হাতিয়া এক্সপ্রেস রাঁচি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম ছুঁতেই নেমে পড়লাম আমরা। বেশ অনেকটা ব্যাগ টেনে পৌঁছালাম প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে। তারপর ওভারব্রিজ পেরিয়ে ওপারে। ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা প্রায়। একটা তরতাজা চনমনে স্টেশন। অসংখ্য ট্যাক্সি,অটো। আমাদের প্রথম দিনের গন্তব্য নেতারহাট। আগেই শুনেছিলাম, স্টেশন থেকেই ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় নেতারহাট। এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের কাছে জানতেই সে বলল, যাওয়া-আসা মিলিয়ে চার হাজার টাকা নেবে। কিন্তু সমস্যা হলো আমরা আর এপথে ফিরবো না। আমাদের ভ্রমণসূচী অনুসারে নেতারহাট থেকে বেতলে সেখান থেকে রাঁচি। ট্যাক্সি ড্রাইভারই সমস্যার সমাধন করে দিলেন।জানালেন, স্টেশন থেকে অটোতে বাস স্ট্যান্ড চলে যেতে, সেখান থেকে ভালো বাস প্রতিদিন নেতারহাট যায়। তবে তাই হোক, বলে একটা অটো ঠিক করলাম। সকালের ব্যস্ত, চলমান রাঁচি শহরের মধ্যদিয়ে ছুটে চলল অটো। নেতারহাটের কথা শুনেই অটোওয়ালা আপ্লুত হয়ে প্রসংশা করতে লাগলেন। বললেন, ‘দুনিয়ামে যাঁহা ভি যাউ,ইতনা আচ্ছা সানরাইজ নেহি দিখনে মিলেগা কভি। উঁহা তো মানো বগল সে নিকলে গা সূরিয়’।
ওনার কথা শুনতে শুনতেই একটা কল্পনার ছবি যেন আঁকা হয়ে যাচ্ছিল মনে। প্রায় আটটার দিকে পৌঁছালাম বাস স্ট্যান্ড। বাস দাঁড়িয়ে আছে দেখে অটো ড্রাইভার নিজেই ব্যাগ গাড়িতে তুলে দিলেন। গতরাতে প্রায় আটটায় খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, পেটে ছুঁচো দৌড়ানো শুরু করেছে। সামনেই একটা পুরীর দোকানে সবে খাবো বলে ঢুকেছি,এমন সময় বাস হর্ণ দিতে শুরু করলো। একদিকে খাবার থালা আরেক দিকে বাসের হর্ণ, দু’দিক থেকে দুজনের ডাকে পুরো কনফিউজড তখন। ভাবলাম পরের বাসে যাবো তবে,কিন্তু কপালে খাবার না থাকলে যা হয়;সেদিন ঠিক তাই ঘটলো। জানলাম, এই আটটার বাসের পর আবার দুপুর দুটোতে বাস আছে নেতারহাট যাওয়ার। কি আর করা অগত্যা খালি পেটেই চেপে বসলাম বাসে। মনে মনে ভাবলাম, পথে কোথাও বাস দাঁড়ালে খেয়ে নেবো কিছু। যেহেতু দূরত্বের জার্নি,তাই বাসের সিটগুলো বেশ আরামদায়ক। এ যাত্রায় আমরা তিনজনই ( আমি, বর আর ছোট্ট ছানা অনুরাগ। মাত্র তিন তখন তিনি)। বাস শুরু করলো ছোটা। দু’তিনটি বিস্কুট খেয়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যে অনুরাগও শুরু করলো বমি করা। বাস শহর ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে নির্জন পথে।প্রতিটি স্টপে দু’একজন নামছে আবার উঠছে। বেশির ভাগই দেহাতি লোকজন। আর আমাদের চোখ ঘুরছে খাবারের দোকানের সন্ধানে। হতাশ হয়ে আবার শুরু করছি অপেক্ষা পরের স্টপের জন্য। এদিকে দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকায় ক্রমশ মাথার দু’পাশে ধরে থাকা চিনচিনে ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। প্রায় ঘন্টা চারেক চলার পর বাস এসে দাঁড়ালো একটা নির্জন গ্রামের পথে। বামপাশে একটা চায়ের দোকান। পান, সিগারেট আর একটা ঝোলানো প্যাকেটে বাবুজী কেক। এত খিদেতে খাবার ইচ্ছাটা প্রায় শেষ তখন। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ঠেলায় বিক্রি হচ্ছে ছোলামাখা। জিভে জল এলো। তাই কিনে খেতে খেতে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালাম। এখনও প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পথ। বাস আস্তে আস্তে আঁকাবাঁকা গ্রাম্য পথ ছেড়ে পৌঁছালো পাহাড়ি পাকদন্ডী পথে। ক্রমশ সমতল ছেড়ে যত উপরে উঠতে লাগলাম,রাস্তা তত খারাপ। পথের দু’পাশে শাল,মহুয়া ও অন্যান্য গাছের জঙ্গল পথের সাথে এঁকেবেঁকে চলেছে। না, সত্যি বলছি এত অপরূপ পথশোভা উপভোগ করার মত অবস্থা তখন আর আমার ছিল না। মাথার যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করেছে তখন। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমাদের বাস সমতল রাস্তায় চলছে। অর্থাৎ নেতার হাটে চলে এসেছি আমরা। কিন্তু ঠিক কোথায় নামবো বুঝে উঠতে পারছি না। দেখলাম, একটি দেহাতী পরিবার বড় রাস্তার উপরে নেমে পড়লো। তারাই বলল, এখানেই নামতে হবে আমাদের। রাস্তার পাশেই রয়েছে দু’একটি দোকান। সেখানে একটি বাঁশের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। আমাদের হোটেল ঠিক করা ছিল না। সঙ্গের ভদ্রলোকটিকে হোটেলের কথা বলাতে উনিই ফোন করলেন হোটেল প্রভাত বিহারের ম্যানেজারকে। ম্যানেজার ওনার বন্ধুস্থানীয়। ম্যানেজারকে আসতে বলে চলে গেলেন ভদ্রলোক। এদিকে মাথার যন্ত্রণা এতটাই তীব্রতা ধারণ করেছে তখন,প্রায় চোখে অন্ধকার দেখছি, প্রচন্ড গা গোলাতে শুরু করেছে। ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তখন। ঠিক আধঘণ্টা হবে! ম্যানেজার এলেন গাড়ি নিয়ে। ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটে। গাড়ি একটা ঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যে প্রবেশ করলো। সুন্দর সাজানো গোছানো। ডানদিকে কাচ ঘেরা একটা বড় রেস্টুরেন্ট। এখানেই হোটেলের খাওয়ার ব্যবস্থা। রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে একটা সরু রাস্তা নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। দু’পাশে মরশুমি ফুল। রাস্তার শেষেই রয়েছে হোটেল ‘প্রভাত বিহার’ পর্যটন দপ্তরের থাকার জায়গা। হোটেলের একতলার অংশ মাটির নিচে। দূর থেকে দেখলে দোতলাকে একতলা বলেই ভ্রম হবে। আমাদের যে ঘরটি দেওয়া হল সেটি দোতলায়। ১০২ নং। দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা খোলা ছাদ পেরিয়ে পৌঁছালাম আমাদের রুমে। সমনে গ্রিলঘেরা বারান্দা। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে সামনের সাজানো বাগান। পথশ্রমের ক্লান্তি মিটাতে হালকা গরম জলে স্নান সারার পর কিছুটা সুস্থ বোধ করতেই, খাওয়ার জন্য গেলাম রেস্টুরেন্টে,কিন্তু খেতে পারলাম না। দু’গ্রাস খেতেই শরীর তীব্র ভাবে প্রতিবাদ জানালো। বাইরে এসে দেখলাম, অন্য সবাই কোথাও বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ম্যানেজার এসে হিন্দি মিশানো বাংলায় বললেন, গাড়ি বলে দিই? আপনারা নিশ্চয় ‘ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট’ দেখতে যাবেন?
ওনার কথা শুনতে শুনতেই একটা কল্পনার ছবি যেন আঁকা হয়ে যাচ্ছিল মনে। প্রায় আটটার দিকে পৌঁছালাম বাস স্ট্যান্ড। বাস দাঁড়িয়ে আছে দেখে অটো ড্রাইভার নিজেই ব্যাগ গাড়িতে তুলে দিলেন। গতরাতে প্রায় আটটায় খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম, পেটে ছুঁচো দৌড়ানো শুরু করেছে। সামনেই একটা পুরীর দোকানে সবে খাবো বলে ঢুকেছি,এমন সময় বাস হর্ণ দিতে শুরু করলো। একদিকে খাবার থালা আরেক দিকে বাসের হর্ণ, দু’দিক থেকে দুজনের ডাকে পুরো কনফিউজড তখন। ভাবলাম পরের বাসে যাবো তবে,কিন্তু কপালে খাবার না থাকলে যা হয়;সেদিন ঠিক তাই ঘটলো। জানলাম, এই আটটার বাসের পর আবার দুপুর দুটোতে বাস আছে নেতারহাট যাওয়ার। কি আর করা অগত্যা খালি পেটেই চেপে বসলাম বাসে। মনে মনে ভাবলাম, পথে কোথাও বাস দাঁড়ালে খেয়ে নেবো কিছু। যেহেতু দূরত্বের জার্নি,তাই বাসের সিটগুলো বেশ আরামদায়ক। এ যাত্রায় আমরা তিনজনই ( আমি, বর আর ছোট্ট ছানা অনুরাগ। মাত্র তিন তখন তিনি)। বাস শুরু করলো ছোটা। দু’তিনটি বিস্কুট খেয়ে ঘন্টা খানেকের মধ্যে অনুরাগও শুরু করলো বমি করা। বাস শহর ছাড়িয়ে ছুটে চলেছে নির্জন পথে।প্রতিটি স্টপে দু’একজন নামছে আবার উঠছে। বেশির ভাগই দেহাতি লোকজন। আর আমাদের চোখ ঘুরছে খাবারের দোকানের সন্ধানে। হতাশ হয়ে আবার শুরু করছি অপেক্ষা পরের স্টপের জন্য। এদিকে দীর্ঘক্ষণ না খেয়ে থাকায় ক্রমশ মাথার দু’পাশে ধরে থাকা চিনচিনে ব্যথাটা বেড়েই চলেছে। প্রায় ঘন্টা চারেক চলার পর বাস এসে দাঁড়ালো একটা নির্জন গ্রামের পথে। বামপাশে একটা চায়ের দোকান। পান, সিগারেট আর একটা ঝোলানো প্যাকেটে বাবুজী কেক। এত খিদেতে খাবার ইচ্ছাটা প্রায় শেষ তখন। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ঠেলায় বিক্রি হচ্ছে ছোলামাখা। জিভে জল এলো। তাই কিনে খেতে খেতে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকালাম। এখনও প্রায় ঘন্টা দুয়েকের পথ। বাস আস্তে আস্তে আঁকাবাঁকা গ্রাম্য পথ ছেড়ে পৌঁছালো পাহাড়ি পাকদন্ডী পথে। ক্রমশ সমতল ছেড়ে যত উপরে উঠতে লাগলাম,রাস্তা তত খারাপ। পথের দু’পাশে শাল,মহুয়া ও অন্যান্য গাছের জঙ্গল পথের সাথে এঁকেবেঁকে চলেছে। না, সত্যি বলছি এত অপরূপ পথশোভা উপভোগ করার মত অবস্থা তখন আর আমার ছিল না। মাথার যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করেছে তখন। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, আমাদের বাস সমতল রাস্তায় চলছে। অর্থাৎ নেতার হাটে চলে এসেছি আমরা। কিন্তু ঠিক কোথায় নামবো বুঝে উঠতে পারছি না। দেখলাম, একটি দেহাতী পরিবার বড় রাস্তার উপরে নেমে পড়লো। তারাই বলল, এখানেই নামতে হবে আমাদের। রাস্তার পাশেই রয়েছে দু’একটি দোকান। সেখানে একটি বাঁশের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। আমাদের হোটেল ঠিক করা ছিল না। সঙ্গের ভদ্রলোকটিকে হোটেলের কথা বলাতে উনিই ফোন করলেন হোটেল প্রভাত বিহারের ম্যানেজারকে। ম্যানেজার ওনার বন্ধুস্থানীয়। ম্যানেজারকে আসতে বলে চলে গেলেন ভদ্রলোক। এদিকে মাথার যন্ত্রণা এতটাই তীব্রতা ধারণ করেছে তখন,প্রায় চোখে অন্ধকার দেখছি, প্রচন্ড গা গোলাতে শুরু করেছে। ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই তখন। ঠিক আধঘণ্টা হবে! ম্যানেজার এলেন গাড়ি নিয়ে। ঘড়িতে তখন প্রায় তিনটে। গাড়ি একটা ঘেরা কম্পাউন্ডের মধ্যে প্রবেশ করলো। সুন্দর সাজানো গোছানো। ডানদিকে কাচ ঘেরা একটা বড় রেস্টুরেন্ট। এখানেই হোটেলের খাওয়ার ব্যবস্থা। রেস্টুরেন্টের সামনে দিয়ে একটা সরু রাস্তা নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। দু’পাশে মরশুমি ফুল। রাস্তার শেষেই রয়েছে হোটেল ‘প্রভাত বিহার’ পর্যটন দপ্তরের থাকার জায়গা। হোটেলের একতলার অংশ মাটির নিচে। দূর থেকে দেখলে দোতলাকে একতলা বলেই ভ্রম হবে। আমাদের যে ঘরটি দেওয়া হল সেটি দোতলায়। ১০২ নং। দোতলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা খোলা ছাদ পেরিয়ে পৌঁছালাম আমাদের রুমে। সমনে গ্রিলঘেরা বারান্দা। সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে সামনের সাজানো বাগান। পথশ্রমের ক্লান্তি মিটাতে হালকা গরম জলে স্নান সারার পর কিছুটা সুস্থ বোধ করতেই, খাওয়ার জন্য গেলাম রেস্টুরেন্টে,কিন্তু খেতে পারলাম না। দু’গ্রাস খেতেই শরীর তীব্র ভাবে প্রতিবাদ জানালো। বাইরে এসে দেখলাম, অন্য সবাই কোথাও বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ম্যানেজার এসে হিন্দি মিশানো বাংলায় বললেন, গাড়ি বলে দিই? আপনারা নিশ্চয় ‘ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট’ দেখতে যাবেন?
‘ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট’ নেতার হাটের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পট ‘সানসেট পয়েন্ট’। ম্যাগনোলিয়া নামে এক ইংরেজ মহিলা এক মেষপ্রতিপালককে ভালোবেসে প্রাণ দিয়েছিল এইখানে। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ঘোড়াসহ এই পাহাড় থেকে গভীরে!
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছিল না। মন তখন নীরবতার মাঝে একন্ত যাপনে মগ্ন হতে চায়ছিল। আর হাতে তো পরের দিনটা আছেই, এই ভেবে বললাম, ‘আজ আর যাবো না, কাল দেখবো’। দেখলাম উপস্থিত অন্যান্য টুরিস্ট সকলেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সূর্যাস্ত দেখতে। বেলা পড়ে এলো প্রায়। ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি,শীত লাগছে বেশ। জড়িয়ে নিলাম হালকা একটা চাদর। আকাশটা ক্রমশ কফি রঙে ডুবে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের আলো গুলো জ্বলে উঠছে একে একে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম সেই খোলা ছাদে। দুটো চেয়ার পাতা রয়েছে। পড়ন্ত দিনের রংটা তখনও মুছে যায়নি। বসলাম চেয়ারে একা নির্জনে। ক্রমশ গুঁড়ো গুঁড়ো অন্ধকার উপর থেকে নেমে আসছে, অনুভব করছি এই অন্ধকারকে ভীষণ ভাবে।একটা অদ্ভুত কথা বলা শুরু হয়েছে অন্ধকারের সাথে নির্জন প্রকৃতির। ছাদের সীমানা পেরিয়েই চোখ আটকে যায় বিস্তীর্ণ জঙ্গলের গায়ে। পাহাড়ি ঢালে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো।ওদের মাঝে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে অন্ধকার! জেগে উঠছে বৃক্ষপ্রকৃতি মিটমিটে জোনাকির আলোয়,আর নিরবচ্ছিন্ন ঝিঁঝিঁর চিৎকারে। একটা ঘোর, একটা নেশা জাগানো ঘোর যেন ঘিরে ধরছে আমায় তখন। চোখ বন্ধ করে গভির অনুভূতিতে সেই প্রথম আমার নীরবতার সাথে অন্ধকারকে মাখা। কি সে অনুভূতি? কি সে নেশা... কোনো ভাবেই ব্যাখ্যা করতে অপারগ আমি। শুধু এটুকু বলতে পারি, সেই প্রথম আমি অন্ধকারের প্রেমে পড়েছিলাম। আজও সেই প্রেম সংরক্ষিত মনে। মাঝে মাঝেই ভেসে আসছিল অদ্ভুত কিছু পশু অথবা নাম-না-জানা পাখির ডাক। ‘মাথায় হিম পড়ছে’ গম্ভীর পুরুষকন্ঠ সতর্ক করলো আমায়। এই নির্জনে আমার খেয়াল রাখার আর কেই বা থাকতে পারে? হ্যাঁ, ঠিক তিনি আমার সেই পরম প্রিয় বন্ধু,যার সাথে একমাত্র ঠুকে ঠুকে ঝগড়া করা যায়।
এমন একটা নির্জন জায়গায়, কাচ ঘেরা রেস্টুরেন্টে বসে রাতের খাবার খাওয়া, বেশ ভালোই লাগছিল। ভালো লাগছিল অন্যান্য টেবিলে খেতে বসা অন্য সব ট্যুরিস্টদের নিজস্ব আচরণ গুলো আড়চোখে দেখতে। বিভিন্ন বিচিত্র স্বভাবের অনেক মানুষ একসাথে বসে অথচ সবার জীবনে একটা ভিন্ন গল্প আছে।
শীত বেশ ভালোই। রাতের বিছানার হাতছানিটাও বেশ উপভোগ্য। সকালে সূর্য মামার হামা দেওয়া দেখতে হবে, মোবাইলে ঘন্টি ঠিক করে রাখলাম।
ঘুমের মাঝে বিশ্রামরত মস্তিষ্ক কিযেন একটা সংকেত পাচ্ছে! আস্তে আস্তে স্পষ্ট হলো সে সংকেত। উঠতে হবে। সূর্য ওঠার সময় হয়ে এসেছে। ঘোলাটে অন্ধকারে চাদরমুড়ি দিয়ে ক্যামেরা হাতে পৌঁছালাম ছাদে।মনে হলো সেই অটো চালকের কথা। অধীর অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে হঠাৎ দেখলাম অন্ধকারের বুক চিরে ছড়িয়ে পড়ছে একটা লালচে আভা। একটু একটি করে আড়াল ঠেলে ছড়িয়ে পড়ছে রং। লাল,হলুদ,কমলার বিচিত্র প্রকাশে ভেসে উঠছে আকাশটা। হঠাৎ দেখলাম একটা লাল বড় আকারের গোল টিপের মত শিশুসূর্য দ্রুত উপরে উঠে আসছে। ক্রমশ আকাশটা আরও যেন রঙীন হয়ে উঠলো, সঙ্গে মনটাও। নিস্তব্ধ সকালটা ক্রমশ যেন শব্দ মুখর হয়ে উঠলো পাখিদের ডাকে।
নেতারহাটে আলাদা করে বিশেষ কিছু দেখার নেই। আপার ঘাগরি আর লোয়ার ঘাগরি বলে দুটো ছোটো জলের ধারা আছে,আর একটা বড় প্রাকৃতিক ঝিল। এখানকার প্রকৃতিই আসলে দর্শনীয়। কি আছে প্রকৃতিতে সেটা নেতারহাট না এলে সঠিকভাবে অনুভব করা সম্ভব নয়। সূর্যোদয় দেখে নেমে এলাম একেবারে নিচে। হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে কুয়াশা মেখে হাঁটতে বেশ লাগলো। রেস্টুরেন্টে সকালের চায়ের সাথে শীতের অনুভব নেওয়া এক অনবদ্য পাওনা। ঘাগরি দুটিতে এই ফেব্রুয়ারিতে জল থাকে না,তাই সেটা দেখার কোনো আগ্রহ এলো না। স্নান সেরে তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। পাশদিয়ে তখন হুসহুস বেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। যারা গতকাল এসেছিল তারা ফিরছে। এখানে সাধারণত শনিবার এক দিনের জন্যই লোকজন আসে। আমাদের মত দু’তিন দিন থাকার পাবলিক খুব কম, এমনটা জানিয়েছিলেন হোটেলের ম্যানেজার স্বয়ং। হাঁটতে এসে পড়লাম গাছগাছালি ঘেরা একট পিচ রাস্তায়। রাস্তার গায়ে আলোছায়ায় বিচিত্র এক নক্সা পায়ের নিচে ফেলে হেঁটে চলেছে তিনটি বাচ্ছা মেয়ে। মাথায় তাদের কাঠের বোঝা। বললাম, ‘এই তোদের একটা ছবি তুলছি’। ওরা হাঁসলো। দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠলো। এটাই এখানকার প্রকৃত চিত্র। বনের কাঠ বেচে উপার্জন এখানকার অনেক মানুষের। কেউ শহরে গিয়েছে রাজমিস্ত্রির কাজে। অনেকে কাজ করে বক্সাইট খনিতে। কিছু আধুনিক যুবক আমাদের মত ট্যুরিস্টদের গাড়ি ভাড়া দিয়ে উপার্জন করে। তবে যেহেতু এখানে ট্যুরিস্টরা শনিবার বেশি ভিড় জমায়, তাই ঐ একদিন বা দু’দিনই যা ইনকাম হয়। বাকি দিনগুলো গাড়ি নিয়ে ওরা যায় শহরে। আর নতুন শহরে বাবুদের দেখলে, ছোটো ছোটো বাচ্চারা টাকা চায়। একটাও একটা উপার্জনের পথ।
আমরা একটা গাছ ঘেরা মাঠের ভিতর দিয়ে হেঁটে পৌঁছালাম সেই বড় রাস্তায়,যেখানে গত দিন বাস থেকে নেমে ছিলাম। যানবাহনের আধিক্য নেই কোনো। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি বা মটরসাইকেল যাচ্ছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম একটা আবাশিক আশ্রমের সামনে। পথের দু’ধারে গাছ আর মাঝে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। একেকটা কুটিরের মত বাগান ঘেরা ছাত্রদের একেকটা থাকার জায়গা। একটি ছাত্রর কাছে জানতে পারলাম এখানে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পড়তে আসে ছাত্ররা। পথে নজরে এসেছিল একটি বালিকা বিদ্যালয়,একটি National Residential School । হাঁটতে হাঁটতে এই সুন্দর পথে কখন যে দুপুর হয়ে গিয়েছে মনেই ছিল না।
দুপুরের খাওয়া সেরে অপেক্ষায় তখন ম্যাগনোলিয়া পয়েন্ট দেখতে যাবার। গাড়ি তো বলা আছে। ঠিক সাড়ে তিনটে, অপেক্ষা গাড়ি এলেই ছুটবো সেখানে। ঘড়ির কাঁটা সরতে লাগলো, কিন্তু গাড়ি আর এলো না। এ এক ভেস্তে যাওয়া পরিকল্পনা আর মন খারাপের গল্প। সত্যি আর এলো না গাড়ি। অনেক ছোটাছুটি করলাম, বড় রাস্তায় গিয়ে দোকান গুলোতে বললাম। হলো না নতুন কোনো গাড়ির যোগাড়। গাড়ির ড্রাইভার কথা দিয়ে কথা রাখলো না। আসলে আসার পথে রাস্তায় পারহেড হিসাবে প্যাসেঞ্জার পেয়ে সে বেমালুম ভুলে গেল আমরা তাকে বুক করে রেখেছি। বড় রাস্তার ধারে প্রতি বুধবার হাট বসে। পড়ে থাকা হাটের কাঠামোর চারপাশ ঘুরে, ফিরে এলাম হোটেলে। সূর্যটা ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে আকাশের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম। কালো থোকা মেঘের মাঝাখান থেকে একটা রক্তাভ আলোর চ্ছ্বটা হোটেলের লনে বসেই দেখা যাচ্ছে। ছবি তুললাম সেই মেঘের। ভিতরে তখন তীব্র না পাওয়ার যন্ত্রণা! ভীষণ মনখারাপ লাগছে, ভীষণ... ভীষণ! সূর্যটা ডুবে গিয়ে নেমে এলো রাত। নিস্তব্ধ নির্জন প্রকৃতির মাঝে ভেস্তে যাওয়া পরিকল্পনার যন্ত্রণাটা ক্রমশ মিশে যেতে লাগলো। পরেরদিন রওনা হবো বেতলা। যতই মনখারাপ হোক, মনখারাপের রাতটা গুছিয়ে রাখলাম অন্তরে।যা পেয়েছি তাই বা কম কি! নেতারহাট সত্যিই ‘নেচারহাট’ কোনো সন্দেহ নেই।
ক্রমশ...
rumkiraydutta@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন