যিনি রাঁধেন তিনি চুল বেঁধেই ক্ষান্ত হন না, তিনি নিজেকে ছড়িয়ে দেন বাতিওয়ালার ভূমিকায়। তিনি শব্দ যাদুকর, মায়াজাল বিছিয়ে দেন কখনো, আবার কখনো সপাট চাবুকে কুম্ভঘুম ভাঙ্গিয়ে দেখিয়ে দেন আমরা আদতে কেমন আছি। তখন ভাবতে বসি, আরে, তাই তো, এভাবেই তো ঘৃণা ভালোবাসা সমস্যা উৎসবে আমাদের দিন আনা দিন প্রেরণা। এভাবেই ছোট ছোট স্ট্রোকে এঁকে দেন আমাদের তৃতীয় নয়ন। তিনি সদালাপী সদাহাস্যময়ী মানবী দশভুজা। সাহিত্য জগত এক ডাকে চেনে তাঁকে, তিনি যশোধরা রায়চৌধুরী । তাঁর কিছু প্রাণের ছোঁয়া এবার ‘শব্দের মিছিল’ এর ‘একমুঠো প্রলাপ’ এ বন্ধুদের জন্য।

আমার দিদা শেষ বয়সে আত্মজীবনী লিখেছিলেন। সেই বইটি নিয়ে গবেষণার কাজ হয়েছে। এ দুটো তথ্য অনেকের অজানা বলেই বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।
না, অন্যেরা লেখেন বলেই আমাকে লিখতে হবে, এরকম চাপের তো প্রশ্নই নেই, কারণ আমার ছোটবেলায়, যখন আমার কবিতা লেখার শুরু, তখন সত্যিই বুঝতাম না এই সাংস্কৃতিক পরিবেশ ইত্যাদির যে আবার কোন দাবি থাকতে পারে। চাপ ছিল মায়ের, পড়াশুনো ভাল করে করার । সেটাতে ফাঁকি দিয়েই তো কবিতা লেখা শুরু।


যাহোক, প্রাকৃতিক নির্বাচন-এর মাধ্যমেই লেখালেখিটাই বোধ হয় লোয়েস্ট কমন ডিনমিনেটর, তাই ওটাই হল। প্রথম ডায়েরি দিয়ে শুরু হল। তারপর কবিতা। আমি তো আমার বাবাকে জ্ঞান হয়ে ইশতক দেখিনি। তাই বাবার বইগুলো আমার কাছে বাবার সমার্থক ছিল। এই ভাবেই বাবার কবিতার বইগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্ক। প্রথম জীবনানন্দ বা টি এস এলিওট পড়েছি বাবার বইতেই।
আর কাকা মানস রায়চৌধুরী সে অর্থে প্র্যাকটিসিং কবি ছিলেন। কিন্তু আমরা আলাদা আলাদা বাড়িতে থাকতাম। তাই সেভাবে জানতেই পারিনি কবিদের সমাজের কথা। আমার প্রথম দেশ পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হল যখন, তখন কাকা পড়ে ফোন করে মজা করে প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা , এই যশোধরা রায়চৌধুরী কি সেই যশোধরা যাকে আমি চিনি?
কাকার ঘনিষ্ঠতা ছিল সুনীল তারাপদ সমরেন্দ্রর সঙ্গে। সেটা অনেক পরে আমাকে একটা অন্যরকম স্নেহবলয় দিয়েছে। যখন আমার দু তিনটে বই বেরিয়ে গেছে। তারপর থেকে চিরদিনই ওঁরা আমাকে “মানসের ভাইঝি” বা “ দিলীপদার মেয়ে” বলে অন্য একটা সমাদর করেছেন।


আমাদের সমাজে যে কোন সাফল্যকেই, মেয়েদের ক্ষেত্রে, দেখা হয় তার চরিত্র বেচে খাওয়া বলে। একটা কথাই তো আছে, স্লিপিং হার ওয়ে আপ। কাস্টিং কাউচের কথাও আমরা তো জানি। এবার সমস্যা হল, কিছু ক্ষেত্রে এরকম নিশ্চয়ি হয় কিন্তু সব ক্ষেত্রে এরকমই যে হবে এটা তো নিশ্চয় করে বলা যায়না। তবু মানুশের জিভ বড় ভয়ঙ্কর । তা কখনো থেমে থাকে না।
আমার চাকরি বা কবিতার যতটুকু যা সাফল্য, কোনটাই নিজের শিরদাঁড়া বেচে নয়। এটুকু বলেও অনেকের চোখে আবার আমরা “অহংকারী” প্রতিপন্ন হই।
সম্ভ্রম বাঁচানোর কথায় বলি, ছোটবেলায় রাস্তা ঘাটে বাসে ট্রামে সব মেয়ের মত শারীরিক নিগ্রহ হয়েছে আমারও, একাধিক। সেই সময়ে ভয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম... ভুলিনি সে অভিজ্ঞতা। সেই জায়গা থেকেই প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি মেয়েদের লড়াই।


কিন্তু গদ্য পুরোটাই না হলেও অনেক বেশি নির্মাণ ও মেধার কাজ। গদ্য লেখা খুব কঠিন। আমি যেটুকু লিখি নিজের ভালবাসা থেকেই। প্রথম দিকে যা লিখতাম তা থেকে অনেক সরে এসেছে আমার কলম। তবে আমি এটা মানি যে এখনো কিছুই লিখিনি। আসলে পরিশ্রমী গদ্যকার হতে শুধু ভালবাসা ছাড়াও আরো অনেক মেধাবী আচরণ লাগে বোধ হয়। আমি সেই পরিশ্রম এখনো করে উঠতে পারিনি। ভবিষ্যতে যে করে উঠব না এমন কিন্তু জানা নেই। করার ইচ্ছে আছে। হয়ত কোনদিন হয়ে উঠবে।
তবে আমার কাছে চার্জ, এনার্জি বা তাগিদের মূল্য খুব বেশি। কবিতা তো লিখতে পারিই না, গদ্যও নিজের বিশ্বাসের ভালবাসার জায়গাটা থেকে উদবুদ্ধ না হলে পারিনা লিখতে। আমার দায়সারা লেখা তাই খুব খুব খারাপ হয়।


পরবর্তী কালে বিভ্রান্তি বা ভয়, বা হাঁটুর কাঁপন কমেছে। আমরা চিরকাল শুনে আসছি, পুরস্কার সবসময় যোগ্যতা দিয়ে হয়না। সেখানেও তো কত কু-মন্তব্য, রটনা। নানাভাবে বলা হয়, দাদা মামা কাকা ধরলেই সব পাওয়া যায়। আবারো বলছি, আমার নিজের ক্ষেত্রে এই বিষয়টা কখনো অনুভব করিনি। কিছু বন্ধুর কাছে থেকে যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তাও এসেছে এই সুরে, যে, তোমার একমাত্র লেখাটাই আছে, লিখে যাও। পুরস্কার তো তুমি আগেই পেতে পারতে। কিন্তু যখন এতদিন কারুকে খুশি করনি, শুধু নিজের লেখাটি লিখে চলেছ সেটাই তোমার নিজস্বতা। সেটাই মন দিয়ে কর। পুরস্কার আপনি আসবে।
তাই, আমার মনে হয় পুরস্কারের ব্যাপারে মাথা না ঘামিয়ে লেখাটা মন দিয়ে করা দরকার। জানি যে এটা পুরস্কার যে পেয়ে গেছে সে বললে লোকে বলবে, তোমার আর কী। তোমাকে তো অস্বীকৃতির বেদনা পেতে হয়নি। তাই বলতে দুবার ভাবি। কে কীভাবে নেবে।


তিলোত্তমার প্রথম দিকের লেখার মধ্যে নারীর স্ট্রাগল তত আসত না। আমার মতে ও কমপ্লিট রাইটার। অ্যাজেন্ডা নিয়ে লিখতে চায়নি। পরে অসামান্য কিছু লেখা এসেছে...যেখানে মেয়েদের জায়গাটা ও একদম নিখুঁতভাবে ধরেছে। সংগীতা আবার একেবারে আলাদা জায়গা থেকে লেখা লিখেছে। ওর লেখা কেমন যেন মায়া ও রহস্যে ভরা। আবার ভোগবাদী জগতের কথাও অবলীলাক্রমে লেখে। ওর লেখায়, ঘটনাক্রমে মেয়েদের কথা এলেও ও নারীবাদী নয়। মেয়েদের ইস্যু লেখাটা অনেকেই প্রধান ভাবে না। ভাবার দরকারও নেই। মেনস্ট্রিম রাইটারদের নইলে কবিতা সিং হের ভবিতব্য হবে। কবিতা সিং হের কথা এজন্য বললাম যে ওরকম জমজমাট গদ্য কোথাও পড়িনি। অথচ কজন মনে রাখে ওঁর কথা? ওঁর লেখার কথা?
আমিও প্রথম দিকে কোন সচেতন অ্যাজেন্ডা নিয়ে লিখিনি। আমি নিজের মত লিখতাম। একটা বয়সের পর থেকে ক্রমশ সচেতন হলাম যে আমার ছাত্রবয়সের নারীবাদ নিয়ে পড়াশুনোগুলো কেমন যেন আমার নিজের অভিজ্ঞতার বলয়ের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে। তখন থেকে আমার সোচ্চার হওয়া। ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের নারীবাদকে প্রকাশ্যে আনা।


তবু, এখানেই মুখ খুলেই, ইদানীঙ খুবই আক্রান্ত হই। যে কোন বিষয়েই দু রকম তিনরকম মতামতের , অবস্থানের পরিসর আছে। তবু লোকে কেন যে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বুঝিইনা।


কাজেই ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঐ দুটোর কোনটাই না। ও আমার খুব ভাল বন্ধু, আমার মতে। আর ওর মত ও বলবেই না। আমার ধারণা আমরা দুই স্বাধীন প্রাণী। তবে কোথাও ইন্টারডিপেন্ডেন্স আছে আমাদের। পারস্পরিক নির্ভরতা। আমার অনেক কবিতার কনসেপ্ট ওর সঙ্গে কথা থেকে পাওয়া। ও মাঝে মাঝে বলে আমি তো তোমার চুণ বালি সাপ্লায়ার। মাঝে মাঝে বলে আমাকে কনসালটেন্সি ফি দাও না তো! কবিতা নিয়ে এক সময় মারপিট হত। ও বলত, কবিতা কীভাবে লিখলে বল তো। বুঝিয়ে দাও কবিতা কীভাবে লেখা হয়। আমি কিছুই বলতাম না। বলতাম ওইভাবে বলা যায়না। ও বলত, বলতে হবে। ছাড়ব না।



তাই আমি কিছুই পড়েও উঠতে পারলাম না। খানিক নিজের মত লিখলাম। সেটাও কিছুই দাঁড়াল না।

যশোধরা রায়চৌধুরী / শর্মিষ্ঠা ঘোষ
5 মন্তব্যসমূহ
অনেক শ্রদ্ধা , অনেক ভালবাসা , গল্প পড়লাম , আমাদেরই চাওয়া-পাওয়া.... আবার বলছি এ যেন পথ চলার গল্প ...
উত্তরমুছুনখুব উপভোগ্য প্রিয় কবির সাবলীল আলাপচারিতা আর দুজনেই অর্থাৎ যিনি সাক্ষাতকার নিলেন আর কবি স্বয়ং আমার বন্ধু তাই উপভোগ করলাম বেশ।
উত্তরমুছুনখুব উপভোগ্য প্রিয় কবির সাবলীল আলাপচারিতা আর দুজনেই অর্থাৎ যিনি সাক্ষাতকার নিলেন আর কবি স্বয়ং আমার বন্ধু তাই উপভোগ করলাম বেশ।
উত্তরমুছুনযশোধরার কথাগুলো পড়লাম।খুব দৃঢ়ভভাবে নিজের কথাগুলো বললেন।আমাদের সমাজে এখনও পুরুষ এবং নারীর তফাত করা হয়।এমনকী উঁচুপদে থাকলেও এসব ভাবতে ইচ্ছে করে না।তবে এসবই তো সত্যি।
উত্তরমুছুনযশোধরা লেখালেখি নিয়ে যা বললেন তা চমৎকার।
ওঁর মাস্টারপিস এখনও হয়তো লেখা হয়নি তবে অদূর ভবিষ্যতেই লিখবেন।
শুভেচ্ছা জানাই দু'জনকেই এত সুন্দর একটা আলাপচারিতার জন্য।
যশোধরার কথাগুলো পড়লাম।খুব দৃঢ়ভভাবে নিজের কথাগুলো বললেন।আমাদের সমাজে এখনও পুরুষ এবং নারীর তফাত করা হয়।এমনকী উঁচুপদে থাকলেও এসব ভাবতে ইচ্ছে করে না।তবে এসবই তো সত্যি।
উত্তরমুছুনযশোধরা লেখালেখি নিয়ে যা বললেন তা চমৎকার।
ওঁর মাস্টারপিস এখনও হয়তো লেখা হয়নি তবে অদূর ভবিষ্যতেই লিখবেন।
শুভেচ্ছা জানাই দু'জনকেই এত সুন্দর একটা আলাপচারিতার জন্য।
সুচিন্তিত মতামত দিন