সোমদত্তা বসু ,বনেদি বাড়ির পিতৃহারা বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে এবং সে একটি কলেজের পার্ট টাইম অধ্যাপিকা ,কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে , বেশ দেরী হয়ে গেছে ,তারমধ্যে এই লম্বা বেনুনী বাঁধতে আরো বেশী সময় লাগে , মাঝে মাঝে ওর মনে হয় চুল টা কেটে ছোট করে দেয় কিন্তু লম্বা চুলের মায়া ও ছাড়তে পারেনা। আজকাল সোমদত্তার বাড়িতে সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় টি হলো ওর বিয়ে....
আজ ক্লাসে বেশী স্টুডেন্ট নেই সবাই ছাব্বিশে জানুয়ারির অনুষ্ঠান নিয়েই ব্যাস্ত ... কলেজে সময় টা ভালোই কাটলো ওর ...
পাত্রবাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার দেখা করে গেলেও আবার আগামী কাল আসবে কিছু দরকারী কথা বলতে, তারপরই সামনের সপ্তাহে ওদের পাকা কথা আর তারপরই বিয়ের কার্ড ছাপতে দিয়ে দেওয়া হবে মানে বিয়ের ঘন্টা বেঁজে যাবে। কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসে বসে এইসবই ভাবছে সে , বাড়ি ফিরেই সেই একই আলোচনা আর ভালো লাগেনা ওর , তাই নিজেকে রিলাক্স রাখতে কানে ইয়ার ফোন লাগিয়ে একটু রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে লাগলো ইউ টিউবে। এতোটুকু ইচ্ছে নেই সোমদত্তার বিয়েতে, সে যে বিয়ে করতেই চায় না কিন্তু সাহস হচ্ছে না তার একথা বলার। বাবার মৃত্যুর পর তার জ্যাঠামশাই তাদের অভিভাবক ,কি করে সে জ্যাঠামশাইয়ের মুখের ওপর বারণ করবে ? কিন্তু তাকে যে স্পষ্ট ভাবে না বলতে হবেই। অবশেষে তার শান্তশিষ্ট মায়ের শরণাপন্ন হলো সে ...
-ছাড় আমাকে ,কাজ আছে যে ...
-না আমার তোমাকে এই ভাবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতে ভালো লাগে ।
-কি বলবি রে ?
-ঠিক কতো বার মেয়ে দেখতে এলে মেয়ে দেখা সম্পূর্ণ হয় মা ?
-কেনো এ কথা বলছিস ? কি হয়েছে আজ তোর ? কি বলতে চাইছিস আসলে ?
-তুমি কি করে বোঝো আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই !
-কারণ আমি তোর মা
-মা আমি বিয়ে করতে চাইনা ,আমি কোনদিনই বিয়ে করবো না
-বাজে কথা বলো না, তোমার বিয়ে হলে তোমার একটা গতি হবে , তোমাকে সংসারী দেখে যেতে না পারলে আমি মরেও শান্তি পাবো না , কি জবাব দেবো আমি ওনাকে ওপরে গিয়ে ?
-আর আমার বিয়ের পর যখন এই কলেজের চাকরি ছেড়ে ,বরের সাথে বিদেশে চলে যাবো ,জ্যাঠামশাইরাও যখন দুদিন পর দাদার কাছে দিল্লি চলে যাবে তখন তুমি পারবে তো একা থাকতে ? আর তোমাকে আমি এভাবে একা ফেলে রেখে গেলে , তোমার কোনো বিপদ হলে আমি কি জবাব দেবো বাবাকে ওপরে গিয়ে ?
-সোমা তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না !তোর জ্যাঠামশাইয়ের মুখের ওপরে কথা বলা আমাদের ঠিক নয় , উনি আমাদের ভালোর জন্যই করেছেন ।
-কিসের ভালো মা ? একই ফ্লোরে পাশাপাশি ফ্ল্যাট আমাদের , অথচ কখনো কোনো ব্যাপারে সাহায্য পাইনি ওনার কাছ থেকে , বাবার জমানো পুঁজি ভেঙে , তোমার গয়না বিক্রি করে তুমি পড়িয়েছো ,পাড়ার মাস্টার দাদু না থাকলে আমি এতো টা এগোতেই পারতাম না ।নেহাত দাদুর মুখের ওপরে না করলে জ্যাঠামশাই পাড়া তে ছোট হয়ে যেতেন তাই কিছু আর বলতে পারেন নি নাহলে ওনার আমার পড়াশোনার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিলো না ,কতো কষ্ট করে এই চাকরি টা পেয়েছি আমি ,আর এটা কি মা ? সব ব্যাপারে ওনার কথা শুনতে হবে ,পাত্র পছন্দের ব্যাপারে তোমাদের সবার সাথে আমারও মতামত আছে , কিন্তু উনি কাউর কথা শুনবেন না , উনি যা বলবেন তাই করতে হবে। যেনো উনি পারমিশন না দিলে আমরা জল টুকু খেতে পারবো না
-হ্যাঁ সেটাই ঠিক সোমা ,সব মেনে নে মা তোর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ...
-না এটা ঠিক নয় ,তোমার মুখের দিকে তাকিয়েই আমি এটা মানতে পারবো না , জানো মা আজ কলেজের ছাব্বিশে জানুয়ারির প্রোগ্রামে আমাকে এই প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে একজন ইতিহাসের অধ্যাপিকা হিসাবে প্রিন্সিপল ম্যাম কিছু বক্তব্য রাখার অনুরোধ করেন ,আমার স্পিচের পর প্রচুর হাততালি পড়লো কিন্তু আমার কিচ্ছু ভালো লাগছিলো না মা , নিজেকে হিপোক্রেট বলে মনে হচ্ছিলো , যেনো আমি নিজেই এই স্বাধীন দেশের প্রজা হিসাবে নিজেকে অসম্মান করছি ,নাকি আমাদের মেয়েদের প্রজা হওযার কোনো যোগ্যতা নেই ! যেদেশের কোনো মধ্যবিত্ত বাড়িতে কোনো বিষয়ে মেয়েদের মতামত কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না সেই দেশে প্রজাতন্ত্র দিবসে শুধু হাততালি পাওয়ার জন্যে স্পিচ টা একধরনের হিপোক্রেসি ছাড়া আর কিছু নয়..তাই আমি জ্যাঠামশাই কে গিয়ে এক্ষুনি বিয়ে বন্ধ করতে বলবো
-না মা ওরকম করেনা ,অনেক অশান্তি হবে ,যাস না তুই ,সবাই খারাপ বলবে...
সোমদত্তা ওর মায়ের কোনো কথা না শুনে সোজা গিয়ে ওর জ্যাঠামশাইয়ের ঘরের বেল বাজালো । জেঠিমা এসে দরজা খুলতেই ও ঘরে ঢুকে জ্যাঠামশাইয়ের সাথে কথা বলতে চাইলো ।
-বলো কি বলবে
-আমি বিয়ে করতে চাইনা জ্যাঠামশাই।
-কি !
-হ্যাঁ আমি জীবনে কোনদিনই বিয়ে করবো না ।
-কলেজে দু পাতা লেকচার পড়িয়েই সব কিছু বুঝে গেছো না ! তোমাকে বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়ে গেছে , বেশি কথা বলোনা , চুপচাপ থাকো আর বিয়ের পিঁড়িতে বসো , ভুলে যেওনা সমাজে আমার একটা মান সম্মান আছে ।
-প্রথমত,আমাদের সংবিধানে বাক্ স্বধীনতা সকলকেই দেওয়া হয়েছে ,আর আমি তো প্রাপ্ত বয়স্কা, আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক,কিন্তু স্বাধীনতা কোনদিন দেখাইনি তবে আজ দেখাবার প্রয়োজন পড়লো। আর দ্বিতীয়ত আমরা তো তোমার সম্মানের কথা ভেবেই চুপ করে আছি এতদিন ধরে , বাবার মৃত্যুর পর মা বাবার চাকরি টা করতেই পারতো , মায়ের পুরো যোগ্যতা ছিলো। কিন্তু তুমি চাও নি বাড়ির বৌ চাকরি করুক ,আর সবাইকে বলেছো মায়ের কোনো যোগ্যতা ছিলোনা , আমি কিন্তু মা বা জেঠিমা নই যে তোমার সব কথা চুপচাপ মেনে নেবো তাই আমাকে একদমই জোর কোরো না বিয়ে নিয়ে ।
সোমদত্তার জেঠিমা হটাৎ ওকে জড়িয়ে ধরে বললো ...
-পাগলী সংসার করবি না ?
-করবো তো সংসার,আমি মায়ের সাথে সংসার করবো ,জানি মেয়েদের মত প্রকাশ কে ঠোঁট কাটার আখ্যা দেওয়া হয় আর এই স্বভাবের জন্যে সবচেয়ে বেশী দ্বায়ী মেয়েদের মা কেই করা হয় তবুও যে যা ভাবুক , যে যা বলুক তোমরা আশীর্বাদ করো শুধু আমাদের আমরা যেনো ভালো থাকি আর খুব ভালো সংসারী হই আমি। ভালো থেকো তোমরা ,আসি ....
#
সেদিন সোমদত্তার বদমেজাজী জ্যাঠামশাই প্রচন্ড রেগে থাকলেও কিছুই বলতে পারেন নি আর। এরপর বলাই বাহুল্য যে ওদের সাথে জ্যাঠামশাইদের যোগাযোগ একরকম বন্ধই হয়ে যায় , মায়ের সব অভিমান অনুযোগ কাটিয়ে তুলতেও সোমদত্তার বেশ সময় লাগে। তবুও ওর মা একবার ওকে বলেছিলো "আমি না থাকলে তোর কি হবে সোমা ? " তখন সোমদত্তা ওর মা কে জড়িয়ে ধরে হেসে বলেছিলো --
--আর একটু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিই মা তারপর কোনো এক বাচ্চা মেয়ে কে দত্তক নিয়ে আমি সিঙ্গল মাদার হয়ে যাবো ,পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনো পুরুষ কে আমি বিয়ে না করলে মা হতে পারবো না এ কথা এ যুগে ভাবা ভুল , জানি এই ব্যপারটা ও এতো সহজ নয় তবে তুমি পাশে থাকলে সব কিছুই সহজ হয়ে যাবে। দেখবে মা আমরা তিনজনে মিলে আরো ভালো থাকবো , খুব মজা হবে , সবার মতামত কে গুরুত্ব দেওয়া হবে আমাদের এই সুন্দর প্রজাতান্ত্রিক সংসারে , সত্যি করেই ভালো থাকবো আমরা.....॥
anushreebhattachrjeemukherjee@gmail.com
1 মন্তব্যসমূহ
খুব ভাল লাগল
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন