জয়িতা দে সরকার

অভিসারিকা-  (ওমেন অন হার জার্নি ওফ লাভ)








শীতের রাতের বৃষ্টি রাতটাকে আরও কনকনে করে তুলেছে। ঘড়িতে মাত্র আটটা। তবু যেন মনে হচ্ছে মধ্যরাত্রি। গোটা শহরে এখন শীতের কার্ফু চলছে । সব্বাই ঘরবন্দী প্রায়। কিছু নিরুপায় মানুষ পেটের তাগিদে রাস্তায় রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। আর কিছু অসহায় মানুষ যাদের ছাদ বলতে ওই খোলা আকাশ এবং ঘর বলতে ফুটপাতের একাংশই সম্বল তারাও বসে আছে কোনরকমে মাথা বাঁচিয়ে। ফ্ল্যাটের জানালা থেকে একদৃষ্টে রাতের ভেজা শহর দেখছিল পৃথা। 

-কি রে কি দেখছিস এত মন দিয়ে?
-ভেজা শহর। নরম গলায় উত্তর দেয় পৃথা।
-খিদে পায়নি তোর? আমার কিন্তু জমিয়ে খিদে পেয়েছে। পিৎজাটা যে কখন আসবে। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
-চলে আসবে। অস্থির হচ্ছিস কেন!
-তুই সবসময় এত কুল থাকিস কি করে বলত? আমার তো শালা...
-চুপ করবি? ফুটপাথের লোকগুলোকে তাকিয়ে দেখ একবার। এই ঠাণ্ডায় কিভাবে ভিজছে ওরা।

কথাগুলো বলতে বলতেই কাঁচের সাটার টেনে দিয়ে খাটের দিকে হেঁটে আসে পৃথা। ঘরটায় এখন অল্প আলো জ্বলছিল। আর এই অল্প আলোতে পৃথাকে যে কি সুন্দর লাগছিল সেটার কোন উপমাই মনে হয় রুপুর কাছে নেই। 

পৃথা পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল। এমন সময় ওর হাত টেনে ধরে একেবারে নিজের ঠোঁটের কাছে নিয়ে আসে রুপু।

-আঃ রুপু ছাড়। এখন না। ইচ্ছে করছে না।
-তোর কি হয়েছে বলতো? দু’দিন ধরে লক্ষ্য করছি কেমন যেন ঝিমিয়ে আছিস? গতকাল রাতেও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লি।
-কিচ্ছু হয়নি আমার।
-শোন পৃথা তুই সারা দুনিয়ার সবার থেকে সব কিছু লুকাতে পারিস কিন্তু আমার থেকে পারবি না। আর সেটা করার চেষ্টাও করবি না কোনদিন।

পৃথা একটু আগেও গুম মেরে ছিল। রুপুর কথায় কিছু ভরসা পেল মনে হয়। বেশ কিছুটা আবেগতাড়িত হয়েই রুপুকে জড়িয়ে ধরল। 

-তুই আমাকে ছেড়ে কক্ষনো কোথাও যাবি না তো রুপু?
-আবার এইসব ভুলভাল কথা কেন বলছিস তুই? আঙ্কেল কিছু বলেছে তোকে?
-না,মা বলছিল। একটা ভালো ছেলের সন্ধান পেয়েছে। কথা এগোতে চায়।
-ভালো ছেলে? আচ্ছা পৃথা তুই কি জানিস আজকের ডেটে ভালো ছেলের সংজ্ঞা ঠিক কি? জানলে আমাকে বলবি প্লিস?

পৃথা চুপ করে থাকে। রুপুর এই প্রশ্নের কোন উত্তর ঠিক এই মুহূর্তে ওর কাছে জানা নেই। আর এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের খোঁজে পৃথা কোনদিন কি আদৌ ছুটেছে।

-পৃথা শোন। এত ভেবে লাভ নেই বুঝলি। তুই বাড়ি গিয়ে যা বলার সব বলবি। তারপর যা হবে দেখা যাবে। আর আমি তো আছিই। এত ভয় পাচ্ছিস কেন তুই? আমি সব সামলে নেবো।

পৃথা রুপুকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায়।

-এই জন্যেই তো তোকে এত ভালোবাসি। তুই ছাড়া আমাকে কেউ বোঝে না। কেউ না।

রুপুও পৃথাকে একটু আদর করে দেয়। ঠিক তখনই ডোরবেলটা বেজে ওঠে। পিৎজা এসে গেল মনে হয়।


(পর্ব-দুই)

আজ ওদের ফাইনাল এক্সামের শেষ পরীক্ষা। এর কিছুদিন পরেই ওরা যে যার বাড়িতে ফিরে যাবে। অথবা যারা ক্যাম্পাসিং-এই চাকরি পেয়ে গেছে তারা সোজা চাকরি জয়েন করতে চলে যাবে। পৃথাকেও বাড়ি ফিরতে হবে। একাই ফিরতে হবে। রুপু ফিরবে না। রুপু তিন-চার দিন পরেই সোজা চেন্নাই চলে যাবে। ওর নতুন চাকরি জয়েন করতে। রুপুর চাকরি হয়েছে বিষয়টা যতটাই আনন্দের ঠিক ততটাই কষ্টেরও রুপু এবং পৃথা দুজনের কাছেই। কিন্তু কিছু করারও নেই। আজ পরীক্ষার শেষে ওরা সিসিডি-তে গিয়ে বসেছিল। পৃথার মুখটা ভার দেখে রুপু ওর হাতের উপর নিজের হাতটা রাখে। পৃথার চোখ দিয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে নেমে এসে ওর গাল ভিজিয়ে দিচ্ছিল। 

-পৃথা প্লিস। তুই এইরকম করলে আমি কিন্তু যাবোই না।
-আচ্ছা ঠিক আছে আমি কাঁদব না।

পৃথার চোখের জল মুছিয়ে দেয় রুপু। ঠিক তখনই পাশের টেবিল থেকে আওয়াজ ভেসে আসে ...

-গার্লফ্রেন্ড নাকি রে?
-হতেই পারে। আজকাল বাপু কিছুই অসম্ভব নয়। বর্তমান সমাজটা একেবারে উচ্ছন্নে যাচ্ছে দিনে দিনে।

ওদের পাশের টেবিলে বসে ছিল খান চারেক বছর পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশের মহিলা। ওরাই এসব কথা আলোচনা করছিল নিজেদের মধ্যে। কথাগুলো ওদের কানে আসছিল। রুপুর কান গরম হচ্ছিল কথাগুলো শুনে। পৃথা বুঝতে পারছিল। ও রুপুর হাত চেপে ধরেছিল তাই।

-নিজেদের ঘরেও তো ছেলে মেয়ে আছে। তাই ভীষণ ভয় লাগে রে। কি যে হচ্ছে এইসব। ফেসবুকেও তো কত আজব আজব ঘটনা শোনা যায় ওই তো সেদিন বুলু বলছিল। ওর কোন পিসির মেয়ে নাকি সারাজীবন বিয়েই করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।

-এই তোরা চুপ করবি? মেয়েগুলো শুনতে পাচ্ছে মনে হয়। তোরা যা ভাবছিস আদৌ যদি সেটা সত্যি না হয় তখন...

ভদ্রমহিলাকে থামিয়ে দিয়ে রুপু,মানে রূপসা বলে ওঠে।
-আপনারা একদমই ঠিক ভেবেছেন। আমরা ‘গার্লফেন্ড’ই। আমি রূপসা আর ও পৃথা। আমরা দুজনে দুজনকে খুব ভালোবাসি। এবং আমরা সারাজীবন একসাথেই থাকতে চাই। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পৃথার হাত ধরে টানতে টানতে সেখান থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় রূপসা।

চারপাশের বাতাবরণটা হঠাৎ করেই কেমন যেন থম মেরে যায়। ওই টেবিলের মহিলারা ছাড়াও বাকিরাও শুনতে পায় এতটাই জোরে কথাগুলো বলেছিল রূপসা। সবাই সবার মুখের দিকে এক-একবার তাকাচ্ছে। কে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিলোনা। এরপরে কি সত্যিই কিছু বলার থাকে।



(পর্ব-তিন) 

ডিনার সেরে আজ সোজা বিছানায় চলে আসে রুপু। এটা ওর প্রতিদিনের অভ্যাস। আর প্রতিদিনের মতই ঘরের বাকি সব কাজ গুছিয়ে আরও মিনিট কুড়ি পরে বিছানায় গা এলায় পৃথা। কিন্তু আজ বিছানায় এসেই পৃথাকে ডাকাডাকি শুরু করে দেয় রুপু।

-কি রে তোর হল? আর কত দেরি করবি?
-আসছি। তুই ঘুমা।
-ঘুমা মানে! কাল আমি চলে যাবো পৃথা। তুই ভুলে গেলি? কতদিন তোকে আদর করা হবে না সেটার হিসেব আছে তোর?
-বেশ। তাহলে শান্ত হয়ে শুয়ে অপেক্ষা কর। হাতের কাজ শেষ করে আমি আসছি। দুদিন পর থেকে ফ্ল্যাটটাও খালিই থাকবে। সব জিনিস গুছিয়ে রাখতে হবে। তোর নিশ্চয় সেটা একেবারেই মনে নেই রুপু?

পৃথার কথায় এবার হেসে ফেলে রূপসা। পৃথাটা ছোট থেকেই বড্ড গিন্নী গিন্নী। এখনও মনে আছে রুপুর ছোটবেলায় যখন ওরা খেলনাবাটি খেলত পৃথা বৌ হত। রুপু বর।

-পৃথা?
-বল?
-আয়না রে। তুই তো জানিস তোকে আদর না করে আমার ঘুমই আসে না।
-তাহলে জেগে থাক। কে ঘুমোতে বলেছে?

পৃথা মুচকি হাসে। রুপু বুঝতে পারে পৃথা ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করছে। পৃথা দেখতে না পায় এমন ভান করে পা টিপে টিপে ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। পৃথা হেসে ফেলে। পৃথার এই হাসিতে যে মাদকতা। তার সাক্ষী কেবল এই রাত। ওই চাঁদ। আর রুপু। দুজনেই দুজনকে অনেক আদর করে। অনেক ভালোবাসার কথা বলে। অনেক প্রতিশ্রুতি আদান-প্রদান করে। পৃথা এবং রুপু একে-অপরকে উজার করে ভালোবাসা দেয়। ওদের নিত্যদিনের ভালোবাসা-বাসির সাক্ষী ওই ভেজা আকাশ। ওই গাঢ় রাত। ওই রাতজাগা তারাদের দল। ফ্ল্যাটের প্রতিটা আসবাব চেঁচিয়ে বলে ওদের ভালোবাসার কাহিনী। ওদের ছোটবেলা জানে সব-জানে এই প্রেম কাহিনীর শুরুর গল্পটা।

পৃথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে রুপু বলে ... 

-পৃথা তোর আমাদের ছোটবেলার কথা মনে আছে?
-আছে। সব মনে আছে। তুই কোনটা জানতে চাস বল?
-সেইরকম করে কিছু নয়। আমাদের রান্নাবাটি খেলার কথাটা আজ খুব মনে পড়ছিল।
-জানিস রুপু আমার বাড়িতে এখনও সেই রান্নাবাটিগুলো সাজানো আছে। মা যত্ন করে তুলে রেখেছে।
-কাকিমা তোকে খুব ভালোবাসে রে।

পৃথা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ... 

-ভালোবাসা ছাড়া মা আর কিই বা করতে পারে বল?
-কাকু মারা যাওয়ার পর কাকিমা বিয়েটা...

-থাক না রুপু। কাল তুই চলে যাবি। এমনিতেই আমার অনেক মনখারাপ। তারপর আবার এসব কথা বলে কেন আরও...। পরশু থেকে আমাকে তো ওদের সাথেই থাকতে হবে তাই না বল?

-হ্যাঁ তা হবে ঠিকই। তবে তুই কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই কলকাতায় ফিরবি। আর ফিরেই চাকরীর চেষ্টা করবি। পৃথা আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার জন্য দুজনেরই স্বাবলম্বী হওয়াটা খুব জরুরী। এটা ভুলিস না রে। কোনও চাপের কাছেই আমরা মাথা নত করব না এটা আশা করি আমরা ভুলিনি?

-না একদমই নয়। আমি কিছু ভুলিনি রুপু। ভালোবাসা মানে যদি বিশ্বাস হয়,তাহলে আমি তোকে সারাজীবন বিশ্বাস করতে চাই। আমার সব ক্ষতের আরাম শুধু তুই আর মা। কিন্তু মা এতটাই অসহায় যে আমি তার কাছে কিছুই আশা করি না।

পৃথার কপালে একটা কিস করে রুপু। ওর বুকে মাথা রাখে। পৃথা ওকে কাছে টেনে নেয়। ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে সব জ্বালা ভুলে যেতে চায়। রুপু পৃথার প্রতিটা আদরের ইশারা বোঝে। রুপুও নিজেকে ডুবিয়ে দেয় পৃথার আদরের আবেগে। সারারাত কেটে যায় এভাবেই। ভোরের সূর্যকে ‘গুডমর্নিং’ বলে ওরা ঘুমোতে যায়।



(পর্ব-চার)

রূপসা চলে গেছে প্রায় মাসখানেক হয়ে গেছে। রূপসার এই পৃথিবীতে খুব আপন বলতে সেরকম কেউই নেই। অনেক ছোটবেলাতেই রূপসা ওর বাবা-মা-কে হারিয়েছে। একটা রোড অ্যাক্সিডেন্ট মুহূর্তের মধ্যে রূপসার সমগ্র পৃথিবীটাই বদলে দিয়েছিল। এরপরেই তো ও চলে এসেছিল পৃথাদের শহরে। আর শুধু শহরেই নয়,রূপসার পিসির কোয়ার্টার আর পৃথাদের কোয়ার্টার ছিল একদম পাশাপাশি। আর সেখান থেকেই রূপসা আর পৃথার এক স্কুল। এক টিউশন। এক খেলনাবাটিতে বড় হয়ে ওঠা। রূপসা আর পৃথার বড় হয়ে ওঠা টা একদমই হাতে হাত ধরে। সেই ছোটবেলা থেকেই ওরা বেস্ট ফ্রেন্ড। রূপসা বাবা-মায়ের আদর সেভাবে পায়নি। যেটুকুও পেয়েছে তার স্মৃতি খুব আবছা। পিসি-পিসেমশাইও ওকে নিরুপায় হয়েই মানুষ করেছিলেন। অথবা বলা যায় ওনারা বাপ-মা মরা মেয়েটির উপর দয়া করেছিলেন। বাবা-মা মরা ছেলেমেয়েরা হয়তো ছোট থেকেই তাদের একটা একার জগৎ তৈরি করে নেয়। রূপসাও ঠিক তাই করেছিল। রূপসার এই একার জগতে শুধুই পৃথার প্রবেশের অধিকার ছিল। নিজের অজান্তেই পৃথাকে অনেক ভালবাসতে শুরু করেছিল রূপসা। আর এই ভালোবাসার চারাগাছটি পৃথা এবং রূপসার মনে এতটাই শিকড় বিস্তার করেছিল যে সেই শিকড় উপড়ে ফেলার সাহস বা ইচ্ছে ওদের কারুরই ছিল না। 

এদিকে পৃথা বাড়ি আর কলকাতা করেই দিন কাটাচ্ছে। সঙ্গে ক্রমাগত চলছে চাকরীর খোঁজ। পৃথাকে চাকরী করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। পৃথা সারাজীবন রূপসার সাথেই কাটাতে চায়। এই সব কিছুই ওর মায়ের জানা। বিশেষ কোনও কারণ আছে বলেই কিনা জানা নেই তবে মেয়ের এই অবাস্তব আব্দারকে মুখ বুজে মেনে নিয়েছে মহুয়া। তবে ওর মাতাল স্বামী এবং সৎ ছেলের ভয়ে এসব কোনও কথাই মুখে আনেনা মহুয়া। মহুয়া জানে পৃথা শান্ত হলেও ওর জেদ কম নয়। ও চুপ করে সব কিছুর প্রতিবাদ করে। রূপসার সাথে এক ফ্ল্যাটে থাকার সিদ্ধান্তটাও পৃথা চুপচাপ থেকেই নিয়েছিল। সমর মেরেপিটেও কিছু করতে পারেনি। এখন সমর আর ওর সৎ ছেলে মিলে উঠেপড়ে লেগেছে পৃথার বিয়ের জন্য। শেষমেশ যে কি হবে সেটা ভেবেই মহুয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তবুও মা যখন...

-মাম,তোমার বাবা তোমার জন্য পাত্র দেখছেন। এবার বিয়েটা...

মায়ের দিকে কড়া ভাবে তাকায় পৃথা। যতটা কড়া দৃষ্টি,ঠিক ততটাই শান্ত গলায় জবাব আসে ...

-তোমার স্বামী ও। কিন্তু আমার বাবা নয়। আর আমার বিয়ের জন্য ওর রাতের ঘুম যেন নষ্ট না হয় সে দায়িত্ব আমি তোমাকেই দিলাম মা। আমি আগেও বলেছি আমি চাকরি করব। আমি রূপসার সাথেই থাকবো। আমি বিয়ে করব না।

একসাথে এতগুলো কথা শুনে হকচকিয়ে গেল মহুয়া। যদিও প্রতিটা কথাই ওর বহুবার শোনা তবুও...

ওদের মা-মেয়ের কথা দরজার আড়াল থেকে শুনছিল সাগর। মহুয়ার সৎ ছেলে। সেটা বুঝে ওঠার আগেই ঘরে ঢুকে সজোরে পৃথার গালে একটা চড় কষাল ও।

-লজ্জা করে না। আমার বাবার পয়সায় ফুর্তি করছিস আবার আমার বাবাকেই...
-তুই এখান থেকে যা সাগর। আমি দেখছি।
-তুমি আর কি দেখবে। এতগুলো বছর তোমাদের পুষে শেষে কিনা এই প্রতিদান। আজ আসুক বাবা। একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব আমি।

পৃথা হঠাৎ জোরে হেসে ওঠে ...

-রাতের অন্ধকারে ষোলো বছরের মেয়ের সারা শরীরে হাত বোলায় যে, সে বাবা?

মহুয়ার গা কেঁপে ওঠে ...
-পৃথা চুপ কর।
-স্কুলে যাওয়ার পথে মেয়েকে ঝোপের আড়ালে নিয়ে গিয়ে নোংরামি করে যে, সে বাবা? আরও শুনবে,আরও শুনতে চাও তোমরা?

মহুয়া পৃথাকে সজোরে একটা থাপ্পড় কষায়। চিৎকার করে ওঠে ... 
-থামবি তুই?
-আচ্ছা থামলাম। তবে আমার গোটা জীবন নষ্ট করেছে যে মানুষ তার কথায় আমি আমার জীবনের বাকি দিনগুলো নষ্ট করব না মা। এই তোমাকে বলে দিলাম...।

এইটুকু বলে সেখান থেকে চলে যাচ্ছিল পৃথা। হঠাৎ থামে এবং সাগরের দিকে তাকিয়ে বলে ... 

-আর এই যে তোমাকে বলছি। আমি আমার বাবার পয়সাতেই পড়াশুনা করেছি। যে কদিন খেয়েছি তোমাদের সংসারে তার হিসেব করে রেখো। চাকরি করে সব সুদে আসলে মিটিয়ে দেব।

ছাদে গিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকে পৃথা। বুকে চেপে রাখা নোংরা কথাগুলো কিছুটা বলতে পেরে মন থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেছে ওর। আরও বলা উচিৎ ছিল পৃথার। মা’কে আর কষ্ট দিতে ভাল লাগে না ওর তাই এইটুকুই বলেছে। ও হয়তো এরপরে এখানে থাকবে না। কিন্তু মাকে তো থাকতে হবে এদের সাথেই। যদিও পৃথার চাকরী হলে ও চেষ্টা করবে মা’কে এই আবর্জনা থেকে সরিয়ে নিজের কাছে নিয়ে রাখার। রুপুও চায় কাকিমা ওদের সাথেই থাকুক। কিন্তু মা যাবে বলে মনে হয় না। মা ওই নোংরা লোকটাকে মন থেকেই স্বামী মেনে নিয়ে এতগুলো বছর ওনার সংসারেই রয়েছে মুখ বুজে। কাঁদতে কাঁদতে রুপুকে ফোন করে পৃথা। রুপু ওকে ওর কাছে চলে আসতে বলে।


এর ঠিক দিন সাত পরেই এক আজব ঘটনা ঘটে যায় পৃথার জীবনে। হঠাৎ করে আজ মা বলে ...

-কাল তোর বিয়ে মাম।
-বিয়ে? সে আবার কি? কি বলছ তুমি? আমি তো কিছুই...

-সমরের বন্ধুর ছেলে। ওরা বিয়েতে রাজী। তোর ছবি দেখেই ওরা তোকে পছন্দ করেছে। ছেলে বাইরে ভালো চাকরী করে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। ক’দিন পরেই ফিরে যাবে। কাল ওরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করতে চায়। সমর হ্যাঁ বলে দিয়েছে।

পৃথা কি বলবে,কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। ও জানে মা’কে ধমকিয়ে আর কোনও লাভ হবে না। তাই চুপ করেই থাকে।



আজ সন্ধ্যালগ্নেই পৃথার বিয়ে। মানে রেজিস্ট্রি। বর এসে গেছে। সাথে আরও কিছু সাঙ্গপাঙ্গ। পৃথার দিশাহারা লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না ও। বিয়ের নাম শুনলেই গা ঘিনঘিন করে ওঠে ওর। কোনও পুরুষের ছোঁয়াই যেন ওর কাম্য নয়। অসহায় লাগছিল ভীষণ। ফোনটাও কেড়ে নিয়েছে সাগর। রুপুকেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিয়ের সময় ক্রমশ এগিয়ে আসছে। পৃথার মা মুখ বুজে সব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। আর সমর আর সাগর দাঁত বের করে ভালোমানুষ সেজে সামাজিকতার দায় মাথায় নিয়ে লোকদেখানো দায়িত্ব পালন করে বেড়াচ্ছে। এসব মিথ্যে ছবি পৃথার রাগ,জেদ ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ ওর মাথায় একটা ভয়ঙ্কর বেপরোয়া সিদ্ধান্ত চাগিয়ে ওঠে। এছাড়া কোনও উপায়ই মাথায় আসে না ওর। ও ঘরে বসে থাকা ওর হবু বর এবং তার পরিবারের লোকজনের সামনে হঠাৎ করেই আলুথালু পোশাকে হাজির হয়ে যায় পৃথা। সময়ের অনেক আগেই মেয়েকে এইভাবে বিনা সাজগোজে আসরে হাজির হতে দেখে সবাই একটু হতভম্ভের মত ওকেই দেখতে থাকে। একটু হোঁচট খেয়ে,ঢোঁক গিলে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ছেলের মা উঠে আসে। পৃথার সামনে এসে ওকে প্রশ্ন করে ...

-তুমি পৃথা তাই না? কিছু বলবে?

পৃথা শান্ত ভাবেই জবাব দেয় ... 

-হ্যাঁ,বলব। আপনারা বোধহয় সবকিছু না জেনেই এ বিয়েতে রাজী হয়েছেন...

সমর এবং সাগর মুখ চাওয়াচায়ি করছে। দাঁত কিড়মিড় করছে। সমর তার আগুনের গোলার মত দৃষ্টিতে বারবার দেখছে মহুয়ার দিকে। মহুয়ার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। যা ঘটতে চলেছে তার পরিণাম ওর জানা। পৃথাও সব বুঝতে পারছে,কিন্তু ও নিরুপায়। 

পৃথা একটুও থামছে না। এ সময় ওকে থামিয়েও লাভ নেই সেটা সমর, সাগর এবং মহুয়া বুঝে গেছে। তবু সমর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখে।

-পৃথা মা তুমি তৈরি হয়ে নাও। যা বলার আছে সেগুলো পরে বললেও তো চলে...

পৃথার কানে এইসব কথা যাচ্ছিলই না।

-আপনারা কি জানেন এ বিয়েতে আমার কোনও মত নেই? আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই আপনারা বিয়েতে মত দিয়ে দিলেন? আমি চাইনা আপনারা কোনও অন্ধকারে থেকে আমার সাথে আপনাদের ছেলের বিয়ে দিন। আমি কাউকেই ঠকাতে চাই না। নিজেকেও না। আমি ‘লেসবিয়ান’,মানে আমার একটি গার্লফ্রেন্ড আছে। আমি ওর সাথেই সারাজীবন থাকতে চাই। এরপরেও কি আপনারা চাইবেন এই বিয়েটা হোক?

ঘরময় অসম্ভব স্তব্ধতা। একটু কান পাতলেই সকলের হার্টবিট শোনা যাবে। কারুর মুখেই কোনও সাড়া ছিল না। এইধরনের পরিস্থিতিতে ঠিক কি বলা উচিৎ সেটা মনে হয় ঠিক কারুরই জানা নেই। পৃথা ছাড়া সকলেই একটা অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে।

কাল বিকালে পৃথার ফ্লাইট। সারারাত আর মায়ের সাথে কোনও কথা হয়নি পৃথার। পৃথা একবার শুধু মা’কে বলেছিল ... 

-আমি চাকরি পেয়ে গেলেই তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব মা।
মহুয়া কোনও সাড়া দেয়নি।

ভোরবেলার ট্রেনে কলকাতা যাচ্ছে পৃথা। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার সময় মা’কে প্রণাম করতে গেছিল পৃথা। মা পা সরিয়ে নিয়েছে। অথচ আবার পৃথার মাথায় হাত রেখেছে। মায়ের ছলছল চোখ দুটো বারবার মনে পড়ছিল পৃথার। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

সুচিন্তিত মতামত দিন