মানব জাতির ইতিহাস আসলে ধর্মের ইতিহাস , এই দৃষ্টিভঙ্গি এর প্রবর্তনকারী পন্ডিত এর নাম হচ্ছে ম্যাক্সমুলার , আমাদের দেশে আমরা ৯০ শতাংশ মুসলিম , এবং আমাদের ধর্ম ইসলাম , ইসলাম এর মাঝে মূর্ত ভাব মূর্ত প্রতীক এবং মূর্ত যে কোন বিষয় অপেক্ষা বিমূর্ত ভাব প্রতীক এবং বিমূর্ত চেতনা কে অধিক হারে গুরুত্বদান করা হয়েছে ।
আমাদের মাঝে শিল্প এবং শিল্পের যে স্থান , তা যতটা না শারীরিক তার অপেক্ষা অনেক বেশী আত্নিক , এই প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি যে মাইকেল এঞ্জেলো যখন পিয়েতা তৈরি করেছিলেন , তখন তিনি মূর্ত এর মাঝেই বিমূর্ত কে খুজেছিলেন , কিন্ত ইসলাম এর ক্ষেত্রে মূর্ত এর মাঝে নয় ভাবনা , চিন্তা বা স্মৃতি অথবা বিমূর্ত এর মাঝে মূর্ত কে খুঁজে বের করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।
ঠিক কেমন ভাবে, সেটির বর্ণনা দিতে গেলে আমাকে আমাদের মসজিদের অলংকরণ এর প্রতি মনোযোগ দিতে হবে , আমাদের বাংলাদেশে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন মসজিদে বিভিন্ন অলংকরণ হয়ে আসছে , আমরা আজও টাইলস এর অলংকরণ এর মাঝে সেটিকে দেখতে পাই । তবে তার মাঝে অধিকাংশই হয় বিমূর্ত অথবা অজীবিক ।
আমাদের বর্তমান যে আর্ট বা শিল্পের বহিঃপ্রকাশ আছে , সেই আর্ট কে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি , ১ ,মূর্ত শিল্পকলা , যেমন ক্ল্যাসিক্যাল , ন্যুড , আইকোনোগ্রাফিক , গ্রাফিতি , পোট্রেট ইত্যাদি ।
এদের মাঝে অধিকাংশই আমাদের নিজেদের শিল্প রীতি নয়, আমাদের শিল্পরীতি মূলত ন্যুড এবং আইকোনোগ্রাফি এর মাঝেই সীমাবদ্ধ , তবে এর সাথে সাথে রিলিজিয়াস ব্লেন্ড ছিল বিপুল পরিমাণে । এবং এর অধিকাংশই আমাদের ধর্মীয় রীতি এর সাথে যায় না । এই কারণে আমাদের ধার্মিক দের মাঝে পেইন্টিং এবং স্কাল্পচার শেখার মানসিকতা একেবারেই নেই ।
আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, মূর্ত শিল্পকলা আমাদের সমগ্র শিল্পর মাঝে মাত্র এক চতুর্থাংশ বা তারও কম । তাহলে আমাদের ধর্মীয় ভাবে ধর্ম প্রাণ বা ধর্মকে মান্য করেন এরকম ব্যক্তি দের মাঝে শিল্প শেখার প্রতি আগ্রহ এত কম কেন । এমনকি হালাল বা পুরোপুরি বৈধ বলে পরিচিত যে সকল শিল্প আছে যেমন ক্যালিওগ্রাফি , আরকিটেকচারাল টেরাকোটা , এসমস্ত ক্ষেত্রেও আমাদের ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী একেবারেই পিছিয়ে বা , এসমস্ত ক্ষেত্রেও আমাদের মাঝে কোনই বিশ্বমানের প্রতিভা আছে বলে শোনা যায় না ।
সে হিসেবে বিমূর্ত এর বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন এবস্ট্র্যাক্ট পেইন্টিং , এরপরে কার্ভড , লিনিয়ার, জিওমেট্রিক ,জেস্টুরাল এবং মিনিমালিস্ট এর ক্ষেত্রে বলাই বাহুল্য ।
আমাদের মাঝে এমনকি কুরআন এর অলংকরণ বিদ্যা বা কুরআন এর পাতাকে সুন্দর করে তোলার মত বা এর সাথে শৈল্পিক মাধুর্য যুক্ত করার ক্ষেত্র কেও নতুন ভাবে শিল্প হিসেবে স্থান দিতে আমরা চরম ভাবে ব্যর্থ । অথচ দেখা যায় যে আরবে ইসলাম প্রচার এর পরে , সেখানে বিপুল পরিমাণে শিল্প , চিত্রকলা , ভাস্কর্য ইত্যাদি এর চর্চা ত্বরান্বিত হয়েছিল , সেখানে খলিফার বাসা কে অলংকৃত করত বিভিন্ন মূর্ত- বিমূর্ত ভাস্কর্য । সেই সময়ে বায়তুল হিকমা থেকেই শুধু নয় , এই পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ থেকেই উঠে এসেছিলেন অসম্ভব গুণী বেশ কিছু শিল্পি , এদের মাঝে একজন এর দেখা আমরা পাই পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদের কাজে ।
سلطنته شهور سنة اثنى و عشرين و سبعماية بناء صفقا لوجه الله لقبل الله منه بخط الضعيف محمدبن محمد بن احمد غفر الله اجمعين-
এই লেখটিতে, এখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে ,
৭২২ হিজরি /১৩২২ ইসায়ি তে এই বিশাল স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল , শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি এর জন্য , অবশ্যই আল্লাহ এটিকে কবুল করবেন , এই শিলালেখ টি খোদিত হয়েছিল আল্লাহর অধম বান্দা মুহাম্মদ , যার পিতা মুহাম্মদ এবং যার পিতা আহমাদ , আল্লাহ তাদের প্রত্যেক কে দয়া করুন ।
অর্থাৎ পান্ডুয়ার যে সকল খোদাই কর্ম করা হয়েছিল তা হয়েছিল একজন মুসলিম এর হাতেই , এবং এই আদিনা মসজিদ এখনও আমাদের মুসলিম দের উপমহাদেশে এক অন্যতম শিল্পের নিদর্শন হিসেবেই দেখা হয় ।
স্বাভাবিক ভাবেই এখন প্রশ্ন থাকে, আসলে ঠিক কি কারণে আমাদের মাঝের এই অনীহা দেখা দিয়েছে । বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের কোন মাদ্রাসাতে কেনই বা কোন ক্যালিওগ্রাফি এর ক্লাস নেই, কেন নেই টেরাকোটা শিল্পের বিভাগ ?
এর মাঝে এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের কে যেতে হবে ত্রয়োদশ শতকের নিযামিয়া মাদ্রাসাতে , নিযামিয়া মাদ্রাসা ছিল মঙ্গোল আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র ইসলাম এর বৃহৎ একটি মাদ্রাসা , এবং সেই সময়ে এই ইউনিভার্সিটি ছিল সমস্ত ইসলামিক বিশ্বে ধ্বংস থেকে বেঁচে যাওয়া একমাত্র মানসম্মত গবেষণা কেন্দ্র ।
তবে এই ইউনিভার্সিটি টি ছিল এনাতোলিয়া অঞ্চলে এবং এখানে নবম শতক হতেই আইকোনোক্লাস্ট মুভমেন্ট বা মূর্ততার বিরোধিতার যে রীতি টি ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিদ্যমান সেটি প্রভাবশালী ছিল , যদিও পরে অটোম্যান যুগে এর প্রভাব কমে যায় ।
এই কারণে সেখানে চিত্রকলা এবং শিল্পের বিষয়ে তেমন কোন গবেষণা সংগঠিত হত না । এই কারণে এখান থেকে যখন প্রদান করা হল সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সেই সময়কার ভার্সিটি সমূহের গাইডলাইন , ইসলামিক ক্ষেত্র থেকে হালাল আর্ট সমূহের উপরেই খুব একটা জোর সেখানে প্রদান করা হয়নি । এছাড়াও নেযামিয়া মাদ্রাসা এর পূর্বে যে সকল মাদ্রাসা ছিল তারা মূলত রিসার্চ বা ইজতিহাদ এর ভিত্তিতে নিজেদের শিক্ষা পরিচালনা করতেন , এবং প্রধান শিক্ষালয় এবং গবেষণাগার বায়তুল হিকমা তেও একই ধরণ এর পদ্ধতি প্রচলিত ছিল , কিন্ত সেই সময়ে গবেষণা উপকরণ এর অভাবে , তাকলিদ বা সেকেন্ডারি রিসার্চ এর উপরে ভর করেই চলতে থাকে ইসলামিক শিক্ষা । যেহেতু শিল্পের ক্ষেত্রে ইসলামিক যুগে ক্ল্যালিগ্রাফি , জ্যামিতিক আর্ট এবং গ্র্যাফিতি প্রতি যুগের সাথে সাথে পরিবর্তিত হত , সেই কারণে তাদের কে আনার জন্য দরকার ছিল নতুন গবেষণা এবং চিন্তার নতুন নতুন ধারা ।
এই কারণে তাকলিদ ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে আর্ট বা শিল্প কলা অনেকটাই অবহেলিত এবং চর্বিত চর্বণ নির্ভর হয়ে যায় । আর শিল্পের যে কেন্দ্র সেটি পূর্ব হতে পশ্চিম এর দিকে ঘুরে যেতে শুরু করে , পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনের সময়ে মুসলিমেরা সরাসরি বিরোধিতা করার দরুণ তাদের কে বিপুল পরিমান সমস্যার মুখে পড়তে হয় , যদিও সেই সময়ে হিন্দু ছাত্র দের সাথে মুসলিম রাও ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেছে এবং উদাহারণ রয়েছে কিন্ত এরপরেও ধীরে ধীরে সেই অনুপাত কমতে থাকে ১৮৫৭ সন পর্যন্ত , কেননা লাখেরাজ আইন বাতিল করে দেয়ার দরুন , বহু মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায় , এবং আর্ট যে ধারাটি টিমটিম করে জলছিল মুসলিম দের মাঝে সেই ধারাটিও সমাপ্তি এর কাছে চলে যায় ।
কেননা তখন ইসলামিক শিক্ষা এর শতকরা ৯০% (কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা এর অংশ ব্যতিত) নির্ভর হয়ে পড়ে মানুষ এর নিজস্ব দান দক্ষিণা এবং ধ্যান দান এর উপরে , আর এই দান-দক্ষিণা তে আর যাই হোক রিসার্চ এবং শিল্প সম্ভব নয় , এই কারণে ধীরে ধীরে আর্ট আরও বেশী সরতে শুরু করে ব্রিটিশ দের প্রতি , শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু সমাজ নিজের দূরদর্শিতার দরুন সেটিকে আপন করে নিলেও আমাদের মুসলিম সমাজ একে একেবারেই আপন করতে পারেনি । এই কারণে আমাদের মাঝে শিল্প বা আর্ট নিয়ে প্রায় চারশত বছর এর এক বিশাল ভয়েড বা শুন্যতা আছে । যা সহসা পূরণ হবার নয় ।
এই বিষয়ে এখনই ব্যবস্থা না নিলে , সুকুমার বৃত্তি এর ক্ষেত্রে আমাদের যে ঐতিহ্য আছে সেটি একেবারেই গোড়া থেকেই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে , যে রকম আজই আর্টিস্ট বা শিল্পী দের সাথে আমাদের ইসলামে একটি দূরত্ব ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে ।
এদিকে ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টি কোন থেকেও যদি দেখি তবেও আমরা একই রকম এর উপসংহারে আসতে পারব । যদিও হাদিসে কুদসি তে উল্লেখ আছে -
“যে আমার ন্যায় সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা করে তার ন্যায় জালেম আর কে আছে “
কিন্ত এর মাঝেও , আমরা মূর্ত এর জয়গান দেখি , বিমূর্ত চিত্রকলা এই ধারণা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে , এমনকি এমন হাদিস ও রয়েছে যেখানে মূর্ত মূর্তির মাথা ভেঙ্গে ফেলার কথা বলা হয়েছে কিন্ত সেটিকে সমাপ্ত করার কথা বলা হয়নি ।
এছাড়াও ইতিহাসবিদ আল মাসুউদী এর গ্রন্থে আমরা উল্লেখ পাই যে মহানবী নিজেই , কাবার প্রান্তরে আঁকা যিশু এবং মেরীর ফ্রেসকো কে মুছে ফেলতে দেননাই , এমনকি এমনও উল্লেখ আছে যে , তারা সমস্ত মূর্তি সেখান থেকে সরিয়ে ফেললেও কাছেই একটি লাইব্রেরী তৈরি করেন যার নাম তারা দেন আল মাকতাবুল আরাবিয়া এবং সেখানেই এই সকল মূর্তি (যা উপাসনার কাজে ব্যবহৃত হত ) তাদের কে গবেষণার কাজে ব্যবহার করার জন্য রেখে দেওয়া হয় , আর যাদের কে ব্যবহার করে আল অয়াকিদি তার বিখ্যাত বই কিতাব আল আনসাম রচনা করেন , যেখানে তিনি আরব এর পৌত্তলিক সময় কালের বর্ণনা প্রদান করেন ।
এই হিসেবেই আমাদের মুসলিম জাতির উচিত যে অবশ্যই হালাল শিল্পের চর্চা করা কেননা এরকম হাদিস ও রয়েছে যে ‘আল্লাহ স্বয়ং সুন্দর এবং তিনি সুন্দর কে ভালোবাসেন “
এই জন্যই আমাদের দরকার সুদূরপ্রসারি কর্ম পরিকল্পনা , ইজতিহাদ বা গবেষণা ধর্মীয় শিক্ষা পদ্ধতির সংস্কার এবং উদার নৈতিক মনোভাব পোষণ , সর্বোপরি , আইকোনোক্লাস্টিক মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসা কেননা শত শত লাইনে লেখা সেটা বোঝাতে পারে না যেটা একটা বিমূর্ত চিত্রের ভাষা মানুষকে বুঝিয়ে দিতে পারে ।
বাংলাদেশ রাজশাহী
৬১০০ , বালিয়াপুকুর
বড়বটতলা , রাজশাহী
হাদীভিলা ।
imranhasan4463@gmail.com
৬১০০ , বালিয়াপুকুর
বড়বটতলা , রাজশাহী
হাদীভিলা ।
imranhasan4463@gmail.com
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন