মানুষ যে কত কিছুতে ভয় পায় তার ইয়ত্তা নেই। আরশোলা, টিকটিকি, ভূত তো খুব কমন ব্যাপার, ছোটবেলায় আমার ভয়ের কারণ ছিলেন – রবীন্দ্রনাথ। সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি ছোটবেলা থেকেই আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে যান আমাদের জীবনে। ফি বছর আমাদের পাড়ায় রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হতো। চক্রবর্তী কাকুদের নিকোনো উঠোনে এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে যোগাড় করা চৌকি পেতে দিব্যি তৈরী হয়ে যেত স্টেজ। পিছনে দাদুর সাদা ধুতি টাঙিয়ে তার উপরে সাঁটিয়ে দেওয়া হতো থার্মোকলে লেখা – রবীন্দ্র জন্ম জয়ন্তী। সামনে ফুলের মালায় সাজানো রবীন্দ্রনাথের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, যা সারা বছর টাঙ্গানো থাকতো চক্রবর্তী কাকুদের বসার ঘরে। চিত্রটা প্রতি বছর একই। প্রতিবছরই অনুষ্ঠান শুরু হতো পাড়ার সব মেয়েদের নিয়ে – ‘এসো হে বৈশাখ’ গানে। হারমোনিয়াম বাজাতেন চক্রবর্তী কাকিমা। বাজেট প্রায় নেই বললেই চলে- তাই মাত্র দুটো মাইক্রোফোন। একটা কাকিমার সামনে, আর একটা হারমোনিয়ামে। দৃশ্যপটটা প্রতিবারই এক। দর্শক, শিল্পীরাও এক। কেউ গাইছেন ‘আমরা সবাই রাজা’ তো কেউ নাচ ধরেছেন ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’। শুধু প্রতিবার আলাদা হতো নাটকটা। অনুষ্ঠানের একদম শেষে নাটক, ওটাই বিশেষ আকর্ষণ। কোনো মঞ্চসজ্জা নেই, নেই আলাদা আলো এমনকি অভিনয়েরও বিশেষত্ত্ব নেই। অফিস ফেরত কেরানী, দোকান বন্ধ করা মুদি বা কলেজে পড়া ছাত্রদের মহড়ায় মঞ্চস্থ নাটকে বারবার দর্শক আটকে থাকতেন গল্পের মাধুর্যে। তখন আমার বয়স ছয় কি সাত। সদ্য স্কুলে ভর্তি হওয়া সেই বাচ্চার সামনে রীতিমত বিভীষিকা এই রবীন্দ্রজয়ন্তী। এমনিতে বাড়িতে রাখা ‘শিশু’ বইটার অনেক কবিতাই আমার মুখস্থ। বাড়িতে আসা গেষ্টদের সামনে দিব্যি বলে দিচ্ছি – বীরপুরুষ। গর্বিত বাবা মায়ের চওড়া হাসির রেশ ধরে গেষ্টরা আমার কালো গাল টিপে বলে দিচ্ছে- গুড বয়। কিন্তু ওই রবীন্দ্রজয়ন্তীর স্টেজে উঠলেই আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যেতো। হ্যালোজেনের চওড়া আলোতে দর্শকাসনে মা’কে দেখা যেতো না। দর্শকাসন আবার কী? উঠোনে মাদুর বা চাটাই পাতা। সামনে মাইকটা এলেই নাভির তলাটা কেমন গুড়গুড় করতো। জানা কবিতাও কেন জানি মনে পড়তো না তখন। এমনকি ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ী’ও না। ‘নমষ্কার, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ’। বলেই ঢোক গিলতাম। আর একবার ‘নমষ্কার’ বলে সময় নষ্ট করতাম। কিন্তু প্রথম লাইনের পর আর দ্বিতীয় লাইনটা কিছুতেই মাথায় আসতো না। বারবার ঢোক গিলছি। দর্শক অধৈর্য্য হয়ে হাসাহাসি করছে আর ঘোষক ভদ্রলোক রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছেন – এর পরেই মুনমুনদির গান ‘আয় তবে সহচরী’। মিনিট খানেক (যদিও আমার কাছে তা কয়েক ঘণ্টা) পর ঘেমে যাওয়া আমি’কে নিচে নামিয়ে আনা হতো। ‘ঘাবড়ে গেছে’, ‘ও কিছু না, বাচ্চা তো’, ‘পরে সুস্থ হয়ে আবার একবার উঠো’ – এমন শব্দবন্ধ শুনতে শুনতে স্টেজ থেকে নেমে আসতাম কান লাল হয়ে যাওয়া আমি। এ ঘটনার ঘন্টাখানেক পর নাচের মেয়েদের ড্রেস আপ রেডি না হওয়ার দরুন ‘নির্দিষ্ট শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ আমি আরও একবার সুযোগ পেতাম। কিন্তু আবার সেই আগেরবারেরই পুণরাবৃত্তি। বাড়ি ফিরতাম মুখ হাঁড়ি করা মায়ের সাথে। সেই থেকে ওই দাঁড়িওয়ালা বৃদ্ধের সাথে আমার আড়ি। কয়েক বছর পর পর একই ঘটনা ঘটায় আমি আর স্টেজে উঠতে চাইনি। মা, পাড়ার লোক, চক্রবর্তী কাকু চেয়েছে বটে...... কিন্তু আমার ভয় ক্রমশ বেড়েছে।
আস্তে আস্তে বড় হয়েছি পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। বই পড়ার নেশা বেড়েছে। তবু সেই ছোটবেলার ভীতি থেকে এড়িয়ে গেছি কবিগুরুকে। হদ্দ গ্রামের লাইব্রেরীতে বিশ্বকবিকে এড়িয়ে খুঁজেছি শরৎচন্দ্র, মানিক, তারাশঙ্করকে। কিন্তু চাইলেই কি আর দূরে রাখা যায়? ঘন ঘন লকআউট হওয়া কারখানার শ্রমিক আমার বাবা কোনো একবছর কারখানা থেকে বোনাস পেয়ে গেলেন। অবিশ্বাস্য কিন্তু সত্যি। নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে কি একটু বিলাসিতা আসতে পারে না? এলো লাল টুকটুকে ন্যাশানাল কোম্পানীর টু ইন ওয়ান। সাথে প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’। ক্যাসেটটা চালিয়ে দরাজ গলায় রবীন্দ্রনাথ ধরা দিলেন আমার কাছে। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দেখতে গিয়ে বারবার ভক্তিভরে নমষ্কার করা আমার মা রোজ ওই একই ক্যাসেট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শুনতেন। প্যানপ্যানানি বলে ক্রমাগত রবীন্দ্রসঙ্গীত এড়িয়ে যাওয়া আমিও বাদ রইলাম না। প্রাইমারি টপকে যত মাধ্যমিকের দিকে এগোচ্ছি তত আমার শেলফে ভিড় করেছে হিন্দি ফিল্মি গানের অডিও ক্যাসেট— ডিডিএলজে, রাজা হিন্দুস্থানী। সাথে সাথে প্রসূন মুখোপাধ্যায়রাও বেড়েছেন জর্জ বিশ্বাস, সূচিত্রা মিত্রদের সাথে। পাড়ার সেই রবীন্দ্রজয়ন্তীতে আর স্টেজে না উঠলেও অনুষ্ঠানটার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি। আফটার অল পাড়ারই তো ছেলে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে নাচের রিহার্সাল হতো আমাদের সেই টু ইন ওয়ান নিয়ে। নটীর পূজা, বাল্মিকী প্রতিভা, তাসের দেশ – সব নৃত্যনাট্যের রিহের্সালে আমি মাষ্ট। টু ইন ওয়ানের অপারেটর যে। আমার কাছে কারণ যদিও অন্য ছিলো— নন্দিনী। ধানক্ষেত ভরাট হয়ে গ্রাম থেকে আধা শহর হতে যাওয়া আমাদের সেই এলাকায় নন্দিনীরা এসেছিলো নতুন বাড়ি করে। সাইকেলে বিনুনি দুলিয়ে পড়তে যাওয়া নন্দিনী, ইস্কুলে স্ট্যান্ড করা নন্দিনী, নৃত্যনাট্যের নায়িকা নন্দিনীকে আমার উচ্চ মাধ্যমিক দিতে যাওয়া মন কাছে টেনে নিয়েছিলো। কিন্তু ভিলেন সেই দাঁড়িওয়ালা বৃদ্ধ। খবর পেলাম নন্দিনীদের বাড়িতে রীতিমতো রবীন্দ্র চর্চা হয়। শোকেস ভর্তি বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র রচনাবলী। বেশ চাপে পড়ে গেলাম। তবু নৃত্যনাট্যের রিহার্সালের অছিলায় ওর সাথে গল্পই সম্বল।
- তোমার স্বপ্নের পুরুষ কেমন নন্দিনী?
ক্লাস ইলেভেনের প্রশ্নের উত্তরে নবম শ্রেণী জানালো – ‘আমার কিন্তু রঞ্জন চাইনা। বিশু পাগলই ভালো’। আমার ক্যালকুলাস, জৈব রসায়ন, ইলেক্ট্রনিক্সে ভরা মাথায় কিছুই ঢুকলো না। এইচ এসে বাংলা না পড়লেও চলে – এমন নীতিতে বিশ্বাসী আমাকে স্মরণ নিতেই হলো বাংলার মাষ্টারমশাই গদাধরবাবুর। যার বড় দাড়ির জন্য ছাত্রমহলে নাম ছিলো – রবীন্দ্রনাথ। আমাদের অঞ্চলের গ্রামীণ পাঠাগারে ‘রক্তকরবী’ আছে জানতামই না। নন্দিনী আমায় পাগল করে দিলো। কিশোর প্রেমটায় সব মশালাই মজুত ছিলো, তাই জমতে সময় নেয় নি। আমার ‘তুঝে দেখা তো এ জানা সনম’ লেখা প্রেমপত্রের জবাব এলো সহপাঠিনী অনিন্দিতার ব্যাগে লুকিয়ে। নন্দিনী লিখেছে –
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদিকালের হৃদয় উৎস হতে।
আমরা দুজনে করিয়াছি খেলা কোটি প্রেমিকের মাঝে
বিরহ বিধুর নয়নসলিলে, মিলন মধুর লাজে—
পুরাতন প্রেম নিত্যনূতন সাজে।
সত্যি বলছি কিছু বুঝিনি। এই সাধুভাষাটা আমার দুচক্ষের বিষ। অগত্যা আবার সেই গ্রামীণ লাইব্রেরী। গোলাপ ফুল, চকলেট, সেন্টেড কালিতে লেখা প্রেমপত্রের পাশাপাশি আমি ঘেঁটে চলেছি রবীন্দ্র রচনাবলী। যুতসই কোটেশন দিয়ে নন্দিনীকে ইম্প্রেস করবো বলে। অজান্তেই প্রেমের রবীন্দ্রনাথ আস্তে আস্তে ঢুকে পড়েছেন আমার শরীরে, আমার শিরায় শিরায়, কোষে কোষে।
বাংলা নতুন বছরে আমাদের বাড়ি ঝাঁড়পোছের একটা রীতি আছে। একবার দাদুর খাটের তলা থেকে বের হলো একটা বন্ধ ট্রাঙ্ক। খোলা হলে দেখা গেলো কিছু পুরোনো উলের জামাকাপড়, কিছু উইয়ে কাটা ফটোগ্রাফ আর খবরের কাগজে মলাট দেওয়া একটা বই- গীতবিতান। বাঙালী মেয়েদের ছোট থেকেই গলা সাঁধা শেখানো হয়। বাঙালী সংস্কৃতির সাথে গুলে যাওয়া এই রীতি কি বিয়ের বাজারে পাত্রীর যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য, কে জানে! কম বয়সে বিয়ে হওয়া আমার মা তার বাপের বাড়ি থেকে দান সামগ্রী, নতুন গয়নার পাশাপাশি নিয়ে এসেছিলেন এই গীতবিতান, তার রোজ সকালের সঙ্গী। বিয়ের পর সংসারের চাপে , সন্তান মানুষ করতে গিয়ে গানের চর্চা গিয়েছে বন্ধ হয়ে। হারমোনিয়ামটা গেছে বিক্রি হয়ে আর গীতবিতানের ঠাঁই হয়েছে এই ট্রাঙ্কে। এতদিন পর খুঁজে পেয়ে ছলছল করে উঠলো মায়ের চোখ। ধুলো ঝেড়ে বই রাখলেন আমার বইয়ের তাকে।
- এই সব পুরোনো জিনিস কেউ মানে নাকি?
যৌবনের রক্ত টগবগ করে ফুটছে আমার।
- দাদু, অনেক কিছুই পাল্টে গেছে জানি। তবু অনেক কিছুই পাল্টায়নি।
মুখ খুললেন আমার দাদু, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। আজ বাংলার কত তারিখ বলতে পারবে? নিরুত্তর আমি। বাংলার সালটুকুও মনে নেই।
- বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজা। এবছর কত তারিখ থেকে জানো?
- ওই তো, অক্টোবরের ....
- উঁহু। বাংলার কত তারিখ বলতে হবে।
তোতলাতে তোতলাতে বললাম, আশ্বিনে কি? তারিখ বলতে পারবো না।
- তোমার জন্মদিন? বাংলার কোন সালের কোন তারিখে?
চুপ আমি।
- রবীন্দ্রনাথের জন্ম দিন কবে জানো?
- পঁচিশে বৈশাখ।
পরিক্ষায় কমন পাওয়া প্রশ্নের মতো উল্লাস আমার।
- উঁহু। এটার ইংরাজি তারিখ বলতে হবে।
- মে মাসের আট বা নয় তারিখ।
কিন্তু কিন্তু করে বললাম আমি।
- দেখেছো, বাঙ্গালী নিজের জন্মদিন ভুলে গেছে তবু পঁচিশে বৈশাখ ভোলে নি। অনেক কিছু পাল্টে গেছে দাদুভাই তবু আমরা পয়লা আর পঁচিশে বৈশাখকে বাংলাতেই মনে রেখেছি।। পঁচিশে বৈশাখ সাধারাণতঃ ইংরাজি মে মাসের আট বা নয় তারিখে পড়ে। কিন্তু ১২৬৮ বঙ্গাব্দের যে দিন রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন, সেটি ছিলো ৬ই মে।
মুচকি হাসেন আমার প্রিয় মানুষটি। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।
এই ঘটনার আরও কয়েক বছর পরে এক সন্ধেতে দাদু মারা যান। তখন আমি সেকেন্ড ইয়ার। ত্রিবেণী শ্মশানে দাহ করে যখন বাড়ি ফিরলাম, পুব আকাশ রাঙা হচ্ছে। শোকের সেই আবহে সারা বাড়িতে আমি মা’কে খুঁজে পাইনি। খুঁজতে খুঁজতে ছাদে উঠে দেখি পূর্ব দিকে মুখ করে একা দাঁড়িয়ে আছেন মা। চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। নতুন সূর্যের আলোয় আকাশে তাকিয়েই চমকে উঠলাম আমি- রবীন্দ্রনাথ। বৈশাখের নীল আকাশে সাদা মেঘ যেন অবিকল রবীন্দ্রনাথের মুখ। আমার মা, আমার ক্লাস টেন পাশ করা মা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’কে ঠাকুর ভেবে নমস্কার করা আমার মায়ের গলায় ছোটবেলার শেখা গান –
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
মায়ের দুগাল বেয়ে জল নামছে। মায়ের হাতে সেই পোকায় কাটা, খবরের কাগজে মলাট দেওয়া গীতবিতান। হলদে হয়ে যাওয়া পাতা উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। দিনটা পঁচিশে বৈশাখ। চক্রবর্তী কাকুদের উঠোনে চৌকিগুলো জড়ো হয়েছে। প্রথমবার নাটকে সেই মঞ্চে উঠবো আমি। ‘তাসের দেশে’র সৈনিক। ডায়লগ নেই। তবু রবীন্দ্রনাথ এতদিন পর আমার হয়ে গেলেন। শুধু আমারই।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন