ভীষণ অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়েই ক্রমাগত পেরিয়ে যাচ্ছি পথ, চারিদিকে আজ মানবতা বিপন্ন, হত্যালীলায় মেতেছে মানুষ, রক্তের হোলি চারিদিকে। যেহেতু গানঘরের বেশীরভাগ সংখ্যাই কবিগুরুকে পাথেয় করে এগিয়ে চলেছে তাই এবারেও ব্যাতিক্রমী না হয়ে কবিগুরুর ভাষাতেই, কবিগুরুর সুরেই শব্দের মিছিলের ৪৯ তম সংখ্যায় নিবেদিত হল গানঘর, মানববন্ধনের প্রত্যাশায় ।
"ওই মহামানব আসে দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে। সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ, নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক, এল মহাজন্মের লগ্ন । আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত ধুলিতলে হয়ে গেলো ভগ্ন। উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব নবজীবনের আশ্বাসে। "জয় জয় জয় রে মানব- অভ্যুদয় মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে ।।" রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- " মানুষ আছে তার দুই ভাব কে নিয়ে, একটা তার জীব ভাব, আর একটা বিশ্ব ভাব। জীব তার আপন উপস্থিতি কে আঁকড়ে চলেছে আশু প্রয়োজনের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে। মানুষের মধ্যে সেই জীবকে পেরিয়ে গেছে যে স্বত্বা- সে হল আদর্শের আহ্বান, এ আদর্শ একটা নিগূঢ় নির্দেশ।" রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে মানুষের কথা বলেছেন, বলেছেন মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশের কথা। তাঁর মতে মানুষের ধর্ম কোনও সম্প্রদায়গত সংকীর্ণ ধর্ম নয়, তা নিত্য শাশ্বত মানব ধর্ম। এই বোধ জাতি সম্প্রদায়হীন বৃহৎ মানবস্বত্বার আত্মপলব্ধি। রবীন্দ্রনাথ মানুষের ধর্ম কি, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন-- মানুষের একটা দিক আছে যেখানে বিষয় বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে। সেই খানে আপন ব্যাক্তিগত জীবনযাত্রা নির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনা শক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে সে জীবন রূপে বাঁচতে চায়। কিন্তু মানুষের আরও একটি দিক আছে যা এই ব্যাক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে । সেখানে জীবন যাত্রার আদর্শে যাকে বলি ক্ষতি তাই লাভ, যাকে বলি মৃত্যু সেই অমরতা। সেখানে বর্তমান কালের জন্য বস্তু সংগ্রহ করার চেয়ে অনিশ্চিত কালের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করার মূল্য বেশী। সেখানে জ্ঞান উপস্থিত প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে যায়, কর্ম স্বার্থের প্রবর্তনাকে অস্বীকার করে. সেখানে আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে বড় যে জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।
স্বার্থ আমাদের যে সব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায় তার মূল প্রেরণা দেখি জীব প্রকৃতিতে ; যা আমাদের ত্যাগের দিকে তপস্যার দিকে নিয়ে যায়, তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম । "THE RELIGION OF MAN" গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন -"Religion of man has been growing in my mind as a religious experience and not merelyas a philosophical thought." এই নিজস্ব অনুভবের কথা ছড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতাবলীতে , তাঁর "আত্মপরিচয়" গ্রন্থের কোনও কোনও রচনায়, শান্তিনিকেতন' ভাষণমালায় এবং অন্যান্য রচনাতেও। ' ছিন্নপত্রাবলীর ' একখানি পত্রে তিনি লিখেছেন; শাস্ত্রেও যা লেখে তা সত্য কি মিথ্যে টা জানিনা ।যে জিনিসটাকে সম্পূর্ণ করে গড়ে তুলতে পারবো সেই আমার চরম সত্য।" মিথ্যা বলতে পারি নে, কিন্তু সে সমস্ত সত্য অনেক সময় আমার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযোগী। বস্তুত আমার পক্ষে তাঁর অস্তিত্ব নাই বললেই হয়। আমার সমস্ত জীবন সকল দিক দিয়েই দেখা যায় মানুষের গতি ভিন্ন জগতের অন্য প্রাণীর চেয়ে। মানুষ অন্তরের মধ্যে আশ্চর্য হয়ে অনুভব করে ভূমাকে , তার নিজস্ব আত্মাকে । এই আত্মা যেমন ব্যাক্তির পক্ষে সত্য, তেমনি সমগ্র মানুষের পক্ষে সত্য বিশ্বমানবাত্মা - সার্বজনীন মানব। এই মানবের অনুসন্ধান তার অন্তরে, বাইরের জগতের নয়। বাউলদের কথায় ইনি-ই মনের মানুষ । " আমি কথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে । হারায়ে সেই মানুষ টার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।" আত্মিক মানববিশ্বের সাথে আমাদের যোগ প্রেমের মধ্যে দিয়ে। ভৌতিক বিশ্বের সঙ্গে আমাদের বাস্তব পরিচয় ইন্দ্রিয়বোধে । " মানবপরমাত্মা " আমাদের আহ্বান করেছেন দুর্গম পথের ভিতর দিয়ে অসত্যের থেকে সত্যের দিকে, অন্ধকার থেকে জ্যোতির দিকে, মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে। এই আহ্বান মানুষকে করেছে চিরপথিক।
কবি বারবার "মানবব্রম্ভ " বা Supreme Person কে মানুসের সংসারেই পেতে চেয়েছেন । তিনি বলেছেন- " আমাদের অন্তরে এমন কে আছেন যিনি মানব অথচ যিনি ব্যাক্তিগত মানব কে অতিক্রম করে' সদা জনানং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট', তিনি সার্বজনীন সর্বকালীন মানব । তাঁরই আকর্ষণে মানুষের চিন্তায় ভাবে কর্মে সর্বজনীনতার আবির্ভাব। মানব্ব্রম্ভ ' শব্দটি রবীন্দ্রনাথ মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের আদর্শ রূপ ফুটিয়ে তুলতে ব্যাবহার করেছেন। এই আদর্শকেই তিনি বলেছেন মানুষের মধ্যেকার মানব, বলেছেন দেবতা। এর আর এক নাম মনুষ্যত্ব- মানুষের ধর্ম । এই শক্তি প্রত্যেক মানুষের অন্তরে সদা জাগ্রত, সতত ক্রিয়াশীল। এই শক্তি মানব সভ্যতার অগ্রগতির শক্তি।
সব শেষে বলা যায় রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টির বৈচিত্র্যকে সত্য এবং অর্থপূর্ণ বলে মনে করেছেন। কেবল নিসর্গ নয়, মানুষের সৃষ্ট সমাজ, রাষ্ট্র এবং তার প্রবর্তিত বিভিন্ন আইডিয়াগুলি রবিন্দ্রনাথের ধারণায় যথার্থ । এর-ই মধ্যে দিয়ে দুঃখ - বিপদ - মৃত্যু অতিক্রম করে মানুষ শেষ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে তার ধারণা। এই ধারণাকেই আত্মস্থ করে আমরা এগিয়ে চলি পথে। ধ্বংসলীলা বন্ধ হোক ,ভ্রাতৃহত্যা বন্ধ হোক ,গড়ে উঠুক নতুন সমাজ যেখানে মানবতাই হবে শ্রেষ্ঠ ধর্ম । এই প্রত্যাশায় শব্দের মিছিলের পক্ষ থেকে আমি অনন্যা নিবেদন করি এবারের গানঘর ।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন