গ্রামীণ সমাজ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনতম সমাজ। আর সেই সমাজ যদি হয় আদিবাসী তথা সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমিজ, কাহার, কৈবর্ত্যদের সমাজ তাহলে বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না তাদের গুরুত্ব ও মূল্যায়নের। কৃষির জন্য, খাদ্য সংগ্রহের জন্য আদিম মানুষকে খুঁজতে হয়েছে আবাস, থাকতে হয়েছে মিলেমিশে। তারপর গড়ে উঠেছে একটি সমাজ। এখন ক্রমে ক্রমে পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠল এক একটি গ্রাম। সমাজের বাইরে কিছু প্রথা, বিশ্বাস বা টোটেম ও ট্যাবু বাসা বেঁধে উঠল সমাজে। কর্মসংস্থান ছাড়া বাকি সময় মানুষ ব্যায়িত করল অবসর বিনোদনে। এই বিনোদনের পদ্ধতি, টোটেম, ট্যাবুই ক্রমশঃ হয়ে উঠতে লাগল লোকসংস্কৃতির উৎস। সমাজে লোকসংস্কৃতির ভিত রচনা হল এভাবেই।
লোকসংস্কৃতির মধ্যে যেমন আছে লোকসাহিত্য, তেমনি আছে শিল্প, আচার-অনুষ্ঠান, সংষ্কার, উৎসব, পূজা-পার্বণ, মেলা এবং লোকসমাজের ভাষা, দর্শন, বিজ্ঞান সবই। লোকসংস্কৃতি হল এক সমন্বয়ধর্মী শক্তি। তাই বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয় দেখা যায় এখানে। ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠীর সীমানা অতিক্রম করে এই যাত্রা তাই যুগে যুগে অব্যাহত রয়েছে। মানুষের অজান্তে তাই এক সমাজের রীতিনীতি,আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিলমিশ হয়ে যায় অপর স্থানের। আজ তেমনই কিছু নিয়ম, রীতিনীতির কথা এখানে, যা আমরা দেখেছি সেগুলি আদিবাসী সমাজে অনুসৃত হয়। আবার বর্ণহিন্দু সমাজেও দেখি তার ব্যবহার। এই সব রীতিনীতিগুলি যে আদিম অবস্থায় আদিবাসী সমাজের কাছে থেকেই এসেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। সেই একই রীতি এখনও চলে আসছে আচার-অনুষ্ঠানের অঙ্গ হয়ে, এটি ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
মানব বিবর্তনের ধারায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থান এবং তাদের জীবনচর্যার বৈশিষ্ট্য এক উল্লেখযোগ্য বিষয়। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসতি আছে। আদিবাসী গোষ্ঠীর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি মোটামুটি ভাবে প্রায় সব অঞ্চলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল---
একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে বসবাস
নিজস্ব জীবনধারণের ঐতিহ্য বহন
সুনির্দিষ্ট সাংস্কৃতিক বিন্যাস যেমন ভাষা, আচার, ধর্মীয় বিশ্বাস; শিল্পকলার ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্যতা পেশাগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রাচীন উপাদানের বিশেষত্ব ।
একটা কথা বলা যেতেই পারে যে অন্যান্য জনগোষ্ঠী সমাজের উপস্থিতি থাকলেও ভারতে তথা পশ্চিমবাংলাতেও সাঁওতাল জনগোষ্ঠীটির উপস্থিতিই সবচেয়ে বেশী। যদিও বর্ণহিন্দু সমাজের সঙ্গে আদিবাসী সমাজের রীতিনীতি,ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মিশ্রণের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সাঁওতাল গোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রণ হয়েছে এমনটি ভাবা ভুল। প্রকৃতপক্ষে তথাকথিত আর্য দের অর্থাৎ আর্য সভ্যতার মানুষগুলির সঙ্গে অনার্য সভ্যতা অর্থাৎ নিষাদ, শবর গোষ্ঠীর মানুষগুলির
সংমিশ্রণ হয়েছে নানা ভাবেই। একটা সময় আর্যসভ্যতার মানুষগুলির কাছে অর্থাৎ উন্নত সভ্যতার মানুষগুলির কাছে পরাজিত হয়ে আদিবাসী জনগোষ্ঠী অর্থাৎ নিষাদ, শবর স্তরের মানুষগুলি বা অনার্য গোষ্ঠীর মানুষগুলি ক্রমশঃ কিছু রাজপুতানার দিকে, কিছু গঙ্গার অববাহিকার দিকে চলে যায়। আবার কিছু ছোটোনাগপুরের মালভূমি অঞ্চলে, বুন্দেল খন্ড, মহানদীর সীমানা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তারা আর দক্ষিণে যায় না। সাঁওতালি লোকসঙ্গীতে এই ধরণের কিছু গানের বিবরণ থেকেও তার হদিশ মেলে। সাঁওতালী বেশ কিছু গানে তারা যে অন্যত্র বসবাস করত এবং সেখান থেকে ক্রমশঃ নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তার একটা বিবরণ পাই। যেমন এই গানটিতে পাওয়া যায়---
“হায় হায়! চেতান দিসম দো
গুরু হো নালম সেনঃ আ
গুরু হো নালম সেনঃ আ ।
হায় হায়! লাতার দিসম দো
গুরু হো নালম সেটেরঃ
গুরু হো নালম সেটেরঃ
নাসুল মিরু লেকা গুরু কো শিকড়ি দহকাম
নাসুল কারে লেকা গুরু কো বিড়ি দহকাম”
অর্থাৎ ---
হায় হায় উপর দেশে
গুরু যেওনা
গুরু যেওনা
হায় হায়! নিচের দেশে
গুরু যেও না
গুরু যেও না
পোষা টিয়াপাখির মত গুরু তোমাকে শিকলে বেঁধে রাখবে
পোষা তোতা পাখির মত গুরু তোমাকে বেড়ি পরিয়ে রাখবে।
গানটির কথা থেকে বোঝা যায় যে নীচে অর্থাৎ উত্তর দিক থেকে তারা ক্রমশঃ নানা দিকে ছড়িয়ে পড়লেও দক্ষিণ দিকে তাদের ছড়িয়ে পড়া সম্ভব হয়নি কিংবা যে কোন কারণেই হোক, তারা যায়নি। দুর্ভেদ্য অরণ্যে, পর্ণকুটিরে থেকে তারা নিজেদের বৈশিষ্ট্য রক্ষা করেছিল, যা ক্রমেই সংমিশ্রিত হয় বর্ণহিন্দু সমাজে। আদিবাসী সমাজের এই মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন হয়ে যাওয়া নিয়ে আরো অনেক গান আছে,যা থেকে বোঝা যায় তারা কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে, এবং তাদের বিগত জীবনে, পূর্বপুরুষেরা যেখানে বসবাস করত সে দেশের কথা তারা তাদের গানের মাধ্যমে জানাতে চেয়েছে।
রাজপুতানা এবং পঞ্জাব ওরফে পঞ্চ নদীর দেশ নিয়েও কিছু গান আছে, যেখানে বলা হয়েছে আদিবাসীদের বিশেষতঃ সাঁওতালদের যে বারোটি গোষ্ঠী আছে, তাদের প্রত্যেকের একটি করে গড় ছিল এবং নিজেদের মধ্যে মারামারি করে তারা সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে নানা দিকে। যে গড়গুলির কথা বলা হছে, সেই গড়গুলির বেশীর ভাগই হচ্ছে আজকের পঞ্জাব অঞ্চল। তবে কি যে সিন্ধু সভ্যতার কথা আমরা বলি, সেই সময়ে বর্তমান প্রজন্মের আদিবাসীদের পূর্বপুরুষদেরও কি কোন ভূমিকা ছিল? খুব জানতে ইচ্ছে করে এসব কথা। গবেষকরা এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলে ভাল হয়। আরো কিছু গান দিতে পারলে ভালো হত, কিন্তু সে আলোচনা আবার পরে কোন সময় করা যাবে।
আলোচ্য বিষয়, আদিবাসীদের কিছু রীতিনীতি। এখানে পুরুলিয়া-বাঁকুড়া অঞ্চলের কথ্য ভাষায় লিখিত একটি কবিতার মাধ্যমে একটি প্রধান রীতির কথা বলা হয়েছে। কবিতাটি এইরকম---
দাঁশায়ের আগের রাইত্যে উপর কুলহির রাবণ হেমব্রম
বুক চিতায়েঁ দাঁড়ালেক আস্যে
বুড়া জগমাঝির সামনে।
জগমাঝি হকচকাঁই গেল্যেক
-ইঃ...নাই দেখি আগে
তুমাকে বাপ এক্কেবারে দুগগার মতন লাগছ্যেক
হুদুড়দুগ্গাই বটে বাপ...বড় ভাল মানাইছ্যে’
বলেই হাঁক দেয় কুলহির মুখে
--আস্যো...আস্যো হে সব্বাই
দেখ্যে লাও দুগ্গাকে
আমাদের হুদুড়দুগ্গাকে...‘ বলেই হা হা হাসি বুড়ার
জগমাঝির আন্ডারে যত যুবক-যুবতী ছিল
ছুটে এসে গড় করত্যে যায় পায়ে
জগমাঝি ধমকাই উঠে
---ঘরকে আস্যেছে তুমাদের
রীতি জানা নাই ন কি!
ই কেমনধারা বটে,
জল লিয়ে আস্যো, ঘটি লাও, গড় করো’
দিকে দিকে ছোটে যুবক-যুবতীর দল
হাতে ঝকঝকে মাজা ঘটি
তাতে জল নিয়ে একে একে রাখে পায়ের কাছে,
গড় করে..
রাবণ হেমব্রম দুহাত তুলে স্বস্তি জানায়
যুবকেরা ঘিরে ধরে তাকে, হুদুড়ুরূপী দুগ্গাকে
নাচ শুরু হয়, দাঁশায়
বোল ওঠে -হায় হায়! ...হায় হায়..!!
এ কবিতাটি পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার অঞ্চলের অধিবাসীদের কথ্য ভাষায় লেখা। ঐ অঞ্চলের আদিবাসীরাও অনেকেই ওখানকার কথ্য ভাষায় কথা বলে থাকেন অন্যদের সঙ্গে, যদিও তাঁরা নিজেদের মধ্যে তাঁদের প্রচলিত ভাষাতেই কথা বলেন। কবিতাটির মূল অর্থ এবং তার ব্যাখ্যাটি আগে করা দরকার। বাকি কথায় পরে আসছি। এই কবিতায় উল্লিখিত জগমাঝি ও হুদুড়দুর্গা এই শব্দ দুটির অর্থ আগে জানা দরকার।
জগমাঝি---আদিবাসী সমাজে প্রতিটি গ্রামেই থাকেন জগমাঝি, যিনি গ্রামের সমস্ত ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও দীক্ষাগুরু বলা যায়। তাঁর দায়িত্বেই থাকে সমস্ত ছেলেমেয়েরা, তিনিই তাদের অভিভাবক। এমন কি বিবাহের সময়ও কথাবার্তা হয় দুই গ্রামের বা দুই পক্ষের জগমাঝির মধ্যেই।
হুদুড়দুর্গা--- কথিত, আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় এক বীরের নাম ছিল হুদুড়দুর্গা। অন্যমতে, মহিষাসুরের নামই ছিল হুদুড়দুর্গা। ‘হুদুড়’ কথার অর্থ হল বজ্র, অর্থাৎ তাঁর শক্তি ছিল বজ্রের মত। তাঁকে অন্যায় ভাবে প্ররোচিত করে হত্যা করেছিলেন মহিষাসুমর্দিনী দুর্গা,এবং হুদুড়দুর্গার নামানুসারেই তাঁর নাম হয় দুর্গা। আদিবাসীদের সেইরকমই বিশ্বাস। শুধু বিশ্বাসই নয়, তাঁরা অভিযোগও করেন একজন পুরুষ বীরের নাম একজন নারীর উপর আরোপিত হয় কি ভাবে! সেকারণেই আদিবাসী সমাজের একাংশ দুর্গাপূজার সময় সেই বীরের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন তাঁদের দাঁশায় নাচের মধ্য দিয়ে। প্রকৃত পক্ষে দাঁশায় হল, সেই বীরের অণ্বেষণ।
অন্য একটি বই, ‘আদিবাসী লোককথা’য় ( সম্পাদনা—দিব্যজ্যোতি মজুমদার) সাঁওতালদের লোককথায় পাচ্ছি, খেরোয়ালদের আদি মাতা-পিতার নাম পিলচু বুড়ি,পিলচু হাড়াম। তাদেরসাত ছেলে,সাত মেয়ে। সবচেয়ে ছোট ছেলের নাম ছিল হুদুড়দুর্গা।
কবিতাটি লেখার উদ্দেশ্য একটিই। আদিবাসী সমাজের দু-একটি রীতি-নীতি বিষয়ে বললেই কিভাবে তাদের রীতিনীতিগুলি বর্ণহিন্দু সমাজেরও অঙ্গ হয়ে উঠেছে, তা পরিস্ফুট হবে। কিংবা বলা ভালো, সেই আদিম কাল থেকে যে রীতিনীতিগুলি চলে এসেছে, ক্রমে ক্রমে তথাকথিত আর্য-অনার্য সংমিশ্রণের ফলেও কিছু কিছু তার ব্যবহার রয়েই গেছে।
প্রথমেই যে রীতিটির কথা মনে আসে, তার কথাই বলি। কবিতাটিতে সেকথাই বলা হয়েছে। এটি হল গৃহে অতিথি কেউ এলে পা ধোবার জল দানের রীতিটির কথা। গ্রাম দেশে বিশেষতঃ এই রীতিটি খুব চোখে পড়ে। গ্রামীণ সমাজে এই রীতিটি এখনও বর্তমান আছে যদিও তা নিম্নবিত্ত বা নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যেই দেখা যায়। নাগরিক সমাজে এই প্রচলন নেই বললেই চলে। কিন্তু আদিবাসী সমাজে এই রীতিটি পূর্ণমাত্রায় বজায় আছে শুধু নয়, এটি মান্য করা হয়ে থাকে। বস্তুতুঃ, আদিবাসী সমাজের রীতিনীতিগুলি সমাজের সকলে মানতে বাধ্য। অর্থাৎ এগুলি বাধ্যতামূলক রীতিনীতি।
আদিবাসী সমাজের রীতি অনুযায়ী গৃহে কোন অতিথি এলে প্রথমেই তার সামনে একটি জলপূর্ণ ঘটি পায়ের কাছে নামিয়ে রাখা হয়। উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার। তখনকার দিনে মানুষের ছিল পায়ে হাঁটা পথ। ক্লান্ত, শ্রান্ত মানুষগুলি বা মানুষটি গৃহে পদার্পণ করলে তার হাত-পা ধোবার জল ও খাবার জলের কথাই আগে মনে পড়ে। তাই সেই রীতিটীকে তাঁরা মেনে চলেন। যিনি এলেন, তিনি হাত-পা ধোবেন, জলপান করবেন, তারপর কথা বলবেন, এটাই তো স্বাভাবিক! কিন্তু শুধুমাত্র সেটুকুই নয়, জলপূর্ণ ঘটিটি সামনে রাখলে যিনি অতিথি, তিনি যদি গৃহস্বামী/ স্বামীনির চেয়ে বয়সে বড় হন, তাহলে গৃহস্বামী অতিথির সম্মুখে ঝুঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন, অর্থাৎ তাঁকে গৃহে আসার আমন্ত্রণ জানান, অতিথি তাঁকে স্বস্তি জানান, গৃহে পদার্পণ করেন। বিপরীত হলে, সেক্ষেত্রে অতিথি গৃহস্বামী/স্বামীনিকে সামনে ঝুঁকে সম্মান প্রদর্শন করেন, গৃহস্বামী/ স্বামীনি স্বস্তি জানান। অর্থাৎ গৃহে অতিথিকে আমন্ত্রণ করলেন। এখানেও সেই রীতিটি মান্য করার জন্যই আদিবাসী যুবক-যুবতীদের কাছে জগমাঝি সেই আবেদন রাখছেন।
শুধু তাইই নয়, যে সকল আদিবাসী মানুষেরা ধর্মান্তরিত হয়েছেন, রীতিনীতি-পূজা-পাল-পার্বণের ক্ষেত্রে তাঁরা কিন্তু তাঁদের সমাজের নিজস্ব রীতিটিই পালন করে থাকেন। আদিবাসীরা গোষ্ঠীবদ্ধতায় বিশ্বাসী, তাই সমাজের নিয়মগুলি কঠোর ভাবে মেনে চলেন। ধর্মান্তরিত আদিবাসী সমাজের মানুষদের দেখেছি তাঁরা বড়দিনে কেক তৈরি করে, নিজেদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে যীশুবাবার জন্মদিন পালন যেমন করেন, তেমনি আদিবাসীদের নিয়মানুযায়ী সোহরাই, বাহা, পাতা পরবেও অংশগ্রহণ করেন। আদিবাসী সমাজের রীতি এবং সমাজের নিয়মগুলি তারা মান্য করেন সকলের মতই। সেক্ষেত্রে ধর্ম তাদের মধ্যে কোন বিধি নিষেধের বেড়া তুলে ধরেনা।
একটা কথা বলা যায় যে, ঠিক এইরকম ভাবে না হলেও এই রীতিটি কিন্তু বর্ণহিন্দু সমাজেও মানা হয়। যদিও বর্তমানে সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়া অনেক আলগা হওয়ার জন্য তা কঠোর ভাবে মানা হয়না। নাগরিক সমাজের মানুষ অতিথিকে অভ্যর্থনা করেন তাঁকে চা-কফি-মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে কিন্তু আসামাত্র জল পরিবেশনের প্রক্রিয়াটি আমাদের মধ্যে নেই। অথচ অবাঙ্গালী পরিবারগুলিতে কিন্তু এই রীতি আছে, দেখেছি। এমনকি খুব শিশু বয়স থেকে তাদের এই শিক্ষা দিতেও দেখেছি। আদিবাসীদের মত তাঁরা হয়ত সামনে জলপূর্ণ ঘটি রেখে ঝুঁকে সম্মান জানান না, কিন্তু গৃহে অতিথি এলে তাঁকে জল পরিবেশন করেন সকলের আগে। এমন কি,বড় বড় দোকান ইত্যাদি অবাঙ্গালী পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও কাস্টমার, অতিথিরা এলে ট্রেতে করে পরিচারকরা জল পরিবেশন করছেন এও দেখা যায়। যে কথাটি বলার, তা হল রীতিটি কিন্তু একই। কোথাও তার কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, কোথাও তা পুরোপুরি মানা হচ্ছে।
দক্ষিণবঙ্গের কিছু কিছু গ্রামে এবং সীমান্তবর্তী ঝাড়খন্ডের কয়েকটি আদিবাসী গ্রামে সমীক্ষা চালিয়ে দেখে গেছে যে গ্রামীণ সমাজের মধ্যেও একটা পরিবর্তন এসেছে। যদিও তা আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রাম, সেখানে গোষ্ঠীবদ্ধতার কারণে প্রায় সকল অঞ্চলেই একই রকম রীতিনীতি মেনে চলার কারণে আদিবাসী নীতি-নিয়মের বড় একটা হেরফের ঘটার সুযোগ কম, তবু সেখানেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বা আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চলে বিভিন্ন বিষয়ে আদিবাসী চেতনার সঙ্গে অন্য প্রদেশ বা অঞ্চলের আদিবাসী চেতনার কিছু পার্থক্য আছে। একটি খুব সাধারণ উদাহরণ দিলে মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি আরো ভালো করে বোঝা যাবে। মেয়েদের বোঝা সহজ কারণ মেয়েরা বেশীর ভাগ গৃহস্থের কাজকর্মে রত থাকেন, পুরুষদের মত বাইরে যাবার সুযোগ কম। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দক্ষিণবঙ্গের মেয়েদের রামায়ণ ইত্যাদি সম্বন্ধে যে জ্ঞান ও কাহিনী সম্বন্ধে চেতনা দেখেছি, সীমান্তবর্তী ঝাড়খন্ড এলাকায় গ্রামের আদিবাসী মেয়েদের মধ্যে এই চেতনা কম, নেই বললেও চলে। অথচ, সেখানকার গ্রামীণ সমাজের বর্ণহিন্দু মেয়েদের মধ্যে পূজা-পাঠ, রামায়ণ-মহাভারত ইত্যদি নিয়ে আলোচনা, পাঠ এসবের যথেষ্ট চল আছে, অনেকাংশে বাংলার গ্রামের মেয়েদের চেয়েও বেশি, কারণ কিছুটা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান অনেক বেশী তারা পালন করেন সেকারণেও তো বটেই। যদিও আদিবাসী সমাজও একপ্রকার পুরুষতান্ত্রিক হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলা ও ঝাড়খন্ডের সীমান্তবর্তী রত্নাতুরা গ্রামে একজন আদিবাসী মহিলা স্বামী যে ‘পরমেশর’ নয়, সেকথা বেশ জোরের সঙ্গে বলেছেন। আদিবাসী সমাজের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মত পরিচ্ছন্নতা এখানেও চোখে পড়ার মত। কিন্তু রামায়ণ-মহাভারত ইত্যাদি বিষয়ে কোনপ্রকার জ্ঞান না থাকার অন্যতম কারণ এখানে বর্ণহিন্দু সমাজ আদিবাসীদের একেবারে আলাদা করে রেখেছেন। বলাবাহুল্য,এই আলাদা হওয়ার কারণ ছোঁয়া-ছুঁয়ি ইত্যাদি কারণে অর্থাৎ অস্পৃশ্যতা, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের পার্থক্য। এই একবিংশ শতাব্দীতেও তার প্রভাব দেখলে বিস্ময় বোধ করি। অন্যদিকে, দক্ষিণবঙ্গের আদিবাসী সমাজের মেয়েরা বর্ণহিন্দু পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ পায়। বিশেষ করে বিভিন্ন অঞ্চলে চাষের সময় নাবাল খাটতে যাওয়া অনেক সময়ই একটা পরিক্রমার মত যা অনেকাংশেই তাদের নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। ঝাড়খন্ড অঞ্চলের সমাজের মেয়েদের কাছে এই পরিক্রমা ও বর্ণহিন্দু মেয়েদের কাছে অচ্ছ্যুত হয়ে থাকার কারণে বাইরের পৃথিবীর দরজা অনেকটাই বন্ধ থাকে।
আদিবাসী সমাজের সবচেয়ে বেশী যে রীতিগুলির সঙ্গে বর্ণহিন্দু সমাজের মিল লক্ষ্য করা যায়, তা হল বিবাহের রীতি। প্রতিটি সমাজ গড়ে ওঠে কয়েকটি পরিবার নিয়ে। পরিবার গঠনের পিছনে আছে সৃষ্টির অমোঘ তত্ত্ব—নারী ও পুরুষের দৈহিক মিলন, সন্তান উৎপাদন ও পরবর্তী প্রজন্মের হাতে পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্বভার অর্পণ যা একটি সুস্থ ও নীতিসম্মত ‘বিবাহ’ নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বিবাহপ্রথার মত প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠী সমাজেরও নিজস্ব একটি বিবাহরীতি লক্ষ্য করা যায়। এই বিবাহ রীতিগুলি সম্ভবতঃ সেই আদিম কাল থেকেই চলে আসছে যা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাতেও সেই সব বিবাহরীতির
কিছু কিছু অনুসৃত হয়। এইসব রীতিনীতি গুলির সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে বর্ণহিন্দু সমাজের বিবাহের রীতির বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়।
বিবাহ এক পবিত্র বন্ধন। তাই আদিবাসী সমাজেও এ বন্ধন অক্ষত রাখার জন্য বিবাহের আচার- অনুষ্ঠানের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি থাকে। আদিবাসীরা অপদেবতায় বিশ্বাসী। তাই দেবতার কোপের চেয়ে অপদেবতার ভয়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নানারকম পূজা-অর্চনা করে থাকেন। তাঁদের মতে বিবাহকালই হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে উর্বরকাল, সুতরাং এই সময়েই অপদেবতার নজরে পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী। তাই বিবাহের সময় নানা ধরণের আচার-অনুষ্ঠান তারা পালন করে থাকে। আদিবাসীদের বিবাহের সঙ্গে বর্ণহিন্দু সমাজের বিবাহ প্রথার অনেক মিল দেখা যায়। একটি একটি করে সেগুলি আলোচনা করা যাক।
বিবাহ উৎসবের শুরুতেই বর্ণহিন্দু বা আদিবাসী উভয় সমাজেই ব্যবহৃত হয় মঙ্গলঘট। জলপূর্ণ কলস রাখার রীতি বিবাহের আচারের মধ্যে পড়ে। অনেকসময় গৃহে ঢোকার মুখে এই কলস স্থাপিত হয়, আবার অনেক সময় বিবাহস্থানে এই কলস স্থাপন করা হয়। আদিবাসী সমাজের অন্তর্গত সাঁওতাল সমাজে এই জলপূর্ণ কলসকে বলে ‘সৌগুন ঠিলি’। বর্তমান কালেও আদিবাসী সমাজে জলপূর্ণ কলস কোন নতুন গৃহে বসবাসের আগে সেখানে রেখে আসা হয়। যদি কলসের জল শুকিয়ে যায়, সেই গৃহ বা স্থানটি অশুভবলে তারা মনে করেন। এমন কি বিচার সভায় কিংবা গ্রামের পাঁচজনে আলোচনার সময়ও এক ঘটি জল সামনে নিয়ে বসা তাদের রীতি।
ধান এবং দূর্বার ব্যবহার বিবাহের আরো একটি প্রধান রীতি। দূর্বাঘাসের ফলন অধিক, তা জলকে ধরে রাখতে অর্থাৎ নরম রাখতে সাহায্য করে। ধান গাছের অধিক ফলনশীলতার কারণে বিবাহের একটি প্রধান আনুষ্ঠানিক দ্রব্য হিসাবে ব্যবহৃত। বস্তুতঃ ধান এবং দূর্বা উভয়ই প্রজননক্ষমতা বৃদ্ধি ও সন্তান-সন্ততি লাভের একটি রূপক হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং বিবাহ ব্যতিরেকে আর কি ভালো অনুষ্ঠান থাকতে পারে যেখানে এগুলি ব্যবহাড় করার। বর্ণহিন্দু সমাজে বিবাহে ‘কনকাঞ্জলি’ নামে একটি রীতি আছে যেখানে পিতৃগৃহ থকে যাবার সময় কন্যার মাতাকে তাঁর আঁচলে কন্যা ধান দুহাত ভরে ধান দেন, মাতা সেটি গ্রহণ করেন। নেকেই এই রীতিটির ভুল ব্যাখ্যা করে থাকেন। এটিকে কন্যার পিতৃগৃহে এতদিন থাকার জন্য মাতা-পিতার ঋণ পরিশোধের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্ত প্রকৃতপক্ষে এটি বিবাহের পরেও পিতৃগৃহে যাতে ধনসম্পদের প্রাচুর্য্য থাকে ,কন্যার ধান প্রদানে সেটিই ইঙ্গিত করে। কন্যা পিতৃগৃহ থেকে শ্বশুরালয়ে পদার্পণের সাথে মাথার উপর ধান রেখে তা ছড়ানো হয়। ইঙ্গিত স্পষ্ট।কন্যার আগমনে গৃহ ও পরিবার যেন প্রাচুর্যে ভরে উঠুক,এ ইঙ্গিত তারই। আদিবাসী সমাজেও এই দুটি রীতিই পালন করা হয়ে থাকে। আদিবাসীরা যদি আদিম অধিবাসী বলে আমরা মনে করি, তাহলে নিশ্চিত যে, এই রীতিগুলি সেখান থেকে বর্ণহিন্দু সমাজে এসেছে।
ধান-দূর্বার মত হরিদ্রা বা হলুদও একটি বিবাহের আচারের বাধ্যতামূলক দ্রব্য। অনেকেই জানি,হলুদ কীটনাশক। যে কারণে বিবাহের পূর্বে হলুদ মাখিয়ে স্নান করার রীতি আছে,যে রীতিটিই গায়ে-হলুদ নামে পরিচিত। আদিবাসী সমাজেও এই রীতিটির প্রচলন আছে।
আর একটি বিশেষ রীতির কথা যা না বললেই নয়, তা হল আমপাতার ব্যবহার বা আম্রপল্লবের ব্যবহার। যে কোন পূজায় বর্ণহিন্দুদের ঘটের উপর আম পল্লবের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। এর দুটি দিক আছে। একটি হল আমগাছ মঙ্গলদায়ক, অশুভনাশক। তাই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব কাজেই এই পাতার ব্যবহার হয়। আর একটি বড় কারণ হল, আম গাছ দীর্ঘজীবনী শক্তির পরিচায়ক। সে কারণেই বিবাহ ইত্যাদি কোন শুভ কাজে আম পাতার ব্যবহার করা হয় দীর্ঘজীবন কামনা করে। বিশেষতঃ বিবাহের পাত্র-পাত্রী ও ভবিষ্যত প্রজন্মের দীর্ঘজীবনের কামনায় আমপাতার ব্যবহার বিবাহের একটি প্রধান রীতি।
এছাড়াও আদিবাসী সমাজের আরো একটি প্রধান রীতি বর্ণহিন্দু সমাজে অনুসৃত হয়, তা হল সপ্তপদীগমন। আদিবাসী সমাজেও এই রীতিটি পালন করা হয়ে থাকে। সাত সংখ্যাটি শুভ সংখ্যা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তাই সকল ক্ষেত্রেই আমরা সাত সংখ্যাটি যেমন সাত সমুদ্র, সপ্ত ঋষি ইত্যাদি ব্যবহার করি। কিন্তু এছাড়া মূল যে কারণটির জন্য সাত বার প্রদক্ষিণ করা হয় বা সপ্তপদীগমন কথাটি এসেছে তা হল, হিন্দু সমাজে সাত পুরুষ পর্য্যন্ত রক্তের সম্পর্ককে স্বীকার করা হয় এবং সে কারণেই আমরা সাত জন্মের তপস্যা, সাতজন্ম যেন একসঙ্গে থাকা ইত্যাদি কথাগুলি বলে থাকি। বিবাহের সপ্তপদী গমনের সঙ্গে সাতপুরুষ যেন সন্তান-সন্ততি নিয়ে বিবাহিত জীবন কাটানো যায় তার অঙ্গীকার করা হয়। কারণ সাত পুরুষ পর্য্যন্ত রক্তের সম্পর্কের কারো সঙ্গে বিবাহকর্ম করা হয় না। বিবাহের সময় যজ্ঞবেদীর উত্তর কোণে সাতটি মন্ডলের আলপনা দেওয়া হয়, তার উপর পান ও সুপারি থাকে, বর ও বধূ সেই সাতটি মন্ডল এক এক করে একতসঙ্গে অতিক্রম করেন। এই সাতটি মন্ডলই কি সাত পুরুষ? প্রশ্ন জাগে। আদিবাসী সমাজেও এই রীতিটি পালন করা হয়ে থাকে, বিশেষতঃ সাঁওতাল সমাজে সাতপুরুষ পর্য্যন্ত রক্তের সম্পর্কে কোন বিবাহ কার্য হয় না।
আদিবাসীরা প্রাণবাদে বিশ্বাসী, তাই প্রকৃতি পূজায় তারা বিশ্বাস করেন। প্রকৃতির যে কোন বস্তুতেই প্রাণ আছে বলে তারা মনে করেন। গাছ, পাথর,পাহাড়,সমুদ্র সকলই তাদের কাছে দেবতার ন্যায় প্রাধান্য পেয়েছে। একটা কথা অস্বীকার করা যায় না, এই যে বিভিন্ন ব্রত, লৌকিক পূজা ইত্যাদি আমাদের বর্ণহিন্দু সমাজে আছে, তার প্রায় সবটাই আদিবাসীদের কাছ থেকে এসেছে এবং এখনও এই আধুনিক সমাজেও সেই সব আচার-অনুষ্ঠান পালিত হচ্ছে। নানা ধরণের বার-ব্রতই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্য যে কোন সংস্কৃতির মতোই সর্বপ্রাণবাদী, প্রকৃতিপূজারী আদিবাসীরা অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে হয়ত কখুও গ্রহণ করেছেন কিংবা করতে বাধ্য হয়েছে, কিন্তু মূল সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিয়ে তারা কখনই নিজেদেরকে বিলিয়ে দেননি। তথাকথিত আর্যস্তরের মানুষগুলির কাছে পরাজয় স্বীকার করলেও তাদের দ্বারা উদ্ভুত বর্ণাশ্রম প্রথাকেও তারা মেনে নেয়নি।, বর্ণাশ্রম প্রথার বাইরে গিয়ে আদিবাসী সাঁওতাল, ওঁরাও, মুন্ডা ইত্যাদি গোষ্ঠীগুলি নিজেদের স্বতন্ত্র সত্ত্বা টিকিয়ে রেখেছেন। প্রকৃতির সন্তানরা প্রকৃতিকেই জানেন প্রকৃত রক্ষক বলে, তাই প্রকৃতিই তাদের সবচেয়ে আপনজন, প্রাকৃতিক সম্পদই তাদের প্রধান ভরসা।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে রামায়ণে উল্লেখিত কিষ্কিন্ধ্যা পর্বের কথা। এ এক অতি প্রয়োজনীয় অধ্যায়। গবেষণায় যারা আগ্রহী, তাদের জন্য রয়েছে অসংখ্য ইঙ্গিত, অজস্র সংকেতময়তা। কিষ্কিন্ধ্যা কান্ড রামায়ণের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এই কারণে, এখানে রাম মিলিত হচ্ছেন আদিবাসী নেতৃত্বের সঙ্গে। এখানে আদিবাসী বীরদের নাম উল্লেখিত হয়েছে,শুধুমাত্র বানর সেনানী বলে তাদের অভিহিত করা হয়নি। রাম এখানে পথিক। তিনি পায়ে হেঁটে হেঁটে সংযোজিত করছেন বিভিন্ন প্রান্তিক ও আদিবাসী বীরদের। আর রয়েছে ভারতের বিশাল বনজ সম্পদের কথা। আদিবাসীরা যে অরণ্যের অদিবাসী, বাল্মীকি তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছেন। দীর্ঘ পরিশ্রমের পর আদিবাসী বীরদের একত্রিত করে রাম অগ্রসর হচ্ছেন। এই যে আদিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা, সেটা তাদের গুণের জন্য। বাল্মীকির মত কবি উপলব্ধি করেছিলেন, সমগ্র ভারতের আধিপত্য পেতে গেলে প্রয়োজন অরণ্যচারী আদিবাসীদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা, সততা ও প্রেরণা। শুধুমাত্র আর্যস্তরের মানুষগুলির শিক্ষা দিয়ে হবে না। তাই কিষ্কিন্ধ্যা কান্ড আদিবাসী গুণে ভরপুর।
আদিবাসীদের রীতিনীতি যেন অনেকটাই বৈদিক যুগের রীতিনীতি, যেখানে প্রকৃতির সকল বস্তুকেই পূজা করা হচ্ছে দেবতাজ্ঞানে। বস্তুতঃ ধর্মের আদিরূপটিও তো তাইই। আদিবাসীদের চেতনায় সেই আদিম রূপটি থেকে গেছে এখনও। তাই তারা দেবতার কাছে প্রার্থনা করেন--এই পৃথিবী শস্যশ্যামলা হোক, পরিপূর্ণ হোক ফসলে, গাভীরা দুগ্ধ দান করুক, নদীগুলি জলপূর্ণ হোক, সন্তান-সন্ততিতে পূর্ন হোক এই পৃথিবী, নারীরা গর্ভবতী হোক...
মারাং বুরুর পূজা লাগে জাহের থানে
পিটূলির গোলা দিয়ে জাহের থানে বিন্দু আঁকে
হাড়িরাম সোরেন।
বিন্দু থেকেই সৃষ্ট এই পিথিবী
চেতনায় কাজ করে
বুড়াবাবার কথা
মুরগী বলি দেয়
রক্ত আর চাল গুঁড়া লেপে দেয় মাটিতে
তারপরে হাঁক দেয় হাড়িরাম, এই গাঁয়ের নাইকে,
মাটিতে লেপা পিটুলি গোলার দিকে একবার চেয়ে
আকাশ পানে চায়---
পূজা লাও, পূজা লাও হে বাবা,
পিথিবীকে বাঁচাই রাখ
আমাদিগে বাঁচাই রাখ, ছেল্যাদিগে বাঁচাই রাখ
জল দাও...জমিন দাও
ই জায়গা-জমিন,গাই-বাছুর, খেতি-বাড়ি, ছেল্যাপুল্যা সব বাঁচাও হে
পূজা লাও...পূজা লাও হে বাবা মারাং বুরু......’ এক কাতর আর্তি ফুটে ওঠে হাড়িরামের কন্ঠে সুন্দর পৃথিবীর জন্য। আমাদেরও প্রার্থনা এক শস্যশ্যামলা পরিপূর্ণ পৃথিবীর।
chatterjee.jharna@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন