অভিজিৎ মান্না

 নতুন প্রভাত








ভোরবেলায় প্রাণায়াম সেরে সায়ন্তিকা তাদের বাড়ির সামনে বাগানে এসে দাঁড়িয়েছে। তখনো পূবের আকাশে রবিরশ্মি দেখা দেয়নি। আকাশের দক্ষিণ কোণে কয়েক টুকরো বারিদ জটলা করেছে। ঈষৎ শীতল সমীরণ বইছে। কোথা থেকে যেন একটা পরভৃতর কণ্ঠ ভেসে আসছে মাঝেমাঝে।

বাগানটা তার নিজের হাতেই গড়া, ফুলগাছের প্রতি তার একটা বিশেষ আকর্ষণ আছে। রোজ সকাল বিকেল গাছে জল দেওয়া তার যেন নেশা হয়ে গেছে। কোন গাছটা কতো বড় হল, কোন শাখীতে কুসুমের কুঁড়ি এলো, কোন গাছটায় পোকা ধরেছে-- স্প্রে করতে হবে, রোজ এইসব ভালো করে পর্যবেক্ষণ না করলে তার যেন রাতে দু-চোখে ঘুম নামে না। তবে শুধু তার বাগানের ফুলের-গাছ ছাড়া আর কোন গাছকেই এমন যত্ন করেনা সায়ন্তিকা। 

আজ বাগানে পাইচারি করতে করতে তার হঠাৎ চোখে পড়লো উত্তরপূর্ব কোণঘেঁষা পাঁচিলের গায়ে একটা কি যেন গাছ বে-আক্কেলের মতো বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এর আগে চোখে পড়েনি, কবে যে এটার উৎপত্তি হল-! দেখা মাত্রই সায়ন্তিকা মনে, মনে ঠিক করল গাছটাকে এই-মুহূর্তে উচ্ছেদ করতে হবে। একে আর প্রশ্রয় দেওয়া যায়না। সে এগিয়ে যায় গাছ-টার দিকে.....

সামনে গিয়ে বুঝল-- সেটা একটা শিশুগাছের চারা। কিন্তু, একে আর বাড়তে দেওয়া চলে না। চোখকে ফাঁকি দিয়ে ব্যাটা ঠিক একসময় পেল্লায় আকার ধারণ করবে। 

কিন্তু, গাছটা উপড়ে ফেলার জন্য সায়ন্তিকা হাত বাড়িয়েও থেমে যায়-! আকস্মিক তার মনের ভিতর যেন এক সাইক্লোন দেখা দেয়-! হঠাৎ ওঠা সেই তুফানে তার মনের সমস্ত চিন্তাভাবনা যেন ওলটপালট করে দেয়। তার হৃদয়ের গভীরে পাথরচাপা পরে থাকা আর একটা সুপ্ত লুকানো মন যেন বলে ওঠে-- "কি করছিস তুই এটা-! তুই একটা প্রাণকে হত্যা করছিস-! তোর কাছে এই প্রাণের কি কোন দাম নেই-? তোদের সমাজে মানুষের মধ্যে যারা ধনীব্যক্তি, যারা বড়-মাপের মানুষ তাদেরি জীবনের দাম দেয় সবাই; আর দারিদ্র্য বা ভিখারি-দের জীবনের দাম যেমন তোরা দিস না-- এই গাছের বেলাও কি তাই করবি-? যে গাছ দেখতে সুন্দর, যে গাছে সুন্দর কুসুম ফোঁটে, শুধু তাদেরি যন্ত করবি-! আর যে গাছে সুন্দর ফুল হয়না, সেগুলো বুঝি গাছ নয়-? যে রকম তোরা পরিবেশ সুন্দর করার জন্য রাস্তার ধার থেকে ভিখারি-দের উপড়ে ফেলে দিস; বস্তি ভেঙে দিস; সেই রকমই বোধয় এই গাছটাকেও উপড়াবি-? পারবি-! দেখ তো পারিস কিনা।"

সায়ন্তিকার হাত যেন কেঁপে ওঠে; গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসে। আতঙ্ক-মাখা মুখ নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়েছিল সেটা বুঝতে পারেনি সায়ন্তিকা; কখন না-জানি তার আঁখির পাতায় দিনমণির প্রভা এসে পড়েছে। সায়ন্তিকা হুঁশ ফিরে পেয়ে চোখ মেলে চায় সূর্যের দিকে; রবির সাতটা বর্ণই যেন সে স্পষ্ট দেখতে পায়-! সাতটি বর্ণই তার সুন্দর লাগে-- কোনোটাকেই মনে হয়না যে এটা বেমানান। সে দেখে একটা সুন্দর মিষ্টি নতুন প্রভাত তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে; নতুন ভাবে বাঁচার জন্য।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ