ভাঙা জানলার পাল্লা বেয়ে শনশন শব্দে রুক্ষ হাওয়া পাল্টি খাচ্ছে। এই শব্দটাই তার অবচেতন মনকে খুশির জলে সিঞ্চন করেছিল। কান্তি স্বপ্ন দেখছিল। পশ্চিম আকাশে এক খন্ড মেঘ। কালো হয়ে, ক্রমশ সারা আকাশটাকে ঢেকে ফেলল। তারপর বৃষ্টি শুরু হল ঝমঝম শব্দে। প্রকৃতির সারা তৃষ্ণা মিটিয়ে কলকল বেগে বইতে লাগল তার দূর্বার ধারা।
আনন্দে নেচে উঠেছে সবাই!
কান্তি আবছা আলোয় বাইরে বেরিয়ে এল। পাতলা জ্যোৎস্নায় ধোঁয়ার মত মেঘগুলো সারা আকাশজুড়ে পাঁক খেয়ে বেড়াচ্ছে। কোন আশা নেই। সারা সন্ধ্যেটা সে খাটুলির উপর শুয়েছিলআকাশটার দিকে তাকিয়ে।যেই একটু আশা জাগছিল।অ মনি রাক্ষসী হাওয়া, ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিচ্ছিল সেই মেঘ।
কোথায় যেন একটা নিম্নচাপের খবর এসেছে। সেই কারণে, টানা একমাস কাঠফাটা রোদ্দুরের পর আকাশে কালো মেঘের দেখা পাওয়া গেছে। তার মোট সাড়ে তিন বিঘে ক্ষেত। সমস্ত জায়গাতেই ধানের চারা পুঁতে ফেলেছে। প্রকৃতি সহায় ছিল। তাই জলের অভাব পড়েনি।
মনে তখন অনেক আশা! মায়াও কোমর বেঁধে স্বামীর সাথে মাঠে নেমে পড়েছিল। আগের বছরের রাখা ধানটুকু বেচে দিয়ে সেই টাকায় ট্রাক্টর ভাড়া আর সারের দামটা কোনরকমে মিটে গেছিল।এ বছর দ্বিগুন ধানের আশায়,মনটাও খুশি ছিল।
তারপর সেই যে আকাশটা নীল হয়ে গেল।আর কিছুতেই কালো মেঘের আগমন ঘটল না। সূর্য যেন আগুন ঝরাতে শুরু করল! ...দিন দশেকের মধ্যেয় কাদা খেত শুকিয়ে গেল।
যাদের জমির সামনে জলের ব্যবস্থা আছে তারা এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে ধানগুলো। কান্তির সমস্ত জমিটায় বাইদ আর কাঁনালি। সামনে পুকুর ডোবা নেই। জল আনতে গেলে সেই বড়বাঁধের বুক থেকে পাম্প চালাতে হবে। সে তো অনেক খরচের ব্যাপার! নিজস্ব পাম্প সেটও নেই। আর আর্থিক সঙ্গতিও শেষ।এই অবস্থায় কারো কাছে হাত পেতে কিছু চাইলেও দিতে চাইবে না। সবাই সাবধান হয়ে গেছে।
প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নেয়, তখন আপন মানুষগুলোও ছাড়ে না। যে ধানটুকু মজুত ছিল চাষের সময় বিক্রি না করলে, সারা বছর পেটের ভাতটুকু অনায়াসে জুটে যেত।এত চিন্তা হত না। প্রকৃতি যে তার উপর এমনভাবে চালাকি করবে একবারও ভাবেনি। চারা যা পুঁতেছিল তার অর্ধেক জ্বলে,পুড়ে শেষ। বাকিটুকু কোনরকমে ধুকছে। এই শেষ আশা। যদি প্রকৃতি সদয় হত অন্তত খাওয়াটুকু জুটে যেত। আর কোন আশা নেই।
কান্তির চোখের জল শুকিয়ে গেছে। ক্ষেতের আলে বসে অনেক কেঁদেছে মরা ধান গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে। নোনা জল যদি ধানের চারা সহ্য করতে পারত তাহলে সে দিনরাত ক্ষেতের মাঝে বসে,বসে কাঁদতো।তবু যেন তারা বেঁচে থাকে। সে উপায়ও নেই।
এখন তাই আর চোখ দিয়ে জল গড়ায় না। মাঝে,মাঝে হৃদয়টা আর্তনাদ করে ওঠে। গলার কাছটাই একটা শুকনো ঢেলার মত শ্বাসবায়ূ জমাট বাঁধতে শুরু করে। নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসে। এ এক কঠিন যন্ত্রণা!
মায়া কিন্তু একদম কাঁদে না। এই তো একমাস আগেকার কথা। মায়া কাদা ক্ষেতে স্বামীর সাথে চারা পুঁততে গিয়ে কত রকম আশায় বুক বেঁধে ছিল।এ বছর নতুন ধানের টাকা জমিয়ে মিতিনের জন্য আর এক জোড়া ইস্কুল ড্রেস বানাতে দেবে। বেচারার একজোড়া মাত্র জামা,প্যান্ট। বর্ষায় জলে ভিজে গেলে শুকোয় না। তখন বাধ্য হয়ে বাড়ির পুরনো জামা পরে যেতে হয়। মাষ্টারমশাইরা রাগ করেন। সেইজন্য মিতিনও রাগ দেখায়। কেঁদে,কেঁদে বলে ওঠে তার সকল বন্ধুদের নাকি দুজোড়া ড্রেস আছে।একমাত্র তারই একজোড়া।
ও আর কী করে বুঝবে? ...অসহায়তা কত বড় রাক্ষস! সব সুখের স্বপ্নগুলোকে চিবিয়ে খেয়ে নেয়। আর তারা বুঝতেও দিতে চায় না। আপ্রাণ চেষ্টা করে অন্তত একমাত্র ছেলেটার গায়ে অভাবের আঁচটা যেন না লাগে।
মিতিন এ বছর সেভেনে উঠেছে। বই,খাতা,পেন্সিল যা দরকার সবটাই কান্তি নিজে গিয়ে দোকান থেকে এনে দিয়েছে। আগে একজোড়া রাবারের হাওয়াই চপ্পল পরে ইস্কুলে যেত। এখন ভালমত ফিতে লাগানো দামি কম্পানির একজোড়া প্লাস্টিকের চপ্পল উপহার দিয়েছে।তাই দেখে মিতিনের কী খুশি! চোখে,মুখে ধরে না।
কদিন তো চপ্পলজোড়াটা মাথার নিচে রেখে শুতে যেত। পাড়ার একজন ভয় দেখিয়ে বলেছিলেন বাইরে রাখলে চোর নিয়ে চলে যাবে।সেই থেকে মিতিন চপ্পলদুটোকে একদম চোখের আড়াল করে না।
কান্তি ভেবেছিল।ভাল মত ফসল উঠলে এবছর মায়াকে একট রুপোর হার বানিয়ে দেবে। গলাটা বড্ড ফাঁকা লাগে। ঈশ্বর বোধহয় তখন অলক্ষ্যে দাড়িয়ে মিটিমিটি হেসে ছিলেন! তিনি তো অন্তর্যামী।না হলে কেন তখন সাবধান করে দেননি?
এমন বেহায়া স্বপ্নগুলো তো দেখত না।
কান্তির এখন মনে হয়। সে যেন হেরে গেছে কঠিন এই সংসার যুদ্ধে। কোন আশার আলো তো চোখে পড়ে না। স্ত্রী,সন্তানের মুখে খাবার না জোটাতে পারলে সে কেমন পুরুষ? তাদেরকে অনাহারে রাখার থেকে মরে যাওয়া তো অনেক ভাল ।কম সে কম তাদের চোখের যন্ত্রণা তো দেখতে হবে না। সে পারে না। প্রতিবার মায়া আর মিতিনের নিষ্পাপ মুখের ছবিদুটো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সে যদি মরে যায় কে দেখবে তখন তাদের? সে যে মরেও শান্তি পাবে না।
কান্তি নিজেকে বোঝাল। না,আর সে বসে থাকবে না। অনেক হল আকাশ আর মাটির দিকে তাকানো। এবার সে বিকল্প রোজগারের চেষ্টা করবে। দরকার হলে দিন মজুরির কাজে বেরোবে। তবু ছেলে,বউকে অভুক্ত রাখতে পারবে না।
পরের দিন সকালে উঠেই কান্তি ছেঁড়া লুঙ্গিটাকে হাঁটুর কাছে ভাঁজ করে গামছাটা কোমরে জড়িয়ে বলে উঠল,আমি কাজে বের হচ্ছি।সেই সন্ধ্যেয় ফিরব। আমার ভাত করার দরকার নেই।
মায়া অবাক হয়ে বলে উঠল,সেকি কথা! হঠাৎ কাজে বের হচ্ছো।কোথায়?
- দেখি রমানাথদের বলে।ওরা সবাই দল বেঁধে জোগাড়ীর কাজে বের হয় দূর্গাপুরে।ওদের সাথে গেলে আমারো একটা কিছু জুটে যাবে।
- হ্যাঁ গো পারবে তো? একে তো তোমার হাঁপানির ধাত আছে।ওসব কাজে তো সিমেন্টের গুড়ো ধরবে নাকে। বরং অন্যকিছুর চেষ্টা করো নাগো।
- না..না। সেরকম কিছু হবে না। দেখি না কয়েক দিন গিয়ে। অসুবিধা হলে তখন ভাবা যাবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়েই কান্তির সাথে সুবলের দেখা হয়ে গেল। প্রকৃতির করাল ছোবল সবার ঘরেই পড়েছে।কিন্তু এদের চোখে, মুখে সেই যন্ত্রণাটা দেখা মেলে না। তার মতো কয়েকজন অসহায় মানুষই যেন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকি সুবলদের মত চাষিরা কিন্তু মিটিমিটি হাসে। তারা অবশ্য ফসলের থেকে বেশি পার্টির খবর রাখে।তাই বোধহয় এই দুর্দিনেও অন্যের সাথে চিবিয়ে,চিবিয়ে কথা বলতে পারে। কান্তি শুনেছে, তারা জমির কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে ফসলের বীমা কার্ড করে রেখেছে। তাদের ফসলের ক্ষতিপূরণ সরকার ভরবে। কান্তিকে এসব ব্যাপারে কেউ কোনদিন কিছু জানাই নি।
সারাদিন তো ক্ষেত আগলে বসে থাকতে হয়। বাড়িতে বসে থাকার সময় কোথায়? ধান উঠলে পরেই অল্প,স্বল্প শব্জি,পাতি লাগাতে হয়।শর্ষে বোনার জন্য জমি তৈরি করা। ধান সেদ্ধ করতে জ্বালানি সংগ্রহ।এরকম ছোট,বড় হাজারটা কাজ, তাকে সারাদিন ব্যস্ত করে রাখে।এসবের ফাঁকে আর দেশ,দুনিয়ার খবর সে পাবেই বা কেমন করে? যারা বছর,বছর ভোট চাইতে আসে। তারাও বেশ ফাঁকি দেয়। না হলে আজ তারও ওরকম একটা কার্ড থাকত। তাকে কোন রকম ধরা,ছোঁয়াই দেয় না। না হলে,এতটা দুশ্চিন্তায় পড়তে হত না।
সুবল মুচকি হেসে বলে উঠল,কিরে কান্তি আজ দেখছি উল্টো পথে হাঁটা দিচ্ছিস! ...পূজোর কেনাকাটা করতে বের হচ্ছিস নাকি?
কান্তি নিশ্বাসটা ফস করে ঠেলে বলে উঠল, মায়ের কৃপা আমাদের মত অভাগা সন্তানদের জন্য নেই রে। ওদিকে নেতারাও ফাঁকি দিল।বাঁচার সব রাস্তাগুলোই তো বন্ধ হয়ে আসছে। যদি কোন রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায়।সেই চেষ্টাই বাড়ি থেকে বের হলাম।দেখি কী হয়?
সুবল বিড়িতে টান দিয়ে বলে উঠল,আরে কান্তি চিন্তা কেন করছিস? আমরা সবাই মিলে জেলা শাসকের কাছে গতকাল গিয়ে ছিলাম।ব্লক পরিদর্শণের জন্য তারা আসছেন। চাল,ডালটা অন্তত পাওয়া যাবে।
কান্তি জবাবে বলে উঠল,কবে দেবে..তার কী কোন ঠিক আছে? ওই মাস কয়েক পর তাও বন্ধ হয়ে যাবে। কিছু,কিছু মানুষদের তো খিদে বেশি। বরাদ্দের সব জিনিস অর্ধেক তাদের পেটেই চলে যায়।আমাদের কথা কী তারা ভাবে বল?
সুবল এবার মুখটা ভারি করে বলে উঠল,এই জন্যই তোর আজ এই দশা। একটু বেশিই বুঝিস তুই। ধারাপাতের বইটা তো তৃতীয় শ্রেণীতেই গিলে ফেলেছিলি। রাম মাষ্টারের একটা বেতের ঘাও কোনদিন খাসনি। তাও কী করতে পারলি জীবনে বল? তোর ওই গা জ্বলা কথার বহর শুনে কেউ আগ বাড়িয়ে ভাল করতে আসে না। নেতাদেরকে একটু মেনে,টেনে চলতে হয় বুঝলি। তবেই কিছু পাওয়া যায়। তা না হলে সেবার ইস্কুলের চাকরিটাও তোর জুটে যেত।অবশ্য এসব কথা তোকে বলা মানে বেকার। যা এবার নিজের কাজে। আপোষ করতে না শিখলে তো বোঝা বইতে হবেই ভাই। দ্যাখ যদি কাম,ধাম কিছু জোটাতে পারিস।
সুবলের কথাগুলো অবশ্য একদম ফেলে দেওয়ার মত নয়। কান্তি সত্যিই পড়াশুনোই ভাল ছিল। তার বাবার সে ছিল একমাত্র সন্তান।সে তখন ওই বছর তিনেকের ছিল হয়তো।তার বাবা বজ্রাঘাতে মারা যান। বাবাকে তার মনে পড়ে না। কোন কালে নাকি জমি,জমার একটা বিবাদ ঘটেছিল। সেই সুবাদে এক কপি ফটো বাড়তি তোলা হয়েছিল,বলেই কান্তি তার বাবাকে চিনেছে। তার বাবার মুখের পুরো আদলটায় তার মধ্যে ফুটে উঠেছে।তিনিও নাকি পড়াশুনোই ভাল ছিলেন।তবে পড়ার সুযোগ পাননি।প্রাথমিকে বছর তিনেক গিয়ে ছেড়ে দিয়ে ছিলেন।অনেক দূরে ইস্কুল ছিল।কাজের কামাই হত।সে সময় বাড়িতে অনেক কাজ ছিল।গোয়াল ভর্তি গরু,ছাগল,মোষ রাখা থাকত।সেগুলো চরানোর দায়িত্ব কান্তির বাবার উপর বর্তে ছিল। তবে ইস্কুল ছাড়লেও পড়াশুনোটা ছাড়েন নি। কান্তির মা বলতেন,তার বাবা নাকি মহাভারত আর রামায়ণ পড়ে সকলকে তাদের মানেগুলো ভেঙে, ভেঙে বোঝাতেন। গ্রামে যাত্রা হলে সকলের পাঠগুলো আলাদা, আলাদা খাতায় লিখে তিনি তুলে দিতেন ।মুক্তোর মত হাতের লেখা ছিল। ছাপা অক্ষরও হার মানত তার সামনে।
তিনি নাকি তার মাকে সবসময় বলতেন,আমি যা পারিনি আমার কান্তি তা করে দেখাবে। কান্তিকে অনেক দূর লেখাপড়া শিখিয়ে বড় মানুষ করার সাধ ছিল। কান্তি যখন গর্ভে ছিল তখন থেকেই তার বাবা সেই স্বপ্ন দেখতেন।
তার বাবার স্বপ্ন পূরণ করার জন্যই কান্তিকে তার মা,বাপের বাড়িতে রেখে দিয়ে ছিলেন। যাতে ছোট মামার বইপত্তরগুলো নিয়ে পড়াশুনোটা চালিয়ে যেতে পারে। ছোট মামা তার থেকে বছর তিনেকের বড় ছিল।জামা,প্যান্টগুলোও হয়ে যেত।তাছাড়া ইস্কুলটাও ছিল দু কিমি দূরে।সেটাই তখন ছিল কম দূরত্ব। সুবলও তার সাথেই পড়ত।ওর পিসিমার বাড়িতে থাকত।
মাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক আগে তার মামা ঘরের দাদু হঠাৎ মারা গেলেন।কান্তির পড়াশুনোয় ভীষণ ক্ষতি হয়ে গেল। মামারা কেউ তার দায়িত্ব নিতে চাইল না। তবু কোন রকমে কান্তি মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিয়েছিল।দ্বিতীয় বিভাগে উর্ত্তীর্ণও হয়েছিল।কিন্তু আর পড়তে পারল না।
নিজের বাড়িতে পড়াশুনো করা মানে তো বিলাসিতা।তবু বাড়িতেই ফিরে এল।বিশ,তিরিশটা গাই,বাছুরের একটা পাল ছিল।কান্তি তারপর থেকে সকাল,বিকেল ওগুলো নিয়েই ঘুরে বেড়াত।সাথে লাইব্রেরি থেকে আনা একটা না একটা গল্পের বই অবশ্যই থাকত।
তার কয়েক বছর পরই গাঁয়ের পাশে একটা নতুন প্রাইমারি ইস্কুল খুলল।তখন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মদতে চাকরি জুটে যেত।কান্তিরও নামটা উঠেছিল। তখন তার মধ্যে উপন্যাসের সৎ নায়কদের আদর্শ টগবগ করে ফুঁটছিল।
পরিস্কার ভাষায় বলেছিল,তিনজনের মধ্যে লিখিত পরীক্ষা করা হোক।পরীক্ষায় যে বেশি নাম্বার পাবে সেই পাবে মাষ্টারীটা।এভাবে দলীয় কর্মীর দয়াই চাকরি নিলে তো সারা জীবন পা চেটেই কাটাতে হবে। মাষ্টারের সম্মান তো ধূলোয় গড়াগড়ি খাবে! তার থেকে তো আমার রাখালি করা অনেক ভাল।
তার এ রকম কথার চোটে দলীয় কর্মীদের এক অংশ ক্ষুব্ধ হয়েই তার থেকে কম নাম্বার পাওয়া অন্য একজনকে চাকরিটা দিয়ে দেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত কান্তি সেই একই রকমভাবে অন্যায়ের সাথে লড়াই করে চলেছে।আগের মত হয়তো মুখের ভাষাটা এত তীক্ষ্ণ নয়। কথা বলা কমিয়েছে। তবে প্রতিবাদী মনোভাবটা ভেতরে ঠিক জীবন্ত আছে। অন্যায়ের সাথে আপোষ করে চলা হোক বা অন্যের পায়ের তলায় দাসত্ব করা কোনটাই তার ধাতে শয় না।
নিজের যেটুকু জমি আছে শরীরের সব শক্তিটুকু দিয়ে সেই মাটির সাথে যুদ্ধ করে প্রাপ্য ফসলটুকু জোগাড় করে নেয়।তাই দিয়ে তিনটে প্রাণীর অন্ন,বস্ত্রটুকু জুটে যায়।এবারো তার অন্যথা হত না। বাঁধ সাধল প্রকৃতি নিজেই।যার উপরে তারও কিছু করার নেই।
বছর তিনেক আগে তার মা মারা যান।যেটুকু টাকা জমে ছিল খরচা হয়ে যায় শ্রাদ্ধ,শান্তির কাজে। না হলে কান্তি এত সহজে দমার পাত্র না।
#
আজ দিন সাতেক হল।কান্তি রমানাথদের সাথে দূর্গাপুরে দিন মজুরির কাজে বের হচ্ছে। প্রতিদিন রাজমিস্ত্রিদের সাথে কাজ জোটে না। তখন বড়,বড় আয়রন ফ্যাক্ট্রির ঠেকেদারকে ধরে গাড়িতে মাল লোডিং-এর কাজ করে।তাদের দলে মোট সাতজন রয়েছে।দিনের শেষে ভাগাভাগি করে মোটামুটি শ দুয়েক জুটে যায়। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়। দরদর করে সারা শরীর বেয়ে ঘাম ছুটে। কান্তির তো হাঁপ ধরে আসে।ঘন,ঘন বসে পড়ে।
সেই দেখে একদিন মোহন তার পিঠ চাপড়ে বলে উঠল,আরে কান্তি এভাবে বসে পড়লে চলবে?একঘন্টার মধ্যে গাড়িটা লোড করতে পারলে কিছু বক্সিস জুটবে রে।চল...চল..পা চালা। এই বক্সিসটা না পেলে আমরা নিজেদের গাড়িগুলোই তেল ভরব কী করে?
তুই তো কখনো তেল ভরবি না।তাই এই অবস্থা!রোজ বলি।চল মেরে আসি দু গ্লাস করে।তখন তো যাস না। সেইজন্য তোর দমও শেষ হয়ে যাচ্ছে।আরে ভাই এসব ভারি কাজে টাকা রোজগার করতে হলে অল্প,স্বল্প বাংলা পেটে ঢালতে হয়।
কান্তি গামছা ঝেড়ে দাড়িয়ে বলে ওঠে,কিযে বলিস মোহন।আমি ভাই ওসব জিনিস কস্মিনকালেও মুখে ঠেকায়নি।বমি আসে।তোরাই ভাই ওর মজা পাস।আমার তো গন্ধ শুকলেই গা গুলিয়ে আসে।
- প্রথম, প্রথম ওরকম মনে হয়।নাক দেবে যেই একবার পেটে চালান করে দিবি।তারপর আসল মজাটা পাবি।
- আমার ভাই বেশি মজাই কাজ নেই।এই যা আছি।ভাল।চল..চল।
সন্ধ্যাবেলায় ফিরে এসেই কান্তি খাটুলীতে মড়ার মতো শুয়ে পড়ে। মায়া অল্প মতো সরষের তেল হাতে,পায়ে মলে দেয়।
আজ বলে উঠল,শুনেছি এসব কাজে নাকি টিকে থাকতে হলে ওই সব ছাঁই,পাস গিলতে হয়।তুমি তো ছোঁবেও না জানি।তাই কাল থেকে অল্প করে মহুল সেদ্ধ করে দেব।গরম ভাতের সাথে এক বাটি বেঁধে দেব। মিশিয়ে খেয়ে নিও।ওতে ধকল যায়।আজকে বের করে রোদে শুকিয়ে রেখেছি। বড়,বড় দুটো মাটির হাঁড়ি ভরে আছে।আকালের দিনে খেয়ে শেষ না করলে তো শুধু,শুধু খারাপ হয়ে যাবে।
মায়ার কথায় কান্তি শায় দিল।সেদ্ধ মহুলেও অল্প মতো নেশা থাকে।শরীরের পরিশ্রম ভাঙে।
তখন সারা শীতকাল জুড়ে তার মা ঝুড়ি নিয়ে আঙনে বসে থাকতেন।সূর্যের তাপ বাড়ার সাথে,সাথে টুপটাপ করে বৃন্ত থেকে মহুলগুলো মুক্তোর মত মাটিতে ঝরে পড়ত।কান্তির সারা ঘরটা ম ম করত।মহুলের ভাসা,ভাসা গন্ধে।খবর পেয়ে ভ্রমর ছুটে আসত।
আজো সেই গাছটা উঠোনের ধার ঘেষে দাড়িয়ে আছে।এয়া মোটা গুড়ি।বয়সটা অনুমান করা যায় না।
কান্তির কাকা,জেঠুরা গল্প করেন।তাদের ঠাকুর্দার আমলের নাকি গাছ।এখন তো প্রতিবছর ডাল,পালাগুলো ছেটে দেওয়া হয়।তাই পরিসর ছোট হয়ে এসেছে।তখন নাকি চারিদিকে ডালপালা মেলে প্রকান্ড জায়গা জুড়ে ছিল।তখন মহুলও আসত প্রচুর।
বর্ষায় চাষের সময় গোবাদী পশুদের খাওয়ানো হত।বদলগুলোর গা থেকে কাদা ভাঙার পরিশ্রম দূর হত।চেহারা ভাঙত না। গাই,মোষগুলো দুধ দিত বেশি।মহুলে নেশা থাকে।তাই তারাও পরিশ্রমের শরীরে এক বাটি করে ক্ষেতের আলে খেয়ে নিতেন।ছোটদের বেশি দেওয়া হত না।
দক্ষিণ দিকের একটা মোটামত শাখা পাশের বাড়ির পাঁচিল টপকে আঙনের আকাশটা দখল করে বসে ছিল। সেই থেকে প্রায় দুই ঘরে বচসা হত।কান্তির গাছ আর পাশের বাড়ির ঘরে পাতা ঝরছে।মানবে কেন?সেই সময় কান্তি ঠিক করেছিল।গাছটা কেটে ফেলবে।কিন্তু গাঁয়ের অনেকেই ভয় দেখাল।মহুল গাছ নাকি কাটা এখন নিষিদ্ধ।জরিমানা ভরতে হবে।তাই আর কাটা হল না। তবে গাছটার প্রধান শাখাটা লোক দিয়ে কাটানো হল।সেই থেকে গাছটাও যেন ঝিমিয়ে গেল।দিন,দিন যক্ষ্মা রোগীর মত শরীরটা ক্ষয় হয়ে আসছে।নতুন পাতাও আসে না।অভিমান,দুঃখ না গাছটা নিজেকে শেষ করার জন্য এমন হচ্ছে বোঝা মুশকিল।
গ্রীষ্মের দুপুরে আগে ওর ছায়ার নিচে কান্তি শুয়ে থাকত।এখন আর শোওয়া যায় না। নতুন ডাল,পালা গোজানো বন্ধ হয়ে গেছে। সেইজন্য মহুলও কম আসে।দু,তিন বছর ধরে জমা করে অনেকগুলোই হয়ে গেছে। সেভাবে খাওয়া হয়নি বলে রয়ে গেছে। দু বছর হল। বলদ জোড়াটাও ঘুচিয়ে ফেলেছে। তাই খরচ হয়নি। না হলে ওর চারার সাথে অল্প করে মিশিয়ে দেওয়া যেত।
পরের দিন কান্তি দলের সাথে খেতে বসল। নতুন তরকারি আনলে অনেকেই ভাগাভাগি করে খায়। আজ তাই রমানাথ কান্তির কৌটোয় মহুল সেদ্ধর বাটিটা দেখে বলে উঠল,আরে কান্তি আজ তোর বউ এটা কী রান্না করে পাঠিয়েছে রে?
- মহুল সেদ্ধ। নে অল্প।নিবি?
রমানাথ অবাক হয়ে বলে উঠল,বলিস কিরে! ..এখনো এসব জিনিস তোর বাড়িতে আছে নাকি?
- তা আছে।উঠোনেয় তো গাছটা।তাই অল্প,স্বল্প কুড়িয়ে,বাড়িয়ে মায়াই রাখে।
- আরে কান্তি।এগুলো তোর বিক্রি হবে।চড়া দাম পাবি।চল আমার সাথে আজ বাংলা ভাটিতে।কথা করে দিচ্ছি।এ দিয়ে ভাল মদ তৈরি হয়।
সেইমত কাজের শেষে কান্তি রমানাথেদের সাথে বাংলা মদের ভাটিতে পা রাখল। মালিকের সাথে কথা বলা হল।বিশ,পঞ্চাশ কেজি। যতই হোক।নিয়ে নেবে।
পরের তিনদিনে দশ কেজি করে ভাল দরে কান্তি তিনটে চোলায় ঠেকেতে মহুলগুলো ঘুরে,ঘুরে বিক্রি করে জীবনের অনেক বড় অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলল।
দরিদ্রতাকে যেন এতদিন ধরে সে পুষে রেখেছে,মনের ভেতরে।কোনদিন মুক্ত হওয়ার স্বপ্নই দেখেনি।আজ তিনদিন দিনমজুরির কাজ বন্ধ রেখে মাথায় করে মহুয়া বিক্রি করতে গিয়ে নিজের শেকল বাধা পায়ের খনখন শব্দ শুনতে পেল।
এইবার সে মুক্ত হবে।তাই পরের দিন থেকে মায়াকে চাট আর ঘুগনি বানাতে বলল। সেইগুলো সে চোলায় দোকানের পাশে ঘুরে,ঘুরে বিক্রি করে।।মাঝে,মাঝে চা দোকানির কাছে ঘুগনিটা গরম করে নেয়।তারসাথে কিছু শুকনো খাবার আর পাপড়ও রাখে। সন্ধ্যে পর্যন্ত দিন মজুরির থেকে বেশি আয় হয়।হাঁ পও ধরে না।দিন,দিন তার ঘুগনির স্বাদ বাড়তে লাগল। তখন পুরনো একটা হাতভ্যান জোগাড় করল।মিতিন ইস্কুলে গেলে মায়া আর কান্তি একসাথে বেরোয় দূর্গাপুরে।মায়া এক হাঁড়ি ঘুগনি বানিয়েই বাস ধরে বিকেলের আগেই বাড়ি ফিরে আসে।ছুটির দিনে মিতিনও মা,বাবার সাথে চলে যায়।
কান্তি সেদিন মায়াকে বলে উঠল,তোমার হাতের গুণে আমার জীবনটা পাল্টে গেল। মায়া জবাবে বলে উঠল,গুণটা আমার না যত,তার থেকে বেশি উঠোনের মহুল গাছটার।বেচারা যেতে,যেতে আমাদের বাঁচার পথটা দেখিয়ে দিয়ে গেল। ওর ডালটা সেবার কেটে দেওয়াতে খুব আঘাত পেয়েছে মনে,মনে।গাছটার দিকে তাকালে আজকাল আমার কান্না আসে গো।ও আর আমাদের দিকে তাকায় না। ওকে আর বাঁচানো যাবে না। কিছুতেই না।
majimaheshwar@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন