে গিয়ে পাওয়া গিয়েছে কিছু টাকা, তা দিয়ে লাউলের বউকে শাঁখা কিনে দেওয়া গেল। রইল কিছু, তা দিয়ে ব্রতিনীর মায়ের শাখাও হল, সব কুমারীরা নিজের মাকে শাঁখা পড়ান --

"লাউল্যার বউরে শাঁখা দিয়া বেশি হইল টাকা
সেই টাকা দিয়া দিলাম মায়েরে শাঁখা।"

মাটির সঙ্গে সূর্যের ছেলে বসন্তদেব বা লাউলের বিয়ে আর মিলনের পালাও শেষ। ঋতুরাজ পৃথিবীকে ফুলে-ফলে ভরিয়ে বিদায় নিচ্ছেন। তাকে যেতেই হবে, একলাই, আবার শীতের মধ্যে বসন্ত হয়ে ফিরবেন, এখন বিদায়। কিন্তু মেয়েরা বৃথাই তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করে --

"কৈ যাওরে লাউল গামছা মুড়ি দিয়া?
তোমার ঘরে ছেইলা হইছে বাজনা জানও গিয়া।
ধোপা জানাও গিয়া, নাপিত জানাও গিয়া, পরুইত জানাও গিয়া।"

( লাউলের ছেলের নাম রাখার অনুষ্ঠান -- )

"লাউলের ঘরে ছেইলা হইছে কি কি নাম-থুমু?
আম দিয়া হাতে রাম নাম থুমু।
বরই দিয়া হাতে বলাই নাম থুমু।
কমলা দিয়া কমল নাম থুমু।
জল দিয়া জয় নাম থুমু।
রাজার বেটা রাজার ছেইলা রাজা নাম থুমু।"

কিন্তু লাউলকে যেতেই হবে। মধুমাস শেষ, বৈশাখের মেঘ দেখা দিল, মেঘ গর্জন করে উঠলো, ঝড় বইলো, উৎসবের সাজ-সরঞ্জাম লন্ডভন্ড করে ভেঙ্গে পড়ল ফুলে-ভরা জইতের ডাল। ঋতুরাজকে বিদায় দিতেই হল -- 

"আজ যাও লাউল,
কাল আইসো।
নিত নিত্য দেখা দিও।
বছর বছর দেখা দিও।"

অদ্বৈত মল্লবর্মনের 'তিতাস একটি নদীর নাম' উপন্যাসে দেখা যায় মৎস্যজীবী মালো মেয়েরা নিষ্ঠা ভরে মাঘমন্ডলের ব্রত করছে। মাঘমাসের প্রতিদিন সকালে কুমারী মেয়েরা স্নান করে ভাঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জলে সিঁড়ি পুজো করে উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্র আওড়ায়। বিবাহের কামনাতেই এই ব্রত। ব্রতের শেষদিন তৈরি হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি, সেই চৌয়ারি মাথায় করে ভাসানো হয় তিতাসের জলে। অক্ষত চৌয়ারির দখল নিতে কিশোরেরা হুল্লোড় করে ওঠে। উঠোন জোড়া আলপনার মাঝে কিশোরী ছাতা মেলে বসে, তার মা ছাতার উপর ছড়িয়ে দেয় খই-নাড়ু, আর তা কাড়াকাড়ি করে খায় কিশোরেরা । 

সূর্যের ব্রত বয়স্ক রমণীদেরও ব্রত । এই ব্রতেও উল্লেখ যোগ্য গান সূর্যবন্দনা এই ব্রতেও ব্রতিনীরা ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নান করেন এবং সমস্ত দিন দাঁড়িয়ে সূর্য উপাসনার গান গান । সূর্য ব্রতের নিয়ম এবং সারাদিন ধরে গান হতো

" চল সখি সূর্য আরাধন করি । 
উদিত যে ভাস্কর , তেজময় দিবাকর 
তার তেজে ভুবন মোহিত গো ও সখি 
কুন্তী রানী একেশ্বর 
যায়ে দীর্ঘ সরোবর 
সরোবরে যাইতে কুন্তী , পান্থে দেখা হইলো মুনি 
দিলেন মুনি পুত্রের যে বর গো 
অকুমারী নারী আমি 
পুত্রের বর দিলেন মুনি 
এখন আমি কি করি উপায় গো 
কোন স্থানে হইবে প্রসব গো । 

কর্ণেতে হইবেন উনি , নাম রাখা কর্ণমুনি 
এই পুত্র জগতের ঈশ্বর গো । 
কর্ণেতে নির্গত উনি , নাম হইলো কর্ণমুনি 
গঙ্গা তুমি ধরো গো কোলেতে । 

জাতক ভাসাইয়া জলে , অবলার নয়নে কান্দে 
এখন আমি কি করি উপায় গো ।। "

কুমারী কন্যার অনিচ্ছাকৃত জননীত্বের দীর্ঘশ্বাস আজও ভেসে বেড়ায় । পুরান, ইতিহাস এই ভাবেই লোকসঙ্গীতের মধ্যে ওতপ্রত ভাবে লৌকিক বৈশিষ্ঠ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে । এই ব্রতের সমাপ্তিতে একটা গান হয়ে থাকে তা হলো--- বর প্রার্থনা । এই গানে বোঝা যায় , মেয়েলি গান কেবল প্রথার অনুসরণই নয় , পদকর্তা ও গায়িকাশিল্পীদের , শিল্পীসত্ত্বার প্রকাশও বটে । এই গানে লব কুশ-কে স্মরণ করা হয়েছে । এখানে লবকুশ কে স্মরণ করে গানে বলা হচ্ছে :-

" তোরা দুই ভাই শিশু কে রে মুনির কাননে 
রামরূপ হেরি শিশুর বদনে । 
শুকনাতে ঝুলে আরও ঝুনা নারিকেল 
জলেতে ভাসিয়া ফিরে পদ্ম-শতদল । 
দুই হস্ত ভরিলো ধবল শঙ্খে মাথা ভরিল ফুলে 
রে মুনির কাননে ।

পরিশিলীত সামাজিক গানে গায়িকারা কোকিলকণ্ঠ পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতেন

" কই যাও লাল ঠাকুর( সূর্য ) কিনা( লাঠি ) ভর দিয়া 
বরতী সকলে রাখছেন তারে চরণে ধরিয়া 
কই যাও লাল ঠাকুর কিবা বর দিলা ,
ধনে জনে বাড়ুক তোমরার আয়স্থ ( আয়ু ) বিস্তর 
গীত সম্পূর্ণ হইল বরতী লইল ঘর 
গীতউলির গলা হউক কোকিলের স্বর । "

যেহেতু এই ব্রতের সঙ্গে লোকাচারে এক কাঙ্খিত বৈবাহিক সূত্রের সম্পর্ক আছে , সেহেতু জোড়নের গান ও আছে । জোড়নের গান, অর্থাত্ বিবাহ স্থির হওয়ার পরে পাত্রপাত্রীর সম্পর্ক স্থাপন বিষয়ে গান গাওয়া হয় । বিবাহের প্রস্তাব , সম্বন্ধ স্থির করার প্রসঙ্গও থাকে । জাতি-গোত্র-সমাজ-পণ --সব প্রসঙ্গেই এবারের গানটিতে খুঁজে পাই ।

" লঙ্গফুল রুইতে হস্তে লাগিল মাটি 
জল আন ঝারি আন হস্তখান পাখালি ( ধুই ) । 
হস্তখান পাখালতে রে সোনাধন দেখিলা সুন্দরী 
দেখিয়া সুন্দরীরে বাছাধন কেওর ( দরজা ) দিলো বারি 
রইল মায়ের বাছা অনুরাগ দিবা 
মাও গেল বইন গেল আরে সোনাধন 
বাগ ডাঙ্গাইবারে । 
পণ্ডিত( ঘটক ) পাঠাইয়া দিছিরে সোনাধন 
সুন্দরীর উদ্দেশে 
শ' লাগে হাজার লাগে রে সোনাধন 
তরে দিব আমি 

বাছিয়া বিয়া করাবো রে জমিদারের বেটি । 
আর দিন তোমার মায়েরে নাগর 
গালি দিছিল মোরে । 
আমার বাপের দেশ গো কন্যা 
এই ব্যাডার আছে 
শাশুড়িরে পুত্রবধূ গালি দিতে পারে । "

অর্থাত্ পুত্রের নির্বচিত সুন্দরী কন্যা অনুমোদন পেল না টাকা দিয়ে হলেও জমিদার কন্যা চাই । এক্ষেত্রে জাতের বিচার প্রকট হয়ে ওঠে

" পুস্কনির আড়ে পুস্কনির চারিপাড়ে 
ফোটে ফুল চম্পা নাগেশ্বর । 
ডাল ভাইঙ্গা ফুল তোলে বিদেশী নাগর ।
রৌদ্রের উত্তাপে জলের পিপাসায় 
বসলেন নাগর শীতল চম্পার তলে ।
সঙ্গের সঙ্গীলা ভাই জিজ্ঞাসা কররে 
ঠান্ডা জল আছে কার ঘরে ,
সেই কথা শুনিয়া ও কন্যা উত্তরে গো 
ঠান্ডা জল আছে মোর ঘরে । 
জল যে খাওয়াইলা ও কন্যা সুন্দরী গো 
কহ কন্যা তোমার বাপের জাতি । 
বাপ যে আমার এই ঘাটের খেওয়ানী রে 
মাও আমার ভূঁইয়া মালীর বেটি ।
সেই কথা শুইন্যা ও কুমার সুন্দর রে 
কান্দে কুমার গামছা মুখে দিয়া ।
বুদ্ধি নাই নির্বোধ কুমার রে 
জল খাইয়া জাতির বিচার করো । 
সঙ্গের সঙ্গীলা ভাই কইও গিয়া মায়ের ঠাই 
জাতি দিলাম ভূঁইয়া মালীর ঘরে ।
আমার যে বাপগো এই দেশের রাজা রে । 
মাও আমার জমিদারের বেটি । 
সঙ্গের সঙ্গীলা ভাই কইও গিয়া মায়ের ঠাঁই 
বিয়া করলাম জমিদারের বেটি
বিয়া করলাম পরমা সুন্দরী ।। 

এই ভাবে এই ব্রতের আরও এক জোড়নের গান পাই :--

" যূথী ফোটে জাতি ফোটে ফোটেরে মালতী 
অলল্যা( ফুরফুরে ) বাতাসে ফোটে গন্ধরাজের কলি
লঙ্গ ফোটে ডালে ডালে গুলাল ফোটে বায় 
প্রভাতে জাগিয়া কন্যা পুষ্প তোলা যায় 
ধল ঘোড়া সোয়ারে নাগর মৃগ শিকারে যায় 
দেখিল সুন্দর কন্যা পুষ্প তোলা যায় ।
নাগরে জিজ্ঞাসা করে , কন্যা গো সুন্দরী 
অলল্যা চম্পার তলে কেন একেশ্বরী 
একেশ্বরী না হই নাগর সঙ্গে পঞ্চ ধাই 
বাপ খুড়ার নগরে ,আমি আনন্দে বেড়াই 
বেড়াও গো , বেড়াও গো , কন্যা বাপ খুড়ার নগরে 
বিধাতার নির্বন্ধ থাকলে বিয়া করবো তোরে ।।

আরও একটি জোড়নের গান পাই , ....গানটি এখানে উল্লেখ করি আবার । এই গানে পাত্র পাত্রীর সাক্ষাতের পরিবেশ সম্পূর্ণ পৃথক । কন্যা কে পাত্র পক্ষ থেকে গহনা দেবার কথা হচ্ছে :--

" অরণ্য জঙ্গলার মাঝে বরইনা গাছটি লো 
বালি বরইনি( কুল ) পারিতে যাবি । 
সোনারি কোটা রুপারই সাজি বালি 
বরইনি পারিতে যাবি 

বরই যে টোকাও ( কুড়াও )সুন্দরী কন্যা গো 
বিয়াও নি হইছে লো তোর 
বিয়াও তো হয় নাই বৈদেশি সাধুরে 
জুড়নী হইছে রে মোর । 

জিজ্ঞেস করো যেয়ে তোমারি বাবার ঠাঁই 
বিয়ানি দিব লো তোরে 
বাস্ক ভরা গয়না দিব লার বালি 
বিয়ানি দিব লো তোরে ।।

বৈবাহিক আচার অনুষ্ঠানের যেমন শেষ নেই , সেই সব লোকাচার ঘিরে গাহর্স্থ জীবনের চিত্রও অজস্র । বিয়ের আগে অঙ্গসংস্কার অধিবাস । হলুদ মেখে নিজেকে উজ্বল করা এবং গন্ধ দ্রব্য তৈরীর গান ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাওয়া যায় । পশ্চিমবঙ্গে , উত্তরবঙ্গে , পূর্ববঙ্গে সর্বত্র সোন্দা মেথি জাল দিয়ে গন্ধ দ্রব্য প্রস্তুতির নানান বর্ণনা আছে । আছে সোন্দার জন্ম , সোন্দার নানাবিধ প্রশান্তি বিষয়ক গান । অনুমিত হয় এক সময় মেয়েরাই গন্ধ দ্রব্য প্রস্তুত করতো । একটি গানে উল্লেখ দেখি

"এ কি সোন্দা গন্ধে আগলি সোন্দা
সোন্দা কে চুরি করলো না রে । 
সকলের কাপড় চোপড় ঝারিয়া ঝুরিয়া চাইলো 
কেবল বাছার কাপড়ের মধ্যে সোন্দার গন্ধ পাইল । "

ইঙ্গিত হলো বিবাহের বরই সোন্দা চুরি করেছে । সোন্দা দিয়ে গন্ধ তেল তৈরীর গান ও ছিল ।

" রামের মা ও মাসি , জেঠি , খুরি , পিসি 
তারাও যায় তৈল রন্ধনে । 
মৃত্তিকার পঞ্চ ইটা , সুবর্ণের পাতিলা গোটা 
তাতে দিলো তৈল ঢালিয়া । 

আগর কাষ্ঠে , চন্দন কাষ্ঠে 
আ,নল জ্বালাইয়া তাতে 
তৈলে দেও সোন্দা মেতের গুঁড়া 
তৈলে দেও পান জোড়া "

সোন্দা, হলুদ , এবং মেথির অজস্র গান আছে প্রায় সকল সমাজে । যেমন :-

"কাচো কাচো হলদা 
অাঙ্গ নাহি উঠেগে রেঙ্গ 
ছিগে ছি নারীর বেটি 
ছিরি নাহি উঠেগে "

অথবা

"যে হইল সে হইল বেটিগে তোর নসিবতে 
আর নিকিন ঘুরিবে গে 
হলদি মাখা দামান "

মেয়েদের স্বামী গৃহে পাঠানোর কল্পে সোহাগ মাগার গান আছে

"আইজ হইব গৌরীর বিয়া 
গৌরীর মায়ে কান্দন করে গো 
গৌরীরে বেড়িয়া গো 
শুন ত্রিপুরারী । "

এই ভাবে বিষাদের শুরু হয় , তারই শেষ হয় কনে বিদায়ের গানে । এই সব গানে যেমন বাবা , মা , ভাই , বোন , আত্মীয় পরিজনের বেদনা আছে , তেমনি আছে স্বামী গৃহে মানিয়ে নেবার উপদেশ । যেমন :-

"বালিলো ভাশুর দেখলে পালাইও 
শ্বশুর দেখলে খেলিও 
মার বাছা পরে লইয়া যায় । 
বালিলো সকলেরে দিও দুধভাত 
তুমি খাইও শুধাভাত 
তবে বলবো বুদ্ধিমানের বেটি গো । "

এই গান চলে আসছে মৌখিক পরম্পরায় । বিষয়বস্তু , গায়কী , বাক্যরীতি , সবই পরম্পরা গত ভাবেই চলে আসছে । আরও একটি কনে বিদায়ের গান শোনা গেছে , এর আঙ্গিক কিছু অন্যরকম । যেমন :--

"নদীর পারে নলখাগড়া বাতাসে হল্ হল্ করে । 
ঝিএর জ্বালা দারুণ জ্বালা , তুষের আ,নল জ্বলে 
কোন পেটে রাখছিলাম পুতের নাড়ি 
আনগো কাটারী কাটি ঝিএর নাড়ি 
পুতের নাড়ি সোনা রূপোয় বান্ধি । 

**** **** ****

দশমাস দশদিন মায়ের মনে অনুক্ষণ 
হইব পুত্র করিব পালন গো ।
তাতে তো পাষণ্ড বিধি 
আইন্যা দিল কইন্যা নিধি 

যাইবো কন্যা পরের ঘরে গো 
সাত পুত্রের সাত বৌধন , সামনে থাকবো অনুক্ষণ 
তুমি ঝিধন নিশার স্বপন গো 
কান্দে কন্যার মা 
মাও কান্দে বাপ কান্দে ভাইঅ কান্দে লুটাইয়া 
যাও গো ঝিধন পরের ভবন গো 
কান্দে কন্যার মা ।।

জলভরার গান হলো আনন্দের গান । একটা গান দেখছি বেশ বিচিত্র , জল ভরনের গানটা কৃষ্ণরাধা দিয়ে শুরু , কিন্তু সংসারের বধূ এসে গেছে তারই বৃত্তে । পরিবারের যারা অভিভাবক , তারা জল ভরার ছলে , বাইরে যাবার অনুমতি দেন না । অথচ মেয়েরা সাজসজ্জা করে জল ভরতে গিয়ে অভিনব আনন্দের মধ্যে মুক্তি লাভ করে । গানটি হলো বাইরে যাবার জন্য অনুমতি চেয়ে মিনতির গান ।

"অষ্ট সখি মিনতি করি শাশুড়ি মা'র কাছে গো 
বধূমাকে জলে যাইতে না করিও মানা গো । 
কেহর পৈরণ লাল নীল কেহর পৈরণ সাদা 
রাধিকা সুন্দরীর পৈরণ কৃষ্ণ নামটি লেখা গো । 

বস্ত্র থইয়া কলসী লইয়া লামল গঙ্গার জলে গো 
বস্ত্র নিল চিকন কালায় , কলসী নিল সোতে গো । 
পুষ্কনির চারিপাশে কালো পিছল মাটি 
পা পিছলিয়া আছাড় খাইয়া ভাঙ্গিল কলসী । 

শাশুড়িএ গালি দিল বাপ ভাইঅ সুগী ( শোকে )
কেমনে ভাঙ্গিল আমার হীরার কলসী । 
আমার বাপের ঘরের পিছনে আছে কুমোর ঘর 
নাইওর গেলে আইন্যা দিব সেই কলসী তোর ।। "

কনে সাজানোর গানের একটা মুখরা পাওয়া গেছে । কনে সাজানো বর সাজানোর যে গান মেয়েরা তখন সানন্দে গাইতো , তার তেমনি একটুকরো মহিমা দেখা যায় এই ভাবে :-

"রাই অভিলাষে সাজে কি শোভা ধরে 
রাই হেলিয়া দুলাইয়া পড়ে । 
রাইএর সর্বসখি মিলে জিজ্ঞাসা করে 
কে সাজাইয়া দিল রাইকে । "

****** ******

" দিদিগো রাইএর সাজন দেখে আমার প্রাণ যায় 
সন্ধ্যা হইলে ঘরের কোণে সায়েব লোকে মেম সাজায় 
কানাইর বাঁশি বাজলে পরে রাইএর সাজন , ঝিকঝিকায় "
আবার স্বামীগৃহের সাজকে নিন্দাও করা হয়েছে কোনো গানে । যেমন :-

"মেঘ সেজেছে , মেঘ সেজেছে , আয়ান ঘোষের বাড়িতে 
তোমরা কি দেখেছো সখি , রাই সাজাইতে 
কৃষ্ণ যে পাঠাইছে চন্দন সে চন্দন তো ভালো না 
ভাল চন্দন না হইলে রাধা চন্দন পরবে না । "

অতীত কালের দেয়া নেয়া মনের টানা পোড়েন মেয়েলি গানে এমন ভাবেই জায়গা করে নেয়।একদিক থেকে প্রথাকে মেনে যেমন প্রথাগত গান গাওয়া হচ্ছে , অন্যদিকে সেই গানের মধ্যেই সমাজ সংসারের বদলে যাওয়া অথবা না যাওয়ার প্রসঙ্গ এসে পড়ছে । বিয়ের গানের একটা অংশ অবশ্য "বান্দাগান"বা ঠাট্টার গান । সে গানে মেয়েরা ,কনের পিতা , বরের পিতাকে উপলক্ষ্য করে পুরুষজাতির প্রতি মনের জ্বালা মেটায় । কিন্তু গানগুলি গাওয়া যেহেতু প্রথাসিদ্ধ , বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলেও সেই প্রতিবাদী গান কিন্তু থামে না । লোকগান এই ভাবেই এগিয়ে চলে মুখ থেকে মুখে , প্রজন্মান্তরে ।


chatterjee.jharna@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ