রঙ্গিনী রায় বর্মন,যেমন ডাকসাইটে সুন্দরী তেমনই মেধাবী ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই ওকে এক ডাকে চেনে। মাস্টারডিগ্রী শেষ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক প্রফেসারের অধিনে গবেষণা করছে।বিষয় “ সাহিত্যে প্রকৃতির প্রভাব”। চব্বিশ বছরের তরতাজা তরুণী তাই, মনটা ওর ভীষণ অবাধ্য। বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। কোলকাতায় গড়ে তুলেছে নিজের পৃথিবী। যাদবপুরের এই চারতলার ফ্ল্যাট,যেটাতে ও থাকে সেটা,নীলাঞ্জনের। নীলাঞ্জন একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে। রঙ্গিনী আর নীলাঞ্জন একসাথে থাকে,ওরা এক নামহীন,দায়বদ্ধতাহীন সম্পর্কে আবদ্ধ।
রঙ্গিনী ব্যাগ থেকে চাবি বার করে ফ্ল্যাটের দরজা খুললো। ভিতরে অন্ধকার। লাইট জ্বালানোর আগেই নীলাঞ্জন ওকে পিছন থেকে জাপটে ধরলো,ঠোঁট ছোঁয়াল ওর পিঠের উন্মুক্ত অংশে। রঙ্গিনী বিরক্ত প্রকাশ করে বলল—‘আঃ! নীল,--ছাড় এখন। এখন একদম ভালো লাগছে না।পুরো হ্যাঙ্গ হয়ে আছি’। তারপর হঠাৎ বসে পরে নিচে পড়ে যাওয়া গবেষণা পত্রের দু’একটি পাতা তুলতে তুলতে বলল—‘ এই কংক্রিটের জঙ্গলে থেকে কি প্রকৃতির প্রভাব অনুভব করা যায়?---জানিস,রিসার্চের কাজ একদম এগোচ্ছেনা। মাথার মধ্যে থেকে সাহিত্য উধাও হয়ে গিয়েছে,পড়ে আছে হাড়-পাঁজর বের করা এই কংক্রিটের কাঠামো’। গবেষণা পত্র গুলো টেবিলে রেখে রঙ্গিনী এগিয়ে এসে দাঁড়াল নীলাঞ্জনের সামনে। হাত দুটো দিয়ে বেড় সৃষ্টি করল নীলের গলায়,তারপর নীলের চোখের দিকে কেমন স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে বলল—‘ ইস্! কত বছর হয়ে গেল উন্মুক্ত আকাশের নিচে, সবুজ প্রকৃতির কোলে শুই নি। দেখিনি চঞ্চল ঝর্ণার উন্মত্ত নাচ!----যাবি নীল,আমাকে নিয়ে এমনই এক উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে?’
রঙ্গিনীর মন প্রকৃতির কোল তো খুঁজবেই,ও যে প্রকৃতির মেয়ে।যে দেশের মানুষ গায়ে, মুখে মেঘ মেখে বেড়ায়,ও তো সেই দেশেই জন্মেছে।কিন্তু সেখানে তো আর ফিরবে না রঙ্গিনী,পরিজনদের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে।
[2]
ঠিক আর একদিন বাকি ফাল্গুন আসতে আর দু’ঘন্টা বাকি রঙ্গিনী আর নীলের ট্রেন আসতে। ওরা যাচ্ছে রাঁচি,ছোটনাগপুর মালভূমির উন্মুক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পান করতে। শহরের বিষ বাষ্প ধুয়ে নেবে জোন্হা,হুড্রু বা দশম প্রপাতের জলে।পিঠে বহন করার মত সামান্য কটা জামা-কাপড় নিয়েছে রঙ্গিনী, নীলাঞ্জন ও তাই। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে।রঙ্গিনী ওর ল্যাপি আর রিসার্চ পেপার গুলো সাবধাণে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। চেন বন্ধ করার আগে ব্যাগের উপর রেখে নিল কয়েকটা চিপ্স আর বিস্কিটের প্যাকেট।নীলের গলায় ঝুলছে বিদেশী ক্যামেরা। ফটোগ্রাফি ওর নেশা। রাঁচির প্রকৃতির ফটো তো তুলবেই সেই সঙ্গে ওর সঙ্গের আদিম সৌন্দর্যে ভরপুর এই জীবন্ত প্রকৃতিকেও উন্মুক্ত করবে ওর ক্যামেরার লেন্সের সামনে।
মাঘের শেষ রাত্রি,রঙ্গিনী আর নীলাঞ্জন পায়চারি করছে হাওড়া স্টেশনের বাইশ-নং প্ল্যাটফর্মে। অনেকেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখছে ওদের। হয়তো ভাবছে ওদের সম্পর্কটা কি ধরনের?—নামহীন সম্পর্কের কথা সমাজ চিন্তাও করতে চায় না। হাতিয়া এক্সপ্রেস এসে দাঁড়াল। নীল আর রঙ্গিনী উঠে পড়ল ট্রেনে। রঙ্গিনী কল্পনায় জাল বুনতে শুরু করেছে। মাত্র ন’ঘন্টা,কিছুটা ঘুমিয়ে কিছুটা জেগে নীলের সাথে গল্প করে কাটিয়ে দেবে। তারপর ভোর হতেই ট্রেন যখন স্টেশন ছোঁবে তখন ও লাফিয়ে নামবে স্টেশনে,দামাল শিশুর মত দাপিয়ে বেড়াবে মালভূমির বুকে।
কখন ঘুমিয়ে পরেছিল মনে নেই,নরম রোদ চোখে-মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো রঙ্গিনীর। ট্রেনের গতি ক্রমশ শ্লথ হয়ে আসছে,বোধ হয় স্টেশনে ঢুকছে। কামড়ার সবাই নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রঙ্গিনী লাফ দিয়ে উঠল,নাক টিপে ডেকে তুলল নীলকে। দুজনেই এসে দাঁড়াল দরজার সামনে।ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া লাগছে রঙ্গিনীর মুখে-চোখে,চুল গুলো উড়ছে---রঙ্গিনী জানে যা কিছু অবাধ্য,তাকে বাঁধার চেষ্টা বৃথা,ঠিক ওর মনের মত।
স্টেশনের বাইরে এসে রঙ্গিনীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। যা ভেবেছিল তা তো নয়,এ তো আরেক কংক্রিটের জঙ্গল। অটো এসে থামলো এক বিসাল বিলাসবহুল হোটেলের সামনে। চলমান জনসমুদ্রের মাঝে কোথাও একফোঁটা সবুজ নেই। এখানে থকলে তো রঙ্গিনী প্রকৃতিকে ছুঁতে পারবে না!---ওর মুখটা বিষন্ন হয়ে উঠলো বলল—“ নীল এখানে প্রকৃতি কোথায়? —আমি তো প্রকৃতি চেয়ে ছিলাম!’
নীল বলল—‘ ধুত্! আজ শুধু হোটেলের নরম বিছানায় তুই আর আমি। আজ শুধু অলস জীবন যাপন। কাল হবে প্রকৃতির খোঁজ’।
[৩]
ফাল্গুনের প্রথমদিন টা ওদের কেটে গেল হোটেলের চার দেওয়ালের মাঝে। ফাগুনের পরশ মাখা বাতাস ওর মনটাকে যেন আরও উদাস করে দিচ্ছে। রঙ্গিনী জানে না কেন হঠাৎ হঠাৎ মন উদাস হয় আর কেনই বা উচ্ছ্বসিত? শুধু বোঝে প্রকৃতির কাছে এমন কিছু আছে যা,মানুষের মনকে নিয়ন্ত্রণ করে।তাই তো মন কখনও প্রথম বৃষ্টির পরশ মাখা ঝলমলে প্রকৃতি আবার কখনও গ্রীষ্মের তাপদগ্ধ খাঁ-খাঁ দুপুর।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তৈরি রঙ্গিনী। নীল বাথরুম থেকে বেরোলেই প্রাতঃরাশ সেড়ে ওরা বেড়িয়ে পরবে জোন্হা প্রপাতের দিকে। আজ ফেরার পর অন্য কোনো হটেলে থাকবে ওরা,স্বাদ বদল। হোটেলের ভাড়া মিটিয়ে ওরা এলো অটো স্ট্যান্ডে। যদিও অনেকটা পথ তবুও রঙ্গিনীর ইচ্ছা ট্যাক্সি নয়,অটোতেই যাবে ওরা। কালো পিচের রাস্তার বুকের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে অটো। সমান গতিতে রঙ্গিনী আর নীলাঞ্জন। কিন্তু রঙ্গিনীর মনের গতি আরও দ্রুত। অটো এসে দাঁড়াল জোন্হা প্রপাতের প্রবেশদ্বারে। প্রপাতের গর্জন কানে আসতেই রঙ্গিনীর মনটা নেচে উঠল, ও ছুটে গিয়ে দাঁড়াল সেই সিঁড়ির মুখে যেখান থেকে নিচে নামতে হবে। একদল দেহাতি তরুণ একটা রসিদ দিয়ে টাকা নিয়ে গেল। রঙ্গিনী নীলের হাত ধরে নিচে নামার প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই পিছন থেকে ডাক পড়ল—‘হেই দিদিমণি,--হেই মেমেসাহেব –একটু দাঁড়াও তো’। রঙ্গিনী নীলের হাতে টান মেরে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে দেখল এক দেহাতি তরুন। কাছে এসে বলল—‘সাতশ সিঁড়ি ভেইঙে যেতে হবে,পারবে তুমরা?---সইঙ্গে লোক দিব?—যা মন চায় ধরে দিবে’। নীল বিরক্তির সুরে বলল-‘না ওসব লোক ফোক লাগবে না’। ওদের পা বাড়াতে দেখেই লোকটি আবার বলল-‘আচ্ছা ওয়া ঠিক আছে,তোমরা দোপরে খাবা না কিচ্ছু?---কি চায় মাছ, মাংস,ডিম সবই মিলবে’। খাবার কথা শুনে দুজনেই বেশ উৎসাহিত হল,নীল বলল—‘ঠিক হ্যায়,দো প্লেট ডিম ভাত’। রঙ্গিনী ভুলেই গিয়েছিল,হঠাৎ মনে পড়তেই জিজ্ঞাসা করল—‘তুমাহারা নাম কিয়া হ্যায়’?---ছেলেটি বলল-‘শুকরা লোহারা’। রঙ্গিনী আবার জিজ্ঞাসা করল—‘তুম বাংলা জানতে হ?’ ছেলেটি মাথা নেড়ে বলল---‘জী মেমসাহেব,বাংলা বলতেও পারি,বুঝতেও পারি। বাঙ্গালী লোক এলে বাঙ্গালায় কথা বলি’।
[৪]
শুকনো পাতায় পা মাড়িয়ে আঁকা বাঁকা সিঁড়ির ধাপ গুনে নিচে নামছে রঙ্গিনী আর নীলাঞ্জন। পাহাড়ের গা বেয়ে স্বচ্ছ-শুভ্র ঝর্ণার জল ঝরে পড়ছে নিচে পাথরের খাঁজে। বড় বড় পাথরের খাঁজে ছোটো ছোটো দ্বীপের মত জমে আছে ঝর্ণার জল। আছড়ে পড়া ছিটানো জলে ভরে উঠলো রঙ্গিনীর মুখ। অপূর্ব লাগছে ওকে। নীলাঞ্জন ওর রূপের খনিকে সংগ্রহ করে চলেছে ওর ক্যামেরায়। রঙ্গিনী উদাস চোখে দেখছে এই প্রকৃতির অপূর্ব রূপমাধুরী। শুধু দেখছে না যেন তৃষ্ণার্তের মত পান করছে। বড় পাথরের উপর বসে পা দুটো ডুবিয়ে দিয়েছে ঝর্ণার স্বচ্ছ জলে। নীল এগিয়ে এসে বসলো ওর পাশে। কাঁধের উপর হাত রেখে বসে আছে দুজনে। নীলের মুখটা রঙ্গিনীর ঘাড়ের কাছে নেমে আসতেই রঙ্গিনী ওকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলল-‘নীল ও দেখছে আমাদের’। বলেই আঙুল তুলে দেখাল বড় পাথরের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ‘শুকরা’।যদিও ততক্ষণে ও পাথরের আড়ালে সড়ে গেছে,তবুও ওর গভীর দৃষ্টি দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রঙ্গিনী ইশারায় ওকে ডাকলো। ও আড়ষ্ঠ পায়ে কাছে এসে দাঁড়ালো,তারপর আঙুল তুলে পিছনের দিকে দেখিয়ে বলল—‘খানা হয়ে গেইছে তাই’,--- বলেই মাথা নিচু করলো। রঙ্গিনী নীলের হাত ধরে ওর পিছু পিছু উপরে উঠতে লাগল।
রঙ্গিনী জিজ্ঞাসা করল-‘আচ্ছা শুকরা, বাড়িতে তোমার কে কে আছে?’
শুকরা বলল-‘আমার বৌ ফুলি আর আমি। বছর গেল শাদি করেছি’।
রঙ্গিনী বলল-‘ তুমি কি শুধু এই কাজ করো?তোমার গাঁয়ের সবাই কি কাজ করে?’
শুকরা বলল-‘আমি চাষও করি। তবে সারা বছরতো আর চাষের কাম থাকে না,তাই তুমাদের মত যারা ঘুরতে আসে তাদের দোপোরের খাবার জোগাড় দিই। হামি আর ফুলি নিজে হাতে রাঁধি গো মেমেসাহেব। বড় তিরপ্তি পাই। গাঁইয়ের কেউ দূরে রাজমিস্ত্রির কাম করে। কেউ ইঁট ভাঁটায় কাম করে,কেউ আবার বনের কাঠ এনে শহরে বেচে।এই ভাবেই চইলছে’। ওরা এসে বসে কিছুদূরেই একটা ছোট্ট ছাঁউনির নিচে। নীল আর রঙ্গিনীর সামনে শাল পাতা জোড়া দিয়ে তৈরি থালায় ভাত,ডাল,পেঁয়াজ,দিয়ে আলুমাখা,আলুভাজা আর ডিম। শুকরা বলে—‘দিদিমণি আলুমাখা খাও তো তুমরা? ভালো কইরে হাত ধুইয়ে মেখেছি’। অন্য সময় সাল পাতার গন্ধটা রঙ্গিনীর ভালো লাগে না। কিন্তু আজ যেন ও প্রকৃতি কণ্যা,এই গন্ধটা যেন আজ ওর বড় প্রিয় হয়ে উঠেছে। এর পরই ফিরতে হবে মনে হতেই ওর যেন কান্না পায়। এই সামান্য সময়েই শুকরা যেন ওর চেনা মানুষ হয়ে উঠেছে। ওর বৌ ফুলি যেন ওর পুরানো সখী,এই প্রকৃতি যেন ওর মায়ের গন্ধ ছড়াচ্ছে। হঠাৎ রঙ্গিনী বলে উঠলো—‘ শুকরা, তোমার এখানে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে’? শুকরা বলল, ‘না দিদিমণি, এখানে তো কোনো হোটেল নাই। তবে মেমসাব, তুমি চাইলে আমার ঘরে থাইকতে পার। আমার দুটা ঘর আছে। –একটায় ফুলি আর আমি থাকি,তোমরা চাইলে আরেকটায় থাইকতে পারো। থাইকলে উৎসব দেইখতে পাবে। পুরুলিয়া থেইকে ছোঁ নাচের শিল্পী আইসছে,কত বাদ্য যন্ত্রর আইসছে,সারা রাত উৎসব হবে,মেয়ে-পুরুষ সবাই মিলে নাচ হবে—সবাই হাড়িয়ার নেশায় মইজে যাব। খুব আনন্দ হবে’।
রঙ্গিনী বলল, ‘হাড়িয়া!—সেটা আবার কি’?
শুকরা বলল, ‘ভাত মজিয়ে আবার কখনও মহুয়ার রস মজিয়ে হাড়িয়া বানাই আমরা। তোমরা থাক,তোমাদেরও খাওয়াব’।
রঙ্গিনী নীলের দিকে তাকাতেই নীল ওর মনের কথা বুঝে যায়। বাঁশের বেড়ার ঘর,টিমটিমে একটা হলুদ আলোর বাল্ব জ্বলছে। সন্ধ্যে হতেই আলো চলে গেছে। ঘন অন্ধকারে জ্বলছে দুটো কুপির আলো জঙ্গল ঘেরা এই প্রকৃতির মাঝে মিটমিটে আলো এক রহস্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু রঙ্গিনীর মনে হয় শুকরার চোখের রহস্য আরো গভীর। একটা নক্সা আঁকা কাঁথা পাতা কাঠের চৌকিতে। নীলের গায়ে মাথা রেখে শুয়ে রঙ্গিনী চেষ্টা করতে থাকে শুকরার চোখের ঐ গভীর রহস্য ভেদের। বেড়ার দেওয়ালের ছোট্ট জানালা দিয়ে তাকায় পাশে শুকরা আর ফুলির ঘরের দিকে। ঘন অন্ধকার। অনুভব করে একজোড়া বণ্য হরিণ-হরিণীর উপস্থিতি। বাইরে বেরিয়ে আসে রঙ্গিনী। স্পষ্ট শুনতে পায় দেহাতি সোহাগের শব্দ। রঙ্গিনীও ঐ দেহাতি সোহাগ পাওয়ার ইচ্ছায় ব্যকুল হয়ে ওঠে।
[৫]
পাখির কূজন শুনে ভোর হয় এদের। অনেক বছর পর রঙ্গিনীর পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলো। মিষ্টি সুরে কোকিল ডাকছে। শহরে এসব কোথায়?—ফুলি চলেছে ঝর্ণায় স্নান করতে। রঙ্গিনীও ওর সাথে চলেছে। ফুলি ওকে হাঁটু পর্যন্ত ডুরে শাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে। রঙ্গিনী এখন দ্বিতীয় ফুলি,এক উজ্বল বর্ণের দেহাতি মেয়ে। ফুলির সাথে কোমর দুলিয়ে পাথরের উপর পা ফেলে,হরিণীর মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। ফুলি জলের কাছে এসেই এক আঁজলা জল ছিটিয়ে নিল নিজের মুখে,ছড়িয়ে দিল রঙ্গিনীর গায়ে। দুজনেই খিলখিল করে হাসছে। নীল ছবি তুলছে একটা বণের হরিণীর আর একটা শহুরে হরিণীর জল কেলির। ফুলির কালো শরীর জলের ছোঁয়ায় যেন প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। রঙ্গিনী স্বচ্ছ পাহাড়ী ঝর্ণার জলে গা ডুবালো। হঠাৎ কেমন যেন আড়ষ্ঠ হয়ে ভিতু খরগোশের মত নিজের ভেজা শরীরটাকে যেন দুহাত দিয়ে আড়াল করতে চাইল। নীল এই মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত কিন্তু রঙ্গিনী ভুল দেখেনি। দূরে পাথরের আড়ালে একজোড়া চোখ যে ওকেই দেখছে। বড় অন্তর্ভেদী এ দৃষ্টি।
সন্ধ্যে হলেই শুরু হবে উৎসব। রঙ্গিনী এক অন্য সাজে সেজেছে। শহুরে বন্ধনহীন বক্ষ ঢাকা কমলা রঙের শাড়ির আঁচলে। শাড়িটা ফুলির বিয়ের শাড়ি। ওর লম্বা সিল্কি চুল চুড়ো করে খোঁপা বেঁধে দিয়েছে ফুলি। তাতে আগুন রঙা পলাশ ফুলের মালা জড়ানো। হাতে পলাশ মালার চুড়ি। ঘুরে ঘুরে নাচ শিখছে দেহাতি মেয়েদের কাছে। নীল রঙ্গিনীর মুখ থেকে চোখ সড়াতে পারে না। নামহীন সম্পর্কটাকে নাম দেওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠে।
সন্ধ্যে হতেই হাড়িয়া পান শুরু হয়ে গেছে। নীল,রঙ্গিনী,শুকরা,ফুলি সবাই হাড়িয়া পানে মগ্ন। রাত বেড়ে চলেছে,ছোঁ-নাচ,বাদ্য যন্ত্র সব শেষে শুরু হয়েছে দেহাতি মেয়েদের নাচ। ফুলির হাত ধরে রঙ্গিনীও নেচে চলেছে আগুনের চারপাশে। আগুনের তাপে আর নাচের পরিশ্রমে ওর মোমের শরীর গলে যাচ্ছে। আগুনের শিখার ফাঁকে ফাঁকে জেগে উঠছে ঘামে ভেজা চকচকে শুকরার শরীরটা। নীল ক্রমশ ঝাপ্সা হয়ে যাচ্ছে। জেগে উঠছে আদিম উদ্যম যৌবন। শুকরার গায়ের ঘামের আদিম গন্ধের নেশায় ঝিমঝিম করছে রঙ্গিনীর মাথা। জেগে উঠছে তীব্র,মিষ্টি নেশা। কংক্রিটে জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া রঙ্গিনি মিশে যাচ্ছে সেই মিষ্টি নেশার স্রোতে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন