কাকলি ভট্টাচার্য

kakali





জানলার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল শ্রী। বৃষ্টি থামার কোন লক্ষণ নেই। ঝমঝম, ঝমঝম, ঝমঝম। যেন সৃজন ছন্দে নেচে চলেছে পৃথিবী জুড়ে। কাচের জানলার বাইরে যেন এই দুপুরেও সব ঝাপসা। চশমা টা একবার মুছল শ্রী। এই তো পরিস্কার দেখতে পাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া, রঙ্গন, ইউক্যালিপটাস গাছেরা স্নান করছে প্রবল বৃষ্টিতে। কিন্তু বাইরের বৃষ্টিতে শ্রী র চোখ দুটো ভিজল কি করে ?

... বছর কুড়ি আগে  ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি র আশুতোষ বিল্ডিং এর দোতলায় দাঁড়িয়ে শ্রী আর অস্মিতা। নীচে মেইন গেটের সামনে মিটিং এর তোড়জোড় । 

- দ্যাখ দ্যাখ শ্রী আমাদের ছাত্র সংগঠনের নেতা শমিক কে । কি স্পষ্ট অথচ বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখে ।
- দূর দূর , এদের জন্যই তো ক্লাস গুলো হয় না ।
- যাঃ কি যে বলিস শ্রী। সেদিন এস.বি র ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি ...  দেখি স্যার কে introspection নিয়ে একটা প্রোজেক্ট দেখাচ্ছিল । এস.বি. তো বললেন প্রাউড অফ উ শমিক ।
- সে ছাড় , আমায় যেতে হবে । অসহ্য ! এসব মিটিং মিছিল।

*

মেইন গেট দিয়ে বেরোনোর সময় কানে এল, " নতুন ভোরের সূর্য ওঠো, ...  ফুটিয়ে তোল হৃদকমল ..."

- এই অস্মিতা -- কার গান রে ?
- ওমা জানিস না যেন ... ইদানিং মিটিং মিছিল এর সব গান গুলোই তো শমিক লিখছে ।
- আহা আমি কেন জানব ?
-  কেন জানবি না?
- তুই একটা পাগল অস্মিতা ...
- তুই পাগল শ্রী ...
- তুই 
- না না তুই হা হাহ হা ...


*

বৃষ্টি টুপটুপ করে পড়েই চলেছে । শমিক শ্যামবাজারের মুখে দাঁড়িয়ে । হটাত শমিক এর প্রায় গা ঘেঁসেই দাঁড়াল ফিয়েট টা। 
- শমিক উঠে এস ।
- আরে শ্রী যে। না না আমি কাছাকাছি' ই যাব। তাছাড়া এই যে টুপটুপ বৃষ্টির একটু একটু করে ঝরে পড়া ...  গায়ে মাখছি যে... 
- হোয়াট দ্য হেল শমিক, বৃষ্টি মাখছ !! 
- হ্যাঁ , মাখছিই তো ... বুঝতে হলে নেমে আসতে হবে যে ... 

শিষ দিতে দিতে শমিক গাইছে ...  পথে এবার নাম সাথি , পথেই হবে এ পথ চেনা ...  পথচলতি লোকজন ঘুরে দেখছে এবার । শ্রী নেমেই এল ... 

- কিশন জি তুমি বাড়ি চলে যাও। গ্যারেজে গাড়ি রেখে মাকে চাবি দিয়ে তোমার ছুটি । আমি পরে আসছি ।
- হাঁটতে এলাম শমিক
- তা বেশ । ধরো এই যে আমরা হাঁটছি ...  এই যে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে আমাদের শরীর মন ভিজছে , এর অনুভুতি কিন্তু অন্যরকম তাই না শ্রী ?
- আমার জ্বর না এলেই হল। 
- আচ্ছা শ্রী ... নেক্সট উইক এক্সকারশান এ যাচ্ছ তো ?
- ভাবতে হবে শমিক । এর আগে কখনও বাড়ি র মানুষদের ছাড়া আমি কোথাও যাইনি । এক সপ্তাহের ব্যাপার তো । একটু ভাবি বুঝলে ... 
- তোমাকে ভাবাবোই ভাবাবো ... সে তুমি মুখে যাই বল না ...  তোমাকে পথে আমি নামাবোই ... "
- এত জোরে কেউ রাস্তায় গান করে না শমিক ?
- হা হা হা ...  জীবনটাকে আমি সমুদ্রের মত দেখি শ্রী।  বিশাল বিশাল তরঙ্গের ওঠাপড়া ... গলা ছেড়ে গান না করলে কি করে ওই তরঙ্গের তালে তাল মেলাব ?
- তুমি অন্যরকম ... 
- কি রকম ? 
- তোমার কথা শুনলে ভয় হয় শমিক ।
- কেন ? 
- যেন নিজের অরবিট ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ব এক্ষুনি । কক্ষচ্যুত হবো ।
- হলেই বা !
-  না না আমায় এবার ফির তে হবে চললাম ...।

*

ক্যান্টিনে আজ এক টেবিলে তূর্ণা , সূর্য , শেখর আর সিরাজ । একটাই গল্প, শমিক আর শ্রী কে আজকাল প্রায়ই আকাদেমি , কফিহাউস, সব জায়গায় একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে । এমন কি সেদিনের মিটিং এর সময়েও শ্রী ছিল শমিক এর পাশে। শ্রী তো পছন্দই করত না মিটিং মিছিল তবে ? তূর্ণা একটু কপাল কুঁচকে বলল ...
- শমিক তো আমাদের থেকে সিনিয়র , M.S.C র রেজাল্ট ও তো বেড়িয়ে গেছে, ও কেন রোজ ইউনিভার্সিটি আসে বল তো ?
সূর্য থামিয়ে দ্যায় ...  চুপ চুপ ...  শমিকদা আর অভিজিত আসছে ।
- আরে তোরা এই টেবিলে ? দাড়া তোদের আজ ডিমের ডেভিল আর চা খাওয়াবো ।
- কেন শমিক দা, কিসের সেলিব্রেশন ? 
- জবর খবর রে । বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে । u.k. থেকে একটি মেইল পেলুম কাল । ওখানকার ইউনিভার্সিটি তে P.h.D জন্য consent letter . সামনের মাসেই রইল ঝোলা -চলল ভোলা । 

বিস্ফারিত চোখে তূর্ণা বলে ওঠে ...  আর তোমার ছাত্র সংগঠন? এত প্ল্যান প্রোগ্রাম ?
- জীবন তরঙ্গের মত তূর্ণা , আমি সেই তরঙ্গের কনামাত্র ...  চলি রে ...   দাম টা দিয়ে গেলাম ।


*

দরজায় বেল বাজল ...  টুংটাং ...  কোথায় চলে গিয়েছিল শ্রী । কত কাজ পড়ে আছে । রুমির মা , ভিজে কাপড় গুলো গেস্ট রুমে মেলে দাও। আর দরজাটা খোলো ... মোহর কলেজ থেকে ফিরল বোধহয়।

- ওমা তুমি !
-  আবার বছর কুড়ি পরে ... তার সাথে দেখা হয় যদি ...  আবার বছর কুড়ি পরে ... 
- কি ব্যাপার ? চেম্বার থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে কাব্যি করছ? এ তো ভাবা যায় না ...
- কারন আমার যে আজ পেশেন্ট দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল টুপটুপ বৃষ্টিতে গান গাইতে গাইতে এই রাস্তা ওই রাস্তায় হাঁটবার গল্টা । চূড়ান্ত ব্যাস্ত সাইকো এনালিস্ট শমিক মজুমদার যে শুধুই স্বামী, বাবা, অথবা পেশেন্টদের প্রাণের মানুষ নন, একজন প্রেমিক ও তো বটে । তরঙ্গবাহিত জীবনের মহাসমুদ্রে আমার যে আঁকড়ে ধরবার অবলম্বন তুমি শ্রী ...  শুধুই তুমি ...  

পাশের ঘরে টিভি চালিয়ে রুমির মা দিব্যি ঘুমোচ্ছে। পুরনো গান চলছে ... " বহুদুর হেঁটে এসে তোমাকে চাই ...  এ জীবন ভালবেসে তোমাকে চাই ...  প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত ...।। 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ