গৌতম বসু

হুইলচেয়ার
এক।

গতরাত থেকেই মেজাজটা বিগড়ে আছে শ্রীময়ীর,সঙ্গে একটা চাপা উৎকণ্ঠা,আবার অফিসে গিয়ে নতুন কিছু না দেখতে হয়।

শ্রীময়ী সেন, হসপিটাল ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর করার পর মাস ছয়েক হল বাইপাসের ধরে একটা বেসরকারী হাসপাতালে যোগ দিয়েছে অর্থোপেডিক ওপিডির অ্যাসিস্ট্যান্ট কোঅর্ডিনেটর হিসেবে। অত্যন্ত মনোযোগী,দায়িত্বশীল ও পরিশ্রমী শ্রীময়ী অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে কর্তৃপক্ষ ও সহকর্মীদের প্রিয় হয়ে উঠেছে। এছাড়াও তার সবচেয়ে বড় গুণ নিজের দায়িত্ব ছাড়াও সাধ্যমত পেশেন্টদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসা,যা সকালের দিকটায় আউটডোরের প্রচন্ড ভিড় সামলাতে ভীষণভাবে কাজে দেয়। শ্রীময়ীর ভূমিকাটা সরাসরি চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত না হলেও সে তার কাজটাকে সেবার দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখে থাকে এবং তার জন্য সে মনে মনে বেশ একটা তৃপ্তিও অনুভব করে।

বেশ কিছুদিন হল এই উৎপাতটা শুরু হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত এক সোমবার সকালে। সেদিন আউটডোরে প্রচন্ড ভিড় আর অনেকগুলো সার্জারি থাকায় ড: কুলকার্নিরও ওটি থেকে বেরোতে বেশ দেরী হচ্ছে। শ্রীময়ী এর মধ্যে দু’চার বার লক্ষ্য করেছে ছেলেটাকে, লম্বা রোগাটে গড়ন,মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট,ঘন্টাখানেক ধরে মুখ নিচু করে হুইলচেয়ারে বসে আছে। বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ব্যাণ্ডেজ,বোধহয় অপারেশন হয়েছে। শ্রীময়ী একসময়ে উঠে এসে জিজ্ঞেস করে,"আপনি কি ড: কুলকার্নির জন্য ওয়েট করছেন?"ছেলেটি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। ড: কুলকার্নির আসার সময় হয়ে এসেছে, শ্রীময়ী ছেলেটির নাম জিজ্ঞেস করে মেডিকেল রেকর্ডের ফাইলটা ড: কুলকার্নির অ্যাসিস্ট্যান্ট মধুমিতাদিকে দিয়ে জানায় যে ,ছেলেটি অনেকক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে।

ইতিমধ্যে অপারেশন সেরে চেম্বারে চলে আসেন ড: কুলকার্নি। স্ট্রেচারে শোয়ানো একজন বৃদ্ধাকে দেখা হয়ে গেলে মিস মধুমিতা চ্যাটার্জী ইশারায় ছেলেটিকে ভিতরে যেতে বলেন। ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে ইতস্তত করতে থাকে,একবার কোনোরকমে একপায়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। শ্রীময়ী বুঝতে পারে ব্যাপারটা, কাছাকাছি কোনো হুইলচেয়ার বাহককে দেখা যাচ্ছেনা, সে নিজেই উঠে গিয়ে হুইলচেয়ার ঠেলে ছেলেটিকে ভিতরে নিয়ে যায় এবং ড: কুলকার্নির দেখা শেষ হবার পর তাকে আবার চেম্বারের বাইরে নিয়ে এসে একজন হুইলচেয়ার বাহককে ডেকে তাকে বাইরে পার্কিং লট অবধি ছেড়ে দিয়ে আসার ব্যবস্থা করে।

পুরো ব্যাপারটাই শ্রীময়ীর কাছে ছিল নিতান্তই মানবিকতার তাগিদ যাকে সে কোনোদিনই কর্তব্যের থেকে আলাদা করে দেখেনি। তাই ঘটনাটা তার মনে আলাদা করে কোনো দাগও কাটেনি। এর কিছুক্ষণ পরে শ্রীময়ীর ইনবক্সে একটা মেসেজ আসে;ছেলেটা ধন্যবাদ জানিয়ে একটা কৃতজ্ঞতাসূচক বার্তা পাঠিয়েছে। শ্রীময়ী ব্যাপারটাকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি। প্রথমত অফিসে থাকাকালীন সে মোবাইল থেকেও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং করেনা, আর তাছাড়া পেশাগত জীবনকে সে ব্যক্তিগত জীবনের থেকে আলাদা রাখতেই পছন্দ করে। যথারীতি ঘটনাটার কথা সে একসময় ভুলেও যায়।

এর প্রায় এক মাস পরের কথা,শ্ৰীময়ী হসপিটালে ঢোকার সাথেসাথেই ডিপার্টমেন্টে একটা চাপা হাসির রোল ওঠে। সে অবাক চোখে সহকর্মীদের দিকে তাকায় কিন্তু ব্যাপারটা তার বোধগম্য হয়না। শেষে মধুমিতাদি তাকে ডেকে নিজের ফোনে হসপিটালের ফেসবুক পেজ ওপেন করে একটা পোস্টের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফোনটা হাতে নিয়ে শ্রীময়ী দেখে সেটা একটা কবিতা,নাম 'হুইলচেয়ার'এবং নীচে হসপিটাল ও তাদের অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্ট ট্যাগ করা। কবিতাটা পড়েই তার সেদিনের ঘটনাটা মনে পড়ে যায় এবং সে রীতিমতো বিব্রত বোধ করতে থাকে। কারোর দিকে না তাকিয়েও সে বুঝতে পারে মধুমিতাদি,অন্বেষা,ঋদ্ধিমারা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। বরাবরের শান্ত স্বভাবের শ্রীময়ী আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। লজ্জায়,অপমানে,রাগে তার চোখে জল চলে আসে। বিষয়টাকে হালকা করার জন্য মধুমিতাদি ও অন্বেষা তাকে বোঝায় যে নিজের দায়িত্বের বাইরে গিয়ে এই অতিরিক্ত কাজগুলো তার করার দরকার নেই। শ্রীময়ী কিছু বলে না,মনটা তেতো হয়ে যায়,কাউকে সাহায্য করারও যে কোনো খারাপ দিক থাকতে পারে,সে ভাবতেই পারেনা। যাইহোক,আস্তে আস্তে ব্যাপারটা থিতিয়ে যায়, শ্রীময়ীও আর বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামায়না। এর মাসখানেক পরে ছেলেটা আবার চেকআপের জন্য এলে শ্রীময়ী যথাযথ পেশাদারীত্বের সাথে হাসিমুখেই পরিষেবা প্রদান করে এবং ভদ্রতাবশত তার কুশলও জানতে চায়। ছেলেটি জানায় সে আগের থেকে ভালো আছে। সেদিন রাতে ফেসবুক খুলে শ্রীময়ী দেখে ছেলেটা তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। ছেলেটার প্রোফাইলে গিয়ে সে দেখতে পায় আরো কিছু কবিতা,যা প্রচ্ছন্নভাবে তার দিকেই ইঙ্গিত করছে। এইবার শ্রীময়ীর ভীষণ রাগ হতে থাকে,এই ধরনের ছেলেরা যে কোনো মেয়েকেই খুব সহজলভ্য মনে করে আর তাদের ভদ্র ব্যবহারের সুযোগ নিতে চায়। পেশাগত কারণে সবার সাথেই তাকে হাসিমুখে কথা বলতে হয়,কিন্তু তার মানেই অপরিচিত যে কেউ তার বন্ধুবৃত্তে আসতে পারে এটা সে ভাবতেই পারেনা। তার আরো মনে হয় যে,যেহেতু সব পোস্টগুলোই পাবলিক নিশ্চয়ই অন্বেষারও এগুলো দেখে থাকবে বা যে কোনো দিন দেখতে পারে আর সেটা যে তার কাছে কতখানি অস্বস্তিকর তা ভেবে সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ওঠে কিন্তু কি করবে ভেবে না পেয়ে তখনকার মত বিষয়টাকে উপেক্ষা করাই স্থির করে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটাও আনরেস্পন্ডেড অবস্থায় পড়ে থাকে।

শ্রীময়ীর প্রোফাইলে তার পছন্দের সঙ্গীতশিল্পীর কিছু ছবি সংগৃহীত আছে যেগুলোকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কভার ফোটো করা তার মত কমবয়সী ফ্যানেদের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক। নিতান্তই কৌতুহলবশত এরপর কয়েকদিন ছেলেটার প্রোফাইলে গিয়ে শ্রীময়ী লক্ষ্য করে সেই শিল্পীর বেশ কিছু সাম্প্রতিক জনপ্রিয় গানের ভিডিও শেয়ার করা রয়েছে। মনে মনে বিরক্ত হলেও এক্ষেত্রে সত্যিই তো তার কিছু করার নেই। এরপর একদিন সন্ধ্যেবেলা হঠাৎই ছেলেটার আবার একটা মেসেজ আসে সেই শিল্পীর একটি স্টেজ পারফরম্যান্সের ভিডিও লিঙ্ক দিয়ে। শ্রীময়ীর মনে হতে থাকে,কি নির্লজ্জ গায়েপড়া বেহায়া টাইপের ছেলেরে বাবা! না,ব্যাপারটা বন্ধ করতেই হবে,কি করবে সে,প্রোফাইলটা ব্লক করে দেবে,নাকি কড়া করে একটা রিপ্লাই দিয়ে দেবে। তার ভদ্রতাকে কেউ যদি তার দুৰ্বলতা বলে ধরে নেয় তা হতে দেওয়া চলেনা। কিন্তু তার মনে হয় এরকম রিয়্যাক্ট করা মানেই এই সমস্ত অসভ্যদের গুরুত্ব দেওয়া। অপরিচিত কারোর রিকোয়েস্ট পাঠানোর অপশনটা বন্ধ করে দিয়ে সে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা ডিলিট করে দেয়। যদি নূন্যতম লজ্জা বা ভদ্রতাবোধ থাকে তাহলে নিশ্চয়ই আর ডিসটার্ব করবেনা । কিন্তু ছেলেটা যদি পাবলিকলি আবার কিছু শেয়ার করে হসপিটাল ডিপার্টমেন্টকে ট্যাগ করে – দুশ্চিন্তায় ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে সে।


দুই।

গৌরব ব্যানার্জী,পেশায় তথ্য প্রযুক্তি কর্মী,মাত্র কিছুদিনের অসুখী দাম্পত্যযাপনের পর বিগত সাত বছর বিবাহবিচ্ছিন্ন। খুব ছোটবেলায় পিতৃবিয়োগ হবার ফলে এবং একমাত্র সন্তান হওয়ায় সংসারে কেবলমাত্র সে আর তার মা। এই অবস্থায় যা হয়ে থাকে, সংসারের প্রতি বিশেষ টান না থাকায় তার নেশা হয়ে দাঁড়ায় ভ্রমণ,আর অনুরাগ সাহিত্য,বিশেষত কাব্যচর্চায়। ছোটবেলা থেকেই এডভেঞ্চারপ্রেমী গৌরব,একটি ট্রেকিং ক্লাবের সদস্য হয়ে যায় এবং বছরে অন্ততপক্ষে একবার পাহাড়ে যাওয়াটাকে সে মোটামুটি রুটিন করে ফেলে। তার মা ও অন্যান্য আত্মীয়রা তাকে প্রথম প্রথম আবার বিয়ে করার কথা বললেও সে'এই বেশ ভালো আছি'গোছের একটা ভাব করে আলোচনাটাকে এড়িয়ে যায়। যদিও মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গতা যে তাকে গ্রাস করেনা এমনটা নয়,কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে সে অনুধাবন করেছে যে, মনের মিল না থাকলে শুধুমাত্র শারীরিক সম্পর্ককে অবলম্বন করে একটা সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা যায়না। তাই নিয়মিত এন্টিডিপ্রেশান্ট নিতে হলেও অপরিচিত কারোর সাথে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার অনিশ্চয়তার মধ্যে সে আর যেতে চায়না।

একবার ট্রেকিংয়ে সিকিমে গিয়ে একটা ছোটো দুর্ঘটনায় তার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে আঘাত লাগে। পর্বতারোহণের ক্ষেত্রে এরকম ছোটোখাটো চোট আঘাত অস্বাভাবিক কিছু নয়,তাই সেও এটাকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে সাময়িকভাবে পেন কিলার নিয়ে ট্রেকিংটা শেষ করে। তার ধারণা ছিল কলকাতায় গিয়ে সপ্তাহখানেক বিশ্রাম নিলেই এটা সেরে যাবে। কিন্তু ফিরে এসে তিন সপ্তাহ পরেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় স্থানীয় অস্থিবিশেষজ্ঞের পরামর্শে তাকে এক্স রে ও এম আর আই করতে হয়। এক্সরেতে কিছু না পাওয়া গেলেও এম আর আইতে ধরা পড়ে যে তার গোড়ালির লিগামেন্ট সামান্য ছিঁড়ে গেছে। এরপর গৌরব কলকাতার প্রখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন ড: বিবেক কুলকার্নির পরামর্শে আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারি করিয়ে নেয় ও দু'সপ্তাহ পর সেলাই কাটার জন্য হসপিটালে আসে। এই কাজগুলো সাধারণত জুনিয়র ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে নার্সরাই করে থাকেন,তাই সেলাই কাটা হয়ে গেলে সে ড: কুলকার্নির সাথে কনসাল্ট করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যদিও সকালেই রিসেপশন থেকে জানিয়ে দিয়েছে আজ অনেকগুলো অপারেশন থাকায় ড: কুলকার্নির আউটডোর চেম্বারে আসতে বেশ কিছুটা দেরি হবে,তবুও গৌরবের মনে হয় একটু দেরি হলেও অন্য একদিন আবার আসার থেকে আজকে দেখিয়ে যাওয়াই ভালো।তাছাড়া নিয়মিত ট্রেকিংয়ে যাবার জন্য তাকে একটা ফিটনেস রুটিন মেনে চলতে হয়,তাই কবে থেকে আবার দৌড়ানো শুরু করতে পারবে সেটা জেনে নেওয়াটাও একান্ত জরুরি। এইসব ভাবতে ভাবতে সে চুপচাপ হুইলচেয়ারে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। 

আজ বেশ ভীড় রয়েছে,চারপাশ দেখতে দেখতে সে একটি অল্পবয়সী মেয়েকে লক্ষ্য করে অসম্ভব দ্রুততার সাথে পরপর পেশেন্টদের মেডিকেল ফাইল নিয়ে বিলিং করছে,আবার মাঝে মাঝেই বিভিন্ন কনসালটেন্ট ডাক্তারের চেম্বারে নানা কারণে তার ডাক পড়ছে এবং কখনো কখনো সে নিজে থেকেই কোনো কোনো পেশেন্টকে,বিশেষত বয়স্কদের,নির্দিষ্ট ডাক্তারের চেম্বারে যেতে সাহায্য করছে। মোটকথা সে দেখতে পায় মেয়েটা একনাগাড়ে বিভিন্ন কাজ করে চলেছে যার মধ্যে হয়তো সবগুলো ঠিক সে অর্থে তার কাজও নয় তবুও তার মধ্যে বিরক্তির চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যায়না,বরঞ্চ গৌরব লক্ষ্য করে তার মুখে একটা স্মিত হাসি লেগেই রয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে তাকে বসে থাকতে দেখে মেয়েটি একসময় উঠে এসে জানতে চায় সে কি ড: কুলকার্নির জন্যে অপেক্ষা করছে, গৌরব হ্যাঁ বলায় সে তার নাম জিজ্ঞেস করে তার ফাইলটা ড: কুলকার্নির অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে আসে। এইসময় গৌরবের চোখে পড়ে মেয়েটির নেমপ্লেটে লেখা ‘শ্রীময়ী’। এরপর গৌরবের ডাক পড়লে কাছাকাছি কোনো হুইলচেয়ার বাহক না থাকায় শ্রীময়ী নিজেই উঠে এসে তাকে চেম্বারে নিয়ে যায় এবং ডাক্তার দেখানো শেষ হলে পরম যত্নে আবার তাকে বাইরে নিয়ে আসে। গৌরবের মধ্যে শ্রদ্ধা,কৃতজ্ঞতা ও মুগ্ধতা মেশানো একটা অপূর্ব অনুভূতি হয়, এতদিনের কঠোর শাসনে দমিয়ে রাখা তার সমস্ত আবেগের বাঁধ এই সামান্য সহযোগিতাটুকুর স্পর্শে এক নিমেষে ভেঙ্গে পড়ে। একবিন্দু জলের জন্য ছটফট করতে থাকা তার তৃষিত হৃদয় যেন সুশীতল বারিধারায় নবজীবন লাভ করে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে এই ভালোলাগার রেশটুকু নিজের অজান্তেই তার সমস্ত মনকে ছেয়ে ফেলে। হঠাৎই ঝোঁকের মাথায় গৌরব ফোনের ফেসবুক খুলে শ্রীময়ীর প্রোফাইল খুঁজে বার করে তাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটা ধন্যবাদসূচক মেসেজ করে ফেলে। কিন্তু বেশ কয়েকদিন পরেও মেসেজটার কোনো প্রত্যুত্তর না আসায় তার মনটা একটু খারাপ হয়ে যায়,অথচ দেখা যাচ্ছে যে,শ্রীময়ী মেসেজটা পড়েছে। মনের মধ্যে তখনও একটা ক্ষীণ আশা তার যুক্তিবোধকে পুরোপুরি আচ্ছন্ন করে ফেলে। গৌরব ভাবে কাজের চাপে শ্রীময়ী হয়তো মেসেজটার কথা ভুলেই গেছে। বরাবরের অভ্যাসমত অন্তরের গভীর অনুভূতিগুলোকে লিখে ফেলতে গিয়ে সে দেখে সেটা একটা সুন্দর কবিতার রূপ নিয়েছে;প্রথমেই তার মাথায় আসে 'হুইলচেয়ার' নামটা। একবার ভাবে কবিতাটা ফেসবুকে শেয়ার করে সে শ্রীময়ীকে ট্যাগ করবে কিনা, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয় ব্যাপারটা খুব একটা শোভন হবেনা। এর মধ্যে অপারেশনের পরে প্রায় ছ'সপ্তাহ কেটে গেছে,গৌরব কিছুদিন আগে থেকেই ওয়াকার ছাড়া হাঁটা শুরু করেছে,এরপর সে একদিন চেষ্টা করে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে ওঠার আর তাতে সে সফলও হয়। আনন্দে ড: কুলকার্নিকে ধন্যবাদ জানানোর কথা মনে হতেই সে ফেসবুকে তার সুস্থ হয়ে ওঠার স্টেটাস আপডেট করে তাঁকে এবং হসপিটালের অর্থোপেডিক ডিপার্টমেন্টের পেজটা ট্যাগ করে,আর কি খেয়ালের বশে নিচে কবিতাটাও শেয়ার করে ফেলে। খুব একটা সচেতনভাবে যে সে এটা করে তাও নয়,আসলে বেশ কিছুদিন যাবৎ তার মনটা পুরোপুরি নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিলনা।এর একমাস পরে ফলোআপ চেকআপের জন্য গেলে আবার শ্রীময়ীর সাথে দেখা হয়,সে হাসিমুখে জানতে চায় এখন গৌরব কেমন আছে। এইবার হসপিটাল থেকে ফেরার সময় গৌরব উপলব্ধি করে সে শ্রীময়ীকে সত্যিসত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু পরক্ষণেই তার নিজের অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। না,সে কিছুতেই তার ভালোবাসার কথা জানাতে পারবেনা,বরং তার চেয়ে যদি একটা মধুর বন্ধুত্বের সম্পর্কও গড়ে ওঠে,তাও তার কাছে পরম পাওয়া। বাড়ি ফিরে শ্রীময়ীর প্রোফাইলটা খুলে সে অনেক্ষন ধরে তার বিভিন্ন পছন্দের বিষয়গুলো দেখতে থাকে। কিছু কিছু বিষয়,বিশেষত মিউজিকের অনেকাংশই তার নিজের পছন্দের সাথে মেলে দেখে সে মনে মনে বেশ উৎফুল্ল হয় আর সাহস করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটাও পাঠিয়ে ফেলে।কিন্তু বেশ কিছুদিন কেটে যাবার পরেও শ্রীময়ী তার রিকোয়েস্টটা একসেপ্ট করেনি, ইতিমধ্যে গৌরব তাদের পছন্দের এক সঙ্গীত শিল্পীর বেশ কিছু মিউজিক ভিডিও নিজের ওয়ালে শেয়ার করেছে।  কিছুটা অধৈর্য্য হয়েই এরপর একদিন সন্ধেবেলা গৌরব তার সংগ্রহে থাকা সেই শিল্পীর একটা স্টেজ পারফরম্যান্সের ভিডিও লিংক শ্রীময়ীকে ইনবক্স করে। কিন্তু এবারও কোনো উত্তর আসেনা,সাথে গৌরব লক্ষ্য করে,এবার আর শ্রীময়ী মেসেজটা পড়েওনি, আর তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটাও ডিলিট করে দিয়েছে। গৌরবের কাছে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হয়ে যায়,শ্রীময়ী ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করছেনা। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায়,অনেককিছু বলার ছিল,অন্তত একবার যদি এভাবে বিরক্ত করার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিতে পারত!

গৌরব বুঝতে পারে,এখনই যদি সে দিনকয়েকের জন্য পাহাড়ে না যায়,আস্তে আস্তে সে আবার গভীর অবসাদে ডুবে যাবে। প্রতিটা ডিপ্রেশন ফেজ কাটাতে যে কি অপরিসীম মানসিক শক্তিক্ষয় হয়,তা যারা অবসাদের শিকার তারা ছাড়া অন্য কেউ বুঝতে পারেনা। এই অবস্থায় একমাত্র পর্বতের বিশালত্বের কাছেই সে আশ্রয় খুঁজে পায়। ট্রেকিং ক্লাবের সাইট খুলে সে দেখে পরের সপ্তাহেই শুরু হচ্ছে অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেক,এটা তার অনেকদিনের স্বপ্ন। ব্যাচ প্রায় ফুল,তড়িঘড়ি করে সে রেজিস্টার করে ফেলে। অফিসে এখন চাপ একটু কম,পুজোর ছুটির সাথে আরো সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি সে ম্যানেজ করে ফেলতে পারবে,খালি মাকে সত্যিটা বলা যাবেনা,আগের বারেই সে লিগামেন্ট ছিঁড়ে এসেছে,মা ভয়ানক কান্নাকাটি করবে। অগত্যা বাড়িতে তিন সপ্তাহের বিজনেস ট্রিপের নাম করে যাবে মনস্থির করে সে কলকাতা থেকে কাঠমানডু যাওয়া আসার ফ্লাইট টিকিটও বুক করে নেয়।


তিন।

অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্রেক শুরু হয় কাঠমানডু থেকে প্রায় ১৭৩ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে লামজং জেলার বেসিশহর বলে একটা জায়গা থেকে, জীপে ঘন্টা ছয়েকের পথ। পরের দিন সকাল থেকে গৌরবদের ট্রেকিং শুরু হবে, টিমে ১৭ জন ট্রেকার,১ জন ট্রেক লিডার, ২ জন গাইড ও ৩ জন পোর্টার সব মিলিয়ে মোট ২৩ জন। এই ধরণের ট্রেকিংগুলো গৌরবের আরো ভালো লাগে কারণ প্রচুর অপরিচিত মানুষের সাথে পরিচয় হয়,অনেক বিদেশীও যোগ দেয় আর এই কদিন একসাথে থাকতে থাকতে সবাই একটা পরিবারের মতো হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে অনেকের সাথেই ট্রেকিংয়ের পরও ফেসবুক,হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ থেকে যায়,অর্থাৎ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সাথে সাথে বাড়তি পাওনা হিসাবে সারাজীবনের মতো কিছু বন্ধুত্বও তৈরী হয়। পরের দিন ভোরের আলো ফুটলে গৌরবরা যাত্রা শুরু করে,আকাশ একেবারে পরিষ্কার,চমৎকার আবহাওয়া। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে,কিন্তু গৌরব জানে একটু কিছুক্ষন পাহাড়ি রাস্তায় উঠলেই এটা কেটে যাবে। প্রথম সপ্তাহটা খুব ভালোভাবেই কাটে,মাঝে একদিন হালকা বৃষ্টি আর তুষারপাত ছাড়া সেরকম উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি,তারা মোটামুটি পরিকল্পনামতই অগ্রসর হচ্ছে। এই ট্রেকটার মূল আকর্ষণ হলো দশম থেকে দ্বাদশ দিন,অর্থাৎ মানাং থেকে মুক্তিনাথ মন্দির যাবার পথে থরুং লা গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করা,প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মিটার উচ্চ এই গিরিপথটিই এই ট্রেকের উচ্চতম এবং সর্বাপেক্ষা বিপদসংকুল স্থান। এই উচ্চতায় যে কোনো সময়ে আবহাওয়া খারাপ হতে পারে এবং অভিযাত্রীরা তুষারধ্বসের কবলে পড়তে পারে। একজন অভিজ্ঞ ট্রেকার হিসাবে গৌরব এটাও জানে যে,তুষারধ্বসের কারণে অন্নপূর্ণা শৃঙ্গ অভিযানের মৃত্যুহার সর্বাধিক,এমনকি কে-টু'র থেকেও বেশি। কিন্তু ছোট থেকেই বেপরোয়া প্রকৃতির গৌরব মৃত্যুভয়কে কোনোদিনই খুব একটা পাত্তা দেয়নি,আর এখন তো সেরকম পিছুটান না থাকায় এসব নিয়ে সে আর ভাবেইনা|নির্ধারিত সূচী অনুযায়ী অষ্টম দিনের শেষে তারা মানাংএ পৌঁছায়,এর পরের দিনটা বিশ্রাম,এই উচ্চতায় আবহাওয়ার সাথে অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় দরকার হয়। পরের দিন গৌরব একটু দেরী করেই ঘুম থেকে ওঠে,ঠান্ডাটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে,একটু বেলা হলে মানাংএর টি হাউসে আগুনের চারপাশে বসে আড্ডা শুরু হয়,আকাশটা বেশ মেঘলা করে রয়েছে, দুপুরবেলাতেও আলো এতো কম আর চারিদিক কুয়াশায় ঢাকা যে ওদের আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করেনা। সন্ধ্যের পর খাওয়াদাওয়া সেরে সবাই তাড়াতাড়ি শুতে চলে যায়, পরদিন থেকে অভিযানের সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ যাত্রাপথের শুরু। ভোরবেলা বাইরে বেরিয়ে গৌরব দেখে আবহাওয়া বেশ খারাপ,টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে আর সারারাতে বেশ ভালোই তুষারপাত হয়েছে,যতদূর চোখ যায় সমস্ত পথটাই বরফে ঢেকে রয়েছে। ট্রেক লিডারের নির্দেশমত ওরা সবাই রেনকোট চড়িয়ে নেয় ও জুতোয় ক্র্যাম্পন লাগিয়ে নেয়। দশম দিনের শেষে ওরা লেতদার বলে একটা জায়গায় পৌঁছায়,ততক্ষণে সন্ধ্যে নেমে গেছে। আজ সারাদিন আবহাওয়া ভীষণই খারাপ ছিল,মাঝে মাঝেই প্রবল বর্ষণ আর তুষারপাতের জন্য ওদের অনেকবার থামতে হয়েছে,সবাই খুব ক্লান্ত,তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে সকলে শুয়ে পড়ে। ভোরবেলা একটা তীব্র শোঁ শোঁ শব্দে গৌরবের ঘুম ভেঙ্গে যায়|জানলার পর্দা সামান্য সরিয়ে সে দেখে বাইরে প্রবল তুষারঝড় হচ্ছে আর যতদূর দেখা যাচ্ছে প্রায় হাঁটু সমান বরফ জমে রয়েছে|ট্রেক লিডার জানিয়ে দেয় যে,আবহাওয়ার উন্নতি না হলে বেরোনো যাবেনা। গৌরব কিছুটা মুষড়ে পড়ে,মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে এই দুর্যোগে নেটওয়ার্কও চলে গেছে|বেলা বাড়লে ঝড়ের তীব্রতা কিছুটা কমে আসে, এইসব ট্রেকে সাধারণত একটা আশ্রয়ে দু’একদিনের বেশি থাকা যায়না কারণ অত্যন্ত দুর্গম অঞ্চল হবার জন্যে রশদের সঞ্চয় থাকে খুবই সীমিত। তাই দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে হালকা তুষারপাত হতে থাকা সত্ত্বেও সকলে পরবর্তী গন্তব্য থরুং ফেদীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়|কিন্তু ভাগ্য বোধহয় তাদের সঙ্গে ছিলনা,এক ঘন্টার মধ্যেই আকাশ পুরো অন্ধকার হয়ে যায়,শুরু হয়ে যায় প্রচন্ড তুষারঝড়। যাত্রাপথের এমন একটা জায়গায় তারা এই বিপদের সম্মুক্ষীন হয় যার কাছাকাছি আশ্রয় নেবার মত কিছুই নেই|এইভাবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে মৃত্যু অনিবার্য,যে কোনো সময় তুষারধ্বস নেমে এসে তাদের তুষার সমাধি ঘটাতে পারে। ট্রেক লিডারের নির্দেশ মত সবাই মিলে একটা লম্বা দড়িতে নিজেকে এক পাক করে জড়িয়ে নিয়ে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকে যাতে কেউ ছিটকে না যায়। তাঁবু খাটাতে পারলে অন্তত প্রচণ্ড ঠান্ডার হাত থেকে একটু বাঁচা যেত,কিন্তু ঝড় একটু না কমলে তা সম্ভব নয়। এদিকে ঝড়ের দাপট ক্রমশ বাড়তেই থাকে,গোটা দলের আর কারোরই দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি অবশিষ্ট নেই। একে একে সবাই খোলা আকাশের নিচেই বসে পড়ে। বসে থাকতে থাকতে অসম্ভব ক্লান্তি আর ঠান্ডায় গৌরব কোনো এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে,তারপর আর তার কিছু মনে নেই।

জ্ঞান ফিরলে গৌরব দেখে সে একটা বিছানায় শুয়ে আছে,তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে সে অনুভব করে পায়ে কোনো সাড় নেই। তাকে ছটফট করতে দেখে নার্সের পোশাক পরা একজন এগিয়ে আসে,আশেপাশে তাকিয়ে গৌরব বুঝতে পারে সে একটা হসপিটালে রয়েছে। এরপর আস্তে আস্তে গৌরব জানতে পারে দুদিন আগে নেপালের ওপর দিয়ে ভয়াবহ একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে,যার জেরে অন্নপূর্ণা এবং ধৌলাগিরিতে প্রবল তুষারধ্বস নেমেছে এবং সংলগ্ন মানাং ও মুস্তাঙ জেলা তুষারঝড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বহু অভিযাত্রীর মৃত্যু হয়েছে,অসংখ্য নিখোঁজ,১৫০ জনেরও বেশি মানুষকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে যাদের অনেকেই এখনো এখানে ভর্তি আছে। চারপাশে তাকিয়ে গৌরব তাদের দলের কাউকেই দেখতে পায়না। ডাক্তারের কাছ থেকে সে জানতে পারে ঝড়ের পরের দিন বেলার দিকে উদ্ধারকারীদল তাকে বরফের উপর অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে,তার পাদুটো কোনোভাবে বরফের মধ্যে আটকে গিয়েছিলো,তাই সে ছিটকে নীচে পড়ে যায়নি,সেক্ষেত্রে সে নিখোঁজ হয়ে যেত অথবা বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব হতো। কিন্তু এরপর ডাক্তারবাবু যা বলেন তাতে গৌরবের বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। সারারাত তার পাদুটো বরফের মধ্যে আটকে থাকায় সে প্রাণে বেঁচে গেছে ঠিকই,কিন্তু তার দু পায়েই তীব্র তুষারক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে এবং দুটো পা ই গোড়ালির খানিকটা উপর থেকে বাদ না দিয়ে দিলে তাকে বাঁচানো যাবেনা। প্রচণ্ড চিৎকার করে চাদর সরিয়ে গৌরব দেখতে পায় তার দুটো পায়ের পাতাই গোদের মত ফুলে রয়েছে এবং বিশ্রী এক কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।গৌরবের বুঝতে অসুবিধা হয়না গ্যাংগ্রিন হয়ে তার পায়ে পচন শুরু হয়েছে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা বাদ দিতে হবে। এখনো নেটওয়ার্ক ঠিক হয়নি,তাই বাড়িতে খবর দেওয়া যাবেনা। অগত্যা সে নিজেই বন্ডে সাইন করে সম্মতি দিয়ে দেয়,এখনো ফেরার এক সপ্তাহ বাকি আছে,অপারেশনের পর প্রয়োজনমত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

অপারেশন থিয়েটারে যেতে যেতে গৌরবের চোখের সামনে মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে,মা যে কি করে এই আঘাতটা সামলাবে সে ভেবে পায়না । শ্রীময়ীর কথা মনে পড়ে,আর কোনোদিন ওর সাথে দেখা হবেনা। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস!এরপর তাকে বাকী জীবনটা হুইলচেয়ারেই কাটাতে হবে,আর কখনো সে পাহাড়ে আসতে পারবেনা,ইচ্ছেমতো রাস্তায় ঘুরতে পারবেনা,আর কোনোদিন একা একা লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়তে পারবেনা;এর চাইতে মরে যাওয়াইতো ভালো ছিল।


চার।

কলকাতায় ফিরে আসার পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে,গৌরব মায়ের সামনে কোনো দুর্বলতা প্রকাশ করেনি। মাও আস্তে আস্তে প্রাথমিক শোকটা কাটিয়ে উঠেছে,আসলে কোনো কিছুই তো থেমে থাকেনা,জীবন ঠিকই তার নিজের ছন্দ খুঁজে নেয়। গৌরবের সারাদিনের সঙ্গী এখন হুইলচেয়ার,সে বারান্দা দিয়ে বাইরের জগৎটাকে দেখে,কখনো বই পড়ে বা গান শোনে, মায়ের জন্যেই মনকে শক্ত রাখতে হয়। অফিস থেকে জানিয়ে দিয়েছে সে আরো কিছুটা সুস্থ হয়ে গেলে বাড়ি থেকেই কাজ করতে পারে,অফিসে আসার দরকার নেই। 

আজ অনেকদিন পর গৌরব লিখতে বসেছে,ভেবেছিল তার ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলবে। ডায়েরীর পাতা উল্টাতে গিয়ে তার চোখ পড়ে কিছুদিন আগেই লেখা 'হুইলচেয়ার'কবিতাটার খসড়ায়। একদিন ভালোলাগা থেকে যে কবিতাটা সে লিখে ফেলেছিলো,সেটা যে তার জীবনের এরকম অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়াবে তা সে দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করেনি। এটা কি নিছকই কাকতালীয়,না কি তার প্রিমনিশন ছিল গৌরব ভেবে পায়না। হঠাৎ মনে হয়,সেদিনের না বলতে পারা কথাগুলো শ্রীময়ীকে জানাতে পারলে ভালো হতো,আজতো তার আর আশা,ক্ষোভ,অভিমান কোনোকিছুই নেই।

#

এবারের পুজোটা পুরো বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে,'হুদহুদ'না কি একটা প্রবল ঘূর্ণিঝড় অন্ধ্র উপকূলে আছড়ে পড়ায় কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিম্নচাপের কবলে,আর তার জেরে টানা প্রবল বর্ষণ। সারা বছরের রুটিনবাধা জীবন থেকে মুক্তি পেতে পুজোর ছুটির কটা দিনও যদি একটু বেরোনো না যায় কারই বা ভালো লাগে। পুজোটা তো গেল,দীপাবলী আসতে চললো,আবার গতকাল থেকে টানা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শ্রীময়ীর শরীরটা ভালো লাগছেনা,কালকে ফেরার সময় পুরো ভিজে গেছে,রাত থেকে একটু জ্বরও এসেছে।  সারারাত বৃষ্টি হওয়ায় বাড়ির সামনের রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে গেছে,আজ আর বেরোতে ইচ্ছে করছেনা। শ্রীময়ী ফোন করে মধুমিতাদিকে তার অসুস্থতার কথা জানিয়ে দেয়। এখনই উঠতে ইচ্ছে করছেনা,মাথাটাও ধরে রয়েছে,একটা প্যারাসিটামল খেয়ে সে আবার শুয়ে পড়ে। সাড়ে দশটার সময় মা'র ডাকে ঘুম ভাঙে,শরীরটা কিছুটা সুস্থ লাগছে,জ্বরটাও এখন নেই। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছিল শ্রীময়ী,হঠাৎ মোবাইলে একটা মেসেজ নোটিফিকেশন এলে সে দেখে ফেসবুকে একটা নতুন মেসেজ। আবার সেই ছেলেটা!শ্রীময়ী ভেবেছিল এতদিনে বোধহয় ঝামেলাটা থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও খানিকটা কৌতূহলবশতই সে মেসেজটা খুলে পড়তে থাকে। 

"ম্যাডাম,

আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল তাই শেষবারের মতো বিরক্ত করছি। আপনি প্রথম যেদিন আমাকে হুইলচেয়ারে ডক্টরের চেম্বারে নিয়ে গিয়েছিলেন সেদিন থেকেই আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিলাম,কিন্তু সংকোচবশত সামনাসামনি বলে উঠতে পারিনি। তাই নিছক আবেগের বশে আমার কিছু লেখা ফেসবুকে পাবলিকলি শেয়ার করে ফেলেছিলাম; বিশ্বাস করুন,আমার কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিলনা। পরে আমি অনুধাবন করেছি,এগুলো হয়তো আপনাকে যথেষ্ট বিড়ম্বনায় ফেলেছে;এর জন্যে আমি আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী। আমি জানিনা এই মেসেজটা আপনি পুরোটা পড়বেন কিনা,কথাগুলো সরাসরি আপনাকে বলতে পারলে আমার মনের ভার কিছুটা হালকা হতো,কিন্তু আপনার সাথে হয়তো আর কোনোদিনই দেখা হবেনা। নেপালে ট্রেকিংয়ে গিয়ে একটা দুর্ঘটনায় আমার দুটো পায়ের পাতাই ফ্রস্টবাইটের জন্য বাদ দিতে হয়েছে;ভাগ্যের বিড়ম্বনায় হুইলচেয়ার আজ আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আপনাকে আশ্বস্ত করছি আর কখনোই আপনাকে নিয়ে কোনো লেখা কোথাও শেয়ার করবোনা। জীবনের দুটো ভালোলাগার মধ্যে ট্রেকিংকে চিরদিনের মতো বিদায় জানাতে হয়েছে,তাই যে ক'দিন বাঁচবো কবিতাকেই সম্বল করে বাঁচতে হবে।

শেষবারের মতো আমার ভালোলাগার একটা কবিতার (চার্লস বুকোওস্কির'নো হেল্প ফর দ্যাট')অনুবাদ আপনাকে শোনাতে চাই। 


হৃদয়ের মাঝে একটি স্থান কখনো হয়না পূর্ণ
সকল আনন্দ ও সুখের মাঝেও রয়ে যায় চিরশূন্য
উপলব্ধি তীব্রতর হয় প্রতিটি অতিক্রান্ত দিনে
আমাদের নিরন্তর অপেক্ষা হৃদয়ের সেই শূন্যস্থানে।

আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবনা|, ভালো থাকবেন।

~গৌরব ব্যানার্জী" 


আশ্বিনের অকাল বর্ষণে বাইরের দৃশ্যপট ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে শ্রীময়ী অনুভব করে বৃষ্টিভেজা কাচের শার্সিটাই শুধুমাত্র তার দৃষ্টিপথকে অবরুদ্ধ করছেনা। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ