কমল দাস

উল্টোপথ




সকালেই কুকুকুটা চিৎকার করে ভোরের ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে দিয়েছে আজ। ডোর বেলটাও যেন জোরে বেজে উঠলো। দরজাটা খুলেই অমিতের মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

সেই লোকটা বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে হাসছে ওর ঝকঝকে দাঁত নিয়ে। অমিত জানে কি বলবে। লোকটার ওই ঢ্যাঙ্গা চেহারা, ঘাড়ে একটা ঝোলা ব্যাগ, পায়ে সাদা ক্যাম্বিস। কিন্তু গায়ে একটা ইস্তিরী করা সাদা জামার ওপরে সোয়েটার।

- কি চাই ? এত সকালে কেন? অমিত খুব বিরক্ত হয়েই প্রশ্নটা করল।
- সকাল কোথায়? এখন তো সাড়ে ছটা বাজে। কত লোক কোথায় চলে গেল। কেউ কাজে গেল। কেউ অকাজে। আর আপনি এখনো ঘুমোবেন? এবার লোকটির মুখে ব্যাঙ্গ। অমিত বেশ রেগে গেল।

বলল, কাল কত রাতে ঘুমিয়েছি জানেন? অনেক রাত অবধি অফিসের কাজ করেছি।
- সেটাই তো কথা,বাড়িতে কেন অফিসের কাজ নিয়ে আসেন? অফিসের কাজ অফিসে আর বাড়ি মানে ঘর। ঘর মানেই শান্তির আশ্রয়। জানি রেগে যাচ্ছেন কিন্তু ভেবে দেখুন না আমি ভুল কি কিছু বলেছি? 

অমিত ভেবে দেখল কথাটা সত্যিই। কিন্তু এছাড়া যে উপায়ও নেই। যে সমস্ত টেন্ডার এর কাগজ পত্র, রিপোর্ট রিটার্ণে যত ভেজাল দিতে হয়, সে গুলো অফিসে করলেই পার্টি, কন্ট্রাক্টরেরা নানা বিষয়ে মাথা গলাতে শুরু করে। নানা ব্যাপারে বড় সাহেবের কানে তোলে। তার চাইতে বাড়িতেই ভালো।

অমিত মুখে কিছু বলল না। শুধু বলল বসুন চা খেয়ে যাবেন। লোকটি মাঝে মাঝেই বাড়িতে আসে। কেন আসে সেটা অমিত জানে না । ভদ্রতার খাতিরে বসতেও বলে। চা খাওয়ায় কিন্তু লোকটি ওর কাছে কিছুই চায় না। অমিত একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল আপনি কি কিছু টাকা পয়সা চান? লোকটি অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তার চোখ বিষাদ মাখা। 

শুধু বলল না না। এমনিই আসি । আপত্তি থাকলে আসব না।
অমিত কেন যেন বলে ফেলল ... না না আপনি আসবেন। আসবেন।

সেই থেকে ছুটির দিন গুলিতে বিকেলে আসতে শুরু করল ভদ্রলোক। আজ কেন যে এই সকাল বেলাতেই ? অমিত ওকে বসতে বলে বাথরুমে ঢুকে গেল। লোকটি তার চেনা ঘরের সোফায় গিয়ে বসল। একটা আনন্দ বাজার পত্রিকা উড়ে এসে ঘরে পড়ল। ভদ্রলোক সেটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

কখন যে অমিত ঘরে এসে পড়েছে ভদ্রলোকটি তা টের পায় নি। অমিত দেখল লোকটি মাথা নীচু করে বিড় বিড় করছে লোভ - লোভ- লোভই সব শেষ করে দিল।

- কি হল আপনার? কি বলছেন বিড় বিড় করে?

অমিত দেখল লোকটির চোখ রাগে জ্বলছে। বলল - শুধু প্রচুর বড়লোক হবার চেষ্টার জন্য কতগুলো মানুষ মারা গেল উড়ালপুর ভেঙ্গে। যারা মারা গেল তারা জানতেই পারল না কার লোভে সে চলে গেল।

অমিত নিজেকেও দোষী সাব্যস্ত করল। একটু যেন কেঁপে উঠল মনে মনে। ওই কাজটার কন্ট্রাক্টর, সিংহানীয়া কনস্ট্রাকশন থেকে কমিশন বাবদ কুড়ি হাজার কয়েকদিন আগেই দিয়ে গেছে। কাল একজন ইঞ্জিনীয়ার সাইটে গিয়ে সব দেখে এসেছেন। অমিত দেখতে পাচ্ছে লোকটি তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

অমিত মুখে শুধু বলল - হ্যা সত্যিই কি যে হচ্ছে।

যতটা রিয়াক্ট করার কথা সেটা করতেই পারল না অমিত। যা বলল সেটা যেন জোলো লাগল নিজেরই কানে। লোকটি তাকিয়ে আছে ।

চা দিয়ে গেল ঝুম্পা। কাজের মেয়ে।

- বৌমা ওঠেনি? লোকটি জিজ্ঞাসা করল? ঝুম্পা উত্তর দিল - উঠেছে বাবানের সাথে ফোনে কথা বলছে। পরে নামবে।
- বাবান মানে আপনার ছেলে? অমিত শুনতে পায় নি। একমনে পেপার পড়ছে। হঠাৎ বলে উঠল ... কি জিজ্ঞেস করলেন?
- বাবান কে ? আপনার ছেলে? 
- হ্যাঁ। ও মেডিক্যালে পড়ছে ব্যাঙ্গালোরে। সকালে মায়ের সাথে কথা না বললে হয় না ।
- ও খুব ভালো । পড়াশুনায় নিশ্চয়ই খুব ভাল ।
- ওই মোটামুটি। প্রাইভেট কলেজে পড়ছে।
- আচ্ছা তাহলে মেডিক্যাল পড়তে গেল কেন? ও হয়তো খুব ভালো একজন গায়ক হত। কিংবা অভিনেতা। আসলে আপনারা বাবা মায়েরা ছোট্টবেলা থেকেই শিশুমন কে বিষিয়ে তুলে লোভী বানিয়ে তুলছেন তো?

অমিত খুব রেগে গেল। আপনি আমাকে জ্ঞান দেওয়া শুরু করলেন?
- না তো । সত্যিটা দেখাচ্ছি। আপনার ছেলেকে আপনি ডাক্তার বানিয়ে সমাজের কি লাভ হবে ? প্রচুর টাকা খরচ করছেন । কোথা থেকে এই অর্থ আসছে সেটা কি কখনো ছেলেকে বলেছেন । জানি বলেন নি। আর সেও বাবার এই খরচ তুলতে গিয়ে একটা টাকা তৈরীর মেশিন হয়ে দাঁড়াবে। ব্যস। আপনি আনন্দিত হয়ে দু হাত তুলে বলবেন আমার ছেলে ডাক্তার হয়েছে।  সত্যিকারের ডাক্তার কি হতে পারবে?

নিজের ছেলের বিষয়ে এসব কথা শুনে অমিত বিরক্ত হয়েই বলল চা খাওয়া হয়েছে?

লোকটি বুঝল এ কথার অর্থ চলে যেতে বলা। হ্যাঁ আমি নিশ্চয়ই যাব। আপনিই আমাকে নিয়ে এসেছিলেন আমন্ত্রণ করে মনে আছে?

- হ্যাঁ মনে আছে। কিন্তু আমার পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাচ্ছেন কেন? লোকটি চুপ করে গেল। হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল অমিতের দিকে। কোথাও যেন একটু কষ্ট হল।

- আসলে কি জানেন আমরা কি শুধু আমার নিজের জন্য বাঁচি? প্রথমতঃ নিজের পরিবারের জন্য। তারপর পাশের বাড়ির জন্য। তারপর পাড়া প্রতিবেশীর জন্য বাচি। এই করে গোটা সমাজের জন্যই বাঁচা তাই না? সেখানে লোভ, অর্থের, ক্ষমতার, সব মিলেই গোটা মানব জাতির নৈতিকতা তলানিতে। কিসের বিনিময়ে আমি কি পাচ্ছি সেটা আর বিচার্য হচ্ছে না। খুব যন্ত্রণা হয় জানেন।

অমিতের বাবার কথা গুলো মনে পড়ল। ছোট বেলায় বাবা বলতেন - যদি কখোনো প্রচুর অর্থও হয় তবু কিন্তু গাড়ি কিনিস না। সাইকেলই ভালো। গাড়িতে বসে তুই যখন যাবি তখন তোর পা দুটি মাটিতে স্পর্শ হবে না। আর সবাইই তোকে উচু তলার মানুষ ভেবে দুরে সরে যাবে। ভালো ভাবে বেঁচে থাকতে অনেক কিছুই লাগে না।

প্রাইমারী স্কুলের নিষ্ঠাবান শিক্ষক সুবোধবাবুকে আজও সবাই মনে রেখেছে একজন ভাল মানুষ হিসেবে। এই মানুষটার মধ্যে বাবার ছায়া যেন দেখেছিল অমিত । সেজন্যই তাকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। বলেছিল আপনি ছুটির দিন মাঝে মাঝে আসলে আমাদের ভাল লাগবে। সুমনা অমিতের বউ এর সাথেও আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। শুধু ছেলের কথা বলা হয় নি। আর ভদ্রলোক ও জিজ্ঞেস করেন নি। সুমনা খুব ভাল ভাবে নেয় নি ওর আসাটা। কিন্তু অমিত এখন কথা গুলো শুনে ওর বাবার মুখটা মনে পড়ল। মনে মনে বলল বাবা আমাকে ক্ষমা কর। আমি তোমার কোন কথাই রাখতে পারি নি।বাড়ি, গাড়ি, প্রাচুর্য অর্থ সব আছে বাবা। কিন্তু তোমার কথা গুলো বলার লোকের বড় অভাব।

লোকটি আবার পেপারে মন দিয়েছে। অমিত জিজ্ঞাসা করল এই প্রথম - আপনি কি করেন?
লোকটি উত্তর দিল - জানেন একবার স্কুলে পড়বার সময় উল্টোদিকে হেটে আমি প্রথম হয়েছিলাম। সেই থেকে উল্টোদিকেই আমি হাঁটি। বলেই হা হা করে হেসে উঠল ভদ্রলোক। আমার ছেলে একটা কলেজের  অধ্যাপক অর্থনীতির। আমার চেয়েও সাধারন। এখন ওর ছেলেকে মানুষ করছে নিজের মত করে। খড়গপুরে থাকে।

অমিতের আবার বাবার কথা মনে পড়ল। বাবা বলতেন একজন ভাল মানুষ হও আগে। ভাবল ভালো মানুষ মানে কি? বাবা না কি সামনে বসা এই মানুষ টা? খুব অস্পষ্ট মনে পড়ল বাবাও বলেছিলেন স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতার দিয়ে পারে ওঠে যে সেই সব থেকে মানসিক শক্তি সম্পন্ন।

লোকটি অমিতকে লক্ষ্য করছিল ।

- কি ভাবছেন অমিতবাবু?
- উম্? এবার থেকে উল্টোপথেই হাঁটব। হোক না একটু দুর।  পৌছাবো লক্ষ্যেই। 
- একজন একজন করতে করতেই একটা বিরাট মিছিল হবে দেখবেন। আজ আসি কেমন?

অমিত দেখল লোকটি মাথা উচু করে বেড়িয়ে যাচ্ছে গেট খুলে। আরে ... একদম বাবার হাঁটার মত হাঁটা।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ