জয়দেব কেন্দুলি থেকে ফিরে

জয়দেব কেন্দুলি থেকে ফিরে




ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছি পথের টানে ।সব ধর্ম এসে মিলেছে যে পথে -- হিন্দু ,মুসলমান , বৌদ্ধ , খৃস্ট .-- এ এক মিলনমেলা ।কবি ,বাউল , ফকির , মিলেমিশে একাকার ।

আকাশে মস্ত বড় চাঁদ আর নিচে চাঁদের হাট বসেছে । জশতাব্দী এক্সস্প্রেস নামিয়ে দিয়েছে দুর্গাপুর স্টেশনে । এরপরের পথটুকু গাড়িতে । সন্ধ্যে নেমেছে । শহরের পথ শেষ ।দুপাশে জঙ্গল মধ্যে রাস্তা । ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন ড্রাইভার -- আপনারা কলকাতা থেকে এই মেলায় ? কেন ? এই উত্তর দিতে গিয়ে রাগ করেছি মনে মনে । আমি যে এই মাটির'ই মেয়ে । মাটি টেনেছে -- ডাক এসেছে তাই --বীরভূমের কবিরা ডেকেছেন বলেই ।

''আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া '' --

গাড়ি জ্যামে পড়েছে । দীর্ঘ লাইন, এত গাড়ি, বাস -- লক্ষ লক্ষ মানুষ চলেছে -- সেই জয়দেব কেন্দুলির পথে । গাড়ি নামিয়ে দিয়েছে অজয়ের এক তীরে। অন্য প্রান্তে বিশাল মেলা। দূর থেকে আলো দেখা যায়। দু কিলোমিটার এই নদীপথ। অন্ধকার মাটির রাস্তা। জনসমুদ্র না জনজোয়ার বলা মুস্কিল। দুদিকে অজয়ের পাড়। কনকনে ঠাণ্ডা। চলতে চলতে পথ চলা শেষ। এসেছি সংস্কৃতির কেন্দ্র ভক্তিভবন। দোতলায় কম্বল মুড়ি দিয়ে সারারাত কাঁপুনি। সেদিন ছয় ডিগ্রিতে নেমে গেছে, শীতলতম দিন। আমি ভাবছি -- যারা এই খোলা আকাশে, খড়ের বিছানায় রাত কাটায় তারা কেমন করে বাঁচে ? কত অবহেলায় পড়ে আছে এই তীর্থস্থান আর মানুষ -- ভাবলে অবাক হতে হয় ।

জয়দেব কেন্দুলি থেকে ফিরে --আমি যখন এই প্রতিবেদন লিখতে বসেছি তখন ভাল,মন্দ দুটোই বলতে হবে। পরিবেশ আর আগের মত নেই। একদিন বাবার সাথে এসে যে গান শুনেছি, আজ সেই গান বেজেছে আখড়ায় কিন্তু চারিদিক থেকে এমন গানের সংমিশ্রণে সে গান পড়ে গেছে ঢাকা । হিন্দি ,চটুল গান বাজছে মাইকে সেখানে ডুবকি,একতারা ক্ষীণ । বাইরে থেকে কিছু মানুষ আসে, মদ বা অন্য কিছুর মোহে -- সে জন্য গভীর দুঃখ রয়ে গেল মনে ।

পরের দিন সেই আলোভরা সকাল। আবার মিশে গেছি পথে, মিশে গেছি মানুষের সাথে।  রাধাবিনোদ মন্দির আজও দাঁড়িয়ে অতীতের সাক্ষী। ভেতরে শ্রীকৃষ্ণ, রাধারানী । একদিন কদমখণ্ডীর ঘাটে কবি জয়দেব পেয়েছিলেন। গরম পায়েস প্রসাদ ।

অজয়ে সেদিন গঙ্গা এসে মেশে -- এই বিশ্বাসে স্নান সেরে পুজো দেয় লক্ষ লক্ষ মানুষ।এঁরা সমাজের অভিজাত শ্রেনী নয়। ধুলো পা, গ্রামীন মানুষ, বউ, ছেলে মেয়ে, বা পরিবার নিয়ে শুধু পুণ্য করতে আসে এই মকর সংক্রান্তির দিনে । নিজেদের ঘরে কি আছে জানা আছে তবু তারা মুঠো মুঠো চাল ,পয়সা দান করে আরও হতদরিদ্র মানুষদের ।

জয়দেব কেন্দুলি থেকে ফিরে --যে কোন আশ্রম বাউল আখড়ায় আপনাকে সাদরে বসতে দেবেন, শালপাতায় প্রসাদ এনে দেবেন । পেট পুরে খেতে দেবেন যা গ্রামের মানুষদের দান । মাধুকরী বলে যাকে। এই আন্তরিকতার কোন তুলনা পাবেন না। ধন্যবাদ জানাবেন না, তাহলে তাঁরা বলবেন জয় নিতাই জয় গৌর -- সব ওপরওয়ালা মালিক । আমরা সেই দীন । এই বোধ নিয়েই এই মেলায় আসা ভাল ।

মেলায় পাওয়া যায় গ্রামের আদিবাসী মেয়েদের তৈরি বেতের ধামা, কুলো, মোড়া,শীতলপাটি, নারকোলের মালায় তৈরি একতারা,পাটের ব্যাগ । 

যে কাজে এসেছি, শুরু হয়েছে একটু বেলায় সেই কবিমেলা। বীরভূমের সমৃদ্ধ মাটি জন্ম দেয় কত কবি, গুনী মানুষ। রীনাদি এসেছেন আলোর বেণু পত্রিকার সম্পাদিকা । উদ্বোধন হল জয়দেব সংখ্যা, প্রতিদ্বন্দ্বী, কিছু বই, গোঁসাইবাগানের মতন কাগজ । এসেছিলেন অরুন চক্রবর্তী যিনি ৫৪ বছর ধরে এই মেলায় আসছেন। সংবর্ধনা জানানো হল কবিদের। এঁরা কবিদের সম্মান দিতে জানেন। আন্তরিক ব্যবহারের তুলনা নেই । মন ভরে উঠল কবিতায়, গানে, বাঁশিতে । আমার স্কুল, কলেজের অধ্যাপক কিশোরীরঞ্জন দাশের চরণ স্পর্শ করে ধন্য হলাম । এসেছিলেন কয়েকজন দুর্গাপুরের কবি পুষ্প কর ,পার্বতীদি, সুমিত্রা পাল, কেউ কলকাতার, সিউরি ,দুবরাজপুর থেকেও এসেছিলেন। সভা শেষ হল ।

ফিরে যেতে মন চায় না -- তবু বিদায় নিয়ে যেতে হবে । প্রণাম জানাই প্রিয় মানুষদের, কবিদের, বাউল আখড়ার শিল্পীদের । প্রণাম রাধামাধব । আবার ফিরে আসব এই মাটির টানে বার বার - প্রতিবার ।



প্রতিবেদক -
 কোয়েলী ঘোষ 
কলকাতা




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ